ভারতের সমস্ত জাতীয় স্তরের খবরের চ্যানেলের এখন আলোচ্য বিষয়বস্তু, যে আম আদমি পার্টি রাজনীতিতে জায়গা করে নিয়েছিল দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে, সেই দলের উপমুখ্যমন্ত্রী নিজেই যদি দুর্নীতিগ্রস্ত হন তাহলে কার কাছে আশা করবে মানুষ? অনেকে প্রশ্ন তুলছেন, যে পার্টি বিজেপি আর কংগ্রেসের বিকল্প হয়ে ওঠার কথা বলেছিল, সেই দলের প্রথম সারির নেতা মন্ত্রীরা যদি দুর্নীতির দায়ে জেলে যান, তাহলে নতুন প্রজন্ম কী দেখে রাজনীতিতে আসবে? অনেকেই বলছেন, যে যায় লঙ্কায় সে-ই হয় রাবণ। কেউ কেউ বলছেন, তাহলে পাঞ্জাবে এবং গুজরাটে যে আম আদমি পার্টি নির্বাচনে লড়ল, তা কি এই দুর্নীতির টাকায়? অবশ্য আম আদমি পার্টির যে ওয়েবসাইট আছে তাতে কেউ টাকা দিলে সেই টাকার প্রাপ্তিস্বীকার করা থাকে। তাঁদের পার্টির কাছে কোনো হিসাব বহির্ভূত টাকা নেই, তা এখনো জোর গলায় বলে চলেছেন মুখপাত্ররা। তবু দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রী মনীশ সিসোদিয়ার গ্রেপ্তারি একটা কথা প্রমাণ করছে, যে আম আদমি পার্টিও ধোয়া তুলসীপাতা নয়। একদিকে যখন জাতীয় স্তরের মিডিয়ায় দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রীর দুর্নীতি নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা চলছে, বাংলার চ্যানেলগুলোতে কী দেখাচ্ছে? সরকারি স্কুলে নিয়োগ কেলেঙ্কারিতে কোন তৃণমূল নেতা কত টাকা নিয়েছেন, কার কাছ থেকে কত টাকা পাওয়া যাচ্ছে, কার কতজন বান্ধবী আছে। সেই বান্ধবীরা কে কী করতেন, সেই নেতা মন্ত্রীদের সঙ্গে মিলে তাঁদের কার নামে কত সম্পত্তি ইত্যাদি। বান্ধবীদের কার সঙ্গে টলিউডের যোগ আছে ইত্যাদি। শুধু টেলিভিশন বা সোশাল মিডিয়ায় নয়, রাস্তাঘাট, চায়ের দোকান, অফিস, আদালত – সর্বত্র এখন একটাই আলোচনা। বাংলার মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জির সততার প্রতীক হওয়া কি তাহলে পুরোপুরি ভাঁওতা? তিনি কি জানতেন না, যে তাঁর মন্ত্রীসভার গুরুত্বপূর্ণ সদস্যরা দুর্নীতিগ্রস্ত?
