১৯৯২ সালে ভারত সরকার সম্মিলিত জাতিপুঞ্জের শিশু অধিকার সনদে হস্তাক্ষর করে। তা সত্ত্বেও ২০১২ সালের আগে জাতীয় স্তরে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে কোনো পৃথক আইন ছিল না। একমাত্র গোয়ায় ছিল। ২০০৭ সালে কেন্দ্রীয় সরকারের শিশু ও নারী কল্যাণ মন্ত্রক শিশুদের উপর হিংসা বিষয়ে ইউনিসেফ এবং সেভ দ্য চিলড্রেন সংস্থার সহযোগিতায় একটা সমীক্ষা করে কিছু ভয়াবহ তথ্য পেয়েছিল। তেরোটি রাজ্যের ১২,৪৪৭ জন শিশুর মধ্যে এই সমীক্ষা চালানো হয়। এদের মধ্যে ৫৩.২২% শিশু জানায় তাদের উপর কোনো না কোনো সময়ে যৌন নির্যাতন হয়েছে। এদের মধ্যে ৫২.৯৪% ছেলে আর ৪৭.০৬% মেয়ে। এই তথ্য মন্ত্রী থেকে সমাজকর্মী – সকলকে চমকে দেয়। কারণ প্রচলিত ধারণা হল, ছেলেদের উপর নির্যাতন কম হয়, মেয়েদের উপর বেশি হয়। বেশিরভাগ শিশু জানিয়েছিল, তারা কোনোদিন তাদের উপর নির্যাতনের কথা কোথাও রিপোর্ট করেনি।

এই সমীক্ষার পর সরকার কিছুটা নড়েচড়ে বসে, শিশু অধিকার কর্মীদের দাবি মেনে নিয়ে শিশুদের উপর যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইন প্রণয়ন করতে রাজি হয়। এখানে বলে রাখা ভাল, বাচ্চা মেয়েদের উপর নির্যাতন হলে ভারতীয় দণ্ডবিধি অনুসারে কেস রুজু করা সম্ভব ছিল, কিন্তু ছেলেদের ক্ষেত্রে সেটা সম্ভব ছিল না। পকসো আইন (Protection of Children from Sexual Offences Act, 2012) প্রণয়ন করার আগে অনেকগুলো মত বিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়, যেখানে আমরা সমাজকর্মীরা বক্তব্য রাখার সুযোগ পাই। শিশুদের যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে আইনের খসড়া তৈরি করার সময়ে বলা হয়, এই আইন যেন লিঙ্গনিরপেক্ষ হয়। অর্থাৎ ছেলে, মেয়ে নির্বিশেষে যে কোনো শিশু যেন এই আইনের সাহায্য পায়। পকসো আইন আমাদের দেশে যৌন নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রথম লিঙ্গনিরপেক্ষ আইন। আরেকটি দিক থেকেও এই আইন অভিনব। এখানে পৃথকভাবে প্রতিবন্ধী শিশুদের উপর নির্যাতন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট ধারা যোগ করা হয়েছিল। পরবর্তীকালে দিল্লির কুখ্যাত ধর্ষণ কাণ্ডের (যা নির্ভয়া কেস নামে পরিচিত) সময়ে ভার্মা কমিটি গঠিত হয়। সেইসময় এই আইনটির বিভিন্ন ধারা ব্যবহার করে আমরা ধর্ষণ আইনে প্রতিবন্ধী মহিলাদের জন্যে একই ধরনের ধারা অন্তর্ভুক্ত করতে সক্ষম হয়েছিলাম। তাই প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মী হিসাবে আমরা পকসো আইনকে আরও বেশি সদর্থক পদক্ষেপ বলে মনে করি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

তার মানে অবশ্য এই নয় যে আইনটিতে কোনো ভুলভ্রান্তি নেই। এই আইনে বাধ্যতামূলক রিপোর্টিংয়ের কথা বলা আছে, যা নিয়ে সমাজকর্মীরা শুরু থেকেই প্রতিবাদ করে আসছে। এখানে রিপোর্টিং কথাটির অর্থ হল আপনি শিক্ষক, মনোবিদ, সাংবাদিক যা-ই হোন, কোনো শিশুর উপর যৌন হেনস্থা হয়েছে শুনলেই আপনাকে পুলিসের কাছে রিপোর্ট করতে হবে। এক্ষেত্রে শিশুটি কী চায়, কেস যদি পরিবারের সদস্যদের বিরুদ্ধে হয়, তাহলে সেই শিশুর দায়িত্ব কে নেবে – এসব ভাবার সময় দেওয়া হবে না। রিপোর্ট না করলে আপনার শাস্তি পর্যন্ত হতে পারে।

