কুণাল ঘোষ তৃণমূল রাজনীতির এক খুচরো নেতা। তিনি নিজেও সেটা জানেন। চোখা ভাষায় কথা বলতে পারেন, কারণে অকারণে আক্রমণাত্মক হতে পারেন – এটা তাঁর গুণ। সাংবাদিকতা করার সুবাদে ছোট-বড় তৃণমূল হোক বা বিরোধী নেতা, অনেকের সঙ্গেই তাঁর ব্যক্তিগত সম্পর্ক রয়েছে। সুতরাং তিনি তৃণমূলের কাজে লাগেন। শতরূপ ঘোষের মতো ছুটকো-ছাটকা নেতা হোক বা শুভেন্দু অধিকারীর মত বিরোধী নেতা, কিংবা রাহুল গান্ধীর মত জাতীয় নেতা – সবার সঙ্গে কথার যুদ্ধে বা দরকারে পায়ে পা লাগিয়ে ঝগড়া করতে তিনি ওস্তাদ। বাছবিচার করেন না। আবার মদন মিত্র মাত্রাতিরিক্ত ভাষণবাজি করলে কুণাল মধ্যস্থতা করেন। সোমেন মিত্রের তৃণমূলে আসার ব্যাপারেও নাকি তিনিই মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা পালন করেছিলেন। অন্যদিকে চ্যালেঞ্জ নেন – নওশাদ সিদ্দিকিকে তৃণমূলে নিয়ে আসার নির্দেশ এলে তিনি তাও পালন করে দেখিয়ে দেবেন।

আবার এই কুণাল একসময় মমতা ব্যানার্জির পুলিশের গুঁতো খেয়ে মুখ্যমন্ত্রীকে সারদা মামলার অন্যতম ভোক্তা বলেও, এখন সেই মমতাকেই বিভিন্ন বিষয়ে বাঁচাতে আসরে নামতে পারেন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এহেন কুণাল প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর পশ্চিমবঙ্গ সফরের দিনে কায়দা করে এক্স হ্যান্ডেলের পোস্টে এবং হোয়াটস্যাপ মেসেজ করে তৃণমূলের সাধারণ সম্পাদক ও মুখপাত্রের পদে ইস্তফা দিয়েছেন। মোদীর ভাষণ ও মমতা-মোদীর বৈঠকের থেকেও সান্ধ্য টিভি শোতে কুণালই বেশি টিআরপি নিয়ে চলে গেছেন।

পদত্যাগ নাটক হলেও, তিনি যে উত্তর কলকাতার তৃণমূল সাংসদ সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিকে একের পর এক অভিযোগের তীর ছুঁড়েছেন তা নাটক নয়। আগুনের ফুলকি যদি তাঁকে উত্তর কলকাতার জেলা তৃণমূলের বিগ্রেড চলোর প্রস্তুতি সভায় না ডাকা হয়ে থাকে, তাহলে বারুদ কিন্তু অনেক দিন ধরেই জমেছে। উত্তর কলকাতার তৃণমূলের আভ্যন্তরীণ রাজনীতির বাইরেও এর ইন্ধন ছিল। কুণাল যদি গলার স্বর হন, তবে সেই গলা আসলে তৃণমূলের ‘সেনাপতি’ অভিষেক ব্যানার্জির। আর এতে প্রচ্ছন্ন সমর্থন রয়েছে মমতারও।

এটি আদতে তৃণমূলের নবীন-প্রবীণ লড়াই-নাটকের একটি অঙ্ক। অভিষেক চান দলের প্রবীণ নেতারা সরে যান, তিনিই রাজ করবেন তৃণমূল জুড়ে। সেই ২০১৬ সালে মমতা মন্ত্রিসভার সদস্য নির্বাচন থেকে যদি লড়াইটা শুরু হয়ে থাকে, তাহলে এখনো সেই লড়াই চলছে সুদীপ-কুণাল দ্বৈরথ দিয়ে। কুণাল যতই সুদীপকে বিজেপির দালাল-টালাল বলে থাকুন এবং তাঁর বয়সের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে থাকুন, আসলে তিনি নেপথ্য নায়ক অভিষেকের মনের কথারই প্রতিধ্বনি করছেন।

