গত কয়েকদিন ধরে সংবাদমাধ্যমে জায়গা করে নিয়েছে বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়। একদিকে আরএসএস-বিজেপির মদতপুষ্ট উপাচার্য এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসন। অন্যদিকে বিশ্বভারতীর আপামর ছাত্রছাত্রীরা। এক অসম লড়াই চলছে বীরভূমের লালমাটিতে।
মোটের উপর ঘটনাক্রম সকলেরই জানা। উপাচার্য তথা বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের যাবতীয় অন্যায়ের বিরুদ্ধে বুকটান করে রুখে দাঁড়িয়েছিল ছাত্রছাত্রীরা। জবাবে তিনজন ছাত্রকে সাসপেন্ড করেছে কর্তৃপক্ষ।  তাদের হাতে হাত রেখে প্রতিস্পর্ধী ব্যারিকেড গড়েছে অন্য পড়ুয়ারা। অবিলম্বে ফিরিয়ে নিতে হবে সাসপেনশন, পদত্যাগ করতে হবে সংঘ পরিবারের মদতপুষ্ট বিদ্যুৎ চক্রবর্তীকে– এই দাবিতে চলছে লড়াই। ঘেরাও হয়ে আছেন উপাচার্য। তাঁর বাসভবনের গেটে ঝুলছে ‘নো পাসারান’ লেখা ব্যানার।
কিন্তু আসল লড়াইটা বোধহয় আরো অনেকখানি বড়।
বিজেপি সরকারের ৭ বছরে একটার পর একটা চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে ছাত্রছাত্রীরা। কখনও জেএনইউ, কখনও দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়, কখনও রোহিত ভেমূলার এইচসিইউ, কখনও যাদবপুর বা এলাহাবাদ বিশ্ববিদ্যালয়। ছাত্রছাত্রীদের বিক্ষোভে বার বার কেঁপে উঠেছে প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর প্রশাসন। সেই তালিকায় নতুন নাম বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সাধের বিশ্বভারতী শতবর্ষের দোরগোড়ায় পৌঁছে গিয়েছে৷ এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে আমাদের দেশ স্বাধীনতা লাভ করেছে, আবার স্বাধীন ভারতবর্ষে গত সাত-আট দশকে নানা রাজনৈতিক সামাজিক পট-পরিবর্তনের ঘটনা ঘটেছে৷ তারই মধ্যে নানা প্রতিবন্ধকতাকে অতিক্রম করে বিশ্বভারতী তার নিজস্ব ঐতিহ্য, গরিমাকে ধরে রাখতে পেরেছিল৷ কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে বিশ্বভারতীকে কেন্দ্র করে যে ঘটনাগুলো সামনে আসছে তা এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সাংস্কৃতিক গরিমাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিয়েছে৷ যে কারণে বিচলিত এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষকদের একাংশ, আশ্রমিক থেকে শুরু করে প্রগতিশীল সমাজ৷ প্রতিটি কথায় ‘হ্যাঁ’ বলতে না চাওয়া বিশ্বভারতীর প্রশাসকের আগ্রাসন নেমে আসছে প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রী ও শিক্ষকদের উপর৷ স্বাভাবিক ভাবেই পাল্টস আওয়াজ উঠেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্য মাননীয় বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর অপসারণের৷