এই ধরনের কিছু ধারা ছাড়াও, বাস্তবে কাজ করতে গিয়ে আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, বেশকিছু ধারার রূপায়ণ প্রায় অসম্ভব। পুলিসের দায়িত্ব শিশুর বয়ান ভিডিও রেকর্ড করে নেওয়া, যাতে বারবার বয়ান না নিতে হয়। মেদিনীপুরের এক গ্রামের পুলিস অফিসার আমাদের জানিয়েছিলেন থানায় ভিডিও করার ব্যবস্থা নেই। তারপর জিজ্ঞেস করেছিলেন, যদি আমার মোবাইল ফোনে রেকর্ড করি, সেটা কি আদালতে ব্যবহার করা যাবে? দেশের বিভিন্ন থানায় এই পরিকাঠামোর অভাবের কথা শুনেছি। আবার দিল্লিতে মঙ্গলপুরী থানা এলাকার একটি মানসিক প্রতিবন্ধী শিশুর ধর্ষণ হলে দেখেছি পুলিশ তার জন্যে বিশেষ ধারা প্রয়োগ করতে পারছে না, কারণ মেয়েটির প্রতিবন্ধী সার্টিফিকেটে গলদ ছিল।

আরো পড়ুন যে সমাজে না বলা বারণ, সেখানে বহরমপুর অনিবার্য

আজ পকসো নিয়ে এত কথা লিখতে হচ্ছে, কারণ ভারতের কুস্তি ফেডারেশনের সভাপতি ব্রিজভূষণ শরণ সিং, যাঁর বিরুদ্ধে নাবালিকাসহ একাধিক মহিলা কুস্তিগীর যৌন হেনস্থার অভিযোগ তুলেছেন, তিনি এখন দাবি করছেন ওই আইনে অনেক ভুল আছে এবং পরিবর্তন করা দরকার। যিনি অভিযুক্ত তিনিই আইন পরিবর্তন করার দাবি করতে পারেন – এ দৃশ্যও আমরা বিজেপি রাজত্বে দেখে ফেললাম। ব্রিজভূষণের এই দাবির সমর্থনে অযোধ্যার মহন্তরা প্রকাশ্য সভার করার প্রস্তাবও দিয়েছিলেন। সম্ভবত বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে ভেবে আপাতত কোনো মহল থেকে তাঁদের নিরস্ত করা হয়েছে। কিন্তু আশঙ্কা তো রয়েই গেল, যে ২০০৭ সালের সেই সমীক্ষা থেকে শুরু করে আমাদের মত বহু সমাজকর্মীর কাজের কোনো মূল্য অদূর ভবিষ্যতে থাকবে না। পুলিসকর্মীদের প্রশিক্ষণ দেওয়া থেকে শুরু করে অসংখ্য সচেতনতামূলক কর্মশালার আয়োজন করতে আমাদের যতখানি সময় এবং শ্রম দিতে হয়েছে তা মন্দিরের পুরোহিতদের কথায় ধুয়ে মুছে যাবে?

আজকের ভারতে দাঁড়িয়ে আজ আমরা বিশ্বাস করতে বাধ্য হচ্ছি, যে ব্রিজভূষণ চাইলেই তার ইচ্ছামত আইন বদলানো হতে পারে। নতুন সংসদ ভবনকে বলা হচ্ছে নতুন ভারতের প্রতীক। এই নতুন ভারতে আইন পরিবর্তন করতে আইনসভায় আলোচনার প্রয়োজনও হয় না। বিরোধী দলগুলোর বক্তব্য শোনার দরকার হয় না, নাগরিক সমাজের সঙ্গে আলোচনার প্রয়োজন হয় না। এই ভারতে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী মানুষ, অন্যান্য প্রান্তিক গোষ্ঠীর মানুষের কোনো মূল্য নেই। ধর্ষকের পক্ষ নিয়ে মিছিল করা, ধর্ষককে মালা পরিয়ে বরণ করা দেখা হয়ে গেছে। এবার কি ধর্ষণে অভিযুক্তের ইচ্ছামত আইন প্রণয়ন দেখতে হবে?

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.