তৃণমূল কংগ্রেস তো ঘোষিতভাবে মানুষের থেকে অনুদান বা চাঁদা নেয় না। তাহলে দল চলে কী করে? এই যে ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনে তৃণমূল কংগ্রেস এত টাকা খরচ করল, এই যে তাঁরা প্রশান্ত কিশোরের মতো একজন ভোটকুশলী এবং তাঁর সংস্থা আইপ্যাকের সাহায্য নিল, তার খরচ কে দিল? বাংলা জুড়ে যে মমতার ছবি দেওয়া, ‘দিদিকে বলো’, ‘বাংলার গর্ব মমতা’ এবং শেষে ‘বাংলা নিজের মেয়েকেই চায়’ ক্যাম্পেন করা হল – তার খরচ কে জুগিয়েছে? অবশ্য এ প্রশ্নের একটা উত্তর পাওয়া গেছে। মমতার দল সংসদে যে নির্বাচনী বন্ডের বিরোধিতা করেছিল, সেই বন্ডের মাধ্যমেই শুধুমাত্র ২০২১-২২ সালে তারা প্রায় ৫২৮ কোটি টাকা পেয়েছে। ২০২০-২১ সালে যে তহবিলে জমা ছিল মাত্র ৪২ কোটি টাকা, তা এক বছরে এতখানি বৃদ্ধি পাওয়ার কারণ কী? কে বা কারা এত টাকার বন্ড কিনেছে তা অবশ্য জানা যায়নি, জানতে পারার কথাও নয়। নির্বাচনী বন্ডের মজাই সেইখানে। ফলে মানুষ নিজের ইচ্ছামত যা খুশি অনুমান করে নিতে পারে। অনেকে মনে করছেন মোদী-ঘনিষ্ঠ শিল্পপতি গৌতম আদানিই নাকি এই টাকার উৎস। একথা সত্যি কিনা, সত্যি হলে বিনিময়ে তিনি কিছু পেয়েছেন কিনা সেটাও স্বভাবতই অজানা। যা জানা তা হল বিধানসভা নির্বাচনের পর আদানিকে নবান্নে মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে করমর্দন করতে দেখা গিয়েছিল। পরে এক অনুষ্ঠানে ঘোষণা করা হয়, দেউচা পাঁচামির খোলামুখ কয়লাখনি এবং তাজপুর বন্দর সমেত আর কিছু বন্দর আদানির হাতে তুলে দেওয়া হবে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
২০১৪ সালের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকারের অধীন তদন্ত সংস্থাগুলো যে ১২৪ জন রাজনীতিবিদকে চাঁদমারি করেছে, তার মধ্যে ১১৮ জনই বিরোধী দলের, অর্থাৎ প্রায় ৯৫%। নিন্দুকেরা বলে থাকেন, যদি এই নেতারা বিজেপিতে যোগ দিতেন, তাহলে আর তাঁদের দুর্নীতি নিয়ে কথা হত না। এর সবচেয়ে বড় উদাহরণটা সম্ভবত পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভার বিরোধী দলনেতা শুভেন্দু অধিকারী। বিজেপিকে ওয়াশিং মেশিন বলা তো এখন দস্তুর হয়ে গেছে। শুভেন্দুকে তৃণমূলে থাকাকালীন নারদ স্টিং অপারেশনে হাত পেতে টাকা নিতে দেখা গিয়েছিল। অথচ তিনি এখন অপাপবিদ্ধ হয়ে গেছেন এবং জোর গলায় তৃণমূলের দুর্নীতি নিয়ে বলতে রোজ ক্যামেরার সামনে আসছেন। দিল্লির মুখ্যমন্ত্রী অরবিন্দ কেজরিওয়াল তো সরাসরি বলেছেন, মনীশ যদি বিজেপিতে যোগ দেন, তাহলে বেকসুর খালাস পেয়ে যাবেন।
