সুরজিৎ পোদ্দার
যে সমস্ত বাড়িতে চোদ্দ পুরুষে কেউ কোনোদিন লিটল ম্যাগাজিন কথাটা অবধি শোনেনি, তেমনই এক বাড়িতে আমার বেড়ে ওঠা। বরানগরের নিউ তরুণ সিনেমার মাঠে এক স্কুল-পালানো দুপুরে কথাটা প্রথম চোখে পড়ে এক লিটল ম্যাগাজিন মেলায়, সেখানেই এক সবজান্তা দাদার কাছে লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরির কথা প্রথম শুনি। তারপর নানা মহাজাগতিক ঘটনার পক্ষপাতে ২০১৬ সালে আমাদের আনুষঙ্গিক পত্রিকার জন্য সন্দীপ দত্তর সাক্ষাৎকার নিতে যাই। এর আগে বেশ কয়েকবার ওঁকে দেখেছি মঞ্চে, মেলায়, একা একা হাঁটা মিছিলে। ফরেস্ট গাম্পের মত কোনো নৈর্ব্যক্তিক লক্ষ্য নিয়ে মিছিল নয়, একদম বস্তুগত উদ্দেশ্য। সরাসরি। জামায় বুকে মাথায় লিখে তাঁর দাবি “লিটল ম্যাগাজিন কিনে পড়ুন”। হয়ত সঙ্গে দু-একজন সাময়িক সঙ্গী।
এর বেশি ওঁকে নিয়ে বোধহয় আর কিছু বলার নেই। ওই জামায় বুকের উপরে লেখা পোস্টারেই তিনি নিজের জীবনের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথাটুকু বলে গেছেন। তারপরে স্রোতের মত পোকামাকড়ের উপদ্রব হয়ে আমাদের যাবতীয় কথাই অর্থহীন থেকে যাবে তাঁকে নিয়ে। কারণ সন্দীপ দত্ত শুধু কথার মানুষ নয়; কাজের মানুষ ছিলেন।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এই যে ‘ছিলেন’, এরপর? কিছুদিন সোশাল মিডিয়ায় দুঃখের উদযাপন: তাঁর ছবি, বক্তৃতা, স্মৃতিচারণ। তারপর? সভা-সমিতি, পত্রিকার বিশেষ সংখ্যা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ। তারপর?
“ডায়েরিতে লিখে রাখলাম শুরুর দিনটা – ২৩শে জুন, ১৯৭৮ সালে টিপ টিপ বৃষ্টি ছিল। আর লিখলাম – To do something constructive”, এইভাবেই তিনি স্মৃতিচারণ করেছেন আনুষ্ঠানিকভাবে “লিটল ম্যাগাজিন লাইব্রেরী ও গবেষণা কেন্দ্র” শুরুর। কোনো ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন নয়, ঘটা করে অনুষ্ঠান নয়, হাসি মুখে বাস্তবের ঝরা পালক শরীরের মানুষের সাজানো ছবি নয়, শুধু ওই ডায়রিতে লেখাটুকু ছাড়া কোনো ঐতিহাসিক তথ্য অবধি নেই উদ্বোধনের। এত এক ব্যক্তিগত উদ্বোধন – এর কাছাকাছি আসতে পারব আমরা যারা ছোট পত্রিকা করি, গবেষণা করি, লেখালিখি করি, যারা তাঁর কাছে আজীবন ঋণী? মনে রাখতে হবে, নকশাল আন্দোলন, বাংলাদেশ, উদ্বাস্তু সমস্যা, জরুরি অবস্থা, ভিয়েতনাম যুদ্ধ – এত কিছু বুকে নিয়ে সে এক উন্মার্গগামী বহির্মুখী সময়। একটা স্রোতের মত বয়ে যাচ্ছিল রাজনীতি আর জীবন। তার মধ্যেই তিনি বাঙালির সারস্বত চর্চার এক সমান্তরাল প্রতিষ্ঠান গড়ে তুললেন। কেন তুললেন? লিটল ম্যাগাজিন কী? সেসব তিনি বারবার ভাঙা রেকর্ডের মত বারবার বিভিন্ন সভায় বলেছেন।
১৯৮৭ সালে প্রকাশিত প্রসঙ্গ লিটল ম্যাগাজিন প্রবন্ধ সংকলনে যেমন আমেরিকায় প্রকাশিত দ্য ডায়াল পত্রিকাটিকে লিটল ম্যাগাজিনের আদি রূপ বলছেন, সেই একই কথা ২০২২ সালে পূর্ব মেদিনীপুর সাহিত্য আকাদেমির মেলায় গিয়েও বলেছেন। তেমনি তাঁর সিগারেট ছেড়ে পয়সা জমিয়ে পত্রিকা কেনার কথা, ন্যাশনাল লাইব্রেরিতে ছোট পত্রিকা অযত্নে রাখা এবং সেই দেখে একটি লাইব্রেরি করার ইচ্ছার কথা বারবার বলেছেন। কিন্তু আমরা কি কিছু শুনেছি? তিনি আমাদের স্মৃতিকে আমাদের সাথে বেয়াদবি করতে দেবেন না বলেই যেন এক কথা বারবার বলে গেছেন। কিন্তু আমরা কি কিছু মনে রাখতে পারব?
