রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রা সাম্প্রতিককালে ভারতের রাজনীতিতে অন্য মাত্রা এনেছে। ভারতের একেবারে দক্ষিণ প্রান্ত থেকে শুরু করে ভারতের মাঝখান দিয়ে গিয়ে একেবারে উত্তরে শ্রীনগরে পৌঁছে সেই পদযাত্রা শেষ হয়েছিল। ভারত জোড়ো যাত্রায় রাহুল নির্বাচনী প্রচার করেননি। বরং মূল বার্তা ছিল ‘নফরত কে বাজার মে মহব্বত কা দুকান খোলনে আয়া হুঁ’, অর্থাৎ ঘৃণার বাজারে ভালবাসার দোকান খুলতে এসেছি। তবে ভারত জোড়ো যাত্রা কর্ণাটক বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস দলকে রীতিমত লাভবান করেছে। রাহুলের অনুকরণে তৃণমূলের দু নম্বর নেতা অভিষেক ব্যানার্জি নবজোয়ার যাত্রা করেছিলেন। উদ্দেশ্যও প্রায় ঘোষিত ছিল – পঞ্চায়েত নির্বাচনে দলীয় বিশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ। ধারে না হোক, বিলাসিতায় অভিষেকের পদযাত্রা রাহুল গান্ধীর ভারত জোড়ো যাত্রাকে টেক্কা দিয়েছে। প্রাচীনকালের যুবরাজদের মৃগয়ার মতই ছিল সেই আয়োজন। লোকলস্কর, পুলিশ প্রশাসন, রাজকীয় তাঁবু, ক্যারাভ্যান – সবকিছু নিয়ে চোখ ধাঁধানো আয়োজন। নিন্দুকেরা বলে দুমাসের পদযাত্রায় খরচ হয়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। জনজীবনকে ব্যতিব্যস্ত করার ব্যাপারেও নবজোয়ার যাত্রা উদাহরণ তৈরি করেছিল।

কংগ্রেস, তৃণমূল কংগ্রেসের পরে সিপিএমের যুব সংগঠন ভারতের গণতান্ত্রিক যুব ফেডারেশন (ডিওয়াইএফআই) এবার পদযাত্রার আয়োজন করেছে। ডিওয়াইএফআই অগাস্ট মাস নাগাদ সাংবাদিক সম্মেলন করে জানায় ৩ নভেম্বর ২০২৩ থেকে ৬ জানুয়ারি ২০২৪ (পরে শেষের তারিখ বদলে ২২ ডিসেম্বর ২০২৩ করা হয়) পর্যন্ত পশ্চিমবঙ্গের প্রত্যেকটা জেলা ছুঁয়ে কোচবিহার থেকে কলকাতা পর্যন্ত পদযাত্রা (ইনসাফ যাত্রা) হবে এবং ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি যুব সংগঠনের ডাকে ব্রিগেড সমাবেশ হবে। মূলত কর্মসংস্থান, নিয়োগ দুর্নীতি, সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মীয় বিভাজন, মৌলবাদের মত বিষয়গুলোকে নিয়ে রাজ্য সরকার ও কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে পদযাত্রায় প্রচার চলবে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

