বছর তেত্রিশের মৃত্যুঞ্জয় বর্মণ কাজের সূত্রে ১০-১৫ বছর ধরে শিলিগুড়িতে থাকতেন। গ্রামের বাড়িতে এসেছিলেন আত্মীয়ের বিয়ে উপলক্ষে। রাতে পুলিস আসে, বিজেপি দলের পঞ্চায়েত সমিতির সদস্য বিষ্ণুপদ বর্মণের খোঁজে। তাঁকে না পেয়ে তাঁর বাবাকে তুলে নিয়ে যেতে চাইলে মৃত্যুঞ্জয় পুলিসকে বাধা দেন। পুলিস সরাসরি বুকে গুলি করে, মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যু হয়। ঠিক যেন উত্তরপ্রদেশ পুলিশের এনকাউন্টার। এমনটাই অভিযোগ কালিয়াগঞ্জের রাধিকাপুরের গ্রামবাসীদের। আরও অভিযোগ, রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জি “পুলিস কি হাতে বালা পরে ছিল?” প্রশ্ন তোলার পরেই পুলিস এমন বেপরোয়া। সশস্ত্র পুলিস প্রতিহিংসাপরায়ণ হয়ে উঠলে নিরস্ত্র নাগরিক মৃত্যুবরণ করা ছাড়া আর কী করতে পারে? পুলিস রাষ্ট্রে সাধারণ নাগরিকের জীবন পোকামাকড়ের চেয়ে শস্তা। মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যু আমাদের শ্বাপদ সময়ের সামনে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে। এমন নয় যে এ রাজ্যে পুলিসের গুলিতে মৃত্যুঞ্জয়ের মৃত্যুই প্রথম, আগেও হয়েছে। আনিস খান খুনের মত একাধিক খুনের তালিকা রয়েছে। তবু মৃত্যুঞ্জয়ের হত্যা যেন ভুয়ো এনকাউন্টার।

গত ২০ এপ্রিল উত্তর দিনাজপুর জেলার কালিয়াগঞ্জ থানার একটি গ্রামের উচ্চমাধ্যমিক পড়ুয়া এক কিশোরী সন্ধেবেলা বাড়ি থেকে বেরিয়ে যায়। বাড়ির লোক সারারাত খোঁজার পরেও কিশোরীকে পাননি। পরের দিন, ২১ এপ্রিল, বাড়ি থেকে ৫০০ মিটার দূরে পুকুরে কিশোরীর মৃতদেহ পাওয়া যায়। মৃতার আত্মীয়দের অভিযোগ, গ্রামেরই ভিন্ন ধর্মের এক যুবক অন্য কয়েকজনের সঙ্গে মিলে কিশোরীকে ধর্ষণ করার পরে খুন করে এবং পুকুরে ফেলে দেয়। চারজনের নামে থানায় অভিযোগ দায়ের করে মৃতার পরিবার। পুলিস গ্রেপ্তার করার আগেই দুজন আত্মসমর্পণ করে। মূল ঘটনা এইটুকুই।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

একদিকে লাশের রাজনীতি অন্যদিকে প্রশাসনিক ব্যর্থতা, দুয়ে মিলে এক কিশোরীর মৃত্যু হয়ে উঠল রাজনীতির আখড়া। ওই কিশোরীর বাড়ি যে গ্রাম পঞ্চায়েতে, সেই পঞ্চায়েতের প্রধান বিজেপির, উপপ্রধান তৃণমূলের। এমনিতে যৌথ সংসার হলেও কিশোরীর মৃত্যু নিয়ে যুযুধান দুই পক্ষই মুখোমুখি সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। তৃণমূলী পঞ্চায়েত প্রধান এমন একটা দুঃখজনক মৃত্যু নিয়ে মাতব্বরের মত সালিশির নিদান দিয়েছিলেন, মধ্যস্থতা করতে চেয়েছিলেন। জটিলতার আরম্ভ এখান থেকেই। পুলিস সুপার প্রাথমিক তদন্তের ভিত্তিতে জানিয়ে দিলেন, কিশোরী বিষ খেয়ে আত্মহত্যা করেছে, দেহের পাশে বিষের শিশি পাওয়া গেছে। আর কিশোরীকে ধর্ষণও করা হয়নি। প্রশাসনিক ব্যর্থতার আরম্ভ এইখানে।

