-পর্ব ১-

১।
হোটেলের বন্ধ ঘর। একা বসে আছে লোকটা। কিছুক্ষণ আগেই ঘরের সমস্ত আলো নিভিয়ে দিয়েছে। টেনে দিয়েছে জানলার সমস্ত পর্দা। বন্ধ ঘরে নেমে এসেছে নিশ্ছিদ্র অন্ধকার। সেখানে বসেই মনে মনে জীবন নিয়ে কাটাকুটি খেলছে সে। প্রতি মুহূর্তেই তার চোখমুখে যে যন্ত্রণার অভিব্যক্তি ফুটে উঠছে অন্ধকারে তা ঠাহর করা সম্ভব নয়।
হঠাৎ, মুখের ওপর হাত রাখতেই বাঁধ ভাঙল। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলল লোকটা।
“তবে কি সবটাই ভুল? আগাগোড়া সবটাই মিথ্যে?”
জীবনে প্রথমবারের জন্য মনে হল মৃত্যুই একমাত্র পথ।
কিন্তু না। স্ত্রীকে একটা ফোন করা দরকার। লোকটা ডায়াল করল নম্বর।
“আমাদের মেয়েটা ৩ মাস ধরে কঠিন অসুখে ভুগছিল। বাঁচবে কি না ঠিক ছিল না। তাহলে? তাহলে শুধুমাত্র একটা ফুটবল ম্যাচের জন্য জীবন কি শেষ হয়ে যেতে পারে?”
ফোনটা রেখে এই যুক্তিটাই মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য যথেষ্ট মনে হল লোকটার।
২।
হ্যাঁ। একটা ফুটবল ম্যাচ। যে ফুটবল ম্যাচে ঘরের মাঠে আর্জেন্টিনার নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজকে ৬-০ গোলে উড়িয়ে দিয়েছিল আর্জেন্টিনারই সান লোরেঞ্জো। আর পরদিন নিউওয়েলসের কোচিংয়ের দায়িত্বে থাকা লোকটার বাড়ি ঘিরে ফেলেছিল জনা কুড়ির একটা দল। বারা ব্রাভাস। আর্জেন্টিনার উগ্র সমর্থকদের গোষ্ঠী।
দরজা খুলে বেরিয়ে এসেছিল লোকটা। হাতে একটা হ্যান্ড গ্রেনেড! চিৎকার করে বলেছিল, “এক্ষুণি তোমরা এখান থেকে না বিদায় হলে আমি পিন টেনে দেব”! তার উন্মত্ত চোখের দিকে তাকানোর সাহস হয়নি উগ্র সমর্থকগোষ্ঠীর। রুদ্ধশ্বাসে চম্পট দিয়েছিল তারা। লোকটা পাগল নাকি!!! সমর্থকদের রোষ ঠেকাতে কোচেদের বন্দুক রাখার চল আর্জেন্টিনার মত ফুটবলমত্ত দেশে নতুন কিছু না? কিন্তু তাই বলে হ্যান্ড গ্রেনেড?
হ্যাঁ, লোকটা পাগলই। উন্মাদ। খ্যাপাটে। সৃষ্টিছাড়া। অদ্ভুত।
তার স্বপ্ন, ধ্যানজ্ঞান সমস্ত কিছু জুড়েই রয়েছে ফুটবল। খেলাটার ধরনধারণ সে বদলে দিতে চায়। আরও আধুনিক করে তোলার স্বপ্নে সে মশগুল। পাগলের মত কত বছর ধরে বিশ্বফুটবলের যাবতীয় খুঁটিনাটি জেনে এসেছে, বই থেকে ভিডিও সমস্ত কিছু গুলে খেয়েছে। আর্জেন্টিনার দুই বিশ্বজয়ী কোচ মেনোত্তি আর বিলার্দোর সান্নিধ্যে থেকে শুনেছে তাদের দর্শন। সব মিলেই গড়ে তুলেছে নিজের ধারণা। সে মনে করে সে বিজ্ঞানী। সে দার্শনিক। সে খানিক অহঙ্কারীও। কিন্তু শেখার প্রশ্নে সে অবিচল। সে আইডিয়ালিস্ট। ফুটবলকে সে দেখে জীবনের চোখে, জীবনের যুক্তিবোধকে মাপে ফুটবলের চোখ দিয়ে।
আর্জেন্টিনায় তার ডাকনাম “এল লোকো” অর্থাৎ খ্যাপাটে লোক বা উন্মাদ।
৩।
