ফেসবুকে এক মাস্টারমশাই লিখেছেন “পাড়ার মোড়ে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার্থী মেয়েটিকে জিজ্ঞেস করলাম, পরীক্ষা কেমন হয়েছে মা? মেয়েটি উত্তর দিল – খুব কড়া গার্ড দিয়েছে স্যার।” এ কোনো কাল্পনিক সংলাপ নয়, আজকের পরীক্ষা ব্যবস্থার গৌরচন্দ্রিকা মাত্র। দিন দশেক আগে মুর্শিদাবাদ জেলার ডোমকলে ছাত্র বিক্ষোভ হয়েছে। দাবি কী? পরীক্ষায় টোকাটুকির সুযোগ দিতে হবে, কারণ করোনার জন্য ঠিক মত প্রস্তুতি নেওয়া হয়নি। দাবি পূরণ না হওয়ায় দল বেঁধে অধ্যাপকদের উপর ইট বৃষ্টি হয়েছে। প্রায় একই সময়ে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার্থীরা নকল করার দাবিতে বিক্ষোভ দেখিয়েছে। মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে পরীক্ষায় টুকলির দাবিতে বিক্ষোভ, ভাঙচুর, শিক্ষক-শিক্ষিকাদের শারীরিক নিগ্রহ খুব সাধারণ খবরে পরিণত হয়েছে আজকাল।
ইংরেজি ‘মাস কপিইং’-এর বাংলা ‘গণটোকাটুকি’। সোজা কথায়, পরীক্ষকের সামনেই পরীক্ষার হলে টুকলি করার অবাধ স্বাধীনতা। ২০১৩ সালে ৬ আগস্ট গণটোকাটুকির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গিয়ে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শক দলকে হুমকির মুখে পড়তে হয়েছিল। ইসলামপুর কলেজে পরিদর্শকরা দেখেন, ২৫ জন ছাত্র তাঁদের সামনেই গণটোকাটুকিতে ব্যস্ত। বাধ্য হয়ে পরিদর্শকরা ওই ২৫ জনের খাতা বাতিল করার নির্দেশ দেন। বিপত্তির আরম্ভ তারপরেই। আসরে নামে তৃণমূল ছাত্র পরিষদ। পরিদর্শক দলকে হুমকি দেয়, আটকে রাখা হয়। পুলিস উদ্ধার করে। তৃণমূল ছাত্র পরিষদ বিবৃতি দেয়, কলেজের ভাল ছাত্রদের পরিকল্পনা মাফিক ফাঁসিয়েছে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিদর্শক দল। সে বছরেই ২৫ ফেব্রুয়ারি মাধ্যমিক পরীক্ষার প্রথম দিনে উত্তর দিনাজপুর জেলার ইসলামপুর মহকুমার বিভিন্ন ব্লকে দেদার গণটোকাটুকির জেরে ৩৫ জনকে পুলিস গ্রেপ্তার করে। বিরোধী দলের নেতাদের অভিযোগ ছিল, তৎকালীন শিক্ষামন্ত্রীর মন্তব্যের জেরেই এমন বেপরোয়া অবস্থা। পরিকল্পিতভাবেই পরীক্ষাকেন্দ্রে পুলিস ছিল অপ্রতুল। শিক্ষক-শিক্ষিকাদের হুমকি, মানসিক ও শারীরিক নিগ্রহের কারণে ইচ্ছা মত পরীক্ষা দেওয়ার, টুকলি করে উত্তর লেখার সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে বাংলায়। ২০২২ সালের ২৩ জুন সোশাল মিডিয়ায় একটি ভিডিও ছড়িয়ে পড়ে। তাতে দেখা যায়, জলপাইগুড়ি জেলার আনন্দচন্দ্র কলেজ অব কমার্সে উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন পরীক্ষা চলছে। ছাত্রছাত্রীরা বইখাতা খুলে দেদার টুকলি করছে। কেউ বা মোবাইল দেখে উত্তর লিখছে। কলেজের এক অধ্যাপক বলেন “অনলাইন পরীক্ষা হওয়ায় আমাদের কোনো নজরদারি থাকে না। তাই এ ব্যাপারে আমি কোনও মন্তব্য করব না। তবে আগেও দেখেছি অনলাইন পরীক্ষা বই দেখেই হয়।”