অভিষেককে তৃণমূলের সর্বভারতীয় সাধারণ সম্পাদক করার পরেই যুবরাজ একটি সংক্ষিপ্ত সফরে বেরিয়েছিলেন। তৎকালীন মহাসচিব পার্থ চট্টোপাধ্যায় থেকে শুরু করে তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সী – সকলের বাড়ি বাড়ি গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে আশীর্বাদ প্রার্থনা করেছিলেন। অনেকেরই মনে থাকবে সেই দৃশ্য, যেখানে সুব্রত বক্সী আবেগবিহ্বল হয়ে অভিষেককে বলেছিলেন, তিনি সব উজাড় করে অভিষেককে রাজনৈতিক মঞ্চ দিয়ে যাবেন। প্রকাশ্যে অভিষেকের নেতৃত্ব মেনে নিলেও, পার্থ বা সুব্রত কেউই তৃণমূলের নেতৃত্ব পুরোপুরি অভিষেককে ছেড়ে দিতে রাজি ছিলেন না। দলেরই অন্য এক সাংসদ কল্যাণ বন্দ্যোপাধ্যায় তো ক্যামেরার সামনেই অভিষেকের নেতৃত্ব মানতে অস্বীকার করেছিলেন।

আরো পড়ুন অভিষেকের নব তৃণমূলে মমতার জোয়ার কই?

এতদিনে সবাই জানেন পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের কী হাল হয়েছে। কল্যাণও পথে এসে গেছেন। অভিষেকের চাপে মুকুল রায় ও শুভেন্দু অধিকারী তো দলই ছেড়ে দিয়েছেন। কয়েকমাস আগে সুব্রতও বুঝে গেছেন তাঁর কী অবস্থা। ব্যারাকপুরে অর্জুন সিং ও সোমনাথ শ্যামের দ্বন্দ্ব মেটাতে গিয়ে দেখেছেন সোমনাথ শ্যাম তাঁকে পাত্তাই দেননি। আসেননি তাঁর ডাকা বৈঠকে। কারণ সোমনাথের খুঁটি নাকি বাঁধা রয়েছে ক্যামাক স্ট্রিটে। সৌগত রায়কে নিয়েও জলঘোলা কম হয়নি। তাঁর নির্বাচনে দাঁড়ানো উচিত কিনা তা নিয়ে বিতর্ক তৈরি করা হয়েছে। প্রকাশ্যে তাতে নেতৃত্ব দিয়েছেন কুণাল ঘোষই। এবার নবীন-প্রবীণের লড়াইয়ে চাঁদমারি সুদীপ।

এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে সুদীপ মমতাকে প্রচুর জ্বালিয়েছেন। তৃণমূল নেত্রীকে এড়িয়ে বিজেপি নেতা লালকৃষ্ণ আদবানির পায়ে পড়ে গিয়েছিলেন বাজপেয়ী মন্ত্রিসভায় মন্ত্রী হওয়ার জন্য। মমতাকে গালাগাল করে তৃণমূল ছেড়ে কংগ্রেসে গিয়ে ২০০৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। যদিও সেবার তিনি সিপিএমের সুধাংশু শীলের কাছে হেরে গিয়েছিলেন। কিন্তু ২০০৬ সালে কংগ্রেসের টিকিটে বউবাজার থেকে বিধানসভায় গিয়েছিলেন।

মমতা সত্যিই মমতাময়ী। যেভাবে তিনি কুণাল ঘোষকে তৃণমূলে মেনে নিয়েছেন, ঠিক সেভাবেই সুদীপকেও মেনে নিয়েছেন। ২০০৯ সালে তৃণমূলের টিকিটে লোকসভায় পাঠিয়েছেন। পরবর্তীকালে তাঁকে লোকসভায় তৃণমূলের দলনেতাও করেছেন। গুজব যে তিনিই মোদীকে অনুরোধ করে রোজভ্যালি কাণ্ডে গ্রেফতার হওয়া সুদীপের জামিনের বন্দোবস্ত করেছিলেন। তাহলে অভিষেক পরিচালিত এই নবীন-প্রবীণ দ্বন্দ্বে মমতার অবস্থান ঠিক কী?