গত শুক্রবার কোচবিহারে এই পদযাত্রা আরম্ভ হয়েছে। কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, ফালাকাটা, বানারহাট, ধূপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি হয়ে এই লেখার সময়ে পদযাত্রা শিলিগুড়ি শহরে পৌঁছেছে। চারদিনে প্রায় ১০০ কিলোমিটার পথ পায়ে হাঁটা হয়েছে। যুব সংগঠনের রাজ্য সম্পাদক মীনাক্ষী মুখার্জির নেতৃত্বে পদযাত্রা চলছে। এই ১১০ কিলোমিটার পথের প্রায় পুরোটাই তিনি পায়ে হেঁটেছেন। জেলায় জেলায় পথসভাগুলোতে স্থানীয় সমস্যার পাশাপাশি কেন্দ্র, রাজ্য – দুই সরকারের বিরুদ্ধেই বক্তারা বক্তব্য রাখছেন। রাজ্য ভাগের হুমকি, সাম্প্রদায়িক বিভাজনের চেষ্টা, মৌলবাদের বিরুদ্ধে কথা বলছেন। সাধারণ মানুষের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ স্থাপন করার চেষ্টা করছেন। চা বাগানের শ্রমিকদের সমস্যার কথা সরাসরি তাঁদের মুখ থেকে শুনছেন। লক্ষণীয় বিষয়, পথচলতি সাধারণ মানুষও তাঁকে পেয়ে নিজের দৈনন্দিন সমস্যার কথা বলছেন। আপাতত মীনাক্ষী যেন হ্যামলিনের বাঁশিওয়ালা। একক দক্ষতায়, সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও পদযাত্রাকে এগিয়ে নিয়ে চলেছেন। এই মুহূর্তে তিনি বাংলার রাজনীতির অন্যতম জনপ্রিয় মুখ। তাঁকে একবার স্পর্শ করার জন্য মানুষের আকুতি চোখে পড়ার মত। তৃণমূল বা বিজেপি করা মানুষও নিরাপদ দূরত্ব থেকে বলছেন “মেয়েটার কথা ভাল লাগে।”

মীনাক্ষী
ইনসাফ যাত্রায় কোচবিহারের মহিলাদের আদরে মীনাক্ষী মুখার্জি। ছবি এক্স থেকে

রাস্তার মোড়ে মোড়ে নবীন, প্রবীণ, কিশোরী কিশোরী, যুবক যুবতীরা মীনাক্ষীর সঙ্গে নিজস্বী তোলার আবদার নিয়ে অপেক্ষা করছেন। বানারহাট মোড়ে রাত্রি নটার সময়ে এক প্রবীণা অপেক্ষা করছিলেন মীনাক্ষীর হাতে ফুল দেবেন বলে। ১৯৮৫ সালে পার্টি সদস্যপদ পাওয়া একজন মীনাক্ষীকে দেখবেন বলে সকাল থেকে রাস্তায় দাঁড়িয়ে অপেক্ষা করেছেন। শিলতোর্সা সেতুর কাছে রীতিমত পথ আটকে স্থানীয়রা সমস্যার কথা জানিয়েছেন। এমন অজস্র ঘটনা ঘটছে। প্রান্তিক মানুষ মিছিলে হাঁটছেন, গতযৌবন মানুষ অভাব অভিযোগ নিয়ে হাঁটছেন। কেউ বলছেন একদিনের কাজের ক্ষতি হল, আগামীকাল উপার্জন খুঁজতে হবে। তবুও হাঁটছেন। ষাটোর্ধ্ব মানুষ বলছেন এই মিছিলের সঙ্গে কলকাতা পর্যন্ত যাবেন। পদযাত্রায় একটা দানপাত্র ঘুরছে। পথসভায় সাহায্যের আবেদন জানাতেই গরিব এবং মধ্যবিত্তরা সেই দানপাত্র ভরে দিচ্ছেন।

