শিখর গুপ্ত
ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার ক্ষেত্রে উৎকর্ষের শিখর ছোঁয়া প্রতিষ্ঠান আইআইটি পরিবারে সাম্প্রতিক সময়ে ঘটে যাওয়া কয়েকটি ঘটনা দিয়েই শুরু করা যাক।
ঘটনা ১: আইআইটি বম্বের মানবীবিদ্যা বিভাগের উদ্যোগে ৭ নভেম্বর দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক, পরমাণু অস্ত্র নিষিদ্ধকরণ আন্দোলনের দীর্ঘদিনের যোদ্ধা অচিন ভানাইক ‘ইজরায়েল-প্যালেস্তাইন সংঘাতের প্রেক্ষাপট’ বিষয়ে বক্তৃতা দিতে আমন্ত্রিত ছিলেন। বক্তৃতার দিন সকালবেলায় কর্তৃপক্ষ সেই বক্তৃতা বাতিল করে দেন। বাতিলের কারণ Bharat For IITB নামে একটি ছাত্র সংগঠনের আপত্তি। অধ্যাপক ভানাইকের বিরুদ্ধে অভিযোগ, উনি আদতে ইসলামিক উগ্রপন্থার সমর্থক, হিন্দুবিরোধী এবং ভারতীয় সেনাবাহিনীর বিরোধী।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
ঘটনা ২: ৬ নভেম্বর মানবীবিদ্যা বিভাগের আর এক অধ্যাপক শর্মিষ্ঠা সাহার আমন্ত্রণে জননাট্য মঞ্চের সদস্য সুধন্য দেশপান্ডে আইআইটি বম্বেতে আয়োজিত একটি অনলাইন আলোচনা চক্রে যোগ দেন। প্যালেস্তাইনের মুক্তিসংগ্রামের সোচ্চার সমর্থক সুধন্যকে “হামাস এবং সন্ত্রাসবাদের সমর্থক” আখ্যা দিয়ে তাঁকে আমন্ত্রণ জানানোর জন্য এক ছাত্র অধ্যাপক সাহার বিরুদ্ধে পুলিশে অভিযোগ জানায়। তার সমর্থনে এগিয়ে আসে Bharat For IITB সংগঠন।
ঘটনা ৩: নভেম্বরের শুরুতে আইআইটি খড়্গপুরের আসন্ন সমাবর্তনে অংশগ্রহণকারীদের জন্য পোশাকবিধি সংক্রান্ত নির্দেশিকায় কেবল বিশেষ ‘ভারতীয়’ পোশাকের ফরমান ছাড়াও নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয় পোশাকের রং, দৈর্ঘ্য, প্রস্থ, জুতোর প্রকার, রং, কী ধরণের গয়না পরা যাবে না এবং সর্বোপরি মহিলাদের ব্লাউজের হাতার দৈর্ঘ্য এবং অন্তর্বাসের রং। এছাড়া পুরুষ ও মহিলা ব্যতীত কোন তৃতীয় লিঙ্গের অস্তিত্বও স্বীকৃতি পায়নি এই পোশাকবিধিতে।
ঘটনা ৪: জুলাই মাসে আইআইটি বম্বের এক ছাত্রকে ছাত্রাবাসের বিধিভঙ্গের কারণে ১০,০০০ টাকা জরিমানা করা হয়। ছাত্রটির অপরাধ হল সে ছাত্রাবাসের ডাইনিং হলের একটি অংশ কেবল নিরামিষাশীদের জন্য সংরক্ষিত রাখার প্রাতিষ্ঠানিক নির্দেশিকা মানতে চায়নি।
ঘটনা ৫: এপ্রিল মাসে আইআইটি গৌহাটিতে ‘গৌ বিজ্ঞান’ বিষয়ক একটি ‘বৈজ্ঞানিক’ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। দেশজুড়ে বিজ্ঞানী মহলে সমালোচনার ঝড় উঠলেও সম্মেলনটি বাতিল হয়নি। এই সম্মেলনের অন্যতম আয়োজক ছিলেন নাগপুরের গৌ বিজ্ঞান অনুসন্ধান কেন্দ্রের আধিকারিক সুনীল মানসিঙ্ঘা। এই অনুসন্ধান কেন্দ্রটি অন্যান্য জিনিসের সঙ্গে সুলভে গোমূত্র এবং তদজাত নানা জিনিস তৈরি করে বিক্রি করার জন্য প্রসিদ্ধ। এছাড়া এই কেন্দ্রের ‘গবেষণা’ দাবি করে যে গোমূত্রে ক্যান্সারের মত দুরারোগ্য ব্যাধিরও বিনাশ সম্ভব।
