২০০৬ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে রাজ্যে ক্ষমতায় এসেছিল বামফ্রন্ট। তার ঠিক দুবছরের মাথায়, ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে প্রথম পশ্চিমবঙ্গের দুর্ভেদ্য বাম দুর্গে ফাটল দেখা দেয়। অধিকাংশ জেলা পরিষদ শাসক দল দখল করলেও সেই প্রথম পঞ্চায়েতে মাথাচাড়া দেয় বিরোধী জোট। পূর্ব মেদিনীপুরে এককভাবে এবং দক্ষিণ ২৪ পরগনায় এসইউসিআইয়ের সঙ্গে জোট বেঁধে জেলা পরিষদ দখল করে তৃণমূল। যে গ্রামবাংলাকে বামফ্রন্টের, বিশেষত বড় শরিক সিপিএমের দুর্গ বলে মনে করা হত, ওই নির্বাচন থেকেই দ্রুত সেখানে শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকে বিরোধী দলগুলো, বিশেষত তৃণমূল।
২০০৬-০৭ সালের সিঙ্গুর ও নন্দীগ্রাম আন্দোলন রাজ্য সরকারকে বড় ধাক্কা দিয়েছিল ঠিকই, কিন্তু তিন দশকের সরকার পড়ে যাবে, এমনটা মনে হওয়ার মতো পরিস্থিতি তখনই তৈরি হয়নি। কারণ রাজ্যের সামান্য কয়েকটা কোণ বাদ দিলে বিরোধীদের সংগঠন ছিল দুর্বল। ২০০৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনই প্রথম বামফ্রন্ট সরকারের মৃত্যুঘন্টা বাজিয়ে দেয়। জেলা পরিষদের নিরিখে বহু পিছিয়ে থাকলেও পঞ্চায়েতের ফল বিরোধী শিবিরকে প্রবল আত্মবিশ্বাসী করে তোলে। তার ধারাবাহিকতাতেই ২০০৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে পশ্চিমবঙ্গে বামফ্রন্টের অভূতপূর্ব নির্বাচনী বিপর্যয়। এরপর ২০১১ সালের ফলাফল প্রত্যাশিতই ছিল।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
পঞ্চায়েত নির্বাচন যে কতখানি গুরুত্বপূর্ণ হতে পারে, তার প্রমাণ আমরা আবার পেলাম ২০১৮ সালে, তবে কিছুটা অন্যভাবে। ২০১৬ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূলের বিরাট বিজয়ের পর পঞ্চায়েতে শাসক দলের একচেটিয়া বিজয় প্রত্যাশিতই ছিল। বিজেপি তখনো বেশ দুর্বল, বিধানসভায় মাত্র তিনটে আসন। প্রধান বিরোধী বাম-কংগ্রেসের বেহাল দশা। কিন্তু তৃণমূল এই অপেক্ষাকৃত সহজ লড়াইতেও সর্বশক্তি নিয়োগ করল। দেদার ছাপ্পা, বুথ দখল, বিরোধী কর্মীদের খুন তো ছিলই বহুকালীন নিয়মে; নতুন যোগ হল রাজ্যজুড়ে বেনজির পরিমাণে মনোনয়ন জমা দিতে না দেওয়া। সব মিলিয়ে রাজ্যবাসী দেখলেন তৃণমূলের তাণ্ডব। নির্বাচনে শাসক দল ত্রিস্তর পঞ্চায়েত ব্যবস্থাকে কার্যত বিরোধীশূন্য করে দিল। কিন্তু গ্রামীণ মানুষের ক্ষোভ উঠল চরমে। সেই ক্ষোভকে কাজে লাগাল বিজেপি। ২০১৯ সালে একদিকে মোদী হাওয়া, অন্যদিকে রাজ্যে গণতন্ত্র হত্যার ফলে প্রবল শাসকবিরোধী ক্ষোভ – এই দুয়ের মেলবন্ধনে অপ্রত্যাশিত ভাল ফল করল বিজেপি। বলা যেতে পারে, বঙ্গ রাজনীতির এক ধরনের পালাবদলের সাক্ষী থাকলাম আমরা।