ইনসাফ
ছবি এক্স থেকে

যুব ফেডারেশন বলেছিল তৃণমূল, বিজেপির নকল যুদ্ধ ভেস্তে দিয়ে আসল সমস্যায় ফিরতে হবে। বেকারদের কর্মসংস্থান, পরিযায়ী শ্রমিক, দুর্নীতি, চা বাগান, শ্রমিক, কৃষকের দৈনন্দিন সমস্যা দিয়ে দ্বিদলীয় রাজনৈতিক চর্চা ভাঙার চেষ্টা করছে ইনসাফ যাত্রা। কতটা সফল হবে তা সময় বলবে। তবে কোচবিহার, আলিপুরদুয়ার, জলপাইগুড়ি, শিলিগুড়ি – চার জেলার পদযাত্রা দেখে এখুনি বলা যায় যে এই পদযাত্রা বাংলায় যে বাণিজ্যিক রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমদানি হয়েছে তার বিপক্ষে বাংলার চিরায়ত আবেগের রাজনৈতিক সংস্কৃতি ফিরিয়ে আনতে সফল হয়েছে। ইনসাফ যাত্রার দুদিন আগে প্রচারে গিয়ে কোচবিহার জেলার যুব নেতা শুভ্রালোক আক্রান্ত হয়েছিলেন। পায়ে সমস্যা দেখা দেয়, চিকিৎসক দশদিন বিশ্রামের পরামর্শ দেন। কিন্তু যাত্রার প্রথম দিন খোঁড়াতে খোঁড়াতেই শুভ্রালোক ২০ কিলোমিটার হেঁটেছেন। আকাশজিৎ কোচবিহার জেলায় হাতে গোনা যে কজন বাম জনপ্রতিনিধি আছেন তাঁদের একজন। তিনিও পায়ের সমস্যা নিয়ে পদযাত্রায় হেঁটেছেন। সিতাই ব্লকের আকিক হুসেন আক্রান্ত হওয়ার পরেও যাত্রায় নেতৃত্ব দিয়েছেন। বাম রাজনীতির অতীত টুকরো টুকরো কোলাজে উঠে আসছে। অতীতে বিমান বসুর নেতৃত্বে পদযাত্রায় জলপাইগুড়ি জেলার হয়ে যিনি নেতৃত্ব দিয়েছিলেন, তিনি আলিপুরদুয়ারে মঞ্চে উঠে পদযাত্রীদের সংবর্ধনা দিয়েছেন। রাত্রিবাস, আহার, আয়োজন – কোথাও আজকের কর্পোরেট রাজনীতির ছোঁয়া নেই। স্থানীয় সংগঠকরা নিজেদের উদ্যোগে সামর্থ্য অনুযায়ী বাহুল্যহীন প্রয়াস করছেন।

ইনসাফ যাত্রার সবকিছু কি নিখুঁত? একেবারেই নয়। প্রায় দু হাজার কিলোমিটার দীর্ঘ পদযাত্রার পরিকল্পনায় বহু ফাঁকফোকর নজরে পড়ছে। যেমন অ্যাম্বুলেন্স নেই। স্থানীয় সংগঠকদের খামতিও চোখে পড়ছে। দুপুরের খাওয়াদাওয়া সন্ধে নামার পরে হচ্ছে। স্থানীয় ইস্যু উঠে এলেও উত্তরবঙ্গে পরিবেশ নষ্ট করে অপরিকল্পিত উন্নয়ন, চা সুন্দরী প্রকল্প, মাল নদীতে হড়পা বানের প্রসঙ্গ, সাম্প্রতিক তিস্তা নদীর বিপর্যয় এখন পর্যন্ত সেভাবে উঠে আসেনি। পরিবেশ নিয়ে এমন উদাসীনতা বামপন্থীদের মানায় না। চা পর্যটনের নামে বাগানের ১৫% জমি শ্রমিক-কুলি-কামিনদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়ে বহুজাতিক সংস্থাকে দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। জমি হাঙরদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্ত জোরালো বক্তব্য উঠে আসেনি। রাজ্যের শিক্ষাব্যবস্থা বেহাল, প্রায় ৮,০০০ স্কুল বন্ধের মুখে। ইনসাফ যাত্রার পথসভায় বক্তারা এসব তুলে ধরার চেষ্টা করছেন, কিন্তু যেন যথেষ্ট হচ্ছে না। তাছাড়া ইনসাফ যাত্রা এখন পর্যন্ত মীনাক্ষীকেন্দ্রিক। সেই নির্ভরতাও কাটানো উচিত।

আরো পড়ুন মমতা ও পশ্চিমবঙ্গ: মাঝির হাতেই নৌকাডুবি?

