রাজা হর্ষবর্ধনের দানমেলার কথা স্কুলে আমরা প্রায় সকলেই পড়েছি। পড়লে মনে হবে, তিনি ছিলেন দয়ালু, প্রজাবৎসল রাজা। তাঁর যুদ্ধাভিযানে গরীব প্রজাদের দুর্দশার কথা কিন্তু পাঠ্য বইয়ে পাওয়া যায় না। তার বর্ণনা সুকুমারী ভট্টাচার্য প্রাচীন ভারত সমাজ ও সাহিত্য রচনায় দিয়েছিলেন। ছদ্মবেশে রাজ্য বা নগর ভ্রমণের কাহিনি অনেক রাজারই আছে। সাধারণত রাজাদের মহিমা কীর্তন করতেই পাঠ্যবইতে এসব স্থান পায়। ভারত এখন প্রজাতান্ত্রিক রাষ্ট্র। রাজতন্ত্র নেই। যদিও প্রজারাই রাজা হয়েছেন, না মন্ত্রীরা রাজসুখে রয়েছেন সেটা বড় প্রশ্ন। পশ্চিমবঙ্গের শাসক দলের সর্বভারতীয় সভাপতির রাজ্য ভ্রমণ, যার পোশাকি নাম জনসংযোগ যাত্রা, সেই প্রশ্নই আবার তুলে দিল। প্রজাতান্ত্রিক ভারতে ভোট শাসকের কাছে যুদ্ধ। ভোট প্রচারে রাজপরিবারকে অবশ্য ছদ্মবেশ ধারণ করলে হয় না, চাই জাঁকজমকপূর্ণ প্রচার।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এত জনদরদী প্রকল্প, দুয়ারে সরকার, কয়েক মাস আগেই দিদির দূত অভিযানের পর এমন যাত্রার আয়োজন নিয়ে অনেকের মনেই প্রশ্ন জেগেছে। শাসক ও বিরোধী সব রাজনৈতিক দল জনসংযোগ করবেন, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু প্রচারসর্বস্ব রাজনীতিতে চমক দিয়ে স্বাভাবিক ঘটনাকেও অস্বাভাবিক করে তোলা হয়। দিদির দূতের অভিজ্ঞতা তৃণমূলের কাছে একেবারেই সুখকর নয়। বিভিন্ন জায়গায় বিধায়ক, সাংসদদের ঘিরে মানুষ বিক্ষোভ দেখিয়েছেন। তারও কয়েক মাস আগে আবাস যোজনা নিয়ে বিক্ষোভে অনেক গ্রামসভার বৈঠক ভেস্তে গেছে। মানুষের ক্ষোভ আর চাপা রাখা যাচ্ছে না। শাসক দলের কাছে তার চেয়েও বড় আশঙ্কার কথা এই, যে মানুষ আর তাদের ভয় পাচ্ছেন না।
প্রজাদের ভয় ভাঙলে শাসকের চরম বিপদ। গণতন্ত্রেও এটা সত্য। এখন তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি সেই ক্ষতে প্রলেপ দিতে নামলেন। দুর্জনেরা অবশ্য বলছে, সিবিআই বা ইডি হানা থেকে বাঁচতেই নাকি এই কর্মসূচি। এই যাত্রা দলে তাঁর কর্তৃত্ব আরও বাড়াবে। আগে তৃণমূলের প্রত্যেক নেতা প্রতি বাক্যে মুখ্যমন্ত্রীর নাম নিতেন। এখন অনেকেই তার সঙ্গে যুবরাজের নাম নেওয়াতেও অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন।
বিলাসবহুল বাস, শীতাতপনিয়ন্ত্রিত তাঁবু খাটিয়ে রীতিমত নাটকীয় ভঙ্গীতে শুরু হয়েছে তৃণমূল নেতার রাজ্য সফর। বিরোধীদের অভিযোগ, এই যাত্রায় প্রতিদিন খরচের পরিমাণ নাকি ৯২ লক্ষ টাকা! মুখ্যমন্ত্রী কথায় কথায় অর্থাভাবের প্রসঙ্গ তোলেন। এমন বিলাসবহুল জনসংযোগ যাত্রা দেখে তা বোঝার উপায় নেই। তৃণমূল বলতেই পারে, এটা দলীয় কর্মসূচি। কিন্তু তৃণমূলের আমলে দল আর সরকারের মধ্যে কি কোনো পার্থক্য আর অবশিষ্ট আছে? যে কোনো সরকারি অনুষ্ঠানে মন্ত্রীরা দলীয় ভাষণ দেন, দলের অনুষ্ঠানে সরকারের প্রচার করেন। সরকারি