লোকসভা নির্বাচনের বিপর্যয় থেকে কী শিক্ষা নিলেন মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়, ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ২০১১ সালের পুনরাবৃত্তি কেন হল না – সেসব অন্য প্রশ্ন। কিন্তু মোদ্দাকথা হল, পঞ্চায়েত নির্বাচন শাসক ও বিরোধী দুপক্ষের কাছেই অ্যাসিড টেস্ট। বিশেষ করে বিরোধীদের জন্য পঞ্চায়েত নির্বাচন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রশাসন এবং শাসক দলের দাপট রুখে যদি পঞ্চায়েতে ভাল ফল করা যায়, তাহলে লোকসভা নির্বাচনের আগে ভাঁড়ারে অনেকখানি আত্মবিশ্বাস জমে।
গত কয়েক মাসে রাজ্য রাজনীতির জল নানা খাতে বয়ে গিয়েছে। তৃণমূলের হেভিওয়েট নেতাদের কয়েকজন জেলে, নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। তৃণমূলে নবীন-প্রবীণের বিরোধ স্তিমিত হলেও এখনো পুরোপুরি মেটেনি। সর্বোপরি, পঞ্চায়েতের ক্ষেত্রে আবাস যোজনার দুর্নীতি নিয়ে বেশ ব্যাকফুটে তৃণমূল। সংবাদমাধ্যমে বিভিন্ন এলাকায় তৃণমূল নেতাদের তাড়া খাওয়ার ছবিও এসেছে। লক্ষ্মীর ভাণ্ডার, দুয়ারে সরকার, কন্যাশ্রী, যুবশ্রীর সাজানো মাঠেও তৃণমূলের অস্বস্তি বাড়াচ্ছে এই ইস্যুগুলো। কিন্তু বিরোধীরা কি আদৌ এগুলোকে কাজে লাগানোর জায়গায় আছেন?

প্রথমেই দেখা যাক প্রধান বিরোধী দল বিজেপির কী অবস্থা। এক কথায় বলতে গেলে – শোচনীয়। বঙ্গ বিজেপি তিন বা তার বেশি শিবিরে বিভক্ত। দিলীপ ঘোষ কার্যত নিষ্ক্রিয়। শুভেন্দু অধিকারী এবং সুকান্ত মজুমদার যুযুধান। শান্তনু ঠাকুর, সৌমিত্র খাঁয়ের মতো সাংসদরা নিয়ম করে তোপ দাগছেন দলীয় নেতৃত্বকে। সুকান্ত মজুমদার এবং অমিতাভ চক্রবর্তীর বিরুদ্ধে দলীয় বৈঠকে নিয়মিত ক্ষোভ প্রকাশ করছেন লকেট চট্টোপাধ্যায়। রাজ্যের দায়িত্বপ্রাপ্ত কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক সুনীল বনশল, মঙ্গল পাণ্ডের সামনেই গোষ্ঠীদ্বন্দ্বে জড়াচ্ছেন নেতারা। বুথ এবং মণ্ডল স্তরে প্রায় কোনও কর্মসূচি নেই বিজেপির। শুভেন্দু অধিকারী নিজের মত করে রাজ্য