ক্যালেন্ডার বলছে ফেব্রুয়ারি মাস আসতে এখনো ঢের দেরি, বৈশাখ মাস তো আরও দূরে। এবার বাঙালি ভাবাবেগ (আজকাল বাঙালিরা হিন্দিভাষী নেতাদের বক্তৃতা শুনে শুনে যেটাকে ‘অস্মিতা’ বলে আর কি) মরসুম অনেক আগেই শুরু হয়ে গেছে। কোনো সন্দেহ নেই যে প্রায় এক দশক ধরে সঙ্ঘ পরিবারের হিন্দি-হিন্দু-হিন্দুস্তান প্রকল্পের প্রকাশ্য ও গোপন আক্রমণ বাঙালি জাতির উপর চলছে। ফলে সাংস্কৃতিকভাবে আক্রান্ত জাতির মধ্যে যেসব প্রতিক্রিয়া দেখা যায়, পশ্চিমবঙ্গের বাঙালির মধ্যেও সেসব দেখা যাচ্ছে। কিন্তু হিন্দি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করার উৎসাহ হাতে গোনা কয়েকজন ছাড়া বিশেষ কারোর মধ্যে দেখা যায় না। না, একটু ভুল হল। সোশাল মিডিয়া খুললে মনে হয় সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালিই লড়ার জন্যে কোমর বেঁধে তৈরি। কিন্তু লড়তে গেলে ঠিক কী যে করতে হবে তার কোনো নীল নকশা কারোর কাছে নেই। যারা কিঞ্চিৎ সংগঠিত তারা ঠিক করেছে হিন্দিভাষী মানুষকে ধমকানো চমকানোই একমাত্র রাস্তা। তার বাইরে যে কয়েকজনের মাথায় দু-একটা পরিকল্পনা আছে, তাদের সঙ্গ দিতে গেলে নিজের জীবনচর্যায় বেশকিছু পরিবর্তন আনতে হবে, বেশকিছু ছোট-বড় সিদ্ধান্ত নিতে হবে। অধিকাংশ বাঙালি সেসব করতে তৈরি নয়। না করার একগুচ্ছ অজুহাতও পকেটে বা হাতব্যাগে সবসময় থাকে। বলামাত্রই বার করে ফেলে। এদিকে সোজাসুজি “পারব না বাপু বাঙালিয়ানা করতে। অনেক কাজ আছে” বলে হাত ঝেড়ে ফেলার ক্ষমতাও নেই। কারণ কতকগুলো বিগ্রহ বাড়িতে এবং/অথবা জীবনে প্রতিষ্ঠা করে গেছেন গুরুজনেরা। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রামমোহন রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেন, ঋত্বিক ঘটক ইত্যাদি। বিগ্রহগুলোর নিয়মিত পুজো করতে হয়, নইলে মনে পাপবোধ তৈরি হয়। কিন্তু বিগ্রহের তো চর্চা বলে কিছু হয় না। ফলে যে সংস্কৃতি বিগ্রহনির্ভর তার চর্চা বলে কিছু থাকা সম্ভব নয়, আর যে সংস্কৃতির চর্চা নেই তাকে শেষ করতে বেশি শক্তির প্রয়োজন হয় না। তাই হিন্দি সাম্রাজ্যবাদও প্রায় ফাঁকা মাঠে জিতে যাচ্ছে। বাঙালি কী করছে? অবাঙালিদের বিরুদ্ধে বিষোদ্গার করছে। যদি বাঙালি সংস্কৃতি মানে রবীন্দ্র-নজরুল সংস্কৃতি হয়, তাহলে এই প্রবণতা সেই সংস্কৃতির ঠিক উলটো পিঠ।