অনেকেই এটাকে পিসি-ভাইপোর ঝগড়া হিসাবে দেখতে ভালবাসেন। কিন্তু এটা বোধহয় বুঝে নেওয়া ভাল যে, এই ঝগড়ার অস্তিত্ব শুধুমাত্র মিডিয়ার চোখেই। এটা ঠিক যে, সৌগতর নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা নিয়ে মমতা তাঁর পক্ষেই কথা বলেছেন প্রকাশ্য সভায়। বয়সকে শুধুমাত্র একটা সংখ্যা বলেছেন। সেই ২০১৬ সালেও নিজের মন্ত্রিসভায় নিজের পছন্দের লোকজনকে রেখেছিলেন। কলকাতা কর্পোরেশনে অভিষেকের আপত্তি সত্ত্বেও নিজের পছন্দের প্রার্থী তালিকা প্রকাশ করিয়েছিলেন এবং নির্বাচনের শেষে ববি হাকিমকেই মেয়র করেছেন। কিন্তু এখন পর্যন্ত না কুণালের বিরুদ্ধে, না অভিষেকের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নিয়েছেন। ব্যবস্থা নেওয়া তো দূরে থাক, এখন পর্যন্ত এই ‘যুব’ নেতাদের বকে দিয়ে কোনো বিবৃতি পর্যন্ত দেননি। কোনোরকম পদক্ষেপ না নিয়ে তিনি বুঝিয়ে দিয়েছেন যে লাটাইয়ের সুতো ছাড়তে মানা করছেন না কাউকে। তিনি বলছেন বটে দলের প্রবীণ বা পুরনো নেতারা গুরুত্বপূর্ণ, কিন্তু অভিষেককেও চুপ করতে বলছেন না। কিছু না করেই সবাইকে বুঝিয়ে দিয়েছেন দলে অভিষেকের গুরুত্ব কতটা।

মমতা আর অভিষেকের দল চালানোর পদ্ধতি সম্পূর্ণ আলাদা। মমতা জানেন তৃণমূল কোনো রেজিমেন্টেড পার্টি নয়। দলটা চলে মমতা-আবেগে ভরসা করে। এখনই পুরনো ও প্রবীণ নেতাদের সরিয়ে দিয়ে পুরো দল অভিষেকের হাতে তুলে দিতে গেলে বিপদ। বিশেষত সামনে লোকসভা নির্বাচন। এখনই কোনো বৈপ্লবিক সিদ্ধান্ত দলের ক্ষতি করবে। কিন্তু দলের ভিতরে হালকা বিপ্লব চলতে দিতে তাঁর নিশ্চয়ই আপত্তি নেই। নচেৎ তিনি কুণালদের এক ধমকে থামিয়ে দিতেন।

মমতা অনেক বেশি ক্ষমাশীল। অভিষেক একদমই তা নন। তাই মমতার দলে সুদীপরা এখনো জায়গা পান। কুণালও পান। অভিষেক মনে করেন বুড়ো নেতারা দলের বোঝা। এদের হঠিয়ে নতুনদের সামনে আনা দরকার এখনই। মমতা এতটা নির্দয় হতে পারছেন না।

তবে সময় ও পরিস্থিতি বুঝে অনেক নেতার মাথার উপর থেকেই মমতার বরাভয় সরে গেছে। সে সারদা কাণ্ডে মদন মিত্রের গ্রেফতার হওয়ার সময়েই হোক বা পার্থ চট্টোপাধ্যায়ের গ্রেফতার (যে পরিমাণ টাকা লোকসমক্ষে এসেছিল, তাতে কিছু করারও ছিল না মমতার) বা বীরভূমের অনুব্রত মণ্ডলের গ্রেফতার। দীর্ঘদিনের সঙ্গী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিককে নিয়ে ইডির তল্লাশি চলার সময়ে সাংবাদিক সম্মেলন করলেও, গ্রেফতার হওয়ার পর আর কোনো উচ্চবাচ্য করেননি মমতা।

কাজেই তৃণমূলের আভ্যন্তরীণ নাটকে কুশীলব হয়ে কুণাল লড়ে যাচ্ছেন নিজের মত করে। কারণ তিনিও নিশ্চয়ই জানেন, মমতার মত অভিষেক কোনোদিন ক্ষমাশীল হবেন না। আপাতত অভিষেকের কাজে লাগছেন কুণাল। কাজ ফুরিয়ে গেলে তাঁর কী হাল হবে তাও নিশ্চয় অজানা নয় কুণালের।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.