রাজ্য সরকারের অধীন সমস্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীদের জন্য ঋতুকালীন ছুটি ঘোষণা করে কেরালা সরকার এক নতুন দৃষ্টান্ত স্থাপন করল। এর আগে কিছু বড় কর্পোরেট মহিলা কর্মচারীদের জন্য ঋতুকালীন ছুটি ঘোষণা করলেও ছাত্রীদের জন্য এ ধরনের উদ্যোগের খবর আমরা ভারতবর্ষে আগে শুনিনি। বলাই বাহুল্য, এই ধরনের ঘোষণা হলে নেতিবাচক আলোচনা খুব বেশি চোখে পড়ে। বিশেষ করে সোশাল মিডিয়ার যুগে নানা মুনির নানা মত শুনতে পাওয়া যায়। এই নেতিবাচক আলোচনাগুলো থেকে যেসব কথা সম্পূর্ণভাবে বাদ পড়ে যায়, তা হল ভারতের বহু স্কুলপড়ুয়া, কলেজপড়ুয়া মেয়ে লেখাপড়া ছেড়ে দেয় ঋতুকালীন অসুবিধার জন্য।

এই আলোচনার মধ্যে যে কথাটা বাদ পড়ে যায় সেটা হল ঋতুকালীন দারিদ্র্য (period poverty)। জনস্বাস্থ্য নিয়ে বেশ কিছু লেখাপত্র পড়লে বোঝা যায় ঋতুকালীন দারিদ্র্য আমাদের দেশের মেয়েদের কতটা পিছিয়ে দিচ্ছে। শুধুমাত্র স্যানিটারি প্যাড কেনার আর্থিক অক্ষমতা নয়, ঋতুকালীন সমস্যা নিয়ে কথা বলা লজ্জার বিষয় হিসাবে ভারতে দেখা হয়। ঋতুকালীন ছুটি নিয়ে যাঁরা হাসাহাসি বা ব্যঙ্গবিদ্রুপ করেন, তাঁরা কখনোই এই বিষয়টাকে প্রাধান্য দেন না, বরং তাঁদের অনেকেরই মনে হয় এই ছুটির মানে হল মেয়েরা কিছু অতিরিক্ত সুবিধা পেয়ে গেল। অথচ পড়াশোনা বা চাকরির ক্ষেত্রে স্বাধীনতার এত বছর পরেও মেয়েদের অংশগ্রহণের যে পরিসংখ্যান আমরা পাই, তা থেকে খুব পরিষ্কার যে এই সুবিধা দেওয়া সরকারের কর্তব্য।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

ছাত্রীদের সঙ্গে কথা বললে জানা যায়, তারা মনে করছে কেরালা সরকারের এই ঘোষণা অত্যন্ত সদর্থক। তার অনেকগুলো কারণ তারা বলেছে। এখন যে সেমিস্টার ব্যবস্থায় পড়াশোনা হয়, সেখানে প্রত্যেক সেমিস্টারে যত শতাংশ উপস্থিতি দরকার, সব মেয়ের পক্ষে অনেকসময় অতদিন কলেজে আসা সম্ভব হয় না। এখনকার তরুণীরা অনেকেই PCOD/PCOS বা endometriosis-এর মত অসুখে ভোগে। PCOS Society আমাদের জানাচ্ছে, ভারতের ২০% মহিলার এই সমস্যা আছে। এই অসুস্থতার কারণে মেয়েদের ঋতুকালীন সমস্যা এতটাই বেশি হয় যে তাদের পক্ষে বাড়ি থেকে বেরিয়ে স্কুল, কলেজ বা বিশ্ববিদ্যালয়ে ক্লাস করতে যাওয়া সম্ভব হয় না।