এবার আসা যাক দিল্লির উপমুখ্যমন্ত্রীর গ্রেপ্তারি এবং বাংলার শিক্ষাজগতের দুর্নীতি নিয়ে হইচই চলতে থাকলে কার লাভ হবে সেই প্রসঙ্গে। প্রথমত, এ জিনিস চলতে থাকলে এটা প্রমাণ করা যাবে যে বিজেপি দুর্নীতির সঙ্গে আপোস করে না। দ্বিতীয়ত, এটা বোঝানো সম্ভব হবে যে কেজরিওয়াল বা মমতার সঙ্গে বিজেপির যোগসাজশ আছে বলে যে অনেক রাজনৈতিক দল অভিযোগ করে – তা মিথ্যা। বরং এরাই বিজেপির মূল প্রতিপক্ষ। এমনিতে বিজেপি চায় কংগ্রেসমুক্ত ভারত। আপ, তৃণমূল নিয়ে হইচই চলতে থাকলে মানুষের মনে কংগ্রেস, বিশেষ করে রাহুল গান্ধীকে নিয়ে যে আগ্রহ তৈরি হয়েছে, তা প্রশমিত হবে। রাহুলের ভারত জোড়ো যাত্রা, যা দেশের মানুষের মধ্যে সামান্য হলেও আশার সঞ্চার করেছে যে এখনো ভালবাসা দিয়ে ঘৃণা ও বিদ্বেষের রাজনীতির বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তোলা সম্ভব, তা থেকে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেওয়া যাবে। তৃতীয়ত, প্রধানমন্ত্রী মোদী এবং আদানির যোগসাজশ নিয়ে যে প্রশ্ন রাহুল এবং কংগ্রেস করে চলেছে, তা থেকেও মনোযোগ অন্য দিকে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। কংগ্রেসকে মাঝে রেখে যে বিরোধী ঐক্য গড়ে তোলার চেষ্টা হচ্ছে তা আটকানো যাবে। জাতীয় স্তরে কেজরিওয়াল আর মমতার বিরুদ্ধেই যে আসল লড়াই, তা প্রমাণ করতেই ওঁদের নেতা, মন্ত্রীদের পিছনে সিবিআই, ইডি ইত্যাদি লেলিয়ে দেওয়া।
কংগ্রেস নেতাদের ওই তদন্তকারী সংস্থাগুলো তলব করলেও সোনিয়া গান্ধী কিংবা রাহুলকে গ্রেপ্তার করেনি। কারণ তাঁদের গ্রেপ্তার করলে কংগ্রেস বেশি প্রচার পাবে। বিজেপি তা চায় না। তাদের একটাই উদ্দেশ্য – কংগ্রেসমুক্ত ভারত। তার জন্য এ খেলায় আপত্তি নেই। বিজেপি জানে, যদি এই মুহূর্তে বাংলায় তৃণমূল কংগ্রেস এবং দিল্লিতে আপকে ক্ষমতা থেকে সরিয়ে দেওয়া যায়, তাহলে বিজেপি ক্ষমতায় এলেও বিরোধী পরিসর কংগ্রেস এবং বামেদের দখলে চলে যাবে। রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সঙ্ঘ তা চায় না। তারা এই দুই জায়গাতেই বিরোধী পরিসরও দক্ষিণপন্থীদের দখলে রাখতে বদ্ধপরিকর। যাতে গোটা রাজনৈতিক ভাষ্য তারা নির্ধারণ করতে পারে। সুতরাং বাংলায় বামপন্থী এবং দিল্লিতে কংগ্রেসকে বিরোধী পরিসর দখল করতে হলে শুধুমাত্র ক্ষমতায় আপ বা তৃণমূলের বিরোধিতা করলে চলবে না। আরও বেশি করে বিজেপির রাজনীতি এবং অর্থনীতিকে আক্রমণ করতে হবে। অথচ হচ্ছে ঠিক উল্টো। এত বেশি ওই দুই রাজ্যের ক্ষমতাসীন দলকে নিশানা করা হচ্ছে যে বিজেপির সুবিধা হচ্ছে।
আরো পড়ুন সাগরদীঘিতে তৃণমূলের ভরাডুবি যেসব প্রশ্ন তুলে দিল
অনেকে প্রশ্ন করতে পারেন, তাহলে কি তৃণমূল বা আপের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ মিথ্যা? অবশ্যই মিথ্যা নয়। কিন্তু এই দলগুলোর বিরুদ্ধে আন্দোলন তো আর ইডি কিংবা সিবিআইয়ের মত কেন্দ্রীয় সংস্থাগুলো করবে না। করতে হবে মানুষকে। তাঁদের সংগঠিত করার কাজটা কি বামপন্থীরা এবং কংগ্রেস করছে? ভারত জোড়ো যাত্রায় হয়ত রাহুলের ব্যক্তিগত ভাবমূর্তির উন্নতি হয়েছে, কিন্তু কংগ্রেসের সংগঠন কি বেড়েছে? পশ্চিমবঙ্গে বামপন্থীদের সংগঠন কি আগের চেয়ে জোরালো হয়েছে? ২০২৪ লোকসভা নির্বাচনের আর বেশি দেরি নেই। কিন্তু বিরোধীরা কি প্রস্তুত একজোট হয়ে বিজেপির মোকাবিলা করতে?
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।