মৃত্যুচিন্তা কাটিয়ে লোকটা শুরু করল নতুন করে। দলের প্রত্যেক খেলোয়াড়কে ডেকে বলে দিল আবার নতুন করে আরও সচেতন ভাবে শুরু করতে হবে। তার ফুটবল দর্শনকে সে চুলচেরা পরখ করে নিয়েছে সেদিন হোটেলের সেই অন্ধকার ঘরে বসেই। না, ভুল নেই কোত্থাও। এটাই শ্রেষ্ঠতম রাস্তা। শুধু প্রয়োগের জন্য খেলোয়াড়দের আরও পরিশ্রম, আরও একাগ্রতা প্রয়োজন।
লোকটা হেডকোচ হিসেবে দায়িত্ব নেওয়ার কিছু পরেই ক্লাব ছেড়ে অন্য দলে চলে যান আর্জেন্টিনার অন্যতম শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা। তাতে কী? ফুটবল তো দলগত খেলা। লোকটার কঠোর পরিশ্রম নিউওয়েলস ওল্ডবয়েজকে আর্জেন্টিনার লিগ এনে দিল। ১৯৯০-৯১ মরসুমে। কী এক অদ্ভুত শক্তিতে দর্শকদের মোহিত করে রাখলেন ফুটবলাররা। সমস্ত খেলাতেই তাদের ক্লান্তিহীন গতিময় ও আক্রমণাত্মক ফুটবল নজর কাড়ল। কিন্তু ১৯৯২-এ দক্ষিণ আমেরিকার সর্বোচ্চ মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা কোপা লিবের্তাদোরেস-এ প্রথম ম্যাচেই ধাক্কা। এই গল্পের শুরুতেই বর্ণিত অঘটন। সান লোরেঞ্জোর কাছে বিধ্বস্ত হল নিউওয়েলস।
তবে দল ঘুরে দাঁড়াল পরের ম্যাচ থেকেই। হার তো নয়ই। একটানা ২৬টা ম্যাচ অপরাজিত থাকল নিউওয়েলস। ফিরতি ম্যাচে হারাল সান লোরেঞ্জোকেও। আস্তে আস্তে সব ম্যাচ জিতে তারা পৌঁছে গেল ফাইনালেও যেখানে প্রতিপক্ষ ব্রাজিলের বিখ্যাত ক্লাব সাও পাওলো। যার প্রশিক্ষক প্রবাদপ্রতিম তেলে সান্তানা, আর অন্যতম কৃতী খেলোয়াড় কাফু।
দক্ষিণ আমেরিকার এই প্রতিযোগিতায় ফাইনাল হয় দুই পর্ব মিলিয়ে। প্রথম পর্বে ঘরের মাঠে ১-০ গোলে জিতল নিউওয়েলস। প্রথম মহাদেশীয় খেতাব কি মিলবে?
ফিরতি পর্বে ৯০ মিনিটের খেলায় সাও পাওলো ১-০ এগিয়ে থাকা খেলা গড়াল টাইব্রেকার অবধি। টাইব্রেকারে হার মানল নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ। এর কিছু পরে দলকে আর একটা জাতীয় ট্রফি দিয়ে দায়িত্ব ছাড়ল লোকটা। ক্লাবের সমর্থকদের
শিরায় শিরায় ‘এল লোকো’র উন্মত্ততা ছড়িয়ে পড়েছে ততদিনে।
৪।
জর্গে গ্রিফা লোকটার আর এক গুরু। সেই জর্গে গ্রিফা যিনি খুঁজে এনেছিলেন বাতিস্তুতাকে। আর্জেন্টিনার বহু নামী খেলোয়াড়ের উত্থানের পেছনেই রয়েছে তাঁর সন্ধানী চোখের কৃতিত্ব। গল্পের লোকটাকেও কোচ হিসেবে তৈরি করার কৃতিত্বের ভাগীদার গ্রিফা।
