মহম্মদ আজাদ পেশায় মাংস বিক্রেতা, নেশায় মাইকেল মধুসূদন দত্তের পাঠক। তাঁর দোকানে রাখা থাকে মেঘনাদবধ কাব্য। একটানা মুখস্থ বলে যান মাংস কাটতে কাটতে। প্রজাতন্ত্র দিবস নিয়ে কথা বললেন নাগরিক ডট নেটের সঙ্গে।

করোনার আগে পর্যন্ত আমার ব্যবসাটা ভালই চলত। কিন্তু তারপর থেকে রোজগার বলতে প্রায় কিছুই নেই। মনমেজাজ একেবারেই ভালো থাকে না। এর মধ্যেও আমার সঙ্গী বলতে সেই মেঘনাদনধ কাব্য। এক অর্থে বলতে পারেন, মাইকেল মধুসূদনই আমাকে বাঁচিয়ে রেখেছেন। কিন্তু সব মিলিয়ে খারাপ অবস্থার মধ্যে আছি। বয়স বাড়ছে, তাও যখন প্রজাতন্ত্র দিবস নিয়ে আমার মতামত জানতে চাইছেন, তখন কিছু কথা বলি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রথমে আমার পরিচয়টা দিই। আমি খাসির মাংস বিক্রি করি, বাঙালিও নই। একজন অবাঙালি মুসলমান মাংসওয়ালার দোকানে কেন মেঘনাদবধ রাখা থাকে, কেন সে প্রায়ই সুর করে সেই কাব্যের বিভিন্ন অংশ মুখস্থ বলতে থাকে, এসব নিয়ে অনেকেরই অনেক কৌতূহল। কারও কারও বিরক্তিও চোখে পড়েছে। আমার তাতে কিছু যায় আসে না।

আমার ছোটবেলা কেটেছে দেশপ্রাণ শাসমল রোডে। ওখানেই একটা স্কুলে পড়লাম। আমি যদিও উর্দুভাষী মুসলিম, স্কুলে বাংলা পড়ানো হত। ক্লাস সেভেনে পড়ার সময় প্রথম মাইকেল মধুসূদন দত্তের লেখার সঙ্গে আমার পরিচয় হয়। প্রথম প্রথম খুব কঠিন লাগত। কিছু কিছু শব্দ তো উচ্চারণ করাই মুশকিল। অনেক শব্দের মানে বুঝতাম না, এখনো যে সব বুঝি তা নয়, কিন্তু কাব্যের চলনটা অসাধারণ লাগত। পাঠ্যবইতে যেটুকু ছিল, তাড়াতাড়ি মুখস্থ করে নিয়েছিলাম। একা একাই আবৃত্তি করতাম। কেমন যেন মনে হত একজন গয়নাগাঁটি পরা মহিলা হেঁটে চলেছেন। বাজনার মত লাগত। সেই যে মধুসূদনকে আঁকড়ে ধরলাম, আর ছাড়িনি। এখনো আমার মাংসের দোকানে, আমার শোওয়ার ঘরে, আমার সত্তায় ওই কাব্য।

প্রজাতন্ত্র দিবসের কথা বলতেই মনে পড়ে শিক্ষকদের নাম। সুনীল জানা আর বিনয় পাহাড়ি। ওঁরা বাংলা পড়াতেন। এই দুই ভদ্রলোকই প্রথম মাইকেলের কবিতার সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন এই উর্দুভাষী ছেলেটাকে। ১৫ আগস্ট, ২৩ জানুয়ারি, ২৬ জানুয়ারির সকালে স্কুলে পতাকা তোলা হত, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হত। আমি মেঘনাদবধ কাব্যের কোনো একটা লম্বা অংশ আবৃত্তি করতাম।

 

আপনাদের গজল ভালো লাগে না? কাওয়ালিতে মুগ্ধ হন না? তাহলে আমি কেন মেঘনাদবধ আঁকড়ে বাঁচতে পারব না? দেখুন, আমি ধর্মবিশ্বাসী মুসলিম। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি। একইসঙ্গে রামায়ণ, মহাভারত আমার ভীষণ প্রিয়।

 

আমার বাবার ছিল মাংসের ব্যবসা। কুঁদঘাটের কাছে ১৯৭৮ সালে মাংসের দোকান দিয়েছিলেন। আমি যখন নেতাজিনগর কলেজের ছাত্র, তখন বাবার হঠাৎ হার্ট অ্যাটাক হল, রোজগার বন্ধ। ১৯৯৮ সাল। আমি তখন কলেজে পড়ার পাশাপাশি টুকটাক টিউশনি করি। বাবার হার্ট অ্যাটাকের পরে জীবনটা বদলে গেল। চাকরি পাইনি, তাই মাংসের দোকানে এসে বসলাম। পুরনো সাংস্কৃতিক বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ কেটে গেল আস্তে আস্তে। তবে রয়ে গেলেন মাইকেল মধুসূদন, রয়ে গেল মেঘনাদবধ কাব্য। আমার দোকানেও এক কপি রাখলাম। অবসর সময়ে পড়তাম, এখনও পড়ি। কিছু কিছু ক্রেতাকে মুখস্থ বলে শোনাই। ওঁরা আনন্দ পান, আমারও ভালো লাগে।

আরো পড়ুন পরেশ দেখিয়ে দিলেন ভদ্রলোক বাঙালি নিরাপদ নন

আপনি প্রজাতন্ত্র দিবসের কথা জানতে চাইছেন। আমি একজন সামান্য মাংসওয়ালা, কী আর বলব! তবে অনেকে আমায় প্রশ্ন করেন, একজন অবাঙালি মুসলিম হয়ে কেন আমি এমন আপাদমস্তক ডুবে আছি মেঘনাদবধ কাব্যে? আমার সাংস্কৃতিক শিকড়টা ঠিক কোথায়? আমি তাঁদের হেসে জবাব দিই, এটাই তো আমাদের দেশের ম্যাজিক। আপনাদের গজল ভালো লাগে না? কাওয়ালিতে মুগ্ধ হন না? তাহলে আমি কেন মেঘনাদবধ আঁকড়ে বাঁচতে পারব না? দেখুন, আমি ধর্মবিশ্বাসী মুসলিম। পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, রোজা রাখি। একইসঙ্গে রামায়ণ, মহাভারত আমার ভীষণ প্রিয়। রাবণ আর মেঘনাদ চরিত্র দুটো থেকে বাঁচার রসদ পাই। রোজগার যখন কমে আসে, সংসার যখন চলে না, তখন আল্লার কাছে মিনতি করি অন্ধকার সময়টা যেন পার করে দেন। ঠিক তেমনই মন ভালো রাখতে, আনন্দ পেতে একটানা আবৃত্তি করি মেঘনাদবধ। এই দুয়ের মধ্যে কোনো বিরোধ নেই।

প্রজাতন্ত্র দিবস নিয়ে আমার মত একজন নগণ্য লোক কী বলবে বলুন তো? শুধু চাইব, রাজারা যেন আমাদের মতো প্রজাদের একটু সমীহ করে চলেন। একদম এলেবেলে ভেবে না ফেলেন। যেন মনে না করেন ধর্মে ধর্মে লড়িয়ে দেওয়ার খেলাটা সবসময় কাজ করবে। আর চাইব আমরা যেন মেঘনাদবধ কাব্যের রাবণের মত হই, পরাজয় নিশ্চিত জেনেও যেন বুকটান করে লড়তে পারি। তাহলেই আমাদের দেশ বাঁচবে, প্রজাতন্ত্র বাঁচবে।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.