আমি যাদের কথা লিখছি বা যাদের হয়ে লিখছি তারা কেউই কলকাতা মহানগরের মানুষ নয়। তারা আমার মতই গ্রাম বা মফস্বল থেকে উঠে আসা নব্বইয়ের দশকের মানুষজন, যারা তাদের পরিবারের স্কুল-কলেজে যাওয়া প্রথম বা দ্বিতীয় প্রজন্ম মাত্র। আমি তাদের কথা বলতে চাইছি যারা সরকারি স্কুল-কলেজের সৌজন্যে উচ্চশিক্ষার পথে পা রাখতে পেরেছিল বা এখনো পারছে।

আমাদের সামনে নানারকম কেরিয়ারের একগুচ্ছ সুযোগ ছিল না, হয়ত এখনো খুব বেশি নেই। আমরা বারো ক্লাসের ফলাফলের ভিত্তিতে কোনো ভালো কলেজে ভালো বিষয় নিয়ে অনার্স পড়তে ভর্তি হতাম। মাস্টার্সের চান্স পেলে ভাল, না হলে বিএড বা ডিএড প্রশিক্ষণ নিয়ে স্কুল সার্ভিস অথবা সরকারি চাকরির প্রস্তুতি নিতাম। যারা মফস্বলের গণ্ডি ছাড়িয়ে বড় শহরের বিশ্ববিদ্যালয়ে পা রাখত, তারা গবেষণা করা বা কলেজে পড়ানোর প্রস্তুতি নিত।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আমরা কেন সরকারি চাকরির পিছনে দৌড়তাম? কারণ বোধহয় ছিল সরকারি চাকরির স্থায়িত্ব এবং আর্থিক নিরাপত্তা। বেসরকারি ক্ষেত্রে যাঁরা চাকরি করেন, তাঁরা হামেশাই চাকরি যাওয়ার আশঙ্কায় থাকেন। সে আশঙ্কা যে অমূলক নয় তা অতিমারীর সময়েই আমরা দেখেছি। বেসরকারি ক্ষেত্রে গণহারে ছাঁটাই হয়েছে। অসংখ্য মানুষ কাজ হারিয়েছেন।

এই মুহূর্তে আমাদের রাজ্যে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ দুর্নীতি নিয়ে চারিদিকে প্রচণ্ড হইচই চলছে। দুর্নীতি যে হয়েছে তা নিয়ে বোধহয় আর কারোর সংশয় নেই। সাদা খাতা জমা দিয়ে চাকরি পাওয়া, পিসি সরকারকে হার মানানো জাদুতে বিসিএস পরীক্ষার নম্বর বেড়ে বিডিও হওয়া, একাধিক অভিযোগে বিদ্ধ হয়েছে রাজ্য প্রশাসন। প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী, উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য সমেত শিক্ষা দপ্তরের একাধিক শাঁসালো কর্তা এই মুহূর্তে কারান্তরালে। চাইলে রাজ্য সরকার সেখানেই একটা সমান্তরাল শিক্ষা দপ্তর খুলে ফেলতে পারে।

শাসকপক্ষ দুটো কথা আমাদের এই কদিনে চিনিয়ে দিয়েছেন। এক, কোনো মামলা হলেই তা “সাব জুডিস ম্যাটার”। আর দুর্নীতির অভিযোগ ওঠা নিয়োগগুলো হল “ব্যতিক্রমী নিয়োগ”। সবথেকে বেশি নজরে পড়েছে স্কুলে নিয়োগ সংক্রান্ত দুর্নীতি। গত দশ বছরে এই নিয়োগে ঠিক কতটা জল মিশেছে তা খোদায় মালুম। বিচারবিভাগ সক্রিয় না হলে যে সরকার এ নিয়ে কিচ্ছু করত না, তা নিয়েও দ্বিমত থাকার কথা নয়।

স্কুল সার্ভিসের প্রার্থীরা ধর্মতলার ধর্নামঞ্চে বসে আছেন সাতশো দিন হতে চলল, সরকারের যথারীতি তা নিয়ে হেলদোল নেই। উলটে কার্নিভাল নামক সার্কাস (কারোর এই শব্দ ব্যবহার খারাপ লাগলে আমায় মার্জনা করবেন, কিন্তু উত্তরবঙ্গের মালবাজারে ভয়াবহ দুর্ঘটনার পরেও কার্নিভালকে আমার নিষ্ঠুর সার্কাস ছাড়া আর কিছুই মনে হয়নি) চলাকালীন ধর্নামঞ্চ সাদা কাপড়ে ঢেকে দেওয়া হল যাতে অতিথি অভ্যাগতদের চোখে না পড়ে। সহনাগরিকদের মনে থাকতে পারে, ট্রাম্প বাবাজি যখন এদেশে পা রেখেছিলেন, তখন গুজরাট সরকার একইভাবে বস্তিগুলোকে রাতারাতি পাঁচিল তুলে আড়াল করার চেষ্টা করেছিল।