দপ্তরে দলের বৈঠক, এমনকি সাংবাদিক সম্মেলন পর্যন্ত হয়। জনপ্রতিনিধি না হওয়া সত্ত্বেও বীরভূমের দোর্দণ্ডপ্রতাপ নেতার বাসভবনে জেলার উচ্চপদস্থ আধিকারিকদের যেতে হত। সর্বভারতীয় সভাপতির সভার জন্য কলেজ ছুটি দেওয়া হয়। নিয়োগ পরীক্ষার ওএমআর শিট শাসক দলের নানা স্তরের নেতাদের বাড়িতে পাওয়া যায়। এই অবস্থায় দলের কর্মসূচিতে সরকারি কোষাগারের অর্থ খরচ হওয়ার আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। আর কিছুতে না হোক, শুধুমাত্র নেতাদের নিরাপত্তার জন্যই বিশাল পরিমাণ অর্থ ব্যয় হয়।
শাসক দলের নেতাদের নিরাপত্তা দিতেই যদি এত পুলিশ নিয়োগ করা হয়, তবে জনসাধারণের নিরাপত্তা কারা দেবে? তৃণমূল নেতা উত্তরবঙ্গ সফর করছেন। উত্তর দিনাজপুরের কালিয়াগঞ্জ এবং মালদার কালিয়াচকে ঘটে গেছে নৃশংস নারী নির্যাতন। কালিয়াগঞ্জে পুলিশের ভূমিকা নিয়ে মুখ্যমন্ত্রী পর্যন্ত উষ্মা প্রকাশ করতে বাধ্য হয়েছেন। মালদার স্কুলে ঢুকে পড়ছে বন্দুকবাজ। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলার এই করুণ দশার মধ্যেই রাজপুত্রের সফর ঘিরেও অশান্তি। কালিয়াগঞ্জে যখন থানা ভাঙচুর করে আগুন ধরানো হচ্ছে, তখন কোচবিহারে তৃণমূলীরা নিজেদের ভোটেরই ব্যালট ছিনতাই করছে। সেটা নাকি ‘পঞ্চায়েত পরিচ্ছন্ন’ করার প্রয়াস ছিল, যার জন্য ভোটের মাধ্যমে তৃণমূলের প্রার্থী বাছাই হচ্ছিল। এই যদি পরিচ্ছন্নতার নমুনা হয়, তাহলে ‘নব্য’ তৃণমূলের আসল চেহারা বুঝতে অসুবিধা হয় না। ব্যালট ছিনতাইয়ে দক্ষ ব্যক্তিরাই বোধহয় তৃণমূল প্রার্থী হিসাবে বেশি যোগ্য। সর্বভারতীয় সভাপতির জনসংযোগ যাত্রায় সেই দক্ষতা দেখানোর প্রতিযোগিতা চলছে।
অনেকে বলছেন, এসব নাকি মহড়া। পঞ্চায়েত ভোট লুঠের প্রস্তুতি। আগামীদিনে জনসংযোগ যাত্রাকে কেন্দ্র করে জেলায় জেলায় এমন অশান্তির আশঙ্কা উড়িয়ে দেওয়া যায় না। ভোট প্রচারে এসে ধর্মস্থানে যাওয়া, কারোর বাড়িতে ভোজপর্ব সেরে মিডিয়ায় তার প্রচার করতে বিজেপি অভ্যস্ত। তৃণমূল সেই পথেরই পথিক। জনসংযোগ যাত্রার নামে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সভাপতি সেসব কাজ নিষ্ঠার সঙ্গে করে চলেছেন।
আইনশৃঙ্খলার বেহাল দশার সুযোগ নিয়ে বিজেপি আবার জমি ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে। রামনবমী ঘিরে রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় তারা অশান্তির চেষ্টা করেছে, বেশকিছু জায়গায় সফলও হয়েছে। সেসব জায়গায় পুলিশ এবং স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের ভূমিকা নিয়েও অভিযোগ আছে। কালিয়াগঞ্জের নৃশংস ঘটনার ফায়দা তুলতে বিজেপি সাম্প্রদায়িকতার তাস খেলতেও পিছপা হয়নি। ধর্ম, জনজাতি গোষ্ঠীর পরিচয় সত্তার রাজনীতিকেই তৃণমূল ও বিজেপি মূলধন করতে চাইছে। জনসংযোগ যাত্রা নিয়ে যত আলোচনা সমালোচনা হবে, তত পঞ্চায়েত ভোটের আসল ইস্যুগুলো পিছনে চলে যাবে। মানুষের অধিকার নিয়ে আন্দোলনের কর্মসূচির ফলে বামেরা গ্রামে অনেকটা জমি শক্ত করেছে। যা কেবল তৃণমূলেরই নয়, বিজেপিরও মাথাব্যথার কারণ। অমিত শাহ রাজ্য সফরে এসে সেই উদ্বেগের কথা প্রকাশও করেছেন। তাই তৃণমূল ও বিজেপি যৌথ উদ্যোগে শুরু হয়েছে ইস্যু গুলিয়ে দেওয়ার যাত্রাপালা।
