সিঙ্গুর নামটাই যথেষ্ট। একটা গোটা পলেমিক্স এ নাম উচ্চারণে সহসাই অবয়ব নিয়ে ফেলে। তার সঙ্গে স্মৃতি। ছায়াছবির মত সব চোখের সামনে ঘটে যাবে অনেকের মনেই। সেদিনের বিরোধী নেত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় আজকের মুখ্যমন্ত্রী। এই যাত্রার সূত্রপাতও সিঙ্গুরেই ঘটেছিল। বছর পনেরো বাদে শিল্প না কৃষি, এই বিতর্কের পরিসমাপ্তি ঘটতে চলছে ভেড়ির সিদ্ধান্তে। মানে নেগেশন অফ নেগেশন! কৃষি ছিল থিসিস। শিল্প হল অ্যান্টি-থিসিস। ভেড়ি আসিল সিন্থেসিস হইয়া! ব্যাপারটা ভেবে দেখার মত বটে!
সিপিএমের তরুণ কমরেডরা সেদিন কোন ক্লাসে পড়তেন তার হিসাব করার প্রয়োজন নেই, কিন্তু তাঁরা বিষয়গুলো ভাল বুঝতে পারেন না। না বোঝাই স্বাভাবিক। বোঝাবার লোক কই? তাঁরা জানেন না, বিতর্কটা আসলে কারখানা নাকি চাষবাস, এই নিয়ে ছিলই না। ছিল অন্য অনেককিছু নিয়ে। প্রথমে বোঝা দরকার, টাটারা সিঙ্গুরে এই যে জমিটা পছন্দ করেছিল, এটা ছিল চার ফসলী। এই জমির উল্টোদিকেই হাইওয়ের অন্য পারের জমিটা যদি টাটারা নিত, তাহলে কৃষকদের আপত্তি ছিল না। কারণ সেই জমি ছিল অনুর্বর, চাষবাস ভাল হয় না। টাটাদের কারখানা চার ফসলী উর্বর জমিতেই কেন করতে হবে, তার কোনো গ্রহণযোগ্য ব্যাখ্যা টাটারা দিতে পারেননি। তাঁদের অস্ত্র ছিল জেদ। যা তাঁরা বলবেন তা-ই সবাইকে মানতে হবে। অন্যদিকে কৃষকদের যুক্তি ছিল পরিষ্কার। উর্বর জমি আমার ইচ্ছামত আমি পেতে পারি না, যা আছে তাকে রক্ষা করতে পারি। কারণ চাষবাস না হলে গোটা খাদ্যাবস্থাতেই বহু সমস্যা দেখা দেবে। কৃষক তো মরবেই, অকৃষকও মরবে। কৃষিবিজ্ঞানীরা সরকারকে বোঝাতে চেষ্টা করেছিলেন, মাটির টপ সয়েল, যার উপর নির্ভর করে চাষবাস হয়, তা তৈরি হতে বহু বছর সময় লাগে। সুতরাং, এই অমূল্য প্রাকৃতিক দান নষ্ট করবেন না। টাটাদের বলুন, উল্টোদিকের জমিটা নিতে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সরকারের যুক্তি কী ছিল? আদেখলা সরকার বারবার বোঝাচ্ছিলেন, যে যদি টাটাদের তাঁদের পছন্দমত জমি না দেওয়া হয় তাহলে তাঁরা অন্য রাজ্যে চলে যাবেন। সুতরাং, তাঁরা যা চাইছেন তা দিয়ে দেওয়াই একমাত্র রাস্তা। টাটা মোটর্সের তদানীন্তন ম্যানেজিং ডিরেক্টর রবিকান্ত পরিষ্কার জানিয়ে দিয়েছিলেন, তাঁদের পছন্দের জমির উল্টোদিকের যে জমি নেবার কথা উঠছে সেই জমিতে তাঁদের আগ্রহ নেই। কারণ, ঐ জমিতে ‘ব্ল্যাক সয়েল’ রয়েছে। তাতে কারখানা তৈরি করতে নাকি কয়েকটা দিন বেশি লেগে যাবে। একলাখি ন্যানো গাড়ি (তৎকালীন হিসাবে তিন হাজার ডলার) দিয়ে গোটা ইউরোপের বাজার ছেয়ে দেবার যে পরিকল্পনা তাঁরা করেছেন তা বানচাল হয়ে যাবে, কারণ ইতিমধ্যে অন্য প্রতিযোগীরা চলে আসবে। কর্পোরেটের এইসব বুকনিবাজি সবাই বোঝে। চিরকাল “কালচার ফালচার” করে আসা বুদ্ধবাবু বোঝেননি। তিনি কাঁটা হয়ে ছিলেন, টাটা চলে যাবে।