মৃতার পরিবার পরিজনের ভাবাবেগকে গুরুত্ব দিয়ে পুলিস প্রশাসন কি আরও সংবেদনশীল হয়ে এই ঘটনার সঙ্গে যুঝতে পারত না? পারত, কিন্তু এই চাওয়া কর্তার অধীন। আমাদের রাজ্যে পুলিশের উপর থেকে সাধারণ মানুষের বিশ্বাস অতীত অভিজ্ঞতার ভিত্তিতে প্রায় তলানিতে ঠেকেছে। পুলিস যদি সত্যি কথাও বলে, তাহলেও সাধারণ নাগরিক কোনোমতেই বিশ্বাস করতে চান না। প্রায় সকলের ধারণা, পুলিসমাত্রই শাসকের দালাল। শাসক তৃণমূল কংগ্রেস যেন ঠিকই করে নিয়েছে, যে কোনো দুষ্কর্ম আড়াল করাই তাদের রাজনীতি। মন্ত্রী শশী পাঁজা পুলিস সুপারের বয়ান অনুযায়ীই বললেন, বিষ পান করে আত্মহত্যা করেছে মেয়েটা, তাকে ধর্ষণ করা হয়নি। পূর্ণাঙ্গ তদন্তের আগে এমন বলা যায়? মুখ্যমন্ত্রীও একই কথা বলেছেন।

বিশৃঙ্খল, উত্তেজনাপূর্ণ পরিবেশ তৈরি করার জন্য যা যা করা উচিত, তৃণমূল তার সবই করেছে। তারপর আসরে নেমেছে রাজ্যের প্রধান বিরোধী শক্তি বিজেপি। বিজেপি প্রথম থেকেই এই মৃত্যুর ঘটনা নিয়ে রাজনীতি করতে চেয়েছে। যেহেতু ঘটনার সঙ্গে আলাদা আলাদা ধর্মের মানুষজন জড়িত, তাই সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি করে উত্তরবঙ্গে একটু নড়বড়ে হয়ে যাওয়া খুঁটি আবার শক্ত করে নেওয়াই আসল উদ্দেশ্য। মৃত কিশোরীর খুনিদের শাস্তি (যদি খুন হয়ে থাকে) নিয়ে, নারী নিরাপত্তা নিয়ে বিজেপির তেমন মাথাব্যথা নেই। এর আগে আমরা দেখেছি, মালদার এক যুবতীকে বহরমপুরে তার প্রেমিক প্রকাশ্যে কুপিয়ে খুন করলেও বিজেপি উচ্চবাচ্য করেনি। বরং সোশাল মিডিয়ায় মৃত যুবতীকে জঘন্য আক্রমণ করেছে। চলতি ঘটনাক্রমের মাঝেই, নিকটবর্তী জেলা মালদাতেও এক যুবতীকে ধর্ষণের পরে খুন করা হয়েছে। সেখানে কিন্তু বিজেপিকে আন্দোলন সংগঠিত করতে দেখা যায়নি, কারণ সেখানে আলাদা আলাদা ধর্মের মানুষের যোগ নেই, অর্থাৎ বিজেপির রাজনৈতিক মুনাফার সুযোগ নেই।