হ্যাঁ, আল্লারাখা রহমান সুরারোপিত ‘কারার ওই লৌহকপাট’ গানের সূত্রেই এত কথা বলছি। প্রথম চোটে গোটা ১৫ সেকেন্ড শুনে বন্ধ করে দিয়েছিলাম ভাল লাগছিল না বলে। কিন্তু ওই গান এবং তা নিয়ে বাঙালির প্রতিক্রিয়া সংবাদ হয়ে উঠেছে আর কোনো ওয়েবসাইট যা সংবাদ তাকে এড়িয়ে যেতে পারে না। ফলে লিখতে হবে, তাই শুনতে হল। অন্য অনেকের মত আমার কানেও মোটেই সুবিধের লাগল না। রহমান মহান শিল্পী, কিন্তু তাঁর সুরারোপিত কিছু হিন্দি গান আছে যেগুলো শুনলে মনে হয় তিনি কথাগুলোকে ঠিক সামলে উঠতে পারেননি, তাই কিছু অর্থহীন ধ্বনি ঢুকিয়ে দিয়ে ছেঁড়া মশারিতে তালি মেরেছেন (স্বদেশ ছবির ‘ইয়ে যো দেস হ্যায় তেরা’, লগান ছবির ‘কোঈ হম সে জিত ন পাওয়ে’ স্মর্তব্য)। এই গান শুনেও তেমনটাই মনে হল। আরও বড় গোলমাল হল, কথা যাচ্ছে লন্ডন আর সুর যাচ্ছে টোকিও। নজরুলের গানের কথায় বিদ্রোহে উৎসাহ দেওয়া হয়েছে। ফলে প্রবল উদ্যম এবং গনগনে রাগ আছে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
কিন্তু রহমানের সুর শুনলে মনে হচ্ছে এ গান ‘ধিতাং ধিতাং বোলে’ জাতীয় আনন্দের গান। সবাই মিলে বেশ নেচেকুঁদে নেওয়া যায় এই গান শুনতে শুনতে। যাঁরা গেয়েছেন তাঁদের হাসি হাসি মুখগুলোও যেন চোখের সামনে ভেসে উঠল। ফলে জ্ঞানত এই সুরারোপকে ব্যর্থ বলা ছাড়া উপায় নেই। সুরকার এবং তাঁর গায়েনরা গানের কথাগুলো বুঝে উঠতে পারেননি বলে সন্দেহ হয়।
গান ভাল না লাগলে নিন্দা করার অধিকার মানুষের জন্মগত, ভাল লাগলে প্রশংসা করার অধিকারের মতই। সুতরাং যখন কোনো শিল্পী নিজের কাজ জনসমক্ষে নিয়ে আসেন তখন তাঁকে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার জন্যে তৈরি থাকতে হয়। নইলে অবস্থা হয় বিবেক অগ্নিহোত্রীর মত। ছবি ফ্লপ হলে বলতে হয়, গীতার চেয়ে তো প্লেবয় বেশি বিক্রি হয়। তা বলে কি গীতাকে ফ্লপ বলব? কিন্তু অমুক গান আমার ভাল লাগেনি বলা এক জিনিস, আর অমুক গান তৈরি করাই অনুচিত হয়েছে, নজরুলকে অপমান করা হয়েছে, বাঙালি জাতিকে অপমান করা হয়েছে, অবাঙালি বলেই এমন করতে পারল, বাঙালিরা কিছু বলে না বলে… ইত্যাদি চেঁচামেচি করা আরেক জিনিস। এই কোলাহল কিছুদূর পর্যন্ত স্রেফ হাস্যকর, তারপর ক্ষতিকর। ইতিমধ্যেই এত বেশি ধুলো ওড়ানো হয়েছে যে পিপ্পা ছবির নির্মাতারা বিবৃতি দিয়ে দুঃখপ্রকাশ করেছেন। সেই বিবৃতিতে অবশ্য একটি মোক্ষম কথা বলা হয়েছে “আমাদের উদ্দেশ্য ছিল আমাদের চুক্তির শর্তাবলী অনুযায়ী গানটির সাংস্কৃতিক তাৎপর্যকে শ্রদ্ধা জানানো, যে চুক্তি আমাদের গানের কথাগুলিকে নতুন নির্মাণে ব্যবহার করার অধিকার দিয়েছিল” (Our intent was to pay homage to the cultural significance of the song while adhering to the terms set forth in our agreement, which permitted us to use the lyrics with a new composition)।

