এবছরের শুরুর দিকে আমরা খবরে জানতে পারি যে লালুপ্রসাদ যাদবকে তাঁর কন্যা রোহিণী আচার্য কিডনি দান করেছেন। প্রায় সব সংবাদমাধ্যম তাঁর দানকে ধন্য ধন্য করে। তবে পিতার জন্য কন্যা অঙ্গদান করেছেন এতে কেউ খুব বেশি অবাক হয়নি। লালুপ্রসাদের পরিবারের অন্য কোনো পুরুষ সদস্য কেন কিডনি দান করেননি তা নিয়েও কোনোরকম আলোচনা সংবাদমাধ্যমে চোখে পড়েনি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সম্প্রতি কিছু গবেষণার রিপোর্টে দেখা গেছে যে ভারতবর্ষের বেশিরভাগ অঙ্গদানে মহিলারা দাতা, অথচ গ্রহীতাদের মধ্যে পুরুষের সংখ্যাই বেশি। পরিবারের মধ্যে অঙ্গদানের প্রয়োজন হলে স্ত্রী, কন্যা বা মা এগিয়ে আসেন। দান করার মত সুস্থ স্বামী, পুত্র বা বাবা থাকলেও তাঁরা দান করেন কম। এই গবেষণা ভারতবর্ষে করা হয়েছে বটে, তবে একটু খবর নিলে দেখা যাবে সারা পৃথিবীতেই অঙ্গদানে এগিয়ে আছে মেয়েরা এবং গ্রহীতা হিসাবে তারা পিছিয়ে। এই লিঙ্গবৈষম্য একটি-দুটি দেশ ছাড়া পৃথিবীর সব দেশেই বিদ্যমান।

গুজরাটের এইচ এল ত্রিবেদী ইনস্টিটিউট অফ ট্রান্সপ্ল্যান্টেশন সার্ভিসেস নামে এক বড় হাসপাতালে গত দুই দশকের অঙ্গদানের সমীক্ষা করে গবেষকরা বলছেন, ২০০০-২০২০ পর্যন্ত যত কিডনি প্রতিস্থাপন হয়েছে, তার মধ্যে জীবিত দাতাদের ৭৯% মহিলা। জীবিত দাতাদের মধ্যে ৩৩.৭% গ্রহীতার মা, ২০% স্ত্রী। কন্যাদের সংখ্যা খানিকটা কম, বোনেদের সংখ্যা সব থেকে বেশি। আবার বোন যদি বিবাহিত হন তবে তাঁর স্বামী, শ্বশুরবাড়ির পরিবারের অনুমোদন নেওয়ার প্রয়োজন পড়ে। অবিবাহিতা মেয়েরা সাধারণত অঙ্গদান করেন না, কারণ এর সঙ্গে পরবর্তীকালে বিয়ে না হওয়ার সম্ভাবনা জড়িয়ে থাকে। শুধু একটি সমীক্ষা নয়, এদেশে যতগুলি সমীক্ষা হয়েছে সবেতেই লিঙ্গবৈষম্যের এই চিত্রই পাওয়া গেছে।

বলা বাহুল্য, জীবিত অঙ্গদানকারীদের মধ্যে বেশিরভাগের নারী হওয়া কোনো কাকতালীয় ব্যাপার নয়। পিতৃতান্ত্রিক ধারা বজায় রাখতে সমাজে এটি প্রচলিত প্রথা। এখনো ধরে নেওয়া হয়, পরিবারের পুরুষ হলেন ‘কর্তা’। তাঁর রোজগারে সংসার চলবে এবং নারীর ভূমিকা পরিচর্যা প্রদানকারীর। পরিবারের পুরুষকে সুস্থ রাখতেই হবে। এই ধারণার কারণেই মহিলারা অঙ্গদান করতে সহজেই প্রস্তুত হয়ে যান। জন্ম থেকেই পরিবারে নারীর মূল্য কম। কাজেই তার অঙ্গ প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন হলেও পরিবারের পুরুষরা এগিয়ে আসে না।

আরো পড়ুন গর্ভপাত নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় বহু মেয়েকে বাঁচাবে

সোশাল মিডিয়ায় প্রতীয়মান চকচকে জীবন আমাদের অনেকসময় ভাবতে শেখায় যে পিতৃতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মেয়েরা অনেকখানি এগিয়ে গেছে। ফেসবুক বা ইনস্টাগ্রামে ছবি দিয়ে অনেকেই বলে থাকেন, ভাইফোঁটায় আসলে ভাই, বোন দুজনেরই দীর্ঘায়ু কামনা করেছে আমাদের পরিবারের সদস্যরা। বোনফোঁটা, বৌমাষষ্ঠী অথবা মহিলা পুরোহিত – এসব চমক দিয়ে যে পিতৃতন্ত্রের গভীরে যে বৈষম্য লুকিয়ে আছে তা সরানো যাবে না। একথা আমাদের মনে রাখা দরকার।

ইদানীং কোনো কোনো ব্যবসায়িক সংস্থা নিজেদের প্রগতিশীল দেখাতে নিজেদের বিজ্ঞাপনে সাবেকি পিতৃতান্ত্রিক অনুষ্ঠানগুলিকে একটু অন্যভাবে উপস্থিত করছে। কখনো আমরা দেখছি ভাই-দুজ উপলক্ষে লিঙ্গান্তরিত (দাদা থেকে দিদি হওয়া) নারী ভাইকে তিলক পরাচ্ছে আর পরিবার তাতে খুব খুশি হচ্ছে। আবার কখনো দেখি কড়ওয়া চৌথের মত অনুষ্ঠানে স্বামী-স্ত্রী দুজনেই উপবাস করছেন। অথচ এই ধরনের পারিবারিক সব অনুষ্ঠানেই যে শুধু পুরুষদের দীর্ঘায়ু কামনা করা হয় তা সর্বজনবিদিত। পরিবার, বিবাহ এবং সম্পত্তির অধিকার অঙ্গাঙ্গী জড়িত – এই সহজ সত্য মেনে না নিয়ে বাইরে থেকে স্রেফ মোড়ক বদলে দিলে এদেশের নারীর অবস্থার বদল হবে কি? লিঙ্গবৈষম্যের রাজনীতি যথেষ্ট জটিল। এই বৈষম্যের বিরুদ্ধে লড়াইকে লঘু করে দেওয়ার প্রবণতার বিপক্ষে লড়াই করাও জরুরি।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.