বিগত সাত মাসে ঘটে যাওয়া ভিন্ন ধরনের পাঁচটি ঘটনাকে খতিয়ে দেখলে বোঝা যায়, তারা আসলে অভিন্ন সূত্রে গাঁথা। সেই অভিন্ন সূত্রটি ইঙ্গিত দেয় আইআইটিতে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি ক্রমশ জাঁকিয়ে বসছে। মুসলমানবিদ্বেষ, জায়নবাদী রাজনীতির প্রতি প্রীতি, নিরামিষভোজীদের বিশেষ সুবিধাদান, পোশাকবিধির আড়ালে বিশেষত নারীদের নিয়ন্ত্রণ, ঔপনিবেশিক মানসিকতার বিরুদ্ধে ভারতীয়ত্ব তুলে ধরার অছিলায় ভারতের বৈচিত্র্য অস্বীকার করে একটি বিশেষ সংস্কৃতিকে ভারতীয় সংস্কৃতি বলে চালানোর প্রয়াস, অপবিজ্ঞানের চর্চা এবং সামান্যতম বিরোধী মত দেখলেই তাকে গলা টিপে আঁতুড়েই মেরে দেবার চেষ্টা – এই লক্ষণগুলি হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক পরিবারের কর্তা আরএসএস পরিচালিত ভারতবর্ষে ফ্যাসিবাদী রাজনীতির পরিচায়ক এবং উপরোক্ত পাঁচটি ঘটনায় এই উপাদানগুলি প্রভূত পরিমাণে মজুত।
এদেশে শিক্ষিত, উদারপন্থীদের নয়নমণি, এমনকি ভারতীয় প্রতিষ্ঠান হিসাবে আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিত আইআইটিতে ফ্যাসিবাদী সংস্কৃতির এমন বাড়বাড়ন্ত কীভাবে হল? পৃথিবীর অন্যতম কঠিন প্রবেশিকা পরীক্ষা দিয়ে স্নাতক স্তরে পড়ার জন্য যাঁরা আইআইটিতে সুযোগ পান, তাঁরা দেশের সেরা প্রতিভা, মস্তিষ্ক ক্ষুরধার। উপরন্তু আইআইটিতে পড়াশোনার বাইরে আরও পাঁচটা জিনিসে উৎসাহ দেওয়া হলেও রাজনীতির প্রবেশ নিষেধ। ফলে আরএসএস পোষিত ফ্যাসিবাদী রাজনীতির ভাষা সেখানে এত প্রভাবশালী হয় কীভাবে, যে ছাত্ররা বক্তৃতা বাতিল করা থেকে শুরু করে কেবল বক্তৃতার আয়োজক হবার ‘অপরাধে’ অধ্যাপকের বিরুদ্ধে মামলা পর্যন্ত করে ফেলতে পারে? এ প্রশ্নের উত্তর লুকিয়ে আছে আরএসএসের কার্যপদ্ধতি এবং আইআইটির অরাজনীতির রাজনীতির মিথোজীবিতার মধ্যে।
আইআইটি একরকম অভিজাত ক্লাব যেখানে অধিকর্তা সচরাচর ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের ব্যক্তিরাই হন, বিজ্ঞান বিভাগকেও পরিষেবা প্রদানকারী বিভাগ হিসাবেই গণ্য করা হয়। মানবীবিদ্যার অবস্থান কী তা বলার অপেক্ষা রাখে না। আইআইটির আবহটি হল, মানবজাতির যাবতীয় সমস্যার সমাধান আছে প্রযুক্তির মধ্যেই। অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজবিজ্ঞানের কোনো ভূমিকা নেই। এই অরাজনীতির রাজনীতিই আইআইটির ছাত্র, শিক্ষকদের বৃহদংশকে স্থিতাবস্থার পক্ষে থাকতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে। এমনিতেই দেশের শিক্ষাব্যবস্থার বহমান ধারা ছাত্রদের প্রশ্ন করতে নিরুৎসাহিত করে, বিজ্ঞানের ছাত্রকে বিজ্ঞানকে কর্মসংস্থানের উপযোগী বিষয় ছাড়া আর কিছু বলে ভাবতে সাহায্য করে না। এর সঙ্গে আইআইটির আভিজাত্য যুক্ত হয়ে যেসব প্রতিষ্ঠানে ছাত্ররা রাজনৈতিকভাবে সচেতন, সমাজকে অর্থনীতি এবং রাজনীতি দিয়ে বিশ্লেষণের চেষ্টা করে এবং ব্যবস্থাকে প্রশ্ন করে – তাদের উপদ্রবকারী, বিভেদকামী হিসাবে দাগিয়ে দিতে সাহায্য করে। অর্থাৎ ক্ষমতার ভাষ্যের বিপরীতে যারা থাকে তাদের একপ্রকার নিম্ন শ্রেণি হিসাবে গণ্য করা হয় আইআইটিগুলিতে।
আইআইটি থেকে প্রযুক্তিবিদ্যায় স্নাতক ছাত্রদের বৃহদংশ লাগে পুঁজির সেবায়। কেবল প্রথাগত ইঞ্জিনিয়ারিং ডিগ্রি নিয়েই তারা সন্তুষ্ট হয় না, ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন ম্যানেজমেন্ট প্রতিষ্ঠানে। মোটা মাইনের চাকরির সঙ্গে সঙ্গে পুঁজির স্বার্থরক্ষায় কাজে লাগে ম্যানেজমেন্ট ডিগ্রি। যে অংশটি উচ্চশিক্ষার জন্য বিদেশে যায় তারাও শেষমেশ অধীত বিদ্যা কাজে লাগায় এই পথেই। গত শতকের নয়ের দশকে ভারতবর্ষের অর্থনীতির উদারীকরণের ফলে বহুজাতিকদের আগমন এ পথ আরও প্রশস্ত করে। আইআইটির প্রবেশিকা পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হবার জন্য কোচিং সেন্টারের রমরমাও ওই সময়েই শুরু হয়। এর আগে ছাত্রদের বিষয় শেখার যেটুকু আগ্রহ ছিল তা ক্রমশ কমতে থাকে, কারণ বাজার চায় কর্মী, যারা বিনা প্রশ্নে মুনাফা বাড়াতে সাহায্য করবে।
এ কথা তো জানাই যে ফ্যাসিবাদের উত্থান পুঁজির সংকটের সঙ্গে জড়িত। সংকটকালে পুঁজির দরকার গণতান্ত্রিক পরিসরের সংকোচন আর তার জন্য প্রয়োজন ফ্যাসিবাদীদের শক্তিসঞ্চয়। ভারতবর্ষে বিগত দশ বছরের ঘটনাবলী অধ্যয়ন করলে এই ছবিটা পরিষ্কার হয়। এই জমিতেই ক্রমশ প্রভাব বাড়িয়েছে আরএসএস। আইআইটিগুলির পরিসরে আরএসএস মতাদর্শের সম্প্রসারণ তাই খুব স্বাভাবিক। অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, যেখানে ছাত্রদের মধ্যে ভিন্ন রাজনৈতিক মতাদর্শের চর্চা আছে, সেখানে আরএসএস কাজ করে তাদের ছাত্র সংগঠন এবিভিপির মাধ্যমে। কিন্তু আইআইটির রাজনৈতিক পরিসর যেহেতু ‘অরাজনৈতিক’, তাই সামাজিক, সাংস্কৃতিক মঞ্চের আড়ালে আরএসএসের পক্ষে শিকড় ছড়ানো সহজ। ২০১২ সালে ইন্ডিয়া এগেন্সট করাপশন মঞ্চের মুখোশ ধরে তারা বিভিন্ন আইআইটিতে শক্তিশালী অনুপ্রবেশ ঘটায়। যে আইআইটির ছাত্ররা সচরাচর কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে জোরালো আওয়াজ তোলে না – বিশেষত স্নাতক