অপর্ণা ভট্টাচার্য ও রাহুল মুখার্জি
আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি ত্রিপুরায় বিধানসভা নির্বাচন। নতুন রাজনৈতিক সমীকরণ, বাদানুবাদ, অশান্তি – সবকিছু নিয়ে ভোটের হাওয়া উত্তপ্ত। গত পাঁচ বছরে আমূল বদলেছে ত্রিপুরার রাজনীতি। একদা প্রবল পরাক্রমী বামেরা এখন হাত ধরেছে পুরনো শত্রু কংগ্রেসের। রাজপুত্র প্রদ্যোৎ দেববর্মার দল তিপ্রা মোথা উঠে এসেছে গুরুত্বপূর্ণ শক্তি হিসাবে। ক্ষমতাসীন বিজেপিও পিছিয়ে নেই। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকবার ঘুরে গেছেন, তৃণমৃল নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ও ত্রিপুরায় যাবেন শিগগির।
ষাটটি আসনের মধ্যে কুড়িটি তফসিলি উপজাতি এবং দশটি তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত। ২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচন অবধি ত্রিপুরাতে প্রাধান্য ছিল সিপিএম নেতৃত্বাধীন বাম জোটের। ২০১৮ সালে ২৫ বছরের বাম শাসনের অবসান ঘটিয়ে ক্ষমতায় এসেছে বিজেপি। এই প্রতিবেদনে আমরা আলোচনা করব ২০১৮, ২০১৯ এবং ২০২১ সালে হওয়া ত্রিপুরা রাজ্যের বিভিন্ন নির্বাচনের ফলাফল এবং ২০২৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তার সম্ভাব্য প্রভাব।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
মূলত তিনটি ভাগে আমরা ফলাফল বিশ্লেষণ করেছি – উপজাতি ভোট, বাঙালি হিন্দু ভোট এবং মুসলমান ভোট।
উপজাতি ভোট
ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ এলাকা উপজাতিপ্রধান, যদিও ২০১১ সালের জনগণনা অনুযায়ী রাজ্যের ৩১.৭৬% মানুষ উপজাতিভুক্ত। ষষ্ঠ তফসিল অনুযায়ী তিপ্রা-গরিষ্ঠ এলাকার স্বায়ত্তশাসন পরিচালনা করে ত্রিপুরা উপজাতি অঞ্চল স্বায়ত্তশাসিত জেলা পরিষদ। কুড়িটি আসন উপজাতিভুক্ত মানুষের জন্য সংরক্ষিত হলেও আরও ১০-১৫ আসনে উপজাতি ভোট বড় প্রভাব ফেলতে পারে। ২০১০ ও ২০১৫ সালের জেলা পরিষদ নির্বাচনে বিপুলভাবে জিতেছিল বাম দলগুলো। ২০১৮ সালের আগে অবধি বিধানসভা ভোটেও ওই ২০ আসনের ১৯টি ছিল বামেদের দখলে, একটি কংগ্রেসের। বিরোধী ভোট কংগ্রেস এবং উপজাতি গোষ্ঠীর দুটি দল আইএনপিটি এবং আইপিপিএফটির মধ্যে ঘোরাফেরা করলেও বামেদের মাথাব্যথার কারণ ছিল না। পরিস্থিতি বদলে যায় ২০১৮ সালে। আইপিএফটির সঙ্গে জোট করে বিজেপি উপজাতি সংরক্ষিত আসনগুলির দশটি জিতে নেয়, আইপিএফটি জেতে আটটি আসন। এই এলাকায় বামেদের আসনসংখ্যা ১৯ থেকে নেমে আসে দুটিতে।
বামেদের বিরুদ্ধে ভোট সরে যাওয়ার হার ছিল গড়ে ১৩.৪৫%। তাদের জন্য সবচেয়ে উদ্বেগজনক ফল ছিল চারিলাম আসনে, যেখানে বিজেপি প্রার্থী ত্রিপুরা রাজ্যের রাজপরিবারের সদস্য জিষ্ণু দেববর্মা ৮৯.৩৪% পেয়ে জেতেন। ২০১৩ সালের তুলনায় এখানে বামেদের ভোটের ক্ষয় ছিল ৪৭.৪৩%।
উল্লেখ্য, ২০১৩ বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেস আইএনপিটির সঙ্গে জোট গড়ে লড়েছিল। ২০১৩ এবং ২০১৮ সালে কংগ্রেস এবং আইএনপিটির প্রাপ্ত ভোটের বুথভিত্তিক ফলের তুলনা করলে এটা স্পষ্ট যে কংগ্রেসের ভোট ২০১৮ সালে বিজেপিতে সরে গেছে। উপজাতিপ্রধান কুড়িটি আসনে কংগ্রেসের বিরুদ্ধে ভোট সরে যাওয়ার ছিল ৩৯.৯৬%। উপজাতি এলাকায় গড়ে বামেরা পেয়েছিল ৩৯.৯২%, বিজেপি ৫৩.৬১% এবং কংগ্রেস ১.৪৭%.