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
আমাদের রাজ্যে পরীক্ষায় নকল, গণটোকাটুকি এখন একটা সংস্কৃতি। অতীতে শোনা যেত প্রতিবেশী রাজ্য বিহারে এমন হয়। এখন আমাদের রাজ্যেও এসবের অবাধ স্বাধীনতা। উপরের ঘটনাগুলো সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত উদাহরণমাত্র। এমন ঘটনা আসলে অজস্র। ২০০৭-০৮ সাল থেকে এই সংস্কৃতির নবজন্ম হয়েছে। পরীক্ষার হলে যাঁরা পরিদর্শকের দায়িত্ব পালন করেন, তাঁদের মানসিক যন্ত্রণার কথা লিখে বোঝানো যাবে না। চোখের সামনে কিশোর-কিশোরীরা নকল করছে, বাধা দিলেই বিপত্তি। পরীক্ষা শেষে ভাংচুর চলতে পারে। পরিদর্শকদের অশ্রাব্য গালিগালাজ করা, গায়ে হাত তোলার মত ঘটনাও প্রায়ই ঘটে। তাঁরা অসহ্য যন্ত্রণায় সময় কাটান। মাথায় একটি কথাই খোদাই করে নেন “আপনি কিন্তু কিছুই দেখেননি, মাস্টারমশাই।”
এমন বেপরোয়া জঘন্য সংস্কৃতির নেপথ্যে আছে রাজনৈতিক মদত। আরও সহজ করে বলতে গেলে শাসক দলের মদতেই অতীতে যেমন বাংলার পরীক্ষা ব্যবস্থায় ঘুঘু চরেছিল, এখনো তাই। সাতের দশক যেমন বাংলায় ‘মুক্তির দশক’ ছিল, একইসঙ্গে রাজ্যটি হয়ে উঠেছিল ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য’ ইন্দিরা গান্ধীর অনুগামীদের মৃগয়াক্ষেত্র। কংগ্রেসি ছাত্রনেতারা কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছুরির ডগায়, বোমার স্প্লিন্টারে পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করত। ছাত্রনেতাদের জন্য আরামদায়ক এক পরীক্ষার হলের দৃশ্য উঠে এসেছে সত্যজিৎ রায়ের জন অরণ্য ছবিতে। পরীক্ষা হলে দেদার নকল চলছে, তুমুল কোলাহল। মাস্টারমশাই ভয়ে ভয়ে সবিনয়ে বলছেন “কী হচ্ছে ভাই?” টুকলি করতে ব্যস্ত ছাত্রদের একজন সকৌতুকে উত্তর দিচ্ছে “পরীক্ষা হচ্ছে ভাই।”
বাঙালি কোনোকালেই ইতিহাস চর্চা করেনি। ইতিহাস চর্চা করলে সত্তরের গণটোকাটুকি নিশ্চিতভাবে গবেষণার বিষয় হত। রাজনৈতিক প্রশ্রয়ে বাংলায় এই সংস্কৃতির জন্ম, আবার সরকারের রাজনৈতিক সদিচ্ছাতেই এই সংস্কৃতির বিলোপ ঘটেছিল। বামফ্রন্ট সরকার ক্ষমতায় আসার পর শিক্ষাক্ষেত্রে নৈরাজ্য দমনে কঠোর ভূমিকা নেয়, গণটোকাটুকি শব্দটি অভিধানে মুখ লুকোয়। আমরা যারা নয়ের দশকে মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি, তাদের কাছে ওসব গল্পকথা মনে হত। ২০০৫ সাল নাগাদ কিছুটা পরিবর্তন নজরে আসে। পরীক্ষার হল থেকে দূরে মাইক চালিয়ে উত্তর বলে দেওয়ার কিছু ঘটনা ঘটে। পুলিশের নজর এড়িয়ে ঢিল ছুঁড়ে উত্তর পৌঁছে দেওয়া চালু হয়। অভিভাবকরা কেউ কেউ চেষ্টা করতেন পরিচিত পরিদর্শকরা যদি পরীক্ষার হলে একটু সাহায্য করেন। তবে ওসব তখনো ব্যতিক্রম, নিয়ম নয়। পরীক্ষার হলে পরিদর্শক তখনো পরীক্ষার্থীদের কাছে সিংহের মত। একটু বেনিয়ম হলেই খাতা কেড়ে নেওয়া, ১০- ১৫ মিনিট বসিয়ে রাখার মত ঘটনা ঘটত। প্রশাসন সদর্থকভাবেই পরীক্ষা নিয়ন্ত্রণ করত।