“আমি যখন শুরু করি, তখন ওই আজকালের মত ধুমধাম করে শুরু করিনি। আজকালকার মতো এই হঠাৎ কবিতা একাদেমি বানিয়ে ফেললাম, তা নয়। আসলে নতুন কিছু করার সময় ছিল উনিশ শতক, এখন তো পলায়নের সময়। পলাতক ভূমিকা।…আমারও প্রতিষ্ঠানবিরোধিতার জায়গাটা এসেছে, আমি তার (ন্যাশানাল লাইব্রেরী) স্বরূপের জায়গাটা দেখলাম। প্রতিষ্ঠান মানেই সর্বৈব সত্যি নয়। ছোটো করে হলেও তার বিরুদ্ধে তুমি কিছু শুরু করো।” এই তাঁর অ্যান্টিথিসিস। এর থেকে সংশ্লেষিত হয়ে তিনি দুম করে শুরু করে দেননি। প্রথমে ন্যাশনাল লাইব্রেরির কার্যকলাপের প্রতিবাদে বাড়ির ড্রয়িং রুম, সদর দরজার সামনের অংশে, যেখানে আজ লাইব্রেরি, সেখানে পার্ট টু পরীক্ষার পরে ৭৫০ পত্রিকা নিয়ে প্রদর্শনী করেন ২৩-২৭ সেপ্টেম্বর ১৯৭২। তারপর বহু জায়গায় ঘুরে ঘুরে প্রদর্শনী করেছেন দীর্ঘদিন। এই করতে করতে নিজের সংগ্রহ এবং চেনাশোনা অনেকের সংগ্রহ একত্র করে প্রায় দেড় হাজার পত্রিকা নিয়ে ‘৭৮ সালে শুরু করলেন লাইব্রেরি। এর মধ্যে ‘৭৭ সালে আংশিক সময়ের শিক্ষক হিসাবে মেদিনীপুরের রাধামোহনপুর স্কুলে নিযুক্ত হলেন। একশো টাকা মাইনে, কলকাতা থেকে প্রায় ঘন্টা দুয়েকের রাস্তা। তার পাশাপাশি কাজ নিলেন লোকসেবক পত্রিকায়, প্রায় ঘন্টা দুয়েকের রাস্তা, ৫০ টাকা মাইনে। তখনো তাঁকে সংসারের দায়িত্ব পালন করতে হত না। তাই প্রায় পুরো টাকাটাই ব্যয় হত পত্রিকা কিনতে।
আজকের স্টার্ট আপ, অন্ত্রেপ্রেনেয়ার অধ্যুষিত সভ্যতায় বিভিন্ন বিষয়ভিত্তিক মাস্টারক্লাসের মাঝে তাঁর এই সফর কি আমাদের কোনো শিক্ষা দেয়? এই যে একটা বড় কাজের আগের পূর্বপ্রস্তুতি, পরিকল্পনা, তারপর একটু একটু করে রূপায়ণ এবং পথ চলা। ১৯৭৯ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর সন্দীপ মেদিনীপুরের চাকরি ছেড়ে কলকাতায় সিটি কলেজ স্কুলে পুরো সময়ের চাকরি নেন ১৯৮১ সালের সেপ্টেম্বরে। মাইনে হয় ৫০০ টাকা, নিতে হয় সংসারের দায়িত্ব। প্রতি রবিবার বিভিন্ন সম্পাদকের থেকে পত্রিকা আনতে যান, কেউ কেউ ডাকে পাঠিয়ে দেয়। কেউ বিনা পয়সায় দেয়। সমস্ত সঞ্চয় ঢেলে প্রায় ৪৪ বছরে ৬০ হাজারের উপর পত্রিকার এক মহার্ঘ সংগ্রহ তৈরি করেছেন। বিনিময়ে জাগতিক লাভ কী হয়েছে? বাড়ি-গাড়ি-অর্থ?
