কলকাতা শহরে শুক্র ও শনিবার দুটো রাজনৈতিক কর্মসূচি ছিল। একটা বিপুল আলোচিত, অন্যটা নিয়ে প্রায় কোনো আলোচনা হচ্ছে না।

প্রথমটা বামপন্থীদের উদ্যোগে। চে গুয়েভারার কন্যা এবং নাতনিকে গণসংবর্ধনা। তাঁদের ভারতে আসা এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ নিয়ে ইতিমধ্যেই বহু কথাবার্তা হয়ে গিয়েছে। শুক্রবার তাঁরা যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। সেখানে যে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হয়েছিল, তা নিয়ে আলোচনার অন্ত নেই। পক্ষে বিপক্ষে বহু কথায় শহর কলকাতা, বিশেষত তার প্রগতিশীল অংশ সরগরম।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

অন্যদিকে শনিবার ধর্মতলায় এক সমাবেশ কর্মসূচি নিয়েছিল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)। দলটার প্রতিষ্ঠা দিবসের সেই কর্মসূচি নিয়ে আগে থেকে মূলধারার সংবাদমাধ্যম কোনো খবর করেনি। কলকাতা, বিশেষ করে শহরের প্রগতিশীল মহলও, ওই কর্মসূচি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল ছিল না। অত্যন্ত স্বাভাবিক। কারণ সমাজের যে অংশ চে গুয়েভারার কন্যার ভারতে আসার পক্ষে বিপক্ষে উদ্বেল হয়, তার মধ্যে আইএসএফের কোনো প্রভাব নেই।

সাধারণভাবে পশ্চিমবঙ্গের মিডিয়ায় আইএসএফের খবর তেমন চোখে পড়ে না। অন্তত বড় দলগুলোর নেতানেত্রীদের বিবৃতি যতখানি গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়, তার ধারেকাছে তো নয় বটেই। যদিও ঘটনাচক্রে, তৃণমূল এবং বিজেপি বাদে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় একমাত্র বিধায়ক আছে যে দলটার, তার নাম আইএসএফ। ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি প্রায় প্রতিদিনই রাজ্যের কোথাও না কোথাও জনসভা করেন। সেখানে ভিড়ও হয় যথেষ্ট। সেই সব সভার খবর পেতে হলে চোখ রাখতে হয় একদম প্রান্তিক কিছু ইউটিউব চ্যানেল বা ফেসবুক পেজের নিতান্ত ‘গ্রাম্য’ উচ্চারণে পরিবেশন করা খবরে।

যাই হোক, চে গুয়েভারার মেয়ে যেদিন কলকাতায় পা রাখেন, সেদিন থেকেই আইএসএফের আবারও সৌভাগ্য হল মূলধারার মিডিয়ায় জায়গা পাওয়ার। ভাঙড়ে তৃণমূলের সঙ্গে আইএসএফের সংঘর্ষের খবর দেখাতে শুরু করল সংবাদমাধ্যম। দেখা গেল, প্রবল প্রতাপান্বিত তৃণমূলের সঙ্গে রীতিমতো সেয়ানে সেয়ানে টক্কর দিচ্ছে আইএসএফ। দুদলেরই বহু কর্মী আহত। রাস্তা অবরুদ্ধ, পার্টি অফিস জ্বলছে। এর ধারাবাহিকতায় শনিবার সকালে ভাঙড়ে আক্রান্ত হলেন বিধায়ক নওশাদ। তাঁর গাড়ির কাচ ভেঙে দেওয়া হল। আইএসএফ অভিযোগ করল, পুলিশের সামনেই বিধায়ক আক্রান্ত হয়েছেন, তাঁর গাড়িতে ইট ছোড়া হয়েছে। পুলিস ছিল নিশ্চুপ দর্শকের ভূমিকায়।

এরপরের রঙ্গমঞ্চ কলকাতার রাজপথ। ভাঙড়ের ঘটনার প্রেক্ষিতে সমাবেশে যোগ দিতে আসা আইএসএফ কর্মীরা বিকেলে ধর্মতলা অবরোধ করলেন নওশাদ সিদ্দিকির নেতৃত্বে। সেই অবরোধ তুলতে রীতিমত কালঘাম ছুটে গেল পুলিশের। এক পর্যায়ে পুলিস বেধড়ক লাঠিচার্জ শুরু করল, আইএসফ কর্মীরাও ইটবৃষ্টির মাধ্যমে প্রতিরোধ করলেন। দেখা গেল, আইএসএফ কর্মীরা পুলিশের দিকে তেড়ে যাচ্ছেন এবং পুলিসবাহিনী দৌড়ে পালাচ্ছে।

খানিকক্ষণের মধ্যেই অবশ্য বিরাট পুলিসবাহিনী ফিরে আসে, লাঠিচার্জের পাশাপাশি কাঁদানে গ্যাস ছোড়া হয়। প্রায় ঘন্টাখানেক গোটা ধর্মতলা রণক্ষেত্রের চেহারা নেয়। পুলিস বিভিন্ন গলিতে ঢুকে আইএসএফ কর্মীদের খুঁজে বের করে মেরেছে বলে অভিযোগ। বহু আইএসএফ কর্মীকে গ্রেফতার করা হয়।