বিবৃতিতে প্রকাশ, চুক্তি স্বাক্ষর করেছিলেন নজরুলের পুত্রবধূ প্রয়াত কল্যাণী কাজী এবং পৌত্র অনির্বাণ কাজী। এখন বাঙালির আবেগের বিস্ফোরণ দেখে অনির্বাণ এবং তাঁর ভাইবোনেরা আমতা আমতা করছেন। জল্পনা চলছে ‘পরিবারেরই ভুলে কি বিকৃতি নজরুল-গীতে?’ কবির পরিবারের সদস্যরা আপ্রাণ চেষ্টা করছেন এই দায় ঝেড়ে ফেলতে। গোটা দুনিয়ার বাঙালির চোখে তাঁরা এখন অভিযুক্ত। অপরাধ কী? না নজরুলের রচিত একটি গানকে অন্য সুরে গাওয়ার অনুমতি দিয়ে ফেলেছেন। এখন নজরুলের নাতনি খিলখিল কাজীকেও বলতে হচ্ছে “যা হয়েছে তা শুধু নজরুল ইসলামকে নয়, বাংলা সংস্কৃতি, বাঙালি জাতিকে অপমান!”
কী হয়েছে? না নজরুলের একটি একদা জনপ্রিয় গানকে অন্যরকম সুরে গাওয়া হয়েছে এবং সে সুর বাঙালির পছন্দ হয়নি। এতদ্বারা বাঙালি দুনিয়াসুদ্ধ লোককে জানিয়ে দিল, নজরুলের গান বেদ, কোরান, বাইবেল বা আবেস্তার মত একটি অপরিবর্তনীয় বস্তু। এদিক ওদিক করলে মহাপাতক হয়। এ স্রেফ শিল্প নয়, যে তুমি পুনর্নির্মাণ করবে। চুক্তি-টুক্তিতে চিঁড়ে ভিজবে না। কপিরাইট আইনকে মারো গুলি। আমাদের বিগ্রহের লেখা গান আমাদের সবার সম্পত্তি। দেশের আইন যা-ই বলুক। আবেগের কাছে আইন, শিল্পের ইতিহাস – এসবের আবার কোনো দাম আছে নাকি? ঠিক যেমন ইতিহাসে রামের অস্তিত্ব থাক আর না-ই থাক, আমাদের আবেগ যখন বলছে ওখানে রাম জন্মেছিলেন, তখন মন্দির ওয়হি বনায়েঙ্গে।
নজরুলের প্রতি অন্যায় করা হল বলে যারা চোখের জল ধরে রাখতে পারছে না, তারা খেয়ালও করছে না, একজন শিল্পীর প্রতি সবচেয়ে বড় অন্যায় হল তাঁর কপিরাইটকে সম্মান না করা। স্লোগান সকলের সম্পত্তি, গান অবশ্যই শিল্পীর একার। কারণ তিনি একাই তা সৃষ্টি করেন। ‘কারার ওই লৌহকপাট’-এর মত মহান সৃষ্টির পিছনে যে পরিশ্রম এবং যন্ত্রণা থাকে তার তুলনা একমাত্র প্রসববেদনা। ও জিনিসের ভাগ হয় না। শিশুকে যে যতই আদর করুক, সে একমাত্র তার মায়ের সন্তান। মায়ের মৃত্যুর পরেও। একজন শিল্পী অন্য এক শিল্পীর কাজকে স্বীকৃতি দিয়ে তা নিয়ে নতুন পরীক্ষা নিরীক্ষা চালাতেই পারেন। সফল হলে প্রশংসা করা আর বিফল হলে নিন্দা করার বেশি অধিকার শ্রোতা, দর্শক বা পাঠকের নেই। যা করা হয়েছে তা শিল্প হিসাবে ভাল-খারাপ ছাড়িয়ে ক্ষতিকর মনে হলে অন্যকে সে কথা বলতে পারেন, পয়সা দিয়ে ও জিনিসের পৃষ্ঠপোষকতা করা থেকে নিরস্ত করার চেষ্টা করতে পারেন। ব্যাস।