এখান থেকে বহু প্রশ্ন উঠে এসেছিল। কর্পোরেটের কাছে এভাবে নতি স্বীকার করে কি সত্যিই প্রকৃত শিল্পায়ন সম্ভব? নাকি এটা হয়ে দাঁড়াচ্ছে চূড়ান্ত আত্মসমর্পণ! শিল্পায়নের কি অন্য কোনো রাস্তা নেই? সিপিএম বোঝানোর চেষ্টা করছিল, এটাই প্রগতির পথ। কারখানা করতে চাইলে একমাত্র এভাবেই (পড়ুন কর্পোরেটের কাছে আত্মসমর্পণের পথে) এগোনো সম্ভব। অত্যুৎসাহী সিপিএম নেতারা এই রাস্তাকে প্রায় সামন্ততন্ত্রবিরোধী গণতান্ত্রিক বিপ্লব বলে কল্পনা করে নিচ্ছিলেন। গল্পকথা নয়, একেবারে লিখিত নোট দিয়ে এই দাবি করেছিলেন শিল্পমন্ত্রী নিরুপম সেন। বামফ্রন্টে তাঁর নোটের ১৬ নম্বর পয়েন্টে বলা হয়েছিল “বামপন্থী হিসাবে আমরা সকলেই জানি কৃষিতে সামন্ততান্ত্রিক আধা-সামন্ততান্ত্রিক ভূমি সম্পর্কের পরিবর্তনের অন্যতম লক্ষ্যই হল শিল্প বিকাশের অনুকূল পটভূমি সৃষ্টি করা। আধুনিক সমাজের ভিত্তিই হল শিল্প। ভূমি সংস্কারের সাফল্যকে ধরেই আমাদের রাজ্যে শিল্পায়নের যতটুকু সম্ভব অগ্রসর হবার প্রয়াস নিতে হবে।” (নবসাম্রাজ্যবাদ: কৃষি-শিল্প বিতর্ক; সম্পাদনা: ইমানুল হক-রন্তিদেব সেনগুপ্ত, ২০০৬) এভাবেই সিপিএম কর্পোরেটের নেতৃত্বে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে মৈত্রীর ভিত্তিতে সংস্কারের পথে সামন্ততান্ত্রিক এবং আধা-সামন্ততান্ত্রিক ভূমি সম্পর্ককে পরিবর্তনের নয়া তত্ত্বও আমদানি করার মত অবস্থায় পৌঁছে গিয়েছিল।
খুব স্বাভাবিকভাবেই এসব কাঁচা তত্ত্ব কেনার খদ্দের বাজারে ছিল না। কেউই মানেননি এসব। নকশালপন্থীরা তো নয়ই, এমনকি বামফ্রন্টের শরিকরাও মানেননি। আরএসপির পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির তদানীন্তন সম্পাদক কমরেড দেবব্রত বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেছিলেন “এ রাজ্যে investment friendly পরিবেশ থাকায় ইন্দোনেশিয়ার সালিম গোষ্ঠী, জাপানের মিৎসুবিসি সংস্থা ছাড়াও আরও ২১টি বাইরের দেশ এ রাজ্যের শিল্প উদ্যোগে অংশ নিচ্ছেন সরকারি ঘোষণায় জানা গিয়েছে। বাইরের মাল্টিন্যাশানাল সংস্থাগুলি এদেশে আসছে এখানকার সস্তা কাঁচামাল, সস্তা শ্রমকে কাজে লাগিয়ে বিপুল মুনাফা করতে। বাইরের MNC সংস্থাগুলি কোটি কোটি টাকা লুঠ করবে আর এ দেশের হাজার হাজার চাষি-মজুরের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার আঁধারে থাকবে তা আর যাই হোক বামপন্থার প্রতিফলন নয়। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার মালয়েশিয়া প্রমুখ দেশগুলির অভিজ্ঞতার কথা আমাদের মনে রাখতে হবে।” (প্রাগুক্ত)
