অর্ক মুখার্জি
এবারের বাজেটে আমাদের মাননীয়া অর্থমন্ত্রী নির্মলা সীতারামণ জানিয়েছেন প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণীর ছাত্রছাত্রীদের জন্য দুশো টিভি চ্যানেল চালু করা হবে । তিনি বলেছেন “ওয়ান ক্লাস – ওয়ান টিভি চ্যানেল”।
অতিমারীর দু বছরে মারাত্মক বেড়েছে স্কুলছুটদের সংখ্যা। কেন্দ্রীয় শিক্ষামন্ত্রী ধর্মেন্দ্র প্রধান সংসদে জানিয়েছিলেন এই দু বছরে গোটা দেশে প্রায় ১৫ কোটি ছেলেমেয়ে মাঝপথে লেখাপড়া ছেড়ে দিয়েছে। সরকারী হিসাব যদি ১৫ কোটি হয়, বোঝাই যাচ্ছে সংখ্যাটা আসল আরও বেশি। প্রথম প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা এবং অর্থনৈতিকভাবে পিছিয়ে পড়া পরিবার থেকে উঠে আসা ছাত্রছাত্রীরা ‘নিউ নর্মালে’ প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যালয় থেকে বিছিন্নতার কারণে হতাশ এবং হতোদ্যম হয়ে পড়ে পড়া ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। বাজেটে কিন্তু এই মাঝপথে ছেড়ে যাওয়া ছেলেমেয়েদের আবার শিক্ষার সঙ্গে যুক্ত করার জন্য কী পদক্ষেপ নেওয়া হবে এবং তার জন্য বরাদ্দ কত, সেসব বলা হয়নি।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
টিভির মাধ্যমে শিক্ষাদানের ব্যবস্থায় ওইসব ছাত্রছাত্রী আদৌ উৎসাহিত হবে কিনা বলা মুশকিল। টিভির মাধ্যমে শিক্ষার সঙ্গে কিছু অলিখিত ব্যাপার জড়িয়ে আছে, যেগুলো কেন্দ্রীয় সরকার ইচ্ছে করেই এড়িয়ে গেছে। প্রথমত, টিভি কেনা এক ধরনের বিনিয়োগ। যদি প্রান্তিক বা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণীর মানুষের কথা ভাবা যায়, তাঁরা মুখ থেকে কথা পড়ার সঙ্গে সঙ্গে টিভি জোগাড় করে ফেলতে পারেন না। মধ্যবিত্ত শ্রেণির বাড়িতে টিভি থাকা খুব স্বাভাবিক ব্যাপার। কিন্তু অতিমারীর ফলে যারা স্কুলছুট হয়েছে, তাদের কাছে কি ব্যাপারটা তত সহজ? বাড়িতে টিভি সেট থাকলেই তো হল না। ‘কানেকশন’ চাই। টিভি তো আর আলাদিনের আশ্চর্য প্রদীপ নয়, যে চালালেই ছবি আসবে। কেবল কানেকশন বা ডিটিএইচ কানেকশন থাকা দরকার। অর্থাৎ আরও বিনিয়োগ। এরপর আছে মাসিক খরচ। সেখানেই শেষ নয়। বিদ্যুৎ সংযোগেরও দরকার আছে এবং টিভি বেশি দেখলে বিদ্যুৎ খরচ বেশি পড়বে। ছোটবেলায় সারস ও শেয়ালের গল্প পড়েছিলাম। শেয়াল সারসকে নেমন্তন্ন করেছিল, কিন্তু এমন পাত্রে খেতে দিয়েছিল যে সারসের পক্ষে খাওয়া সম্ভব হয়নি। টিভিতে শিক্ষা অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল শ্রেণির জন্য শেয়ালের নেমন্তন্নের মত। সরকার কি একথা বোঝে না? তাহলে কেন টিভিতে শিক্ষার কথা বলা হল?
প্রথমত, শিক্ষার পাশাপাশি সরকারের কাজের বিজ্ঞাপন ও প্রচারের এক আদর্শ মাধ্যম হয়ে উঠতে পারে এই টিভি চ্যানেলগুলো। অর্থাৎ সূক্ষ্মভাবে সরকারী প্রকল্পের প্রচার চালানো যাবে। আর একটি বড় কারণ, আগামীদিনে শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নষ্ট করে দেওয়ার চেষ্টা। ইতিমধ্যেই বাজার দখল করছে বিভিন্ন লার্নিং অ্যাপ এবং অনলাইন কোর্স। তবে এগুলো এখনো উচ্চবিত্ত, মধ্যবিত্তদের মধ্যেই সীমাবদ্ধ আছে। নিম্ন মধ্যবিত্ত বা দরিদ্ররা এখনো শিক্ষার প্রাতিষ্ঠানিক রূপেই বিশ্বাসী এবং সন্তানের জন্য তার উপরেই ভরসা করেন। তাঁদের এই মানসিকতা বদলানোর জন্য, ডিজিটাল শিক্ষায় আগ্রহী করে তোলার জন্যেই হয়ত এই ব্যবস্থা।
অর্থাৎ বেসরকারি ডিজিটাল বাজার যাতে আরও ক্রেতা পায়। ভারতে যে কোনো জিনিসের সবচেয়ে বড় ক্রেতা হল মধ্যবিত্ত ও নিম্ন মধ্যবিত্ত শ্রেণির মানুষ। ভারত সঞ্চার নিগম লিমিটেড মানুষকে মোবাইলে অভ্যস্ত করেছিল। তারপর সেই সরকারি সংস্থাকে ধীরে ধীরে অকেজো করে দিয়ে বিভিন্ন বেসরকারি টেলিকম সংস্থাকে সরকার বাজার ছেড়ে দিল, আমাদেরও বাধ্য হয়ে সেই কোম্পানিগুলোর গ্রাহক হতে হল। একইভাবে প্রথম শ্রেণি থেকে টিভির মাধ্যমে শিক্ষা দিয়ে ‘নিউ নর্মাল’ শিক্ষাব্যবস্থার সঙ্গে পরিচয় ঘটানো হচ্ছে। তৈরি করা হচ্ছে বেসরকারি লার্নিং অ্যাপের সম্ভাব্য ক্রেতা।
বোঝানো হবে, ভাল মানের শিক্ষার সঙ্গে আপোষ না করার জন্যেই লার্নিং অ্যাপস। কিনুন, সাবস্ক্রাইব করুন আর সন্তানের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করুন। আর ১৪ বছর পর্যন্ত বিনামূল্যে শিক্ষার অধিকার চুলোয় যাক। আপনি প্রথম শ্রেণি থেকে টিভির ব্যবস্থা করছেন, কেবল কানেকশনের পিছনে খরচ করছেন, বিদ্যুৎ বিল মেটাচ্ছেন। বিনামূল্যে শিক্ষার দাবি ভুলেই যাবেন।
অর্থমন্ত্রী বলেছেন “ওয়ান ক্লাস, ওয়ান চ্যানেল” কিন্তু এটা আদতে এটা সাবস্ক্রাইবার তৈরি করার লক্ষ্যে একটি পদক্ষেপ।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।