“একটা জীবনের কতগুলো মোটো তৈরি করে নিতে হয়, আমি এটা বিশ্বাস করি। ধৈর্য্য-বিশ্বাস-ধারাবাহিকতা। তুমি যদি একটা জিনিসকে বিশ্বাস না কর, তাড়াতাড়ি যদি প্রাপ্তির চেষ্টা কর তাহলে কিন্তু টেঁকে না। তোমাকে ধৈর্য ধরতে হবে।” খুব জ্ঞানের বকুনি হয়ে আমাদের দৃষ্টি কি অন্য কোনোদিকে অমোঘ আকর্ষণ খুঁজে পাচ্ছে? এক প্রাচীন একঘেয়েমির প্রোপাগান্ডা হয়ে আমাদের উত্তরাধুনিক স্বাধীনতায় হাতুড়ির বাড়ি মারছে কি কথাগুলো? আমরা কি কোনো ভিন্ন সমাধান খুঁজে পেয়েছি বা পেতে পারি? আমাদের কি অভীষ্ট ভিন্ন? এই ধরনের গ্রন্থাগারের কি দিন ফুরিয়েছে?
প্রশ্নের ভিড়ে তথৈবচ এক সময়। সময় যদি খেই না হারায় তাহলে তার থেকে নতুন কিছু আসবে কী করে? সন্দীপ দত্তর কথায়, “ব্যাপারটা হচ্ছে সময়টা খুব গুরুত্বপূর্ণ। ‘৭০ সালের ১৫ই আগষ্ট, আমি দেখলাম জাতীয় পতাকা পুড়ছে। তার ধরো একবছর আগে, নকশালবাড়ি ‘৬৯-এর পয়লা মে প্রতিষ্ঠিত হল। তখন বিভিন্ন জায়গায় স্লোগান এল ‘চিনের চেয়ারম্যান আমাদের চেয়ারম্যান’। ‘দেশব্রতী’ প্রভৃতি কাগজের লিফলেট দেখতে লাগলাম। ওই সময়ই ডিসেম্বরে ‘পত্রপুট’ বের করলাম। নিজের অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে সময়টাকে বুঝতে লাগলাম। তখন কাগজের বেশী দাম ছিল না। ১০ পয়সা, ১৫ পয়সা এইরকম। এইসব পত্রিকা দেখতে দেখতে, রাজনীতি দেখতে দেখতে, সেইসব নকশাল ছেলেদের দেখতে দেখতে, তরুণদের উপর যে কী টর্চার, গুলির আঘাত, রাতে বোমার আওয়াজ, অসীম চ্যাটার্জী ‘কাকা’ প্রেসিডেন্সিতে ট্রামের উপর উঠে বক্তৃতা দিচ্ছে, পুলিশ সার্চ করছে পথে-ঘাটে, কলেজে যাওয়ার থলে সার্চ করছে। এরপর ’৭৫ সালের ইমার্জেন্সি। সেইসময় ‘কলকাতা’ বলে একটি পত্রিকা বেরোত – জ্যোতির্ময় দত্ত, গৌরকিশোর ঘোষ করত। এরা ইমার্জেন্সির বিরুদ্ধে লিখল, ইমার্জেন্সি উঠে যাওয়ার পরেও লিখল। পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত হল। এই যে এক অন্যরকম সংস্কৃতি। সংস্কৃতির যে সততার জায়গা, এই যে নতুন কিছু ভাবনাকে দেখার জায়গা, একে প্রশ্রয় দিয়েছিল সেই সময়ের তরুণরা। ‘গ্রাম দিয়ে শহর ঘেরো’ শুধুমাত্র রাজনৈতিক স্লোগান নয়। এর পিছনে সাংস্কৃতিক বাতাবরণ ছিল।
