কসবায় হিন্দু মহাসভার দুর্গাপুজোয় অসুরের মূর্তি তৈরি করা হয়েছে মোহনদাস করমচাঁদ গান্ধীর আদলে। সপ্তমীর সকাল পর্যন্ত সেই মূর্তিই বহাল ছিল, তারপর নানা মহলের চাপে অসুরের মুখে দাড়িগোঁফ লাগিয়ে তার রূপ বদলানো হয়েছে।
এতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই। উক্ত সংগঠন কোনোদিনই তাদের নাথুরাম গডসে-যোগ বা তাঁর প্রতি ভক্তি এবং গান্ধীর প্রতি ঘৃণাকে আড়াল করেনি। আশ্চর্য হল ওই অঞ্চলের মানুষ এবং বাংলার সাধারণ মানুষের মুখ বুজে থাকা। খবরটা সোশাল মিডিয়ায় আসার আগে অব্দি প্রতিবাদ জানায়নি কেউ।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
বাঙালির এই নীরবতার অবশ্য একটা অর্থ হতেও পারে। ছোটবেলা থেকেই আমরা শিখে এসেছি, গান্ধী নিজের ক্ষমতা ধরে রাখতে, ব্যক্তিগত স্বার্থসিদ্ধির জন্য সুভাষচন্দ্রকে কংগ্রেস থেকে বহিষ্কার করেছিলেন। একা সুভাষচন্দ্রই নন, তিনি নাকি বাংলার কোনো বিপ্লবীকেই শ্রদ্ধা করতেন না। ফলে এক শ্রেণির বাঙালি ভাবতেও পারে – বেশ হয়েছে। অন্যদিকে গান্ধী অনেক ব্যাপারেই দক্ষিণপন্থী। ফলে এক শ্রেণির বামপন্থী এই ঘটনায় নেহাত অখুশি না-ও হতে পারেন।
নিরপেক্ষভাবে ভেবে দেখতে গেলে গান্ধীকে বিরাট পরমতসহিষ্ণু বলা যায় না। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের বাড়িতে একবার তিনি শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ও সুভাষচন্দ্রের উপস্থিতিতে বাংলার সশস্ত্র বিপ্লবীদের “দেশের শত্রু” বলে অভিহিত করেছিলেন। শরৎচন্দ্র অবশ্য তাঁর এই অন্যায় মন্তব্যের কড়া প্রত্যুত্তর দেন (সূত্র: শরৎচন্দ্র জীবন ও সাধনা; সারা বাংলা ১২৫তম শরৎচন্দ্র জন্মবার্ষিকী কমিটি)। ভগৎ সিং প্রসঙ্গে তাঁর মনোভাব ছিল “ভগৎ সিং-পূজা দেশের অপরিমেয় ক্ষতি করছে এবং করেই চলেছে” (সূত্র: ওরা আকাশে জাগাত ঝড়; শৈলেশ দে)। আর সুভাষচন্দ্র বসুর ত্রিপুরী কংগ্রেসে সভাপতি পদে নির্বাচন, তাঁর পদত্যাগ এবং কংগ্রেস ত্যাগ পর্বে গান্ধী যে আচরণ করেছিলেন, তা নিন্দনীয়। ব্রিটিশ ঐতিহাসিক মাইকেল এডওয়ার্ডসের বিখ্যাত উক্তিটি স্মরণে রাখা যায়, “গান্ধী তাঁর অসহযোগ অস্ত্রটি এই সময় ব্রিটিশের বিরুদ্ধে নয়, কংগ্রেসের সভাপতির বিরুদ্ধে প্রয়োগ করেছিলেন”।
কিন্তু গান্ধীর এই অসহিষ্ণুতা কি কেবল ক্ষমতার লোভে, ব্যক্তিগত আক্রোশের বশে, যেমনটা আমরা ছোট থেকে জেনে আসছি? স্বয়ং সুভাষচন্দ্র কিন্তু এর অন্যরকম ব্যাখ্যা দিয়ে বলেছিলেন, “বাস্তবে পার্টির অভ্যন্তরের এই সংগ্রামের পিছনে রয়েছে শ্রেণিসংগ্রাম (ক্রসরোডস)।” প্রকৃতপক্ষে, নিজের জ্ঞাতসারে কিংবা অজ্ঞাতসারে গান্ধী ভারতের নব্যোত্থিত বুর্জোয়া পুঁজিপতি শ্রেণিরই স্বার্থরক্ষা করতেন। তাঁর সোশালিজম অফ মাই কনসেপশন বইটি পড়লে একথা পরিষ্কার হয়। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় ‘বর্তমান রাজনৈতিক প্রসঙ্গ’ প্রবন্ধে গান্ধী সম্পর্কে লিখেছিলেন “তাঁর আসল ভয় সোশিয়েলিজমকে। তাঁকে ঘিরে রয়েছেন ধনিকরা, ব্যবসায়ীরা। সমাজতান্ত্রিকদের তিনি গ্রহণ করবেন কি করে? এইখানে মহাত্মার দুর্বলতা অস্বীকার করা চলে না।” (বানান অপরিবর্তিত)