বিজেপির নেতা, কর্মীরা কালিয়াগঞ্জের ঘটনায় কিন্তু প্রথম থেকেই যুক্ত। পরিবারের লোকজনের সঙ্গে মিলে বিজেপি কর্মীরাই পুকুর থেকে কিশোরীর দেহ রাস্তায় তুলে আনে। রাস্তা অবরোধ হয়। রাস্তা থেকে পুলিস অমানবিক, বর্বরোচিত কায়দায় চ্যাংদোলা করে মৃতদেহ তুলে নিয়ে যায়। আগুনে ঘি পড়ে। নিমেষে ভাইরাল হয় সেই মর্মান্তিক দৃশ্য, পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপ হতে থাকে। বিজেপি রাজ্য সভাপতি, স্থানীয় সাংসদ, বিধায়করা মৃতার বাড়িতে আসেন। শাসক ও বিরোধী – দুই পক্ষের তর্জা চলতেই থাকে। জাতীয় শিশু সুরক্ষা ও অধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান এসেই বলেন, মন্ত্রী শশী পাঁজা মিথ্যে বলছেন। দফায় দফায় অবরোধ চলে। ভিন্ন ধর্মাবলম্বী এক টোটো চালক শারীরিক নিগ্রহের শিকার হন, কিছু মানুষের দোকানে আগুন পর্যন্ত লাগিয়ে দেয় আন্দোলনকারীরা। ক্রমশ সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা তৈরি হয়। পুলিস, প্রশাসন নিজেদের ব্যর্থতা ঢাকতে কালিয়াগঞ্জ এলাকায় ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয়, ১৪৪ ধারা জারি করে।

বিক্ষোভকারীরা যেদিন থানা ঘেরাও করে, সেদিনই বিজেপি রায়গঞ্জের এস পির অফিস ঘেরাও করারও ডাক দেয়। পুলিস এবং গোয়েন্দা বিভাগ এতটাই ব্যর্থ যে হাজারখানেক উত্তেজিত জনতা থানা দখল করে আগুন জ্বালিয়ে দিতে পারে – এর পূর্বাভাস পায়নি। আসলে পুলিস নিজেই নিজেকে গণশত্রুতে পরিণত করেছে। থানা ভাংচুর, জ্বালিয়ে দেওয়ার কর্মকাণ্ডে বিজেপি প্রকাশ্যে জড়িত না থাকলেও, পুরো আবহ বিজেপি-আরএসএসের তৈরি। ইতিপূর্বে আদিবাসী ঐক্য মঞ্চ দেখা গেলেও, এই প্রথম আদিবাসী তফসিলি ঐক্য মঞ্চ কালিয়াগঞ্জ থানা আক্রমণের দিন প্রকাশ্যে এসেছে। এমন যৌথ মঞ্চ তৈরির সংবাদ পর্যন্ত পুলিসের কাছে ছিল না – এতটাই অপদার্থতা। সোশাল মিডিয়ায় আমরা দেখেছি, বদ্ধ ঘরের মধ্যে কয়েকজন পুলিসকর্মী হাতজোড় করে প্রাণভিক্ষা চাইছেন, উত্তেজিত জনতা নির্মমভাবে তাদের মারছে। থানা জ্বলছে, মাটিতে ফেলে সিভিক ভলান্টিয়ারকে নিগ্রহ করছে। পুলিসকর্মীরা প্রাণভয়ে থানা লাগোয়া যে সমস্ত বাড়িতে আশ্রয় নেন, উত্তেজিত জনতা সেখানেও ভাংচুর করে। ঠিক যেন হিন্দি সিনেমার দৃশ্য। শাসকের প্রতি ক্ষোভ প্রকাশের গণতান্ত্রিক পথগুলো বন্ধ হয়ে গেলে এমনটাই হয়, নেমে আসে নৈরাজ্য।