রাজনীতিতে তো দৃশ্যের নির্মাণ জরুরি। এমন দৃশ্য, যার অভিঘাত থাকে অনেকদিন। শনিবারের কলকাতা দেখল, নির্বাচিত বিধায়ক নওশাদকে রাজপথের উপর দিয়ে টেনে হিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে গ্রেফতার করছে পুলিস।

সামনেই পঞ্চায়েত নির্বাচন। আইএসএফ ছোট দল, তাদের প্রভাব বলয় অত্যন্ত সীমাবদ্ধ। কিন্তু একটা কথা স্পষ্ট করে বলে দেওয়া যায়, এই দলটি ঠিক সেভাবেই বিরোধী রাজনীতি করছে, যেভাবে করা এ দেশে দস্তুর। বিজেপি এবং তৃণমূলকে কেবল বিবৃতি দিয়ে নয়, রাস্তায় চ্যালেঞ্জ করছে। তৃণমূল কংগ্রেস একুশের নির্বাচনে বিপুল সাফল্য পেয়েছে, সংখ্যালঘুরা দুহাত তুলে সমর্থন করেছেন মমতা ব্যানার্জিকে। কিন্তু তার অনেকটাই হয়ত সদর্থক সমর্থন নয় – বিজেপিকে রুখতে তৃণমূলকে সমর্থন। বিধানসভা নির্বাচনের পর কেটে গিয়েছে প্রায় দু বছর। তৃণমূলের দুর্নীতি আরও প্রকট হয়েছে। বিশেষ করে গ্রাম, মফস্বলের শিক্ষিত বেকার ছেলেমেয়েদের শিক্ষকতার স্বপ্ন ধাক্কা খেয়েছে ভালরকম। আরও নিচের তলার মানুষের রুটিরুজির উপর প্রভাব ফেলেছে একশো দিনের কাজ নিয়ে দুর্নীতি, প্রধানমন্ত্রী আবাস যোজনা নিয়ে দুর্নীতি। ২০১৮ সালে মুখ্যমন্ত্রীর বিরোধীশূন্য পঞ্চায়েত গড়ার ডাকে সাড়া দিয়ে যেভাবে নির্বাচন করা হয়েছিল, সেই ঘা এখনো গ্রামাঞ্চলের মানুষের মনে দগদগে। ফলে সংখ্যালঘু তথা গরীব মানুষের ভোট যে যোগ্য বিরোধীর আশায় নেই এমন নয়।

আরো পড়ুন দুর্নীতির সুযোগ বিজেপি যেন নিতে না পারে: নওশাদ

আইএসএফ কেবল ভাঙড়ে সীমাবদ্ধ বলে অনেকে মনে করেন। কথাটা ঠিক নয়। দুই ২৪ পরগনা, হাওড়া, মালদা, মুর্শিদাবাদসহ বিভিন্ন জেলায় তাদের সভায় নজরকাড়া ভিড় হচ্ছে। তৃণমূলের চোখে চোখ রেখে লড়ার সাহস দেখাচ্ছে তারা। প্রায় কোথাও আইএসএফের উপর আক্রমণ হলে তা প্রতিরোধহীন অবস্থায় শেষ হচ্ছে না। সবচেয়ে বড় কথা, দলের এখনকার প্রধান মুখ নওশাদ নিজে থাকছেন সামনের সারিতে। তিনি নিজে আক্রান্ত হচ্ছেন, প্রতিরোধ করছেন। ডিসেম্বর পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় সিপিএমের আক্রমণাত্মক কর্মসূচি চোখে পড়ছিল। সিপিএম কর্মীরা বাড়ি বাড়ি যাচ্ছিলেন, প্রত্যেক পঞ্চায়েতের সামনে ধরনা হচ্ছিল, একাধিক জায়গায় পুলিস এবং তৃণমূলের সঙ্গে সরাসরি সংঘর্ষ হয়েছে, রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম স্বয়ং ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে যাচ্ছেন – এ দৃশ্যেরও জন্ম হয়েছিল। এসবের জেরে পূর্ব মেদিনীপুরের সিপিএম জেলা সম্পাদক নিরঞ্জন সিহিকে পুলিস ভর সন্ধেবেলা পার্টির দপ্তর থেকে টানতে টানতে নিয়ে গিয়ে প্রিজন ভ্যানে তোলে। বিক্ষোভ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারী পার্টিকর্মী আরজুনা বিবির শাড়ি খুলে নেয় পুলিস। লকআপে তাঁর উপর অত্যাচারের বিবরণও অনেকেরই অজানা নয়।

বিরোধী রাজনীতি করতে গেলে এইরকম বিপদের ঝুঁকি নিয়েই করতে হয়। অথচ আরজুনার জন্য স্থানীয় স্তরে একটা মিছিল ছাড়া বিশেষ কিছু করেনি সিপিএম। উপরন্তু জানুয়ারি এসে পড়তেই যেন শীতঘুমে চলে গেছে তাদের বিরোধিতা। নাকি চে কন্যা ও নাতনির আপ্যায়নের উদ্যোগে আরজুনারা বিস্মৃত হয়েছেন সাময়িকভাবে?

পশ্চিমবঙ্গের অন্য ধর্মনিরপেক্ষ বিরোধী দলটি তো আছে কিনা বোঝাই যায় না। এঁরা আইএসএফকে দেখে নতুন করে ভাববেন কি?

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.