এই লোকটাকে নিয়েই গ্রিফা একদিন রাত দুটোর সময়ে মরিসিও পচেটিনোর বাড়ি গিয়ে হাজির হন ও তাকে নিউওয়েলস ওল্ড বয়েজ-এ চুক্তি করান। হেড কোচ হওয়ার আগে বাতিস্তুতার ডায়েট পাল্টে দেওয়া আর বৃষ্টির মধ্যে ট্রেনিং করতে শেখানোও এই লোকটারই কৃতিত্ব যার জন্য বাতিস্তুতা ভবিষ্যতে ধন্যবাদ জানাবেন লোকটাকে। এই অদ্ভুত লোকটা ধীরে ধীরে গড়ে তুলতে থাকে একের পর এক খেলোয়াড়কে, প্রভাবিত করতে থাকে তাঁদের। নিজের অদ্ভুত দর্শন দিয়ে। সেই দর্শনের কথা বলব পরে। শুধু পাঠকের এটুকু জানা থাক, বিখ্যাত ফুটবল লেখক জোনাথন উইলসনের মতে আশির দশকের শেষ থেকে পৃথিবীর দুই প্রান্তে যে দুজন বিশ্ব ফুটবলে আধুনিকতার সর্বোচ্চ প্রভাব আনতে চেষ্টা করে যাচ্ছিলেন তাদের মধ্যে একজন এই লোকটাও। অন্য জনের নাম লুই ভ্যান গাল। গল্পের লোকটা আবার ভয়ঙ্কর ভাবে বুঁদ হয়ে পর্যবেক্ষণ করত ভ্যান গালের ট্রেনিং পদ্ধতি, শ্রদ্ধা করত তাঁর দর্শনকে। এই দুজনের ফলিত দর্শনই ভবিষ্যতে সুফল এনে দেবে ফুটবলের ইতিহাসে। শুধু ভ্যান গাল সফল হিসেবেই বিবেচিত হবেন, আর এই লোকটার জন্য হয়তো থাকবে চিরকালীন ব্যর্থতার দায়ভার। কেন? সে গল্পে প্রবেশ করব এবার।
গল্পের পরবর্তী পর্যায় থেকে ট্রফি জয়ী লোকটাকে সম্ভ্রমাত্মক সম্বোধনের স্তরে উন্নীত করা যাক। লোকটার নাম মার্সেলো বিয়েলসা। আর তার ফুটবল ঘরানা? তার নাম “বিয়েলসিয়েস্তা”।
৫।
নিউওয়েলস ছাড়ার পরে দেশ ছেড়ে বিয়েলসা চললেন মেক্সিকোর উদ্দেশে। সেখানে অ্যাটলাসের দায়িত্ব নিলেন তিনি, তবে এবার হেডকোচ নয়, ফুটবল ডিরেক্টর হিসেবে। কাজ, দেশের সেরা ফুটবলারদের খুঁজে বের করা। এর আগে আর্জেন্টিনার ম্যাপকে ৭০টা অংশে বিভক্ত করে গাড়ি নিয়ে মাইলের পর মাইল পেরিয়ে প্রতিটা জায়গায় পৌঁছে গেছিলেন তিনি। লক্ষ্য একটাই, যত বেশি সম্ভব প্রতিভা তুলে আনা। কোনও প্রতিভা যেন বাদ না পড়ে যায়। এ হেন কাজপাগল লোককে অ্যাটলাসের ফুটবল কর্তাদের যে পছন্দ হবে সেটাই স্বাভাবিক। অ্যাটলাসের দায়িত্ব নিয়ে বিয়েলসা যে নকশা তৈরি করলেন তাতে প্রতি বছর সারা দেশের ২০০০০ ফুটবলারকে দেখে নেওয়ার বন্দোবস্ত হল। কাজও হল সেরকম। প্রচুর স্কাউটিং সেন্টার তৈরি হল। ফল মিলেছিল বেশ কিছু বছর পরে। ২০০৬ সালে মেক্সিকো যখন আর্জেন্টিনার সঙ্গে বিশ্বকাপের প্রি-কোয়ার্টার ফাইনালে মরণবাচঁন খেলা খেলছে তখন তাদের দলের ১১ জনের আটজনই বিয়েলসার এই সিস্টেমের ফসল। বিয়েলসার কাছে হাতে ধরে ফুটবল ট্রেনিংও নিয়েছিলেন অনেকেই। মেক্সিকো জাতীয় দলের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ গোলদাতা বর্গেত্তি ছিলেন সেই দলে, ছিলেন অসওয়াল্ড সানচেজ এবং মেক্সিকোর কিংবদন্তি অধিনায়ক রাফায়েল মার্কয়েজ। তাঁরা প্রত্যেকেই স্বীকার করেন তাঁরা কতটা ঋণী বিয়েলসার কাছে।
অ্যাটলাসের কাজের পরে কিছুদিন ক্লাব আমেরিকায় কোচিংও করান বিয়েলসা। কিন্তু সাফল্য আসেনি। তবে পাঁচ বছর পরে যখন মেক্সিকো ছাড়েন বিয়েলসা, তখন মেক্সিকোর ফুটবল ট্রেনিং পদ্ধতির সংখ্যা ৩০০ থেকে বেড়ে দাঁড়িয়েছিল ৫০০!