এরপরেও একটা কথা আছে। সারা পৃথিবীতে প্রতিবাদী শিল্পের যে ধারা (protest art), তাতে অনেক সময় কোনো গানের রচয়িতা খুঁজে পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়ে, অর্থাৎ আক্ষরিক অর্থেই সেই গানটা সকলের হয়ে যায়। সে গানের অসংখ্য সংস্করণ তৈরি হয়ে যায়। নজরুলের গানের যে পবিত্রতা নষ্ট হয়েছে বলে হাত-পা ছোড়া হচ্ছে, সেই পবিত্রতা তখন চুলোয় যায়। সেখানেই গানটার সাফল্য। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ আর ‘বেলা চাও’। পৃথিবীর বিভিন্ন ভাষায় এই গানদুটোর নানা রূপ। সাধারণত দেখা যায় সুর এক আছে, কথা পালটে গেছে। কেবল বাংলা ভাষাতেই ‘উই শ্যাল ওভারকাম’ গানের অন্তত দুটো রূপ (‘আমরা করব জয়’, ‘একদিন সূর্যের ভোর’) পাওয়া যায়। এ যদি অন্যায় না হয়, তাহলে সুর বদল হলে মহাভারত অশুদ্ধ হবে কেন? নাকি রাগের কারণ আসলে একটা আশঙ্কা, যে নজরুলের উপর আমাদের মৌরসি পাট্টা নষ্ট হয়ে যাবে। তিনি আর কেবল বাঙালির থাকবেন না?
তার মানে! যে যেমন ইচ্ছা আমাদের সংস্কৃতির পিণ্ডি চটকাবে আর বাঙালি চুপচাপ বসে দেখবে?
তা কেন? বাঙালির সংস্কৃতির পিণ্ডি যে বাঙালিই সবচেয়ে বেশি চটকাচ্ছে সেটা খেয়াল করুন, তার প্রতিকারের ব্যবস্থা করুন। নইলে অন্যদের আক্রমণ আটকাবেন কী করে? ভেবে দেখুন তো, পাড়ায় পাড়ায় মে-জুন মাসে রবীন্দ্র-নজরুল সন্ধ্যা (কোথাও কোথাও জুড়ে যেতেন সুকান্তও) বন্ধ হয়ে গেছে কতদিন হল? ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা নজরুলের ‘ঝিঙে ফুল’ কবিতাটা জানে? বাবুদের তালপুকুরে হাবুদের ডালকুকুরে কী কেলেঙ্কারি ঘটিয়েছিল সে খবর আজকালকার কনভেন্ট শিক্ষিত, সেকেন্ড ল্যাঙ্গুয়েজ হিসাবে হিন্দি পড়া ছেলেমেয়েদের জানানোর জন্যে কী উদ্যোগ নিচ্ছে নজরুলপ্রেমী বাঙালি সমাজ? গোঁফের রেখা ওঠা ছেলেরা আর মেয়ে থেকে মহিলা হয়ে ওঠার পথে পা বাড়ানো মেয়েরা এখনো ‘বিদ্রোহী’ বা ‘আমার কৈফিয়ৎ’ পড়ছে? মেগা সিরিয়াল থেকে শুরু করে রাস্তার সিগনাল – সর্বত্র রবীন্দ্রসঙ্গীত তো বাজছে, নজরুলগীতি গাওয়া হয় কটা জায়গায়?