অন্যদিকে, পাঞ্জাব ও বাংলার বিপ্লবী নেতারা ছিলেন পেটি-বুর্জোয়া অ্যানার্কিজমের প্রতিনিধি, যারা পুঁজিবাদের বিরোধী। সুভাষচন্দ্র বা ভগৎ সিংয়ের মতো কয়েকজন নেতা আবার তার থেকে এক ধাপ এগিয়ে সমাজবাদকে সমর্থন করেন। এই আদর্শগত পার্থক্য ও শ্রেণিস্বার্থের সংঘাতই গান্ধীকে এই নেতাদের বিরুদ্ধে প্ররোচিত করেছে। ব্যক্তিগত লাভ-ক্ষতির আলোচনা এখানে না আনাই উচিত, আদর্শগত ব্যবধানই প্রধান।
কিন্তু সবথেকে বড় কথা হল, হিন্দু মহাসভা ও তার সমমনস্করা কিন্তু গান্ধীর বিরোধী তাঁর এই অসহিষ্ণুতা বা ধনিক শ্রেণির প্রতি সমর্থনের জন্য নয়। এই গান্ধীকে তাঁরা আদৌ ভয় করেন না। তাঁদের ভয় সেই গান্ধীকে, যিনি গেয়ে ওঠেন, “ঈশ্বর আল্লা তেরো নাম/সবকো সম্মতি দে ভগবান”। যখন জাতীয় নেতারা ঠাণ্ডা ঘরে বসে দেশের ভাগাভাগিতে ব্যস্ত, তখন ভারতের এক কোণ থেকে আর এক কোণে দাঙ্গাবিধ্বস্ত জায়গাগুলোতে ছুটে ছুটে যাচ্ছিলেন যে গান্ধী, সেই অসাম্প্রদায়িক গান্ধীকে ভয় পায় এরা। গান্ধীকে এরা ঘৃণা করে, কারণ তিনি ‘প্রো-মুসলিম’। ঠিক এই কারণেই নাথুরাম তাঁকে হত্যা করেছিল। সংবাদমাধ্যমকে সাক্ষাৎকার দিতে গিয়ে আজ অসুরের মূর্তি গান্ধীর আদলে গড়ার পিছনে একই কারণের দিকে ইঙ্গিত করেছেন উদ্যোক্তারা।
আরো পড়ুন বুলবুলির সওয়ার সাভারকর ও আরএসএস ইতিহাস
প্রশ্ন উঠতে পারে, গান্ধীকে যে কারণে এদের ভয়, সেই কারণে স্পষ্ট বামপন্থী ও ধর্মনিরপেক্ষ নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু ও ভগৎ সিংকে ভয় করে না কেন? গান্ধীর বিপরীতে হিন্দু মহাসভা কেন এঁদের তুলে ধরতে চায়? এর কারণ, এরা আদৌ নেতাজি বা ভগৎ সিংয়ের আসল রূপকে তুলে ধরে না। এই দুজনকে হিন্দুত্ববাদী নেতা হিসাবে তুলে ধরাই এদের উদ্দেশ্য।
প্রশ্ন উঠতে পারে, “সন্ন্যাসী ও সন্ন্যাসিনীদিগকে ত্রিশূল হাতে হিন্দু মহাসভা ভোট ভিক্ষায় পাঠাইয়াছে।…ধর্মের সুযোগ নিয়া ধর্মকে কলুষিত করিয়া হিন্দু মহাসভা রাজনীতি ক্ষেত্রে দেখা দিয়াছে। হিন্দুমাত্রেরই এর নিন্দা করা কর্তব্য” (১৪মে, ১৯৪০, আনন্দবাজার পত্রিকায় প্রকাশিত) – এই কথা বলা সুভাষ এবং স্বঘোষিত নাস্তিক ভগৎ সিংকে হিন্দুত্ববাদী হিসেবে ‘প্রোজেক্ট’ করা কি এতই সোজা? উত্তরে বলতে হয়, হ্যাঁ, সোজা। স্বাধীনতার পর থেকে রাজনৈতিক দলগুলো এই নেতাদের আদর্শ ও রচনার সঙ্গে দেশের মানুষকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করেনি। তাই বাংলার বাইরে নেতাজি এবং পাঞ্জাবের বাইরে ভগৎ সিংকে ইচ্ছামত তুলে ধরা এমন কিছু কঠিন নয়। আর দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তো ইতিহাস বদলানোর লাইসেন্স দিয়েই রেখেছেন।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।