পঞ্চায়েত ভোট যখন দুয়ারে, তখন কেমন আছে গ্রামবাংলা? রাজ্যের কৃষি অর্থনীতি বিপর্যস্ত। ফসলের সঠিক দাম না পাওয়াই এখন স্বাভাবিক। সরকার কোনো ব্যবস্থাই গ্রহণ করছে না। কিষাণ মান্ডি কৃষকদের উপকার করতে পারেনি। জমির নথি না থাকায় অনেক প্রকৃত চাষি কৃষক বন্ধু, কৃষি ঋণসহ নানা সরকারি সুযোগসুবিধা থেকে বঞ্চিত। কৃষক আত্মহত্যার ঘটনা উদ্বেগজনকভাবে বেড়ে চলেছে। অনেকেই কৃষিকাজে উৎসাহ হারাচ্ছেন। তারই সুযোগে কৃষিজমির চরিত্র বদল হচ্ছে। মাটি, বালি, জল, কয়লা – সবেতেই চলছে লুঠের রাজত্ব। পরিবেশ ধ্বংস হওয়ার প্রভাব কৃষিসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে পড়ছে।
ঢাকঢোল পিটিয়ে একসময়ে হয়েছিল কর্মতীর্থ। বিশেষ কাজে আসেনি। এখন মুখ্যমন্ত্রী সেগুলো ক্লাবের নিয়ন্ত্রণে দিতে চান। শাসক দলের মদতপুষ্ট সমাজবিরোধীদের কর্মসংস্থানের সুন্দর ব্যবস্থা। উপার্জনের সুযোগ যত কমছে, তত বাড়ছে মাফিয়ারাজ। নানা উপায়ে অর্থ উপার্জনের প্রতিযোগিতায় মানুষ গভীর সঙ্কটে। এসবই চলছে শাসক দলের প্রত্যক্ষ মদতে। জীবিকার জন্য ভিনরাজ্যে চলে যাওয়ার প্রবণতা বাড়ছে। গ্রামবাংলার পাড়ায় পাড়ায় আজ ভিনরাজ্যে যাওয়ার হিড়িক। দীর্ঘদিন স্কুল, কলেজ বন্ধ থাকায় সেই প্রবণতা বেড়েছে। একশো দিনের কাজ দেড় বছরেরও বেশি সময় ধরে বন্ধ। কেন্দ্র-রাজ্য তরজার নাটকে কেড়ে নেওয়া হচ্ছে এই প্রকল্পে কাজ পাওয়ার আইনি অধিকার। মাসের পর মাস অনেকের মজুরি বকেয়া রয়েছে।
তন্তুবায়, মৎস্যজীবীসহ নানা পেশার লোকেদের জন্য সরকারের অনেক প্রকল্প রয়েছে। কৃষকদের মতই বাস্তবে তার সুযোগ অনেক যোগ্য লোক পান না। সরকারি দপ্তর, পঞ্চায়েতের মোড়লদের কাছে পদে পদে হেনস্থা হতে হয়। সামাজিক সুরক্ষা যোজনার সুযোগ ক্রমশ কমানো হচ্ছে। কেন্দ্র ও রাজ্য – দুই সরকারের যৌথ উদ্যোগে রেশন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত। কমেছে চালের বরাদ্দ, রাজ্য খাদ্য সুরক্ষা যোজনায় গম বা আটা দেওয়া বন্ধ হয়ে গেছে। ডিজিটাল রেশন কার্ডের মহিমায় গরীব কম চাল পাচ্ছেন, তুলনামূলকভাবে সচ্ছল পরিবার বেশি পরিমাণ চাল এবং গম বা আটা পাচ্ছে। তফসিলি জাতি, উপজাতি, অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির শংসাপত্র নিয়েও চলছে দুর্নীতি। অনেক যোগ্য লোকই সুযোগ পাচ্ছেন না, হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। অনলাইন পরিষেবার নামে খরচের সঙ্গে সঙ্গে হেনস্থাও বেড়েছে।