মেগা সিরিয়াল বলতে খেয়াল হল – কেবল আবহসঙ্গীতে নয়, মেগায় যে পরিস্থিতির সঙ্গে লাগসই আস্ত হিন্দি ছবির গান বাজানো হয় তাতে হিন্দি আগ্রাসন দেখতে পান না? কোনো প্রতিবাদ হয়? মহিলা পুরুত দিয়ে করানো প্রগতিশীল বাঙালির বিয়েতে বর-কনের শেরওয়ানি আর ঘাগরা কি বাঙালি সংস্কৃতির পিণ্ডি চটকায় না? কোন এ আর রহমান এসে বাঙালি মেয়েদের মাথায় বন্দুকে ঠেকিয়ে বিয়ের আগে মেহেন্দি অনুষ্ঠান বাধ্যতামূলক করে তুলেছেন? ধনতেরাস উপলক্ষে ঝাঁটা না কিনলে মানসম্মান থাকছে না বাঙালি সংস্কৃতির কোন ধারা অনুযায়ী?
এসব প্রশ্নের উত্তর না খুঁজে সোশাল মিডিয়ায় রে রে করে কোনো শিল্পীর দিকে তেড়ে যাওয়া অনেক সহজ। তাতে অ্যাড্রিনালিন ক্ষরণ, নিজের সংস্কৃতি বাঁচাতে লড়াই করার আনন্দ পাওয়া যায়। রবীন্দ্রনাথ বা নজরুলের ক্ষেত্রে আবার উপরি পাওনা বিগ্রহের মান বাঁচাতে লড়াই করার আনন্দ। ধর্মান্ধরা কোনোদিনই বোঝে না যে তাদের দেবতা তাদের চেয়ে অনেক বড়। তিনি নিজেকে নিজেই বাঁচাতে পারেন, চুনোপুঁটি ভক্তদের মুখাপেক্ষী নন। সাংস্কৃতিক বিগ্রহের পূজারী বাঙালিও বোঝে না, রবীন্দ্রনাথ বা নজরুল এত সামান্য শিল্পী নন যে তাঁদের বাঁচাতে হবে। ১৯৯১ সালে যখন আইন মোতাবেক রবীন্দ্রনাথের কপিরাইট উঠে যাওয়ার কথা ছিল, তখন কেবল বিশ্বভারতী নয়, প্রায় সমস্ত শিক্ষিত (ডিগ্রিধারী অর্থে) বাঙালি গেল গেল রব তুলেছিল। কপিরাইট উঠে গেলেই নাকি সর্বনাশ হয়ে যাবে। রবীন্দ্রনাথের গানের সাড়ে বারোটা বাজিয়ে দেবে লোকে, লেখাগুলোর কী যেন একটা ভয়ঙ্কর ক্ষতি হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা ছিল। সেবার এত দাপাদাপি শুরু হল যে ভারতের সংসদ দেশের আইন পরিবর্তন করে ফেলল। কপিরাইটের মেয়াদ ছিল স্রষ্টার মৃত্যুর ৫০ বছর পর পর্যন্ত। তা বাড়িয়ে করা হল ৬০ বছর পর পর্যন্ত। শেষমেশ ২০০১ সালে রবীন্দ্রনাথের লেখাপত্র কপিরাইটের আওতার বাইরে এসেছে। গত ২২ বছরে বিশ্বভারতী ছাড়া রবীন্দ্রনাথের আর কোন সৃষ্টি তিনি যেমন ছেড়ে গিয়েছিলেন তার চেয়ে নিকৃষ্ট মানের হয়ে গেছে? একথা ঠিক, আজকাল একেকজন এত বাজনা সহযোগে রবীন্দ্রসঙ্গীত গেয়ে থাকেন যে গান ছাড়া আর সবকিছু শোনা যায়। কেউ আবার কালোয়াতি করে বোঝাতে চান শাস্ত্রীয় সঙ্গীতে তিনি একজন ওস্তাদ। কেউ বা বাহাদুরি করে মাঝখান থেকে গান শুরু করেন। কিন্তু তাতে কী? যার যেমন রুচি সে তেমনই শোনে। যার যেটা ভাল লাগে না, সে সেটা শোনে না। এসবে গীতিকার রবীন্দ্রনাথের কী ক্ষতি হয়েছে?