২০১৯ সালে এই ছবি আবার বদলে যায়। গড়ে ২৯.৫৪% ভোট বাড়িয়ে লোকসভা নির্বাচনে দ্বিতীয় স্থানে উঠে আসে কংগ্রেস। চারিলাম বাদে সব আসনে বামেদের ভোট কমেছে। এর মধ্যে রামচন্দ্রঘাটে সব থেকে বেশি – ৩৩.৬৯%। এই আসনে কিন্তু আইপিএফটি এককভাবে লড়েছিল। কয়েকটি আসনে এনডিএ র ভোট ভাগ হয়।
২০১৯ সালের পর পরিস্থিতি আমূল বদলে গেছে। ত্রিপুরার রাজপরিবারের সদস্য প্রদ্যোৎ প্রদেশ কংগ্রেস সভাপতির পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে তৈরি করেন আদিবাসী প্রগতিশীল আঞ্চলিক জোট বা তিপ্রা মোথা। ২০২১ সালে ত্রিপুরা উপজাতি স্বায়ত্তশাসন পরিষদের নির্বাচনে তিপ্রা মোথা আইএনপিটির সঙ্গে জোট করে লড়ে শাসক বিজেপিকে পর্যদুস্ত করে। তিপ্রা মোথা জোটের প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪৬.৭৩%, বিজেপি ও জোটসঙ্গী আইপিএফটি পেয়েছিল ২৯.৪৩% এবং বাম জোট ১২.৪৬%। কংগ্রেসের ভোট কমে দাঁড়ায় ২.২৪%। গত দুবছরে উপজাতি গোষ্ঠীর বেশ কয়েকজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা যোগ দেওয়ায় তিপ্রা মোথা আরো শক্তিশালী হয়েছে। ফলে এবারের বিধানসভা নির্বাচনে নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে চলেছে তিপ্রা মোথা।
আরো পড়ুন ত্রিপুরার পুরভোট: গণতন্ত্রের বস্ত্রহরণ এবং বঙ্গ মিডিয়ার আশ্চর্য চেহারা
বামেদের পক্ষে পরিস্থিতি আরও কঠিন হয়ে উঠছে। বিগত লোকসভা নির্বাচনের নিরিখে বলা যেতেই পারে, উপজাতি এলাকায় বাম ভোটব্যাঙ্ক বলে আর প্রায় কিছুই অবশিষ্ট নেই।
তফসিলি ভোট
ত্রিপুরার দশটি আসন তফসিলি জাতির জন্য সংরক্ষিত। ২০১৩ সালের বিধানসভা নির্বাচনে সেই দশটি আসনের আটটি ছিল বামেদের দখলে, দুটি কংগ্রেসের। ২০১৮ সালে বিজেপি পায় আটটি আসন, বামেরা দুটি। এর মধ্যে দুটি আসন – বারজালা এবং বাধারঘাটে আগে কংগ্রেসের পাওয়া দুটি আসনই বিজেপির দিকে যায়। বাধারহাটের বিধায়ক ২০১৮ সালে বিজেপি প্রার্থী হয়ে যান। নিচের টেবিল থেকে স্পষ্ট, বামেদের হারের বড় কারণ ছিল কংগ্রেস ভোট পুরোপুরি বিজেপির দিকে সরে যাওয়া এবং প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জের। বাম সরকারের বিরুদ্ধে ভোট সরে যাওয়ার হার ছিল ৬.৮৭%। এই পরিসংখ্যান উদ্বেগজনক, কিন্তু ২৫ বছর সরকারে থাকার পর অপ্রত্যাশিত নয়। কিন্তু বামেদের অবস্থা আরও শোচনীয় হয় পরের বছর সাধারণ নির্বাচনে।
২০১৯ সালের লোকসভা নির্বাচনে উপজাতিভুক্ত মানুষদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলোর মতই কংগ্রেস এগিয়ে আসে দ্বিতীয় স্থানে। বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল গড়ে ৫৫.৭৫%। এক বড় অংশের বাম সমর্থক কংগ্রেসকে ভোট দেন। ২০১৮ সালের তুলনায় কংগ্রেসের পক্ষে ভোট সরে যাওয়ার হার ছিল ১৯.৭৯%, যদিও জেতার জন্য তা যথেষ্ট নয়। বামেদের বিরুদ্ধে ভোট সরে যাওয়ার হার ছিল ২৮.২১%.