স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও নানা উৎপাদক গোষ্ঠীর মাধ্যমেও মানুষের সমস্যার সমাধান হচ্ছে না। স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন কোনো সরকারি প্রকল্প নয়। মানুষ নিজেরাই গঠন করতে পারেন। কিন্তু গোষ্ঠী চালাতে পঞ্চায়েত, সরকার, ব্যাঙ্ক, সমবায় সমিতির সাহায্য দরকার। সরকারের বেঁধে দেওয়া ছকেই বাস্তবে গোষ্ঠীকে চলতে হয়। মহিলাদের আর্থসামাজিক উন্নয়নের জন্য স্বনির্ভর গোষ্ঠীকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। তাদের কাজের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হচ্ছে ক্ষুদ্র ঋণ। বেশিরভাগ গোষ্ঠীর কাজই এই ক্ষুদ্র ঋণের মধ্যেই সীমাবদ্ধ, উৎপাদনমূলক কাজে লাগছে না। আবার ঋণ না মেটাতে পারায় অনেক গোষ্ঠী উঠে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র ঋণের পাশাপাশি রয়েছে অর্থ উপার্জনের জন্য নানা সুযোগ দেওয়া, প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। সেই প্রশিক্ষণ হয় পরিকল্পনাহীনভাবে। অনেকেই প্রশিক্ষণ নিয়ে অর্থ উপার্জন করতে পারছেন না। গোষ্ঠীর সমষ্টিগত উন্নয়নের ঘোষিত লক্ষ্য পূরণ হচ্ছে না। পঞ্চায়েত বা শাসক দলের মাতব্বরি এবং তাদের প্রতি আনুগত্যের জমিটাই কেবল পাকাপোক্ত হচ্ছে।
স্বনির্ভর গোষ্ঠীগুলোতে শাসক দলের মাতব্বরির অন্যতম মাধ্যম হল উপসংঘ ও সংঘ। গোষ্ঠী বা দলগুলো যাতে নিজেদের মধ্যে সমম্বয় করে কাজ করতে পারে তার জন্য গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে উপসংঘ গঠিত হয়। আবার কতকগুলো উপসংঘ নিয়ে গঠিত হয় সংঘ। নিয়ম অনুসারে গোষ্ঠীগুলোই উপসংঘ ও সঙ্ঘের পদাধিকারী ঠিক করবে। বাস্তবে আর পাঁচটা গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানের মত এখানেও শাসক দলের প্রভাবের অভিযোগ ওঠে। পশুপালন, স্কুলের পোশাক, মিড ডে মিলের বরাদ ইত্যাদি নিয়ে উপসংঘ ও সঙ্ঘের মাতব্বরিতে শাসক দলের প্রচ্ছন্ন ভূমিকা থাকে। নিচু তলা থেকে দলের সদস্যাদের পরিকল্পনার স্থান দখল করে এইসব উপসংঘ ও সংঘ। সমম্বয়ের নামে দলবাজির সুযোগ থেকেই যায়। এমনকি কাজের বরাত পেতে সংঘ বা উপসংঘ থেকে শাসক দলের কেউ কেউ টাকা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ ওঠে।
কৃষক ও অন্যান্য উৎপাদক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রেও একই অবস্থা। কেন্দ্রের জাতীয় গ্রামীণ জীবিকা মিশনের অধীনে উৎপাদকরা সংঘবদ্ধভাবে সংস্থা বা গোষ্ঠী গড়ে তুলতে পারে। এই কাজ দেখার দায়িত্ব পঞ্চায়েতের নারী, শিশু উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ উপসমিতির। কৃষি ও অন্যান্য উপসমিতির সঙ্গে সমম্বয় গড়ে সুপরিকল্পিতভাবে এই কাজ করা যায়। বাস্তবে এই গোষ্ঠীগুলোর মাধ্যমে ঋণের কারবারই বেশি চলছে। ঋণ না মেটাতে পারায় অনেক গোষ্ঠী উঠেও যাচ্ছে। সামাজিক নিরীক্ষার মাধ্যমে উপসমিতিগুলো এ নিয়ে সার্বিক পরিকল্পনা গ্রহণ করতে পারে। সরকার বা পঞ্চায়েতের মাতব্বর, শাসক দলের নেতাদের এসব কথা অজানা নয়। কিন্তু, দলবাজি ও তোলাবাজিতে কোনো সম্ভাবনাকেই কাজে লাগানো যাচ্ছে না। গ্রামীণ সমবায়গুলোও আজ ধ্বংসের মুখে।