আরো পড়ুন বাংলা মাধ্যম ও বাংলা বিপন্ন, কিন্তু রেডিও জকির হাতে নয়
প্রগতিশীল বাঙালিরা নিজস্ব দেবতাকুল বানিয়ে নিয়েছেন, তাতে নতুন নতুন বিগ্রহও যোগ করে যাচ্ছেন। গত বিশ বছরে যোগ হওয়া এক বিগ্রহের নাম ঋতুপর্ণ ঘোষ। তিনি কিন্তু রবীন্দ্রনাথের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে একটা পরীক্ষামূলক কাজ শুরু করেছিলেন টিভির জন্যে (প্রযোজকদের সঙ্গে গোলমালে নাকি সে কাজে শেষ পর্যন্ত থাকেননি)। শাশুড়ি-বউমার কোন্দল আর এক পুরুষের দুই নারী ছকের বাইরে সে ছিল এক ব্যতিক্রমী মেগা সিরিয়াল – গানের ওপারে। রবীন্দ্রনাথকে যারা বিগ্রহ বানিয়ে রাখে তাদের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের আধুনিকীকরণের দ্বন্দ্ব ছিল সেই সিরিয়ালের মূল উপজীব্য। সেখানে বেশকিছু রবীন্দ্রসঙ্গীত এমনভাবে গাওয়া হয়েছিল যা অভ্যস্ত কানে মোটেই সইবে না।
তাতে রবীন্দ্রসঙ্গীত হয়ত সমৃদ্ধ হয়নি, কিন্তু দরিদ্রতর হয়ে গিয়েছিল এমন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। ঋতুপর্ণকেও আজ আর সে কাজের জন্যে কেউ রহমানের মত আক্রমণ করে না। তখন যারা করেছিল তারাও ক্ষমা করে দিয়েছে। সে কি তিনি বাঙালি বলে, নাকি তিনি নিজেই বিগ্রহে পরিণত হয়েছেন বলে?
মজা হল, বাঙালির এই শতকের বিগ্রহরা কেউ বাংলার সঙ্গে হিন্দি, ইংরিজির মিশেল ছাড়া চলতে পারেন না। সৌরভ গাঙ্গুলির মুখের ভাষা শুনলেই টের পাওয়া যায়। বাংলা ভাষার সাংবাদিকতায় বিগ্রহ হতে চলা গৌতম ভট্টাচার্যের একটি বই প্রকাশিত হয়েছে সম্প্রতি। তার নাম আবার বিশ্বকাপ তুঝে সেলাম। এসবে তাঁদের কারোর জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়ছে না, কেউ বাংলার সংস্কৃতির সর্বনাশ হয়ে যাচ্ছে বলেও অভিযোগ করছে না। যত দোষ এ আর রহমানের। যেহেতু তিনি বাঙালি নন, যেহেতু আক্রমণকারী বনাম আক্রান্তের বয়ান খাড়া করার পক্ষে ব্যাপারটা সুবিধাজনক।