যখন ’৭১ সালে আমরা পরীক্ষা দিলাম, দেখলাম গণ-টোকাটুকি চলছে। তখন হোম-সেন্টারে পরীক্ষা হত। আমরা সেইসব ঘটনার ভিক্টিম। পরের দিন স্কটিশ এবং প্রেসিডেন্সির পরীক্ষা বাতিল হল। পরে গোয়েনকাতে পরীক্ষা দিলাম। ‘পরিচয়’তে অমলেন্দু চক্রবর্ত্তী অসাধারণ গল্প লিখেছিলেন ‘দেবশিশু’ বলে – চারিদিকে গণ-টোকাটুকি চলছে তার মধ্যে একজন নিজে একা পরীক্ষা দিচ্ছে। এইসব দেখলাম। তারপর ওই ন্যাশানাল লাইব্রেরীর লিটল ম্যাগাজিনের প্রতি যে ব্যবহার তাতে অবাক হলাম। এত যে কাজ হচ্ছে, ভালো ভালো কাজ। সেইসব সংরক্ষণের ভাবনা থেকেই জেদে শুরু করি।”
আমাদের কি সেই জেদ আছে? সেই জেদ যার বশে আমরা দীর্ঘদিন অতি যত্নের সঙ্গে, ধৈর্যের সঙ্গে, অহঙ্কার ও অবজ্ঞার থেকে শত হস্ত দূরে শুধু নিজের লক্ষ্যে অবিচল থেকে যেতে পারব? শুধুমাত্র পথ চলাকেই অভীষ্ট মনে করতে পারব আমরা? নিজেদের সংলাপকেই মতবাদের রূপ কি দিতে পারব কোনোদিন? জীবনযাপনকে করে তুলতে পারব সাহিত্যের মত?
আরো পড়ুন বাইশে শ্রাবণে নিরলস সাহিত্যসাধকদের সম্মাননা প্রদান
সন্দীপ দত্ত নেই। আর কোনোদিন তিনি অশক্ত শরীরে লিটল ম্যাগাজিন প্যাভিলিয়নে এসে বসবেন না কোনো অচেনা লিটল ম্যাগাজিনের টেবিলে, একা হাঁটবেন না কোনো মিছিলে, খবর পেয়ে ছুটে যাবেন না কোথাও নতুন লিটল ম্যাগাজিন মেলা হচ্ছে শুনে, পরিচয় করিয়ে দেবেন না নবদ্বীপের ক্ষুদ্র পত্র-পত্রিকা সংরক্ষণ কেন্দ্রের তপন ভট্টাচার্যের সঙ্গে, লাইব্রেরিতে গেলে আর খোঁজ নেবেন না পত্রিকা কেমন চলছে। কিন্তু আমরা এরপর কী করব? প্রতিটি মহাজাগতিক বিরল ঘটনার পর এই প্রশ্ন জরুরি। এর উত্তর হাতড়ানোর মধ্যে দিয়েই তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে পারি আমরা। অন্য কোনো উপায় নেই।
সূত্র: আনুষঙ্গিক, তৃতীয় সংখ্যা, ২০১৬
নিবন্ধকার শখের বাতেলাবাজ, উত্তর কলকাতায় এই প্রজাতির মানুষদের ঘরবাড়ি। লেখালিখি করে বাতেলাকেই প্রতিষ্ঠা করতে নানা ফন্দি আঁটেন, তারই রকমফের আনুষঙ্গিক পত্রিকা, যা বিগত সাত-আট বছর ধরে বন্ধুদের সঙ্গে প্রকাশ করে আসছেন। যাপনচিত্র ওয়েব পত্রিকার সম্পাদনাতেও যুক্ত। মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।