দক্ষিণপন্থী রাজনীতির উত্থানের সঙ্গে সামাজিক অবক্ষয়, নৈতিক অধঃপতনের নিবিড় যোগ রয়েছে। পশ্চিমবঙ্গে ২০০৮ পরবর্তী সময়ে দক্ষিণপন্থী রাজনীতির মদতে পরীক্ষার হলে এক শ্রেণির অভিভাবক এবং শিক্ষকদের প্রচ্ছন্ন প্রশ্রয়ে অসদুপায় অবলম্বন করে পরীক্ষা দেওয়ার প্রবণতা সংক্রামক হয়। রাজনৈতিক অস্থিরতার কারণে পরিদর্শকরাও হেনস্থা হওয়ার ভয়ে চুপ করে থাকতে শুরু করেন। ক্ষমতা বদলের সাথে সাথে শাসক মদতপুষ্ট কিছু মানুষ পরীক্ষা ব্যবস্থা নিয়ে ছেলেখেলা আরম্ভ করে। এখন তা দুর্বার গতি পেয়েছে। বাংলার জেলা ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে, বিশেষ করে উত্তরবঙ্গ, মুর্শিদাবাদ, মালদা, উত্তর দিনাজপুরে টোকাটুকি সাধারণ প্রবণতায় পরিণত হয়েছে। বাধা দিলেই নিগ্রহ, বিক্ষোভ, ভাংচুর। অবাক করার মত ব্যাপার হল, ছাত্রছাত্রীদের পাশাপাশি অভিভাবকরাও নকল করার দাবিতে শিক্ষক নিগ্রহ করছেন। ভাইরাসের মত এই প্রবণতা উত্তরে জলপাইগুড়ি, কুচবিহার, আলিপুরদুয়ার জেলা, দক্ষিণে বীরভূম পর্যন্ত ছড়িয়েছে। বিস্তীর্ণ অঞ্চলে পরীক্ষায় অনৈতিক উপায় অবলম্বন করা দস্তুর হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজ্যের শাসক দল এখন অবধি এমন কোনো কাজ করেনি, যাতে বোঝা যায় গণটোকাটুকি বন্ধ করার কোনো ইচ্ছা আছে। বরং মুখ্যমন্ত্রীর বিভিন্ন সময়ের কিছু মন্তব্যে গণটোকাটুকি প্রশ্রয় পেয়েছে। সদ্য তিনি বলেছেন “না লিখতে পারলেও সমস্যা নেই। আমরা আছি। পাস হয়ে যাবে।” অভিভাবকরা রাস্তায় দাঁড়িয়ে অনুরণন তুলেছেন, দিদি আছে, পাস করে যাবে।
আরো পড়ুন আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য নিগ্রহ অন্ধকারে আলো ফেলেছে
সত্যজিতের শাখা প্রশাখা ছবির মত এখন সবাই দু নম্বরি। তাই নিয়মটাই বেনিয়ম। পরিচিত এক শিক্ষক নিজের মেয়েকে ইংরেজি মাধ্যমে ভর্তি করিয়েছেন। কারণ জানতে চাওয়ায় বললেন “প্রতি বছর মাধ্যমিক পরীক্ষার পরিদর্শক হয়ে পরীক্ষার হলে থাকি। সবই দেখি, কিছু বলতে পারি না। অসহায় হয়ে দেখি। পশ্চিমবঙ্গ মাধ্যমিক শিক্ষা পর্ষদের অবনমন প্রতিদিন দেখছি। আমি চাই না আমার সন্তান এই বোর্ডের অধীনে মাধ্যমিক পাশ করুক।” নকল, গণটোকাটুকি এখন এতটাই স্বাভাবিক হয়ে দাঁড়িয়েছে যে,বড় ধরণের বিশৃঙ্খলা, থানা-পুলিস না হলে খবর হয় না।
শাসকের মদত তো আছেই। সঙ্গে সঙ্গে অভিভাবকদের নৈতিক অধঃপতন, চুরি করে হলেও আরও বেশি নম্বর চাই – এই প্রবণতা ফিরিয়ে এনেছে গণটোকাটুকি। এই ব্যবস্থা গড়ে তুলছে মেরুদণ্ডহীন, অসৎ, লোভী এক প্রজন্ম।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।