ফুটবলে ডুবে থাকা মানুষটার মেক্সিকো ছাড়ার পেছনেও প্রধান কারণ ছিল অন্তর্নিহিত শক্তির নিঃশেষিত হয়ে যাওয়া! আবার দেশে ফেরার পালা।
৬।
দেশে ফিরে সবাইকে খানিক অবাক করে দিয়েই বিয়েলসা দায়িত্ব নিলেন ভেলেজ সার্সফিল্ডের। সবাই ভেবেছিল দেশের সবচেয়ে সফল ক্লাবগুলোর একটাতেই হয়তো যাবেন তিনি। ১৯৯৭-৯৮ মরসুমে “ক্লসুরা” বা জাতীয় লিগ জিতলেও এই মরসুমেই তাঁর খেলোয়াড় ম্যানেজমেন্ট নিয়ে কিছু প্রশ্নচিহ্ন উঠল। দলের নির্ভরযোগ্য খেলোয়াড় প্যারাগুয়ের কিংবদন্তি গোলকিপার চিলাভার্ট সরাসরি তাঁর ব্যবহারের সমালোচনা করলেন। সেই সমালোচনায় তিনি বললেন, বিয়েলসা খেলোয়াড়দের থেকে প্রচন্ড বেশি প্রত্যাশা করেন, খেলোয়াড়ের যা দেওয়ার ক্ষমতা তার থেকেও। গোলকিপারও যদি ফিল্ড খেলোয়াড়দের মত পা ব্যবহার করে পাসিং গেমে অংশ নিতে পারে তবে বিয়েলসা খুশি হন (ভাবুন ৯৭-৯৮ সালে! লাতিন আমেরিকান ফুটবলে কিন্তু নতুন ধারণা)। অর্থাৎ সিস্টেম না খেলোয়াড় কে অগ্রাধিকার পাবে? এখানেই মূল দ্বন্দ্ব আর এখানেই প্রয়োজন বিয়েলসার ফুটবল দর্শন বোঝার। এবার সেই আলোচনায় আসা যাক।
৭।
“Though this be madness, yet there is method in’t” (হ্যামলেট, act 2, scene II)
বিয়েলসা বলতেন, “আপনি যখনই একদম নতুন কিছু করতে যাবেন, নতুন আইডিয়াকে নিয়ে সফল না হবেন ততক্ষণ আপনাকে পাগল বলা হবে।” বিয়েলসার এই তথাকথিত ‘পাগলামি’র পিছনে আছে দীর্ঘদিনের পরিশ্রম এবং নিজস্ব পদ্ধতি তৈরির নিরন্তর চেষ্টা। লোকটার প্রায় ২৪ ঘন্টাই ধ্যান জ্ঞান ফুটবল।
ইউরোপে দর্শনের দিক থেকে বিয়েলসার ফুটবল গুরুর নাম ইতালির আরিগো সাচ্চি, আর দক্ষিণ আমেরিকায় উরুগুয়ের অস্কার তাবারেজ। দুজনেই কিংবদন্তি। নব্বইয়ের দশকে বিয়েলসা বলতেন, তাবারেজের দর্শন অনুযায়ী ফুটবল খুব সহজ খেলা। তার চারটে মুলগত ধারণা আছে। ১। রক্ষণ বা ডিফেন্স, ২। আক্রমণ বা এটাক, ৩। রক্ষণ থেকে আক্রমণে যাওয়া এবং ৪। আক্রমণ থেকে রক্ষণের দিকে যাওয়া। এই প্যাসেজগুলোয় কতটা মসৃণ ভাবে চলাচল করা সম্ভব সেটা ভাবাই একজন ফুটবল ভাবুকের কাজ। বিয়েলসার মতে, যা যা সম্ভবপর সব ঘটে গেছে ইতিমধ্যেই। এবার সময় ‘অসম্ভব’ কিছু ঘটানোর।
এই অসম্ভব ঘটানোর লক্ষ্যে বিয়েলসার হাতিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি। খেলাকে বিশ্লেষণ করার জন্য ভিডিও-র সাহায্য নেওয়া। ইউরোপে মোটামুটি চালু হলেও দক্ষিণ আমেরিকায় নব্বইয়ের দশকে ফুটবল তখনও প্রযুক্তির হাত দৃঢ়ভাবে ধরতে পারেনি, বিয়েলসা তাকে একলাফে অনেক দূর নিয়ে যান। এখানে প্রতিটি খেলোয়াড় সম্বন্ধে কতরকম তথ্য পাওয়া যেতে পারে তার হিসেব রাখা হয়। প্রতিটা খেলোয়াড়ের উন্নতি করার সম্ভাবনাকেও দেখা যেতে পারে। একজন খেলোয়াড় কতক্ষণ দৌড়াতে পারে, কতটা অঞ্চল সে জুড়ে রাখতে সক্ষম, বল ধরে ও বল ছেড়ে তার চলাফেরায় কীরকম পরিবর্তন আসতে পারে ইত্যাদির চুলচেরা বিশ্লেষণ।