এবার আমাদের বিদ্যায়তনে নিয়োগের বিষয়টা সাধ্যমত একটু বোঝানোর চেষ্টা করি। এমনিতে অন্যান্য সরকারি চাকরিতে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের পরীক্ষায় পাওয়া নম্বরের খুব একটা গুরুত্ব নেই। গ্র্যাজুয়েট হলেই আইএএসের মত সর্বোচ্চ স্তরের পরীক্ষায় বসা যায়। কিন্তু বিদ্যায়তনিক নিয়োগের ক্ষেত্রে মাধ্যমিক থেকে শুরু করে সবকটা পরীক্ষায় কত শতাংশ নম্বর পেয়েছি তার উপরে স্কোরিং হয়। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্ষেত্রে অ্যাকাডেমিক পেপার প্রকাশ, গবেষণা এবং শিক্ষকতার অভিজ্ঞতার উপরেও নম্বর থাকে। স্কুলে নিয়োগের ক্ষেত্রে একটা লিখিত পরীক্ষা হয়। তাতে পাস করলে ইন্টারভিউতে ডাক পড়ে। ইন্টারভিউয়ের পর লিখিত পরীক্ষার নম্বর, অ্যাকাডেমিক স্কোর এবং ইন্টারভিউতে প্রাপ্ত নম্বর – এই তিনটে যোগ করে শূন্য পদের অনুপাতে ক্যাটেগরিভিত্তিক চূড়ান্ত প্যানেল তৈরি হয়।

ইন্টারভিউতে সাধারণত দশ নম্বর থাকে। সুতরাং যার অ্যাকাডেমিক স্কোর ভাল এবং লিখিত পরীক্ষায় ভাল নম্বর পেয়েছে, সে মাঝারি মানের ইন্টারভিউ দিলেও প্যানেলে থাকার দাবিদার হয়ে ওঠে। শেষ স্কুল সার্ভিসের নিয়োগের যে স্কোরশিট আদালতের ধমকের পর প্রকাশিত হয়েছে, তাতে দেখা যাচ্ছে অনেক প্রার্থী, যাদের অ্যাকাডেমিক স্কোর মাঝারি বা নিচের দিকে, তারা লিখিত পরীক্ষায় দারুণ নম্বর পেয়েছে আর ইন্টারভিউতে সাড়ে নয় থেকে দশে দশ অবধি পেয়ে গেছে। অথচ যাদের অ্যাকাডেমিক স্কোর এবং লিখিত পরীক্ষার নম্বর – দুটোই প্রথম দিকের, তাদের অনেকের কপালেই ইন্টারভিউতে পাঁচ-সাড়ে পাঁচের বেশি জোটেনি। তার উপর যারা অ্যাকাডেমিক স্কোর নিচের দিকে থাকা সত্ত্বেও লিখিত পরীক্ষায় দারুণ নম্বর পেয়েছে, তাদের প্রায় সবার নম্বরই ৫৩ থেকে ৫৫।

এই ব্যাপারগুলোই নিয়োগ প্রক্রিয়াকে সন্দেহের মুখে ফেলে দিচ্ছে। আমরা দেখেছি, গত এগারো বছরে স্কুল সার্ভিসে নিয়োগ নিয়মিত হয়নি। এখানে একটা কথা বোঝা দরকার। আমাদের রাজ্যে অ্যাকাডেমিক স্কোরের হার প্রতি বছর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ২০১২ সালে যারা কলা বিভাগে গ্র্যাজুয়েট হয়েছিল তাদের নম্বর থাকত গড়ে ষাট থেকে সত্তর শতাংশ। যারা অ্যাকাডেমিক স্কোরে এগিয়ে থাকে, তাদের কথা বলছি। ২০১৭ সালের পর যারা পাশ করেছে তাদের অনেকেরই স্নাতক স্তরে নম্বর নব্বই শতাংশের বেশি। ফলে অ্যাকাডেমিক স্কোরিংয়ের সময়ে আগে পাস করা প্রার্থীরা অনেকটাই পিছিয়ে পড়বে। এই মুহূর্তে সল্টলেক করুণাময়ীতে ২০১৪ সালের প্রাথমিক টেটের যেসব প্রার্থী আমরণ অনশনে বসেছে, তারাও এই নতুন প্রার্থীদের সাথে বিদ্যায়তনিক নম্বরের দৌড়ে পিছিয়ে থাকার ভয়টাই প্রকাশ করেছে।