ব্যর্থ শিল্পপ্রচেষ্টাকে ব্যর্থ বলে বুঝে নিয়ে অন্য জিনিসে মন দেওয়ার নির্লিপ্তি না থাকলে, শিল্পে পরীক্ষা নিরীক্ষা সম্পর্কে অনমনীয় হলে যা হয়, পশ্চিমবঙ্গে ঠিক তাই হচ্ছে। গড়ে উঠেছে পুনরাবৃত্তির সংস্কৃতি। সাহিত্য ভূতে, গোঁজামিল ইতিহাসে আর রহস্য রোমাঞ্চে ছয়লাপ। কারণ ‘ওটা পাবলিক খায়’। সিনেমার বড় অংশ জনপ্রিয় গোয়েন্দা গল্পের চলচ্চিত্রায়ন। তাও আবার একই গল্পকে একবার, দুবার, তিনবার পর্দায় আনা হচ্ছে। আরেকটা অংশ? এই শতকের প্রথম দিকে চলছিল দক্ষিণ ভারতীয় ছবির পুনরাবৃত্তি, তারপর থেকে চলছে পুরনো জনপ্রিয় বাংলা ছবির পুনরাবৃত্তি। পুনর্নির্মাণ বলা যাবে না। কারণ এসব ছবি মূল বয়ানে নতুন কিছু যোগ করে না, কোনো নতুন ব্যাখ্যা দেয় না।
এরই পিছু পিছু এসে পড়েছে জেরক্স সংস্কৃতি।
‘অপরাজিত ছবিটা দারুণ হয়েছে।’
কেন? না সত্যজিৎ রায়ের চরিত্রে যে অভিনয় করেছে তাকে দেখতে অবিকল সত্যজিতের মত। পথের পাঁচালীর দৃশ্যগুলো একেবারে পথের পাঁচালীর মত। এদিকে পরিচালক অনীক দত্ত সাহস করে চরিত্রের নামটাই সত্যজিৎ রাখতে পারেননি, সে চরিত্রের তৈরি পুরস্কৃত ছবির নামও করে দিয়েছেন পথের পদাবলী।
‘মৃণাল সেনের বায়োপিকটা দারুণ হবে।’
কেন? না টিজারে দেখা গেছে মৃণালের চরিত্রাভিনেতাকে অবিকল তাঁর মত দেখাচ্ছে।
নির্দেশকরা কেনই বা এই ছকের বাইরে যেতে যাবেন? ছক ভাঙতে গিয়ে রহমানাতঙ্কের মত কিছুর কবলে পড়ার ঝুঁকি কে নেবে বাপু?
বাঙালি সংস্কৃতিকে এই বিষচক্র থেকে এবং হিন্দি, ইংরেজি ইত্যাদি আগ্রাসন থেকে বাঁচাতে পারে একমাত্র বাঙালি। কিন্তু তা করতে হলে রহমানাতঙ্ক কাটিয়ে উঠে বাঙালি সংস্কৃতি জিনিসটা ঠিক কী সে প্রশ্ন তুলতে হবে। পশ্চিমবঙ্গ বিজেপির একদা সভাপতি তথাগত রায়, সোশাল মিডিয়ায় হিন্দি আগ্রাসনবিরোধী বাঙালির বাপ বাপান্ত করাই ইদানীং যাঁর জীবনের ব্রত, প্রায়ই মন্তব্য করেন যে বাঙালির সর্বনাশ করেছে ‘রসুন’ সংস্কৃতি। অর্থাৎ রবীন্দ্র-সুকান্ত-নজরুল। তৃতীয়জনকে নিয়ে তথাগতবাবুর আপত্তির কারণ অতি সহজবোধ্য আর বাঙালি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক হিসাবে সুকান্ত ভট্টাচার্যের স্থান আদৌ রবীন্দ্রনাথ, নজরুলের পাশে নয়। তাই ও নিয়ে আলোচনা করা সময় নষ্ট। কিন্তু বাকি দুজন যে বাঙালি সংস্কৃতির অনেকখানি তা নিয়ে বিতর্কের অবকাশ নেই। আরএসএসের দীক্ষায় দীক্ষিত তথাগতবাবুর ওই দুজনকে প্রবল অপছন্দ প্রমাণ করে তাঁরা স্রেফ শৈল্পিক উৎকর্ষে নয়, সামাজিক-রাজনৈতিক ভাবনায় এবং কার্যকলাপেও যথার্থ মানবতাবাদী, অতএব প্রয়োজনীয়। কথা