পশ্চিমবঙ্গের বিধানসভা নির্বাচনের ফলপ্রকাশের পর ঠিক ২ মাস ১২ দিন অতিক্রান্ত হয়েছে। এই প্রথম বাংলার বিধানসভা কমিউনিস্টশূন্য। ভোট শতাংশ নেমে এসেছে পাঁচ শতাংশের আশেপাশে। কেন এমন বিপর্যয়, তা নিয়ে বিবিধ বিশ্লেষণে কয়েক হাজার দিস্তে কাগজ খরচ হয়ে গিয়েছে। এমনকি, একদম নজিরবিহীনভাবে, মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য স্তরের পরিচিত নেতারা দলীয় নেতৃত্বকে কাঠগড়ায় তুলছেন। ভাবটা অনেকটা এইরকম, তিনি যেন নেতৃত্বের অংশ নন। তাঁর সদিচ্ছা, সৎ প্রয়াস সবকিছুই অন্য নেতাদের ভুলভ্রান্তির জন্য মাঠে মারা গেল। আর, সমালোচনার বর্শামুখ নিয়েও নানা মুনির নানা মত। কান্তি গঙ্গোপাধ্যায় তৃণমূলের নাম না করে বলছেন, বিহারে দুর্নীতিগ্রস্ত শক্তি আরজেডির সঙ্গে হাত মেলানো গেলে বাংলায় কেন নয়! আবার তন্ময় ভট্টাচার্য পার্টির হোলটাইমারদের ভাতা বৃদ্ধির কথা তুলছেন। সপ্তাহে অন্তত দুদিন সর্বোচ্চ বিক্রীত বাংলা দৈনিকের চারের পাতায় বঙ্গে বাম বিপর্যয় চলছে।

সব মিলিয়ে যাকে বলে তাজ্ঝিম মাজ্ঝিম অবস্থা।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এই আবহে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদক সূর্যকান্ত মিশ্র একটি সুদীর্ঘ ফেসবুক লাইভ করলেন। প্রায় দু ঘন্টার সেই বক্তৃতায়, যা অনেকের কাছে ঈষৎ ক্লান্তিকর মনে হলে দোষ দেওয়া যায় না, কমরেড মিশ্র চেষ্টা করলেন নির্বাচনী বিপর্যয়ের ব্যাখ্যা দিতে। বহু প্রশ্ন তিনি ছুঁয়ে গিয়েছেন বক্তৃতায়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যা দাঁড়াল, সেটাকে এককথায় বলা যায় ভুলভুলাইয়া।

প্রায় দু ঘন্টার বক্তৃতায় সূর্যবাবু বলেছেন:

বিজেপির সঙ্গে অন্য কোনও দলকে এক করে দেখা যায় না। বিজেপি দলকে চালায় আরএসএস। তারা একটা ফ্যাসিস্ট সংগঠন। এই বিজেপির সঙ্গে কংগ্রেস, তৃণমূল কাউকেই এক করে দেখা যায় না।

কিছু স্লোগান, কিছু বক্তব্য দলের এই কর্মসূচিগত বোঝাপড়ার বাইরে চলে যাচ্ছে। বিজেপি আর তৃণমূল এক — এইরকম বলা হচ্ছে অনেক সময়। এটা ঠিক নয়। এই দুই দলের সঙ্গে সিপিআই(এম)-এর সমদূরত্বের নীতি নেই। রাজনীতিতে ‘বিজেমূল’ স্লোগানের কোনও জায়গা নেই।

সূর্যকান্ত মিশ্র আরও বিশদে গিয়ে বলেছেন, বিজেপি এবং তৃণমূল মুদ্রার এপিঠ ওপিঠ হতে পারে। কিন্তু মুদ্রারও হেড এবং টেল আছে। ২০১৯ সালের আগে বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের বোঝাপড়া ছিল। তারা একসঙ্গে সরকারও চালিয়েছে। কিন্তু গত লোকসভা নির্বাচনের পর থেকে পরিস্থিতির পরিবর্তন হয়েছে। ওই সময় থেকে যদি বলা হয় বিজেপি এবং তৃণমূল বোঝাপড়া করে লড়ছে, তাহলে তা ঠিক নয়।

সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, “আমাদের লড়াই এই দুই দলের বিরুদ্ধেই। কিন্তু এই দুই দলকে এক করে দেখা ভুল।”

২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনের সময় থেকে ‘আগে রাম, পরে বাম’ স্লোগানের উল্লেখ করে সিপিআই(এম) রাজ্য সম্পাদক বলেছেন, “এই স্লোগান আরএসএস-এর সৃষ্টি। আমাদের কেউ কেউ এই স্লোগান দিয়ে থাকতে পারে। এতে লাভবান হয়েছে বিজেপি।”