আগের পর্ষদ সভাপতি জেলযাত্রা করার পর, বর্তমানে যিনি পর্ষদ সভাপতি হয়েছেন তিনি সংবাদমাধ্যমে সঠিকভাবেই জানিয়েছেন, টেট পাস করা চাকরি পাওয়ার গ্যারান্টি নয়, ইন্টারভিউতে বসার ছাড়পত্র মাত্র। প্রসঙ্গত, কেন্দ্রীয় সরকারও বছরে দুবার করে টেট পরীক্ষা নিয়ে থাকে। কিন্তু সমস্যা অন্যত্র। বর্তমান পর্ষদ সভাপতি জানাচ্ছেন, এরা আগে দুবার ইন্টারভিউতে অকৃতকার্য হয়েছে। সুতরাং কারোর বয়স ঊর্ধ্বসীমা ছাড়িয়ে গেলেও কিছু করার নেই। কিন্তু এখন অব্দি আদালতের রায়ে অনেকটাই স্পষ্ট যে আগের দুই দফাতেই প্রভূত কেলেঙ্কারি ধরা পড়ার সম্ভবনা রয়েছে। সুতরাং এরা যে ন্যায্য বিচার পায়নি তা বলাই বাহুল্য।

পর্ষদ এবং সরকারের একের পর এক বিভ্রান্তিকর মন্তব্য পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে। রাজ্য সরকার বলছে বিরোধীরা ইচ্ছা করে নিয়োগ নিয়ে মামলা করছে। কিন্তু তারা যা সযত্নে এড়িয়ে যাচ্ছে তা হল এই নিয়োগ নিয়ে আগেই একাধিক অভিযোগ খোদ মুখ্যমন্ত্রীর দপ্তরে জমা পড়ার পরেও তারা উচ্চবাচ্য করেনি। বঞ্চিত প্রার্থীরা বাধ্য হয়েই আইন-আদালতের শরণাপন্ন হয়েছে। এই নিয়োগ সংক্রান্ত দীর্ঘসূত্রিতার দায় একান্তই রাজ্য সরকারের এবং দুর্নীতির ব্যাপক অভিযোগ ওঠায় সরকার শিক্ষিত বেকারদের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। অবশ্য এসব নিয়ে রাজ্য সরকার এবং তাদের শিক্ষা দপ্তর আদৌ ভাবিত – এরকম অভিযোগ তাদের অতি বড় শত্রুও করবে না। তারা খেলা, মেলা এবং কার্নিভাল নিয়ে ব্যস্ত। সামনে পঞ্চায়েত ভোট। আগের পঞ্চায়েত ভোটেই দেখা গেছিল যে তারা জনমতের উপর খুব একটা ভরসা করে না। এবার কী হয় সেটাই দেখার।

আরো পড়ুন স্কুল সার্ভিস কমিশন: একটা প্রজন্মকে পথে বসিয়ে দেওয়া হল

তাহলে এই ছেলেমেয়েগুলোর কী হবে? স্বচ্ছ নিয়োগ কি আদৌ হবে? যারা দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছে, তাদের চাকরি কি যাবে? অনেকগুলো জরুরি প্রশ্ন। আমরা তদন্তকারী সংস্থা এবং আদালতের উপর ভরসা রাখার চেষ্টা করছি। চেষ্টা করছি কথাটা লিখছি, কারণ গণতান্ত্রিক অভিজ্ঞতায় অনেক ক্ষেত্রেই পূর্ব অভিজ্ঞতা সুখকর নয়।

একদল অতি সচ্ছল সরকারপন্থী মানুষ সমানে জ্ঞান দিয়ে যাচ্ছেন, এরা চাকরির পিছনে না ছুটে ব্যবসা করছে না কেন? অতিমারীর পর এদেশে অসংগঠিত ক্ষেত্রে ছোট ব্যবসার কী হাল হয়েছে তা নিয়ে আদৌ কোনো ধারণা আছে এঁদের? যে কোনো শহরের ফুটপাথে একটা ডালা নিয়ে বসতেও আজকাল স্থানীয় দাদাদের সেলামি দিতে হয়। সে টাকা কি এই জ্ঞানদাতারা দিয়ে যাবেন? তার চেয়েও বড় কথা, এঁরা হোয়াইট কলার কাজ করেন। নিজেদের ছেলেমেয়েদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত পড়িয়ে অসংগঠিত ক্ষেত্রের ছোট ব্যবসায় নামতে উৎসাহ দেবেন তো? নাকি সব জ্ঞানই অপরকে বিলোবার জন্য?

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.