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা যেতে পারে, বামফ্রন্টে আরএসপি জমি অধিগ্রহণের পদ্ধতি নিয়ে যে নির্দিষ্ট লিখিত প্রস্তাব পেশ করেছিল সেখানে তারা সুস্পষ্টভাবে বলেছিল “দুই বা তিন ফসলী জমি দেবার ক্ষেত্রে সম্পূর্ণভাবে জমির মালিকদের ইচ্ছার উপর নির্ভর করতে হবে।” (২/ঘ, ‘কৃষিজমি অধিগ্রহণ প্রসঙ্গে বামফ্রন্ট কমিটিতে আর.এস.পি-র প্রস্তাব’; প্রাগুক্ত)
রাজ্য বামফ্রন্টে সিপিআই জমি অধিগ্রহণ নিয়ে যে প্রস্তাব দিয়েছিল তাতে অভিযোগ করা হয় “পার্টির পক্ষ থেকে বার বার বলা হয়েছে ‘Land Use Board’ পুনর্গঠন করা হোক। এই ব্যাপারে সিপিএম-এর পক্ষ থেকে আমাদের সঙ্গে সহমতও পোষণ করা হয়েছিল। কিন্তু আজ পর্যন্ত তা কার্যকরী হয়নি।” (‘কোথায় কীভাবে শিল্প ও পরিকাঠামো গড়ে উঠবে ও তার পদ্ধতি কী হবে’/ বিন্দু ১)। উক্ত দলিলে বলা হয়েছিল “সরকারি বা বেসরকারি বন্ধ হয়ে যাওয়া কারখানার জমিতে শিল্প গড়ে ওঠা সম্ভব”। (বিন্দু ৩) “শিল্পের জন্য যেসব শিল্পপতিরা ইতিমধ্যেই যে সব জমি নিয়েছেন অথচ শিল্প গড়েননি সেসব জমি পুনর্দখল করা হোক।” (বিন্দু ৪) এবং “মূলত অনুর্বর ও অকৃষি জমিতে শিল্প গড়ে উঠবে। প্রয়োজনে কিছু একফসলা জমি শিল্পের জন্যে দেওয়া যেতে পারে”। (বিন্দু ১০)
সুতরাং দেখা যাচ্ছে, সিপিএম নেতৃবৃন্দ যেভাবে জমি অধিগ্রহণ করছিলেন তাতে প্রায় কারোরই সম্মতি ছিল না। বামফ্রন্টের বাইরে এবং ভেতরে অন্য কোনো বামপন্থী দল তাঁদের সাথে একমত ছিলেন না। প্রত্যেকের সাথে তাঁদের তীব্র বিরোধ বাধছিল। কিন্তু বড় ধরনের নির্বাচনী জয়ের আত্মগৌরবে তাঁদের ঔদ্ধত্য চরমে পৌঁছেছিল। কারোর কথায় তাঁরা কর্ণপাত করার প্রয়োজন বোধ করেননি। এমনকি জনগণের মধ্যে ক্ষোভ-বিক্ষোভ যখন বাড়ছে তখন তাঁরা পার্টি ক্যাডারদের দিয়ে জনগণকে শায়েস্তা করার রাস্তা নিতেও কুন্ঠা বোধ করেননি। আজকাল দেখি, সিপিএমের কেউ কেউ বলার চেষ্টা করেন, সিঙ্গুরে অধিকাংশ কৃষকই জমি দিতে চেয়েছিলেন। কাগজপত্তরে হয়ত ব্যাপারটা তাই। তথাকথিত ইচ্ছুক কৃষকদের থেকে অনিচ্ছুক কৃষকদের সংখ্যা কম ছিল। কিন্তু এটা বাস্তবতার প্রকৃত প্রতিফলন নয়। জমি দিয়ে অন্যান্য সুযোগসুবিধা পেতে প্রকৃতই আগ্রহী ছিলেন সেই সমস্ত জমির মালিক, যাঁরা শহরে থাকতেন এবং জমির উপর খুব একটা নির্ভরশীল ছিলেন না। কিন্তু এঁদের সংখ্যা ছিল খুবই কম। বাকিদের সম্মতি কীভাবে আদায় করা হয়েছিল তা নিয়ে বেশি আলোচনার প্রয়োজন নেই। সরল লোকেদের বাদ রাখলে সেসব সকলেই জানেন। কৌটিল্য প্রণীত চার পদ্ধতি আমাদের দেশের শাসক মহলে যথেষ্ট জনপ্রিয় — সাম, দাম, দন্ড, ভেদ। অর্থাৎ কানে সামগানের মন্ত্র