সফর করছেন, তাঁকে এড়িয়ে চলছেন সুকান্ত মজুমদারের অনুগামীরা। সংখ্যার বিচারে অনেক দুর্বল, বিধানসভায় একটিও আসন না পাওয়া বামপন্থীরাও পঞ্চায়েত নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে গ্রামে গ্রামে জনসংযোগ করছেন, কিন্তু গোষ্ঠী কোন্দলে দীর্ণ বিজেপির সেসব বালাই নেই। উত্তরবঙ্গে এখনো বিজেপি অত্যন্ত শক্তিশালী। সেখানে দলের আভ্যন্তরীণ সমস্যাও কম। কিন্তু দক্ষিণবঙ্গের ছবিটা গেরুয়া শিবিরের জন্য মোটেই আশাবাদী হওয়ার মত নয়।

মহম্মদ সেলিম রাজ্য সম্পাদক হওয়ার পর আগের তুলনায় অনেকটাই গতিশীল সিপিএম। সম্প্রতি রাজ্যজুড়ে গ্রাম জাগাও কর্মসূচি নিয়েছিল রাজ্যের সবচেয়ে বড় বাম দল। দলীয় সংগঠনের নড়াচড়াও বেড়েছে। বীরভূমসহ কিছু কিছু জেলায় আগের তুলনায় অনেক বেশি বুথে পৌঁছতে পেরেছেন বামপন্থীরা। গ্রাম জাগাও কর্মসূচিকে মোটের উপর সফল বলেই মনে করছে আলিমুদ্দিন স্ট্রিট। সেই কর্মসূচির পর জোর দেওয়া হয়েছে বাড়ি বাড়ি জনসংযোগে।
একসময় সিপিএমের সংগঠনের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভরকেন্দ্র ছিল কৃষক সভা। তেভাগা আন্দোলনের সময় থেকেই বাংলার গ্রামাঞ্চলে বামপন্থীদের সংগঠন ধরে রেখেছিল কৃষক সভা। দুটো যুক্তফ্রন্টের স্বল্পমেয়াদি সময়কাল পেরিয়ে রাজ্যে যখন ১৯৭২-৭৭ কংগ্রেসের রাজত্ব কায়েম হল, তখনো বহু প্রতিকূলতা সত্ত্বেও গ্রামবাংলায় বামপন্থী জনভিত্তিকে আগলে রেখেছি কৃষক সংগঠন। ১৯৭৭ সালের বিধানসভায় কংগ্রেসবিরোধী ভোট জনতা দলের দিকে না গিয়ে বামফ্রন্টের দিকে আসার নেপথ্যেও গ্রামাঞ্চলে বহু দশক ধরে চলে আসা কৃষক সভার সক্রিয়তা। কিন্তু ‘উন্নয়নের হাতিয়ার’ বামফ্রন্ট সরকারের শেষদিকে ক্রমাগত দুর্বল ও গুরুত্বহীন হয়ে পড়েছে কৃষক সভা। পার্টির নেতৃত্বেও কৃষক নেতাদের প্রতিনিধিত্ব ক্রমশ কমেছে। ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পরেও সেই অবস্থার খুব একটা বদল হয়নি। অথচ কৃষক সভা শক্তিশালী না হলে পঞ্চায়েতে নজরকাড়া ফল করা কঠিন।
সিপিএমের সাংগঠনিক স্থবিরতা খানিকটা কেটেছে ঠিকই, কিন্তু প্রশাসন ও তৃণমূলের সাংগঠনিক ক্ষমতার মোকাবিলা করে তাদের পক্ষে পঞ্চায়েত নির্বাচন থেকেই আশাতীত ফলাফল করা কঠিন। অবশ্য বাংলার বামপন্থীরা ঠিক কতখানি আশা করছেন তা বলা মুশকিল।
আরো পড়ুন সিঙ্গুর প্রসঙ্গ: সন্ধিক্ষণের জন্য অপেক্ষা না উদ্যোগ?