ঠিক কী কারণে ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে প্রগতিশীল সমাজ মনে করছেন উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর অপসারণ না করলে বিশ্বভারতীর আপন ঐতিহ্য কে রক্ষা করা যাবে না? ২০০৭ সালে দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক থাকাকালীন যৌন হেনস্থার অভিযোগ উঠেছিল যাঁর বিরুদ্ধে (যা পরবর্তীতে আপেক্স কমিটির তদন্তে সত্যতা প্রমাণিত হয়), সেই বিদ্যুৎবাবুকে কেন্দ্রের বিজেপি সরকার জেএনইউ-এর মত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের এক্সিকিউটিভ কাউন্সিলের সদস্য করতে সচেষ্ট হয়েছিল। পরবর্তীতে বিশ্বভারতীর মতো একটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এই রকম একজন অভিযুক্তকে উপাচার্য পদে মনোনিত করা হয়। ফলে অসন্তোষের শুরুটা অনেক দিন আগেই হয়েছিল।
আসলে রাষ্ট্র চায় প্রশ্নহীন অন্ধ আনুগত্য৷ রাষ্ট্রের বর্তমান কর্তাদের বিশ্বভারতীর মতো প্রগতিশীল মুক্তমনা ক্যাম্পাসে অন্ধ আনুগত্যবাদের চাষ করার প্রয়োজনে উপযুক্ত ভরসার ব্যাক্তি হলেন এই বিদ্যুৎবাবু৷ ২০১৮ সালের নভেম্বর মাসে উপাচার্য হিসেবে বিদ্যুৎ চক্রবর্তী দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে রাষ্ট্র এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে গেরুয়াকরণ করার নীল নকশা তৈরি করে তাঁর মাধ্যমে৷ গত দেড় বছর ধরে করোনা পরিস্থিতির কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার সুযোগে এই কাজে আরও গতি পেয়েছে। সাম্প্রতিক ঘটনাক্রম লক্ষ্য করলেই তা বোঝা যায়৷ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপকদের উপর নজরদারির দেওয়াল তুলতে ২০২০ সালের জুলাই মাসে উপাচার্যের দিক থেকে নানা বিধিনিষেধের মৌখিক নির্দেশ দেওয়া হয়৷ শিক্ষকদের একাংশের প্রবল প্রতিবাদে উপচার্য এই বিধিনিষেধ বাস্তবায়িত করতে পারেননি ঠিকই, কিন্তু নজরদারির চেষ্টা বিবিধ অপকৌশল নানা ভাবে চালিয়ে গেছেন৷ কখনও ক্যাম্পাসে রবীন্দ্র সংস্কৃতির পরিপন্থী পাঁচিল তুলে দেওয়ার চেষ্টা, আবার কখনও প্রতিবাদী কন্ঠ দমন করতে ক্যাম্পাসের বিভিন্ন স্থানকে নো ডিস্টার্ব জোন ঘোষণা করা- আঘাত নেমেছে একের পর এক৷ গত বছর জানুয়ারী মাসে যখন এন.আর.সি/সি.এ.এ এর বিরুদ্ধে গোটা দেশ প্রতিবাদ আন্দোলনে উত্তাল, ঠিক সেই সময় স্বপন দাশগুপ্তর মত একজন রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বকে নিয়ে এসে এই উপাচার্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসে এন.আর.সি/সি.এ.এ এর পক্ষে প্রচার করতে সেমিনারের আয়োজন করেন৷ এমনকি নীতি আয়োগের যুগ্ম অধিকর্তাকে দিয়ে সর্বশেষ পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভা নির্বাচনে “বিজেপির পরাজয়ের কারণ কি?” – এই শীর্ষক একটি আলোচনার আয়োজন করেন। যেটি আবার বিশ্বভারতীর অফিসিয়াল ওয়েবসাইটে ফলাও করে প্রচার করেন৷ যদিও তীব্র প্রতিবাদের মুখে এই আলোচনার আয়োজন তাঁকে বাতিল করতে হয়েছিল পরবর্তীতে৷