দাও, অর্থাৎ বোঝাও, প্রতিশ্রুতি দাও ইত্যাদি। তাতে কাজ না হলে নগদ দাম দাও, টাকাপয়সা দাও। তাতে কাজ না হলে শাস্তি দাও, হামলা করো, জীবনটাকে নরক করে দাও। পাশাপাশি তাদের মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টি করো, ভেদ বাড়াও, সবাইকে একসাথে আক্রমণ না করে আলাদা আলাদা করে আক্রমণ করো। এই চারটে পদ্ধতি একযোগে প্রয়োগ করো। সঙ্গে ছিল মূলধারার সংবাদমাধ্যম। তারাই তো বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে ‘ব্র্যান্ড বুদ্ধ’ বানিয়েছিল। এর সঙ্গে যোগ করতে হবে সরকারি হিসাবে প্রভূত ‘জল’-এর উপস্থিতি। বর্তমানে দেউচা-পাঁচামি প্রকল্পের দিকে লক্ষ্য রাখুন। তাহলেই সেদিনের সিঙ্গুরের কৃষকদের সম্মতির ব্যাপারটা পরিষ্কার বুঝে যাবেন। সর্বস্তরের বাদ-প্রতিবাদকে চরম অবজ্ঞা করে সেদিন আত্মম্ভরী সিপিএম নেতৃত্ব গায়ের জোরে এগিয়ে গিয়েছিল।
কিন্তু এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয় হল জমি অধিগ্রহণ, শিল্পায়ন, উন্নয়নের পথ — এসব নিয়ে সেদিন সিপিএমের সঙ্গে বিতর্কটা হয়েছিল মূলত অন্য বামপন্থী পার্টিগুলোর। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন তৃণমূল কংগ্রেসের এই বিতর্কে কোনো ভূমিকা ছিল না। ওঁরা পরিষ্কার করে কোনো ভবিষ্যৎ নীতিমালা ঘোষণা করেননি। সরকারে এলে কী করবেন তা কখনোই বলেননি। শুধু বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের সরকারকে সমস্ত প্রশ্নে প্রবল সমালোচনা করে তুলোধোনা করেছিলেন। তৃণমূলের সরকার হলে গায়ের জোরে জমি অধিগ্রহণ হবে না — শুধু এটুকুই তাঁরা বলেছিলেন। এর বেশি একটা কথাও বলেননি। আবার অন্য বামপন্থী দলগুলো যা যা বলছিল তার প্রকাশ্য বিরোধিতাও করেননি। আসলে মমতা ভাল করেই জানতেন, তাঁরা সরকারে এলেও এই একই কাজ তাঁদের করতে হবে। কারণ তাঁদের কোনো ভিন্ন নীতি ছিল না। এই নীতিগুলো তো বামফ্রন্টের নীতি, কংগ্রেসের নীতি বা তৃণমূলের নীতি তা নয়। প্রকৃত প্রস্তাবে এগুলো নয়া উদারবাদী নীতি। কেন্দ্রে অথবা রাজ্যে সরকারে এসে নয়া উদারবাদ লাগু না করে বিকল্প কিছু করব, এমন বলিষ্ঠতা বুদ্ধবাবুর যেমন ছিল না, মমতা দেবীরও নেই। এই হল সত্য। আজও কেরালায় সিপিএমের সরকার তো অন্যরকম কিছু করছে না। কোনো রাজ্যের কোনো সরকারই করছে না। তফাতটা হল, কে কত দক্ষভাবে নয়া উদারবাদ লাগু করতে পারে।
‘দক্ষতা’ মানে কী? মানে জনতাকে নিষ্পেষণ করব কিন্তু জনতা আমার বিপক্ষে যাবে না, বা যাবার জায়গা পাবে না। এই তো। বামফ্রন্টের উপর জনগণের সিঙ্গুরের আগে কোনো ক্ষোভ ছিল না এমন তো নয়। ২০০৬ সালের নির্বাচনেও তো তৃণমূল কংগ্রেস ভালো ফলের আশাই করেছিল। মমতার “হয় এবার নয় নেভার” স্লোগানের কথা অনেকেরই মনে থাকবে। তারও আগে ২০০১ সালেও বামফ্রন্ট আপাতদৃষ্টিতে বেকায়দায় ছিল। কিন্তু একদিকে তখনো তারা ‘দক্ষতা’ হারায়নি, অন্যদিকে মমতা বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হিসাবে মোটেই গ্রহণযোগ্য ছিলেন না।