হল, ওঁদের নিয়ে আমাদের যে উথাল পাথাল আবেগ প্রকাশ পায় ক্ষণে ক্ষণে, তা কি খাঁটি? যদি খাঁটি হয়, তাহলে সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যারে লাইন দিয়ে অযোধ্যার রামমন্দিরের আদলে তৈরি প্যান্ডেল দেখতে গিয়েছিল কারা? যারা নজরুলের অপমান নিয়ে বেজায় উত্তেজিত তাদেরই ভাই বেরাদররা তো। রহমানের বিরুদ্ধে বিবৃতি, ফেসবুক পোস্ট, আইনি ব্যবস্থার হুমকি কত কী দেওয়া হচ্ছে এখন। বিখ্যাতরাও দিচ্ছেন। তখন এত প্রতিবাদ ছিল কোথায়? নাকি রবীন্দ্রনাথ আর নজরুলের গান, কবিতাই কেবল বাঙালি সংস্কৃতির অঙ্গ; তাঁদের সামাজিক, রাজনৈতিক ভাবনা নয়, জীবনচর্যাও নয়?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
“কারার ঐ লৌহকপাট…” নিয়ে সাম্প্রতিক সময়ে যত মানুষ প্রতিবাদে সামিল হলেন তার এক শতাংশও কিন্তু বিনাবিচারে দীর্ঘ দিন কারান্তরালে থাকা বন্দিদের নিয়ে ভাবিত নন। এর কারণ বোধহয় গান নিয়ে প্রতিবাদটি অনেকটাই নিরামিষ, কিন্তু জেলবন্দিদের মুক্তিতে সোচ্চার হলে রাষ্ট্রের বিষ নজরে পড়তে হতে পারে, দরজায় রাষ্ট্র কড়া নাড়তে পারে। যদি ভুল বলে থাকি বা কারো সেন্টিমেন্টে আঘাত লাগে মার্জনা করে দেবেন। একান্ত অপছন্দ হলে এই মন্তব্য ইগনোর করবেন।
Experiment করতে গেলে একটু আধটু গোলমাল হবেই, তা আবার যদি সে অবাঙ্গালি হয়। প্রথম প্রত্থম রবিন্দ্রনাথের copyright উঠতে গেল গেল রব উঠেছিলো। শান্তিনিকেতনের স্নিগ্ধতার কোন কপি কেউ করতে না পারলেও এটা যে ফসিল ঘরানা হবে না তা এখন নিশ্চিত। তবে যেটা মূল প্রতিবাদের বিষয় তা হোল সিনেমা টু OTT খিচুড়ি শিল্প। এটার ছাপ দুর্গা পুজার প্যান্ডেলও দেখা যায়। অধুনা ভারত খিচুড়ি ভারত। ইহাই সত্য। বাঙালির পূজায় মাইকে যে গান বাজানো হয় তা কান পাতলেই মালুম হয়। নজরুল নিয়ে চেল্লামেল্লি আমাদেরই vintage wine কে নতুন স্বাদে আধুনিকীকরণের অক্ষমতা নয়তো ? রহমান ঈশ্বর শিল্পী, তবে সব শিল্পীর আনেক সৃষ্টি – ই ফ্লপ তা ধ্রুব সত্য। শিল্পীর কাজ নিয়ম ভাঙ্গা। রহমানের নিরবতা একদিকে তাঁর এক নতুন ক্ষতের কষ্ট ও অন্যদিকে ভাঙ্গা মনে আবার নতুন সৃষ্টির সাধনার মৌনব্রত বলেই মনে হয়। শিল্পীর ছুটি নেই, শিল্পীর ক্ষমা নেই। সে একেকটা Christ!