ইনসাফ যাত্রার তেমন প্রচারও নেই। বহুলপ্রচলিত বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমে এর উপস্থিতি নেই। কিন্তু স্থানীয় বৈদ্যুতিন সংবাদমাধ্যমগুলো নিজেদের এলাকায় খবর করছে। সবচেয়ে বড় ব্যর্থতা প্রচার পরিকল্পনায়। বিজু কৃষ্ণণ নাসিক থেকে মুম্বাই লং মার্চে সেকুবাঈয়ের পায়ের ক্ষতের ছবি তুলে এনে দেখিয়েছিলেন ঝাঁ চকচকে ভারতের সঙ্গে গ্রামভারতের তফাত। একটা মাত্র ছবি জাতীয়, আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমকে বাধ্য করেছিল ওই লং মার্চের খবর করতে। এই পদযাত্রায় বিজুর মত কেউ বলে নেই বলেই বানারহাট বাগানের বৃদ্ধা কামিন মংরি ওঁরাওয়ের কাতর আর্তি “তিন হফতা সে তলব নহি মিলা” কেউ শুনতে পেল না। প্রচার পরিকল্পনার অভাবে সেই যুবকের কথা কেউ জানতে পারল না, যে নবান্ন অভিযানে ২২ দিন জেল খাটার পরেও নিজেকে বিক্রি করেনি। মতাদর্শের টানে বাগানে যুব সংগঠন করছে, অহংকার নিয়ে বলছে “এই লোকজন আমাদের।” সদ্য কলেজ পাস তন্ময় মিছিলে হাঁটতে হাঁটতে গান ধরেছে – আমাদের চোখে নতুন ভোরের স্বপ্ন। পিঠে টিউশনির ব্যাগ নিয়ে সাব্বির স্লোগান তুলেছে “বাঁশের লাঠি তৈরি করো, মৌলবাদের ধোলাই করো।” টুকরো টুকরো মহাকাব্যিক দৃশ্যপট আড়ালেই থেকে যাচ্ছে। এমএসসি পাস বেকার পদযাত্রায় হাঁটতে হাঁটতে যন্ত্রণার আলপনা এঁকেছে, গৃহশিক্ষিকা মলের সামনে পদযাত্রা দেখে হঠাৎ থমকে গিয়ে বলেছেন “আমি সমর্থন করি, আমি সমর্থন করি।” জলপাইগুড়ি শহরে দিনমজুর থেকে টোটো চালক বারবার বলেছেন “এই উপার্জনে সংসার চলে না। জীবন অসহ্য হয়ে উঠেছে।” দুই সরকারের বিরুদ্ধে ক্ষোভ উগরে দিয়েছেন। মিড ডে মিলের রাঁধুনি বলেছেন “তিন মাস বেতন নেই। কীভাবে সংসার চলবে? এই পদযাত্রা যদি সমস্যার সুরাহা করে…।” এগুলো খোদাই করা থাকছে না।

ভোটের নিরিখে বাম রাজনীতিকে ব্যাখ্যা করার মত বোকামি না করাই ভাল। ভোট সব হলে জব কার্ড হোল্ডার খেতমজুর কাজ পাননি, মিছিলে হাঁটার জন্য একদিনের উপার্জন ৩০০ টাকার ক্ষতি হয়েছে – এমন হয় কেন? ময়নাগুড়ি রেলস্টেশন পাড়ার সেই প্রান্তিক মজুর বলছেন “হোক ক্ষতি।” সমস্যা হবে, তবু মিছিলে হাঁটবেন। কেন এখনও ‘শূন্য’ বামেদের সঙ্গে আছেন? প্রশ্ন শুনে অবলীলায় উত্তর দিয়েছেন “বামেতেই মোর শেষ জীবন যাবে…।” ভোট নেই বলে প্রাক্তন বিধায়ক সুখমেইত ওঁরাওয়ের নিরাভরণ উপস্থিতি, তাঁর উদাত্ত নাচগান এতটুকু মলিন হয় না। বরং নীতিহীন রাজনীতির আবহে আরও বেশি উজ্জ্বল হয়ে ওঠে।

নেপালি, ভাওয়াইয়া, বাইচি নৃত্য, আদিবাসী, ধামসা মাদলের আন্তরিকতা – কী নেই ইনসাফ যাত্রায়? সব আছে, শুধু প্রচার পরিকল্পনার অভাবে জানানো যাচ্ছে না উত্তরবঙ্গ বঞ্চনার কী অপরিসীম খতিয়ান তুলে ধরছে পথে পথে। রাজ্য আর কেন্দ্রের সরকারের বিরুদ্ধে ধিকধিক করে তুষের আগুন জ্বলছে। কেউ শুনতে না চাইলে, শোনাতে না চাইলে, একদিন হয়ত দাবানল হয়ে রাজ্য ভাগ করে বসবে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.