কেন বলছি মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তখনো গ্রহণযোগ্য বিকল্প ছিলেন না? সরকারি নীতির বিরুদ্ধে আন্দোলন সংগ্রাম জারি রাখা বিকল্প রাজনৈতিক শক্তি হয়ে উঠতে পারার এক অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটা ছাড়া কোনোভাবেই কেউ বিকল্প হয়ে উঠতে পারবেন না। কিন্তু এটাই সব নয়। পরিভাষা প্রয়োগ করে বললে, বলতে হবে, এটা আবশ্যিক শর্ত কিন্তু পর্যাপ্ত শর্ত নয়। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর সারা জীবনে প্রভূত আন্দোলন সংগ্রাম করেছেন। কিন্তু প্রকৃত বিকল্প হয়ে দেখা দিয়েছিলেন একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে। এটা ঘটে তখনই, যখন জনতার মনে এই বিশ্বাস তৈরি হয় যে, প্রতিযোগী রাজনৈতিক শক্তি বর্তমানের প্রশাসনের থেকে উন্নততর প্রশাসন উপহার দিতে পারে। একটা অধিকতর গ্রহণযোগ্য সরকার তৈরি করতে পারে। এই বিশ্বাস না থাকলে জনগণ সাধারণত সরকার পরিবর্তনের মত গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নেন না। এটা বুঝতে হবে। আজকের সিপিএম এটা বোঝে না। তাদের ৩৪ বছরের সরকারের অভিজ্ঞতা এবং ক্ষমতা হারানোর কারণের যদি তারা বস্তুনিষ্ঠ মূল্যায়ন করত তাহলে এটা সহজেই বুঝতে পারত। উলটে তারা সাধারণত জনগণকে গরু, গাধা ভাবতে অভ্যস্ত। তাই কখনোই জনগণের উপর রাগ-অভিমানের বাইরে যেতে পারছে না। এর সঙ্গে আছে কমিউনিস্ট আন্দোলনে জনপ্রিয় ‘কন্সপিরেসি থিওরি’ বা ষড়যন্ত্র তত্ত্ব। মার্কিন সাম্রাজ্যবাদ, অথবা ভগবান জানে কোন আপদ, এমন একটা জমাট ষড়যন্ত্র করল যে সিপিএমের সাজানো বাগান শুকিয়ে গেল! প্রবল আত্মম্ভরিতা থেকে উদ্ভুত হঠকারী কার্যকলাপ একদিকে যেমন ২০০৭-০৮ সাল নাগাদ বামফ্রন্টের সমস্ত ‘দক্ষতা’-কে শুষে নিয়েছিল, তেমনি অন্যদিকে মমতার সিপিএম ছাড়া অন্য বামদলগুলোকে সঙ্গে নিয়ে চলতে পারার কৌশল, অন্তত সিপিএমের বিপক্ষে নিয়ে যাওয়া বা নিরপেক্ষ অবস্থান নেবার বাধ্যবাধকতা তৈরি করতে পারার মধ্যে দিয়ে জনতার মনে এই বিশ্বাস তৈরি হয়েছিল যে, মমতার সরকার আর যা-ই হোক এই বামফ্রন্টের থেকে খারাপ হবে না। তাই সরকার পরিবর্তিত হয়েছিল।