রাজ্য সরকারের তুঘলকি আচরণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো এখন খোলার থেকে বন্ধই বেশি থাকে। সুতরাং বাড়ছে প্রাইভেট টিউশনের উপর নির্ভরতা। প্রথম প্রজন্মের পড়ুয়াদের অবস্থা এর ফলে সবচেয়ে সঙ্গীন। সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা ধ্বংসের মুখে। স্কুল বন্ধ মানে মিড ডে মিলও বন্ধ থাকছে, গ্রামের বহু গরীব পরিবারের শিশুর অপুষ্টি বাড়ছে। অঙ্গনওয়াড়ি, আশা, মিড ডে মিলসহ নানা প্রকল্পের কর্মীরা গ্রামোন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন। তাঁরা এখনো সরকারি কর্মচারীর মর্যাদা পাননি। জনস্বাস্থ্য, কারিগরি দপ্তরসহ নানা দপ্তর বা প্রকল্পে জল সরবরাহের কাজে নিযুক্ত ঠিকে কর্মীরা ঠিকমত বেতন পাচ্ছেন না। সব মিলিয়ে গ্রামবাংলা যেন নেই রাজ্য আর নৈরাজ্যের দেশ।
পঞ্চায়েত আইন অনুসারে ঠিকমত কাজ হলে এমন হওয়ার কথা নয়। রাজ্য সরকার, পঞ্চায়েতের মোড়ল বা শাসক দল – কেউই এমন মাতব্বরির সুযোগ পেত না। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মূল লক্ষ্যই হল মানুষের সক্রিয় অংশগ্রহণ। তাঁরাই হবেন গ্রামোন্নয়নের কাজের মূল কর্মকর্তা। নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি ও সরকারি আধিকারিকরা সহযোগীর ভূমিকা পালন করবেন মাত্র। বাস্তবে সাধারণ মানুষ ব্রাত্য হয়ে গেছেন। সামাজিক নিরীক্ষা, গ্রাম সংসদ, গ্রামসভায় মানুষের অংশগ্রহণের কোনো সুযোগই থাকে না। স্বনির্ভর গোষ্ঠী ও উৎপাদক গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনা গৃহীত হয় না।
প্রত্যেকটা গ্রাম পঞ্চায়েতের কাজ পরিচালনার জন্য অর্থ ও পরিকল্পনা, শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য, নারী, শিশু উন্নয়ন ও সমাজ কল্যাণ, কৃষি ও প্রাণিসম্পদ বিকাশ এবং শিল্প ও পরিকাঠামো – এই পাঁচটা উপসমিতি রয়েছে। বাস্তবে তাদের কাজও ঠিকমত হয় না। আইন যা-ই থাকুক, পঞ্চায়েতে মানুষের অংশগ্রহণের সুযোগ কমিয়ে, কেন্দ্রীকরণের ঝোঁক বাড়ছে। পঞ্চায়েতের স্থান নিচ্ছে রাজ্য সরকারের নানা বিভাগ। আমলাতন্ত্রের ভিত আবার শক্ত হচ্ছে। তৃণমূলের সীমাহীন দুর্নীতি ও মাতব্বরি সেই সুযোগ করে দিয়েছে। রাজ্য সরকার পঞ্চায়েতের ক্ষমতা কমাতে চায়। আবার কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্য সরকারের ক্ষমতা খর্ব করছে। পঞ্চায়েতের আসল লক্ষ্যই আজ ব্যর্থতায় পর্যবসিত হতে চলেছে।
আরো পড়ুন পঞ্চায়েত নির্বাচন: বিরোধীরা যে যেখানে দাঁড়িয়ে