প্রদেশ কংগ্রেস নিয়ে আলোচনা মূলত তিনটে জেলায় সীমাবদ্ধ। মুর্শিদাবাদে অধীর চৌধুরীর দুর্গের অবস্থা শোচনীয়। খোদ বহরমপুর শহরেই পুরসভা নির্বাচনে একচেটিয়া ‘ভোট করিয়ে’ জয় পেয়েছে তৃণমূল। পঞ্চায়েত নির্বাচনেও তৃণমূলের সাংগঠনিক শক্তি এবং প্রশাসনের মোকাবিলা করা কংগ্রেসের পক্ষে কঠিন। তবে সাগরদীঘির উপনির্বাচনে যদি তৃণমূলের গোষ্ঠীদ্বন্দ্বকে কাজে লাগিয়ে কংগ্রেস অপ্রত্যাশিত ভাল ফল করতে পারে, তাহলে পঞ্চায়েতের লড়াই জমবে। মুর্শিদাবাদের কংগ্রেসের প্রধান সমস্যা হল, অধীর বাদে আর কোনো নেতা না থাকা। এলাকায় এলাকায় এখনো কংগ্রেসের পক্ষে সমর্থন বিপুল। তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রধান শক্তি কংগ্রেসই, কিন্তু সবটাই অধীরের মুখ চেয়ে। তিনি প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতি, লোকসভাতেও তাঁর দায়িত্ব বিপুল। ফলে সাংগঠনিক শূন্যতা ভরাট করার কেউ নেই।
মুর্শিদাবাদের চেয়ে মালদা এবং দিনাজপুরে কংগ্রেসের অবস্থা অনেক ভাল। ফরওয়ার্ড ব্লকের তরুণ নেতা ভিক্টর কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন, নজরকাড়া ভিড় চোখে পড়ছে তাঁর জনসভায়। সংখ্যালঘু মানুষের মধ্যে ভিক্টরের পারিবারিক ও ব্যক্তিগত প্রভাব রয়েছে। তার সঙ্গে যুক্ত হয়েছে কংগ্রেসের পুরনো কাঠামো ও জনভিত্তি। ফলে দিনাজপুরে নির্বাচন হলে আগের তুলনায় ভাল ফল করতে পারে কংগ্রেস। একই কথা বলা যায় মালদা সম্পর্কেও। ঈশা খান চৌধুরীর নেতৃত্বে আগের চেয়েও অনেকটাই সক্রিয় কংগ্রেস। তৃণমূল ছেড়ে কংগ্রেসে যোগ দিচ্ছেন মানুষ – এমন ছবিও চোখে পড়ছে এই জেলায়।

তিন ‘বড়’ বিরোধীর বাইরে পড়ে রইল চতুর্থ বিরোধী দল ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (আইএসএফ)। তাদের শক্তি সীমিত। দক্ষিণ ২৪ পরগনা, হুগলী, উত্তর ২৪ পরগনা, মালদা ও মুর্শিদাবাদের কিছু এলাকায় সীমাবদ্ধ। কিন্তু যেসব এলাকায় আইএসএফের সংগঠন রয়েছে, সেখানে তৃণমূলের অস্বস্তি ক্রমবর্ধমান। ভাঙড়ের বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি ক্রমশই পশ্চিমবঙ্গের সংখ্যালঘু পরিসরে গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক চরিত্র হয়ে উঠছেন। অতি সম্প্রতি কলকাতার রাজপথ থেকে তাঁকে টেনে হিঁচড়ে গ্রেপ্তারির দৃশ্য তৃণমূলের জন্য নিঃসন্দেহে অস্বস্তিকর। রাজ্য রাজনীতির তুলনামূলক কম আলোচিত এই দলটার কর্মীবাহিনীও অত্যন্ত লড়াকু। এবারই প্রথম পঞ্চায়েত নির্বাচনে লড়বে আইএসএফ। পশ্চিমবঙ্গের জনসংখ্যার প্রায় ৩০% ইসলাম ধর্মাবলম্বী। পঁচিশ শতাংশের বেশি মুসলমান ভোটার রয়েছেন – এমন বিধানসভা আসনের সংখ্যা ১৪৬। একুশের ভোটে এই আসনগুলোর মধ্যে তৃণমূল জেতে ১৩১টা। অর্থাৎ সংখ্যালঘু ভোট যার, বাংলা তার। এ এক মোটা দাগের হিসাব বলা যায়। এই বিরাট অংশের মধ্যে ক্রমশ শক্তিশালী হয়ে উঠছে আইএসএফ। পঞ্চায়েত নির্বাচন নওশাদদের কাছেও তাই অগ্নিপরীক্ষা। যদি আইএসএফ অন্তত কয়েকটা কোণেও ভাল ফল করতে পারে, তাহলে রাজ্য রাজনীতি নিয়ে নতুনভাবে ভাবতে হতে পারে।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।