প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে সিপিএমকে যদি নয়া উদারবাদ নিয়ে লিখতে বলা হয়, তাহলে ওঁরা পরীক্ষার খাতায় ১০০-তে ৯৫ পাবেন। কিন্তু যখনই নিজেদের সরকারের নির্দিষ্ট পদক্ষেপের সঙ্গে মিলিয়ে নিয়ে বলতে বলা হয়, তখন দেখা যায় তাঁরা আসলে ভারতে নয়া উদারবাদের প্রতিষ্ঠাতা কংগ্রেসের থেকেও বড় নয়া উদারবাদী। সুতরাং তাঁরা অতীত পদক্ষেপগুলোর ব্যাপারে নির্মম আত্মসমালোচনা করে সেগুলোর সঙ্গে মৌলিক এবং সম্পূর্ণ বিচ্ছেদ ঘটাতে পারেন না। কাগজপত্রে কিছু প্রসাধনী আত্মসমালোচনার কথা বলছি না। প্রকাশ্যে অতীতের সঙ্গে মৌলিক বিচ্ছেদ ঘটানোর মত আত্মসমালোচনার কথা বলছি। সাম্প্রতিক কৃষক আন্দোলনে আমরা রাকেশ টিকায়েতকে এরকম একটা আত্মসমালোচনা করতে দেখেছি পশ্চিম উত্তরপ্রদেশের মুজফফরনগরে। টিকায়েতরা অতীতে মুসলমানবিরোধী দাঙ্গায় যুক্ত ছিলেন, বিজেপিকে প্রভূত সুবিধা করে দিয়েছিলেন। কিন্তু এবারের কৃষক আন্দোলনে সেই টিকায়েতকেই দেখা গেছে প্রকাশ্য মঞ্চে মুসলমান কৃষক নেতাদের বুকে জড়িয়ে ধরতে, অতীতের কাজের জন্য আত্মসমালোচনা করতে, এমনকি চোখের জলে প্রায়শ্চিত্ত করতে। তবেই টিকায়েত কৃষক আন্দোলনের সর্বজনগ্রাহ্য নেতা হিসাবে উঠে এসেছেন। অবামপন্থী ধনী কৃষক নেতারা যা করতে পারেন, দেখা যাচ্ছে বামপন্থীরা তা পারেন না। ফলে তাঁরা কী করে জনতার মনে এই বিশ্বাস উৎপাদন করবেন, যে তাঁরা বর্তমান সরকারের থেকে অধিক গ্রহণযোগ্য প্রশাসন তৈরি করতে সক্ষম? কীভাবে বর্তমান সরকারের নয়া উদারবাদী হামলাগুলোর বিরুদ্ধে জনমত গঠন করবেন, আন্দোলন সংগঠিত করবেন? সিঙ্গুরে গাড়ি কারখানার সমর্থক কি দেউচা পাঁচামি খনি প্রকল্পের বিরোধিতা করতে পারেন? আর করলেই বা তাঁকে লোকে বিশ্বাস করবে কেন?
সুতরাং মমতা সিঙ্গুরে ভেড়ি করে দিয়ে পার পেয়ে যাবেন বৈকি। কারণ একথা তো সত্যি, যে ভেড়ি ছাড়া ওখানে অন্য কিছু হবে না। জমির টপ সয়েলটা তো টাটারাই নষ্ট করেই গিয়েছেন। সিঙ্গুরের কৃষকরা যদি আজ ওই একদা-উর্বর জমিতে চাষবাস না করতে পারে, তার জন্য তো দায়ী সিপিএম। টাটাদের ন্যানো প্রজেক্ট তো ডাহা ফেল। ইউরোপের বাজার কেন, ভারতের বাজারেই ন্যানো খুঁজে পেতে দূরবিন লাগবে। টাটারা ন্যানো তৈরি করা বন্ধও করে দিয়েছেন। গুজরাটের সানন্দের ন্যানো কারখানায় আজ হয়ত অন্য কোনো গাড়ি বানানো হয়। সে তো সিঙ্গুরে হাইওয়ের উল্টোদিকের জমিতেও করা যেত। কটা দিন দেরি হয়ে যাবার যে অজুহাত সেদিন দিয়েছিলেন রবিকান্ত, সে তো পুঁজিবাদের ভাগ্যবিধাতা ২০০৭ সালের বিশ্বমন্দার মোক্ষম চালে কবেই ধুয়ে মুছে দিয়েছেন।
সুতরাং, ভেড়িই ভবিতব্য। ধান-সবজি না হয় না-ই পেলাম, মাছ তো পাব। দোষ কারো নয় গো মা।
মতামত ব্যক্তিগত
আরও পড়ুন: https://nagorik.net/politics/state-politics/singur-pisciculture-death-of-industry/
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।