সোশাল মিডিয়ায় কেউ কেউ প্রশ্ন তুলেছেন, যে মেয়েদের এই ধরনের কোনো অসুবিধা নেই তারা কেন এই সুযোগ পাবে? জোমাটোর মত কোম্পানি যখন তাদের কর্মীদের জন্য ঋতুকালীন ছুটি ঘোষণা করেছিল, তখনই প্রশ্ন উঠেছিল যে আলাদা করে ছুটি ঘোষণার দরকার কী? এদের তো আলাদা মেডিকাল লিভ দিয়ে দিলেই হয়। আসলে বিষয়টা অত সহজ সরল নয়। ঋতুচক্র মেয়েদের জীবনে প্রত্যেক মাসেই আসছে, কাজেই মেডিকেল লিভ বাড়িয়ে দিলে মহিলা কর্মীদের বিশেষ সুবিধা হবে না। একথা সত্যি, যে ঋতুকালীন শারীরিক কষ্ট সব মেয়ের সমান হয় না। যাঁরা কাজ করতে পারবেন, পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পারবেন, তাঁরা এই ছুটির অন্যায় ফায়দা তুলতে পারেন – এই সন্দেহে কি যাঁরা পারবেন না তাঁদের বঞ্চিত করা উচিত কাজ?

PCOD/PCOS না থাকলেও অন্য কিছু সমস্যা আমাদের দেশের স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের মেয়েদের মেনে নিতে হয়। পর্যাপ্ত পরিমাণে শৌচালয় বা বা থাকলেও সেখানে জলের ব্যবস্থা না থাকা তার মধ্যে অন্যতম। স্যানিটারি ন্যাপকিন ভেন্ডিং মেশিন এখন কিছু কিছু জায়গায় স্থাপন করা হচ্ছে ঠিকই, কিন্তু শৌচালয়ে ব্যবহৃত ন্যাপকিন ফেলার জন্য বিন রাখা যে প্রয়োজন, তা বেশিরভাগ স্কুল কলেজ কর্তৃপক্ষই মনে করেন না।

আরো পড়ুন গর্ভপাত নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের রায় বহু মেয়েকে বাঁচাবে

সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ কথা হল, ছাত্র ইউনিয়নগুলোও এখন ঋতুকালীন সমস্যা নিয়ে কথাবার্তা বলতে শুরু করেছে। এতদিন এ নিয়ে শুধুমাত্র নারীবাদী কিছু সংস্থা মুখ খুলত। কেরালা সরকারের এই ঘোষণার কারণে নিশ্চয়ই অনেক মেয়ের পড়াশোনা চালিয়ে নিয়ে যাওয়ার সুবিধা হবে। তবে আমার মনে হয় সবথেকে বড় পাওনা, সরকারের পিরিয়ড বা ঋতুচক্র নিয়ে কথাবার্তা শুরু করা। এত বছর ধরে আমরা দেখেছি, মেয়েদের জননতন্ত্র সংক্রান্ত অধিকার (reproductive rights) নিয়ে কথা বলা মানেই শুধু তার মা হওয়ার ব্যাপারে কথা বলা। মাতৃত্বের বাইরেও মেয়েদের আরও কিছু অধিকার যে আছে, রাষ্ট্র যেন সেকথা মানতেই চাইত না। এতদিনে দেখছি এক রাজ্যের সরকার একটু অন্য পথে হাঁটল। ঋতু বিষয়ক কলঙ্ক বা লোকলজ্জা দূর করতে এটা গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।

তবে এই ঘোষণার একটা সমালোচনা যথাযথ বলেই মনে হচ্ছে। সরকার বলেছে “female students” পিরিয়ড লিভের সুবিধা পাবে। ফিমেল না বলে এখানে “students who menstruate” বলা সঠিক হত। কারণ কিছু বৃহন্নলা (transgender) ছাত্রেরও এই ছুটির দরকার হতে পারে।

শোনা যাচ্ছে মুম্বইয়ের টাটা ইনস্টিটিউট অফ সোশ্যাল সায়েন্সেজের ছাত্রছাত্রীরাও ঋতুকালীন ছুটির দাবি তুলেছে। আশা করা যায়, কেরালা সরকারের পরে ভারতের আরও অনেক রাজ্য থেকে আমরা ছাত্রছাত্রীদের এই দাবি মেনে নেওয়ার খবর পাব। নারীশিক্ষার জন্য তা হয়ে উঠতে পারে বিশেষ সুখবর।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.