অসংরক্ষিত আসন এবং বাঙালি ভোট
ত্রিপুরা রাজ্যের প্রায় ৭০% মানুষ বাংলাভাষী। তিরিশটি আসন অসংরক্ষিত এবং বাঙালিপ্রধান। ২০১৩ সালের ভোটে এই ৩০টি আসনের মধ্যে ২৩টি ছিল বামেদের, সাতটি কংগ্রেসের। ২০১৬ সালে পশ্চিমবঙ্গে বাম-কংগ্রেস জোট হওয়ার প্রতিবাদে কংগ্রেস ছেড়ে তৃণমূল কংগ্রেসে যোগ দেন সুদীপ রায়বর্মণসহ ছয় বিধায়ক। ২০১৭ সালে তাঁরা বিজেপিতে যোগ দেওয়ায় কংগ্রেসের সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়ে। ২০১৩ সালে অসংরক্ষিত ৩০ আসনে কংগ্রেসের গড় ভোট ছিল ৪৫.৪৮%, বামফ্রন্টের ৫১.৩১% এবং বিজেপির ১.৯৪%। ২০১৮ সালে কংগ্রেসের ভোট নেমে এসে হয়েছিল ২.২৪%। তাদের বিরুদ্ধে ভোট সরে যাওয়ার হার ছিল ৪৩.২৪%, বামেদের বিরুদ্ধে ভোট সরে যাওয়ার হার ছিল ৫.২৫% — প্রাপ্ত ভোট ৪৬.০৬%। রাজ্যের বাকি অংশের মতই বিজেপির সাফল্য এখানেও ছিল চমকপ্রদ। ৪৬.০৯% ভোট বেড়ে দাঁড়ায় ৪৮.০৪ শতাংশে, যদিও সংরক্ষিত আসন এবং অসংরক্ষিত আসনের তুলনা করলে দেখা যাচ্ছে, সংরক্ষিত আসনে বিজেপি নেতৃত্বাধীন এনডিএ জোটের প্রাপ্ত ভোটের ভাগ অনেক বেশি।
২০১৯ সালে সংরক্ষিত আসনের মত একই প্রবণতা দেখা গেছে। ২১.৭৩% ভোট বেড়ে কংগ্রেস উঠে এসেছে দ্বিতীয় স্থানে, ৪.৪৪% ভোট বেড়েছে বিজেপিরও। আর ২৯% ভোট হারিয়ে বামেদের ভোট নেমে এসেছে ১৭.০৫ শতাংশে।
মুসলমান ভোট
ত্রিপুরার জনসংখ্যার ৮.৬% মানুষ ইসলাম ধর্মাবলম্বী। এঁদের সংখ্যাগরিষ্ঠ বাংলাভাষী এবং আর্থসামাজিকভাবে পিছিয়ে থাকা মানুষ। রাজনীতিতেও মুসলমান নেতার সংখ্যা জনসংখ্যার নিরিখে কম। ২০১৮ সালের বিধানসভায় নির্বাচিত মুসলমান বিধায়ক ছিলেন তিনজন – সবাই সিপিএমের। রাজ্যের দশটি আসনে মুসলমান ভোটারের সংখ্যা ১২ শতাংশের বেশি। এর মধ্যে ছটি আসনে মুসলমানরা নির্ণায়ক ভূমিকা নিতে পারেন।
২০১৩ সালের ভোটে এই দশ আসনের নটিতে জিতেছিলেন বাম প্রার্থীরা। এর মধ্যে ২০১৮ সালে আটটি ধরে রাখতে পারে বামেরা। সংখ্যাটি গুরুত্বপূর্ণ, কারণ সংক্ষিত ৩০ আসনের মধ্যে বামেদের প্রাপ্ত আসন ১২। অর্থাৎ ২০১৮ সালে বামেদের ভরাডুবির সময়েও মুসলমান ভোটাররা তাদের পাশেই ছিলেন।
২০১৯ সালে কিন্তু মুসলমানরা বামেদের থেকে মুখ সরিয়ে নিয়েছেন। বাস্তবে মুসলমানপ্রধান এলাকায় বাম ভোট কমেছে অন্যান্য এলাকার তুলনায় বেশি।
২০২৩ সালে একদা শত্রু বাম এবং কংগ্রেস একজোট হয়ে লড়াইয়ে অবতীর্ণ। একথা অস্বীকার করা যাবে না ভোটবাক্সে তাদের মোট সমর্থন প্রতিফলিত হলে বিজেপির পক্ষে চিন্তার কথা। কিন্তু পশ্চিমবাংলায় ২০১৬ সালে এই পরীক্ষার ফল বিশেষ ভাল হয়নি। উপজাতিপ্রধান এলাকায় তিপ্রা মোথার আধিপত্য এমনিতেই অনেক সমীকরণ বদলে দিয়েছে। তৃণমূল কংগ্রেস বাঙালি এলাকায় কতটা ভোট কাটবে সেটাও দেখার বিষয়।
তথ্য ও গ্রাফিক্স লেখকদ্বয়ের
অপর্ণা ভট্টাচার্য পাবলিক রিলেশনস ও ডেটা অ্যানালিসিসের কাজ করেছেন, অধুনা কনসাল্টেন্সিতে যুক্ত।
রাহুল মুখার্জি ভারতীয় রাজনীতির উৎসাহী পর্যবেক্ষক, ইতিহাসে আগ্রহী। ব্র্যান্ড কনসাল্টেন্সি এবং ভ্রমণ নিয়ে ব্যস্ত থাকেন।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।