তৃণমূলের জনসংযোগ যাত্রায় এসব প্রশ্ন উঠবে না। প্রশ্ন তোলা হবে না, গত বছর উত্তরবঙ্গে যখন গরম কম, তখন গরমের ছুটি দেওয়া হয়েছিল কেন? কেন শিক্ষা ও জনস্বাস্থ্য উপসমিতির স্কুল ছুটি দেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণের অধিকার থাকবে না? কেন গ্রামসভাকে গুরুত্ব না দিয়ে একের পর এক উন্নয়ন প্রকল্পের নামে পরিবেশ ধ্বংস করা হবে, মানুষকে জীবিকা-বাসস্থান থেকে উচ্ছেদ করা হবে? কেন রাজ্য সরকারের শিক্ষক বদলি নীতিতে গ্রামের স্কুলগুলো শিক্ষকের অভাবে ধুঁকবে? কেন পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে কাজে লাগিয়ে স্বনির্ভর ও উৎপাদক গোষ্ঠীগুলোকে নিয়ে বিকল্প উন্নয়নের সুযোগ গ্রামবাসীর থাকবে না? আবাস যোজনাসহ নানা প্রকল্পে কারা সুযোগ পাবেন, তা ঠিক করার অধিকার কেন মানুষের থাকবে না? কেন আইন অমান্য করে কেন্দ্র ও রাজ্য দুই সরকারই ১০০ দিনের কাজ দেবে না?
নয়া উদারনীতি গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের বিরোধী। সুশাসনের নামে প্রশাসনিক ও শাসন কাঠামোতে বেসরকারিকরণ ও কর্পোরেটতন্ত্র কায়েম করা তার দর্শন। যেখানে মানুষ কেবলই আজ্ঞাবহ প্রজা থাকবে। পঞ্চায়েত ব্যবস্থার মাধ্যমে মানুষ প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের অধিকার পান, তা কেন্দ্র বা রাজ্য – কোনো সরকারই চায় না। আইন যা-ই বলুক, বাস্তবে পঞ্চায়েতগুলো বিভিন্ন কেন্দ্রীয় ও রাজ্য সরকারি প্রকল্প কার্যকরী করার হাতিয়ারে পরিণত হয়েছে। প্রকল্পের সঙ্গে থাকে নানা শর্ত। অনেক প্রকল্প আবার নানা আন্তর্জাতিক সংস্থার অর্থে ও শর্তে চলে। সেইসব প্রকল্পের ঢাকঢোল পিটিয়ে নামও দেওয়া হয়। বর্তমান কেন্দ্রীয় সরকার যেমন আগের নানা প্রকল্পের নাম বদলে নতুন মোড়কে হাজির করছে। আবার রাজ্য সরকার কেন্দ্রীয় প্রকল্পের নাম বদলে নিজের নামে চালাচ্ছে। তা নিয়ে রাজনৈতিক তরজার শেষ নেই। কিন্তু এভাবেই নানা প্রকল্পের নামে পঞ্চায়েতগুলোর স্বাধীনভাবে কাজ করার অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে। এখন আবার অনেক প্রকল্প এনজিওগুলোর হাতে দিয়ে আসলে পরিষেবার বেসরকারিকরণ করা হচ্ছে। সেখানেও আবার নানা বড় বড় কর্পোরেট পরিচালিত এনজিওর অর্থ ঘুরপথে আসছে। পরিণতিতে পঞ্চায়েতে সাধারণ মানুষের প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের সুযোগ থাকছে না। জনসংযোগ যাত্রা, গরীবের বাড়িতে ভোজসভার নাটক মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের বিষয়টাকেই আড়াল করে দিচ্ছে। গ্রামবাসীর উন্নয়নে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণের আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত করাই এবারের পঞ্চায়েত নির্বাচনের প্রধান ইস্যু হওয়া প্রয়োজন।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।