উত্তরবঙ্গ জুড়ে এক বিশেষ জনগোষ্ঠীর ইউটিউবাররা মৃত কিশোরীর দেহ নিয়ে পুলিসি বর্বরতার ভিডিও সম্পাদনা করে নাটকীয় সংলাপসহ চিত্রনাট্য তৈরি করেছে। উত্তরবঙ্গ জুড়ে ছড়িয়েছে সেই ভিডিও। উত্তেজিত জনতা নেতৃত্বহীন, নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে থানা আক্রমণ করেছে। মুখ্যমন্ত্রী পুলিসকে বেপরোয়া হওয়ার বার্তা দিয়েছেন, পুলিস প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতেই মৃত্যুঞ্জয়ের বুকে গুলি করেছে বলে অভিযোগ।

তৃণমূল ও বিজেপি – দুই দলই নিজের মত করে গুছিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। তৃণমূল ক্ষয় নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেছে, বিজেপি রাজনৈতিক ফায়দা তুলেছে। তাহলে বামপন্থীরা কী করছে এই চিত্রপটে? ঘটনার প্রথম দিনই সিপিএমের ছাত্র ও যুব ফ্রন্টের জেলাস্তরের নেতা, কর্মীরা মৃতার বাড়িতে গেছেন, পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছেন। ছাত্র, যুব, মহিলা সংগঠন মিলে কালিয়াগঞ্জ, রায়গঞ্জ থানা ঘেরাও করে এবং বিক্ষোভ দেখায়। সিপিএমের জেলা সম্পাদকসহ বামফ্রন্টের প্রতিনিধি দল ঘটনাস্থলে মৃত কিশোরীর বাড়িতে গেছেন। দোষীদের উপযুক্ত শাস্তির দাবি করেছেন, নিরপেক্ষ বিভাগীয় তদন্তের দাবি জানিয়েছেন, রায়গঞ্জে শান্তি মিছিল করেছেন। কিন্তু সেসব সংবাদমাধ্যমে জায়গা পায়নি। সংবাদমাধ্যম ইচ্ছাকৃতভাবেই কালিয়াগঞ্জ কাণ্ডের প্রতিবেদনে তৃণমূল আর বিজেপির বাইরে বেরোয়নি। এর বেশি বামেদের কিছু করারও ছিল না। বিচার চাই বলেই পরধর্মবিদ্বেষ ছড়ানো বামেদের পক্ষে সম্ভব নয়। তবু যে মীনাক্ষী মুখার্জি, মহম্মদ সেলিমের মত শীর্ষ নেতৃত্ব ঘটনাস্থলে গেলে হয়ত বিজেপি পরিস্থিতির এমন সুযোগ নিতে পারত না। এক অংশের সাধারণ মানুষের প্রশ্ন, আনিস হত্যা মামলার মত কালিয়াগঞ্জ এলাকার কিশোরীর মৃত্যু এবং মৃত্যুঞ্জয়ের খুনে মীনাক্ষী কি সক্রিয় হতে পারতেন না?

আরো পড়ুন জীবিত আনিসের চেয়ে মৃত আনিসকে বেশি ভয় পাচ্ছে মমতা সরকার?

পুলিস থানা আক্রমণের অভিযোগে এ পর্যন্ত প্রায় ৫০ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। গ্রামে গ্রামে পুলিসি হানা চলছে। নিকটবর্তী গ্রাম পুলিসের জুলুমের ভয়ে পুরুষশূন্য। উত্তেজনা কমে যাবে, তৃণমূল-বিজেপিও থিতিয়ে যাবে। তখন জেলবন্দীদের পাশে, অভিযুক্তদের পাশে দাঁড়াবে কে?

একটা মৃত্যু এবং আরও একবার সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের প্রচার, বিজেপির ঘৃণার বেসাতি – সবই আটকানো যেত একটা মাত্র বাক্যে। মৃতার পরিবারের দাবি মেনে মুখ্যমন্ত্রী যদি বলতেন, সিবিআই কিশোরীর মৃত্যুর তদন্ত করবে। কিন্তু পুলিস রাষ্ট্রে এমন হয় না, তাই হয়নি।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।