 এই ঘটনাগুলি প্রমান করে আসলে বিদ্যুৎবাবুকে উপাচার্য হিসেবে নিয়োগ করা হয়েছে বিশ্বভারতীর গেরুয়াকরণের পথকে প্রশস্ত করতে৷ তিনি বিজেপির কর্মী ছাড়া আর কিছু নন। গেরুয়াকরণের বিরুদ্ধে যখনই যাঁরা রুখে দাঁড়িয়েছেন, উপাচার্য তখনই তাঁদের বিরুদ্ধে সক্রিয় হয়েছেন। কখনো নিরাপত্তারক্ষী দিয়ে হেনস্তা করা,  কখনো আবার সরাসরি শাস্তির খাঁড়া নামিয়ে আনা৷ সম্প্রতি যার শিকার হয়েছেন বিশ্বভারতীর অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক সুদীপ্ত ভট্টাচার্য, তিন ছাত্র ফাল্গুনী, সোমনাথ ও রূপা।
ফাল্গুনীদের অপরাধ কী? কীসের জন্য এই তিন ছাত্র-ছাত্রী উপাচার্য কর্তৃক তিন বছরের জন্য সাসপেন্ড হয়েছে? স্পষ্ট জবাব নেই।লকডাউনের সুযোগকে কাজে লাগিয়ে কেন্দ্রের সরকার যেমন ছাত্র স্বার্থ বিরোধী নয়া জাতীয় শিক্ষানীতি প্রয়োগ করার চেষ্টা করতে উদ্যোগী হয়েছে, তেমনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান গুলি লাগাম ছাড়া ফি বাড়িয়ে নিয়েছে৷ সরকারি নজরদারির বালাই তো নেই বটেই, বরং বলা যায় সরকারি মদতেই চলছে এই কাজ। সম্প্রতি দেখা যায় বিশ্বভারতীর ভারতীয় ছাত্র-ছাত্রীদের ফি দ্বিগুণ, সার্ক অর্ন্তগত দেশগুলির ছাত্র-ছাত্রীদের ফি পাঁচ গুণ এবং অন্যান্য দেশগুলির ছাত্র-ছাত্রীদের ফি দশগুণ বৃদ্ধি করা হয়েছে৷ এই ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে ক্যাম্পাসের ছাত্র-ছাত্রীরা সোচ্চার হয়। গত ৯ই জানুয়ারী তারা উপাচার্যর সাথে কথা বলতে যায়৷ কিন্তু উপাচার্য তাদের সাথে কোনো কথা না বলে নিরাপত্তারক্ষীদের দিয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের মারধর করেন৷ ফি্ বৃদ্ধি বিরোধী আন্দোলনরত ছাত্র-ছাত্রীদের বিরুদ্ধে উপাচার্য বিশ্বভারতীর সম্মান হরণের, শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগ আনেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তৈরি হয় তদন্ত কমিটি। এই কমিটি ১৪ই জানুয়ারি ফি বৃদ্ধির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়া তিন ছাত্র ফাল্গুনী, সোমনাথ ও রূপাকে তিন মাসের জন্য সাসপেন্ড করে৷ পরে তা পর্যায়ক্রমে তিন মাস থেকে বাড়িয়ে ছয় মাস, এবং তারপর আরো বাড়িয়ে নয় মাস করে৷ এই নয় মাসের সময়সীমার মধ্যে গত ২৩ শে আগষ্ট কর্তৃপক্ষ এই তিন ছাত্র-ছাত্রীকে তিন বছরের জন্য সাসপেন্ড করে৷ স্বাভাবিক ভাবেই উপাচার্য তথা বিশ্বভারতী কর্তৃপক্ষের অগণতান্ত্রিক স্বৈরাচারী পদক্ষেপের বিরুদ্ধে সাধারণ ছাত্র-ছাত্রী থেকে শুরু করে সমগ্র প্রগতিশীল ছাত্র, শিক্ষক, আশ্রমিক, শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষ প্রতিবাদে সোচ্চার হচ্ছেন। উপাচার্য বিদ্যুৎ চক্রবর্তীর একনায়কতন্ত্র, স্বেচ্ছাচারের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে  তুলছেন তাঁরা৷