কমরেড মিশ্র বললেন, বিজেপি বাংলা দখল করতে এসেছিল। মুখ্যমন্ত্রীকে নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছিল। তাঁর নিজেরও ওই কুৎসিত আক্রমণ শুনতে ভাল লাগেনি। মানুষ এই সবের জবাব দিয়েছেন। মুখ্যমন্ত্রীর হুইল চেয়ারে বসে প্রচার নিয়ে ব্যঙ্গ মানুষ মেনে নেননি।

নির্বাচন পরবর্তী পরিস্থিতি প্রসঙ্গে কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্র বলেছেন, বিজেপি যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামো মানে না। তারা রাজ্যের অধিকারে হস্তক্ষেপ করছে। এই অবস্থায় বামপন্থীদের যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোর পক্ষে থাকতেই হবে।

আরও স্পষ্ট করে তিনি বললেন, “আঞ্চলিক দলের হাত থেকে বিজেপি জোর করে ক্ষমতা কেড়ে নিতে চাইলে মানুষ প্রতিরোধ করবেন।”

তৃণমূল সরকারের বিভিন্ন প্রকল্প নিয়ে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকের মত, ‘দিদিকে বলো’ বা ‘দুয়ারে সরকারে’র মতো প্রকল্প নিয়ে ঠাট্টা করেছেন অনেকে। অনুদান বা ডোলের রাজনীতি বলেছেন। এগুলো ভুল। কমরেড মিশ্র বললেন, “আমরা কি এগুলিকে ছোট করে দেখেছি? ঠিক করিনি।” আরও বললেন, “যে সব বুথে আমরা সরকারি প্রকল্পগুলিকে ইতিবাচক ভাবে নিয়েছি, জনগণ যাতে সত্যিই প্রকল্পের সুবিধা পান, সেই দাবি তুলেছি, সেখানে আমরা ভাল ভোট পেয়েছি। যেখানে এর উল্টো কাজ হয়েছে, সেখানে সাফল্য আসেনি।”

সূর্যকান্ত মিশ্র আরও বললেন, “আমরা যা করেছি, ঠিক করেছি — এই অহংকারবোধ ঠিক নয়। কমিউনিস্টরা এমন অহংকার নিয়ে চলতে পারেন না।”

সিপিএম রাজ্য সম্পাদকের এই ভাষণ নিয়ে বামপন্থী মহলে শোরগোল পড়ে গিয়েছে। সিপিআইএমএল লিবারেশন সহ যে বামপন্থী শক্তিগুলি বিধানসভা নির্বাচনের আগে থেকেই ‘বিজেমূল’ স্লোগানের বিরোধিতা করছিল, তারা প্রত্যাশিতভাবে কমরেড মিশ্রের বক্তৃতাকে ‘ভুল স্বীকার’ বা ‘বোধোদয়’ হিসাবে দেখছেন। বস্তুত, এই ফেসবুক লাইভে সূর্যকান্ত যে কথাগুলি বলেছেন, গত প্রায় মাস ছয়েক ধরে সেই কথাগুলিই একটানা বলে আসছিলেন লিবারেশন নেতৃত্ব, বিশেষ করে তাঁদের সাধারণ সম্পাদক দীপঙ্কর ভট্টাচার্য। লিবারেশন-সহ বামফ্রন্ট শিবিরের বাইরে থাকা বাম দলগুলির বক্তব্য ছিল, বিজেপি এবং তৃণমূলকে কখনোই এক করে দেখা যায় না। বিজেপি অনেক বড় বিপদ। এই মুহূর্তে পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের আশু কর্তব্য হল, বিজেপিকে রোখা।

এই বিতর্ক নির্বাচনের প্রচার পর্বে তুঙ্গে উঠেছিল। দীপঙ্করকে তির্যক মন্তব্য, নানা রকম কটাক্ষ করেছিলেন সিপিএম সমর্থকরা। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, ভোটের ফলাফলে বড় রকমের ধাক্কা খাওয়ার পর প্রায় একই সুরে কথা বলছেন সিপিএম রাজ্য সম্পাদক।

এর কারণ কী? এটা কি আদৌ সিপিএমের তথাকথিত বোধোদয়? নাকি ২০১১ পরবর্তী সময়ে যে বিভ্রান্তির গোলকধাঁধায় তাঁরা ঘুরছেন, তারই আরও এক রকমফের?