স্তরের প্রযুক্তিবিদ্যার ছাত্ররা – তারাও এই মঞ্চের ব্যানারে দুর্নীতিবিরোধী মিছিল করে। ২০১৪ সালে বিজেপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর থেকে নানা স্তরে আরএসএসের প্রভাব বাড়তে থাকে। যেহেতু আইআইটির প্রধান ভাষ্য হল কর্পোরেট পুঁজির সেবক হওয়াই মোক্ষলাভের উপায়, সেহেতু ক্ষমতার প্রতি অনুগত বাহিনী তৈরি করা সহজ হয়ে দাঁড়ায়। একদিকে স্টার্ট আপকে উৎসাহ দিয়ে কর্মসংস্থানে সরকারি দায়িত্বের প্রয়োজন কমিয়ে আনার ভাষ্যের সমর্থন, অন্যদিকে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে প্রাচীন ভারতের অলীক গৌরবগাথার প্রচার – এই দুইয়ের মেলবন্ধন সফলভাবে প্রয়োগ করার উপযুক্ত পরীক্ষাগার হয়ে দাঁড়ায় আইআইটিগুলি। সেইসঙ্গে প্রশাসনিক পদগুলিতে বসানো হয় এই মতাদর্শের সমর্থক, বা খোলাখুলি সমর্থক না হলেও, ক্ষমতার প্রতি অনুগত ব্যক্তিদের। বিভিন্ন আইআইটিতে তৈরি হয় ইন্ডিয়ান নলেজ সিস্টেম। প্রাচীন ভারতের জ্ঞান বিজ্ঞানের চর্চার নামে আসলে কী হয় তা আইআইটি খড়্গপুরের বহুচর্চিত ক্যালেন্ডার দেখলেই বোঝা যায়।
আরো পড়ুন সবই ব্যাদে আছে ক্যালেন্ডার: একটি গর্বের মৃত্যু
ঝান্ডা রাজনীতির ছোঁয়া এড়িয়ে বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে আইআইটির ছাত্র ও শিক্ষকসমাজের ভিতরে গেড়ে বসা দর্শনকে নিজেদের প্রভাব ছড়াতে এইভাবেই ব্যবহার করেছে আরএসএস। সরকারে আসীন হবার সুযোগের পূর্ণ সদ্ব্যবহার করে উর্বর জমিতে ফসল ফলিয়েছে তারা। উপর্যুক্ত যে ঘটনাগুলি বর্ণনা করে এই লেখা শুরু হয়েছিল, সেই ঘটনাগুলির ব্যাখ্যা লুকিয়ে আছে তাদের এই পরিকল্পিত পদক্ষেপগুলির মধ্যে।
তাহলে আইআইটিতে মতাদর্শ কি একমাত্রিক? আশার কথা এই যে অন্য মতাদর্শের পরিসর ক্রমশ সংকুচিত করে দেওয়া হলেও (সোজা আঙুলে কাজ না হলে আঙুল বেঁকিয়ে, যেমন করা হচ্ছে অধ্যাপক সাহার ক্ষেত্রে) কিছু ছাত্র সাংগঠনিকভাবেই পাল্টা ভাষ্যের চর্চা করছেন। আইআইটি বম্বের আম্বেদকর পেরিয়ার ফুলে পাঠচক্র, আইআইটি মাদ্রাজের আম্বেদকর পেরিয়ার পাঠচক্র, আইআইটি দিল্লির আইআইটি দিল্লি ফর জাস্টিস, ফ্রিডম অ্যান্ড ডেমোক্রেসি প্রমুখ সংগঠন নিয়মিত আইআইটির ভিতর ও বাইরের বৈষম্যমূলক ইস্যু নিয়ে আওয়াজ তুলছেন। আরএসএসের অঙ্গুলিহেলনে চলা কর্তৃপক্ষের চোখরাঙানি তাঁদের দমিয়ে দিতে পারেনি। কিন্তু একটি আদর্শ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের মত মুক্ত চিন্তার পরিসর তৈরি করা আইআইটির মতাদর্শগত ভিতটি না নড়ালে সম্ভব নয়।
লেখক একটি আইআইটির প্রাক্তনী। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।