বিদ্যুতবাবু তথা বিশ্বভারতীতে সক্রিয় আরএসএস চক্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে গিয়ে ছাত্রছাত্রীদের অকল্পনীয় বাধার মোকাবিলা করতে হচ্ছে। কোনোভাবেই যখন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করা যাচ্ছে না, তখন ছাত্রছাত্রীরা বাধ্য হন উপাচার্যকে ঘেরাও করার পথে যেতে। সেই সময় সরাসরি উপাচার্যের নির্দেশে পুরুষ নিরাপত্তারক্ষীরা ছাত্রীদের হেনস্থা করে বলে অভিযোগ। এই নিয়ে ইতিমধ্যেই দায়ের হয়েছে শ্লীলতাহানির মামলা। ছাত্রীরা জানিয়েছেন, স্বয়ং উপাচার্য নির্দেশ দেন, কোনো মহিলা নিরাপত্তারক্ষী নয়, কেবলমাত্র পুরুষ নিরাপত্তারক্ষীরাই যেন ছাত্রীদের মোকাবিলা করেন! শুধু তাই নয়, চক্রান্ত শুরু হয়েছে অনির্দিষ্টকালের জন্য বিশ্বভারতী বন্ধ করার। সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারক বডিতে এই মর্মে প্রস্তাব পাশ করিয়ে দেখানোর চেষ্টা করা হচ্ছে যে, ক্যাম্পাসে অচলাবস্থা চলছে। অবশ্য যে উপাচার্যকে গদগদমুখে অমিত শাহের মতো গণহত্যাকারীর সঙ্গে পোজ দিয়ে ছবি তুলতে দেখা যায়, তাঁর পক্ষে এটাই স্বাভাবিক।
আসলে বিশ্বভারতীতে যা ঘটে চলেছে তা কোনও বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়৷ গোটা দেশ জুড়ে শাসকের প্রতিটি পদক্ষেপে লক্ষ্য করা যাচ্ছে ফ্যাসিবাদের পদধ্বনি৷ বিশ্বের ইতিহাসে নানা ঘটনাক্রম পর্যালোচনা করলে আমরা দেখতে পাবো ফ্যাসিবাদের প্রথম এবং প্রধান আক্রমণের লক্ষ্য হয়ে উঠেছে মুক্ত চিন্তার পরিসরগুলো৷ ওরা মানুষের মগজের দখল নিয়ে সকলকে ওদের নিজস্ব ছাঁচে ফেলতে চায়৷ যার সাথে রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টি বিশ্বভারতী কখনও আপোস করতে পারে না৷ বিশ্বভারতী আপোস করেনি, লড়ে যাচ্ছে। ফাল্গুনি, সোমনাথ, রূপাদের অজস্র সহযোদ্ধারা লড়ছে৷ ঠিক যেমন কখনও আপোষ করেনি আরাবল্লীর কোলে বেড়ে ওঠা জেএনইউ থেকে শুরু করে বাংলার যাদবপুর প্রেসিডেন্সি সহ অজস্র শিক্ষা প্রতিষ্ঠান৷ তাই বিজেপি সরকার এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর উপর নামিয়ে আনছে রাষ্ট্রীয় আগ্রাসন। প্রশ্ন করলেই, প্রতিবাদ করলেই ‘দেশদ্রোহী’ বলে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ছাত্রছাত্রীদের। আসলে ফ্যাসিবাদ চায় না নাগরিকরা সুশিক্ষিত হোক, প্রশ্ন করুক ব্যবস্থাটাকে। তাই আজ লড়াইটা শুধু তিন ছাত্রের সাশপেনশন প্রত্যাহার বা উপাচার্যের অপসারণের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়৷ লড়তে হবে সামগ্রিক ভাবে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে৷ ফ্যাসিবাদীদের সমূলে উৎখাত করতে হবে কবিগুরুর দেশ থেকে৷ তা নাহলে আমাদের আরও অনেক গৌরী লঙ্কেশ, রোহিত ভেমুলা থেকে আফরাজুল, আখলাকদের হারাতে হবে৷
এই লড়াইটা অনেক বড়৷ অনেক মানুষকে নিয়ে লড়াই। বামপন্থীদের দায় এর নিউক্লিয়াস হয়ে ওঠা। আমাদের মাঠ দিন দিন ছোট হয়ে যাচ্ছে। তা হতে দেওয়া যাবে না। মাঠটাকে আরো বড় করা দরকার। অনেক অনেক বড় করতে হবে মাঠ।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.