নির্বাচনী প্রচার পর্বে ‘বিজেমূল’ তত্ত্বের সবচেয়ে বড় প্রচারক যাঁরা ছিলেন, তাঁদের অন্যতম সূর্যবাবু। তিনি নিজে প্রায় সব বক্তৃতায় এই কাল্পনিক বিজেমূলকে আক্রমণ করেছেন৷ কেবল তা-ই নয়, নির্বাচনী প্রচারে সিপিএমের কয়েকজন সমর্থক যে ‘টুম্পা’ গান রিলিজ করেছিলেন, যাতে বেশ জোরে শোরে ‘বিজেমূল’কে কটাক্ষ করা হয়েছিল, সেটাও সূর্যবাবু শেয়ার করেছিলেন। তাঁর কথা, তাঁর ভাষণ এই রাজ্যের কোটি কোটি বাম সমর্থককে নির্বাচনী প্রচারের দিশা জুগিয়েছিল। এখন, ভোটে হারের পর ‘বিজেমূল’কে কাঠগড়ায় তোলা কি বেশ সহজে স্কোর করার চেষ্টা নয়?

বিজেমূল স্লোগান ঠিক না ভুল, এই প্রতিবেদক সেই আলোচনায় যেতে আগ্রহী নয়। প্রশ্ন, বয়ানের ভোলবদল নিয়ে। সিপিএমের রাজ্য সম্পাদককে কলকাতা প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদি নির্বাচনের ফল ত্রিশঙ্কু হয়, তাহলে তাঁরা কাকে সমর্থন করবেন? সূর্যবাবু উত্তর দিয়েছিলেন, তাঁরা কাউকেই সমর্থন করবেন না। এরপর তো মাত্র মাস তিনেক কেটেছে। এর মধ্যে কী এমন বড় ঘটনা ঘটল, যাতে রাজনৈতিক বোঝাপড়া বদলানোর প্রয়োজন পড়ল? তাহলে কি সিপিআইএম দলের নেতৃত্ব নির্বাচনসর্বস্বতার শিকার হয়ে পড়েছেন? নির্বাচনের সাফল্য, ব্যর্থতা দিয়ে রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক হচ্ছে? যে কারণগুলির জন্য বিজেপি এবং তৃণমূলকে আপনারা এক আসনে বসিয়েছিলেন, সেগুলি কি ঠিক না ভুল? বিজেমূল বলার সময় আপনারা বারবার তৃণমূল থেকে বিজেপিতে যাওয়া নেতাদের কথা বলতেন। শুভেন্দু অধিকারী, রাজীব বন্দ্যোপাধ্যায়, মুকুল রায় — আরও অনেকে। ভোটের ফলে আপনারা শূন্য হওয়ার পরে কি সেই বাস্তবতাটি বদলেছে? মুকুল রায় বসছেন বিজেপি বিধায়কদের জন্য বরাদ্দ আসনে, অথচ তাঁকে পিএসি চেয়ারম্যান করা হল তৃণমূলের পক্ষ থেকে! রাজীব ব্যানার্জি তৃণমূলে ঢুকব ঢুকব করছেন। সোনালী গুহ আবার বড় ফুল ছেড়ে ছোট ফুল ফিরে এসেছেন। আরও অনেকের ঘর ওয়াপসির জল্পনা চলছে।

তাহলে, আপনারা কেন আপনাদের বক্তব্য থেকে সরতে চাইছেন, কমরেড সূর্যকান্ত মিশ্র?

আসলে, আপনাদের গোটা রাজনৈতিক লাইনটাই দাঁড়িয়ে রয়েছে কেবলমাত্র নির্বাচনী ছক কষার উপরে। নাহলে ভোটের আগে তারস্বরে বিজেমূল বলে এখন এই ‘বোধোদয়’ হত না। যদি সংযুক্ত মোর্চা খান তিরিশ আসনও পেত, তাহলেই বিজেমূলকে ভুল মনে হত না। মার্জনা করবেন, হয়তো স্বর চড়ছে, কিন্তু এটাই সত্যি। নির্বাচনে সামান্য ছিটেফোঁটা সাফল্য পেতে আগ বাড়িয়ে কংগ্রেসের সঙ্গে জোট করেছেন আপনারা। যে কংগ্রেস আসন সমঝোতা নিয়ে দিনের পর দিন টালবাহানা করেছে। এমনকি গত লোকসভাতেও আপনারা তাদের জেতা দুটো আসনে প্রার্থী না দেওয়া সত্ত্বেও তারা আপনাদের জেতা আসনে প্রার্থী দিতে দুবার ভাবেনি। এবারও, ভোটে হারার পরেই কংগ্রেসের অধীর চৌধুরী জানিয়েছেন, ভবানীপুরে উপনির্বাচনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রার্থী হলে তাঁরা লড়বেন না। সূর্যবাবু, আপনাদের জাস্ট পাত্তাই দিচ্ছে না বিধান ভবন। নির্বাচনী আঁক কষতে আপনারা এতই ব্যস্ত যে অপমানটুকুও বুঝতে পারছেন না। আর কেবল অপমান তো নয়, এ তো রাজনৈতিক বিপর্যয়। তার উত্তর না খুঁজে কেবল কৌশলগত ভুল খুঁজলে চলবে?

সূর্যকান্ত মিশ্র – ছবি ইকোনমিক টাইমস থেকে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.