কিন্তু ফুটবল দলগত খেলা। একটা মাঠে রেফারিকে বাদ দিয়ে একসঙ্গে ২২ জন খেলোয়াড় থাকেন। ফুটবল আধুনিকতার অন্যতম সূচক হল “স্পেস” বা পরিসরকে প্রধান ফ্যাক্টর রূপে গণ্য করা। এই স্পেস সুনির্দিষ্ট হবে নাকি তার উৎপাদন সম্ভব তা নিয়েও ফুটবল চিন্তকেরা কাজ করেন।
স্পেস ভৌগলিক, মানসিক সব স্তরেই অবস্থান করতে পারে। ভৌগলিকভাবে একটা স্পেস এর মানে নির্ধারণ হতে পারে সেই স্পেসে কিছু বিষয় ঘটলে বা না ঘটলে, কিছু অবজেক্ট থাকলে বা না থাকলে। খুব পাতি ভাবে একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে। একটা বাড়িতে কেউ বসবাস করলে সেই স্পেসের মানে একরকম হয়, আবার একটা পরিত্যক্ত বাড়ির ক্ষেত্রে স্পেসের মানে অন্যরকম। আবার আমরা প্রায়শই সম্পর্কের ক্ষেত্রেও স্পেস শব্দটা ব্যবহার করে থাকি।
ফুটবল খেলায় যদিও জ্যামিতিক স্পেস এর ধারণাই বেশি জরুরি তবুও খেলোয়াড়দের মানসিক স্পেস এর ধারণাও রাখতে হয়। তা হয় বিভিন্ন ড্রিল এর মাধ্যমে। অর্থাৎ, একটা স্থানে বিপক্ষের বা নিজের খেলোয়াড় থাকলে কী করতে হবে আবার না থাকলে কী করতে হবে সেই অনুযায়ী খেলোয়াড়ের ভূমিকা ঠিক হয়। আবার মাঠেই নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময়ে দলের নির্দিষ্ট শেপ বা আকার বজায় রাখতে খেলোয়াড়ের ভূমিকা ঠিক হয়। স্পেসের মানেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে পাল্টাতে থাকে। তবে খেলার সময় যেহেতু পূর্বনির্ধারিত তাই খেলোয়াড়কে নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে তার ভূমিকা পালন করতে হবে। অর্থাৎ, সময় ও স্পেস দুই ধারণা একত্রে তাকে অনুশীলনের মাধ্যমে রপ্ত করতে হয়। আর আধুনিক ফুটবলে বিশেষজ্ঞ ফুটবলারের ধারণা কিন্তু এই স্পেস কেন্দ্রিকই।
বিয়েলসার ফুটবলের মোদ্দা কথা হল বল নিয়ে স্পেস তৈরি করো ক্রিয়েটিভিটি বা সৃষ্টিশীলতার জন্য। রক্ষণ করার আলাদা করে প্রয়োজন নেই, কারণ, রক্ষণের সবচেয়ে ভাল উপায় হল আবার আক্রমণ করা। যদি বিপক্ষের কাছে বল থাকে তবে ক্রমাগত “প্রেস” করে যাও, বা তাড়া করে যাও যাতে বিপক্ষ সেই ক্রিয়েটিভিটি বা সৃষ্টিশীলতার স্পেস না পায়। অর্থাৎ উদ্দেশ্যহীন ভাবে ভাবে তাড়া করা নয়। স্পেসের ধারণাকে সঙ্গী করে বল কেড়ে নেওয়ার জন্য তাড়া করা। এবং বল একবার পায়ে চলে এলে বিভিন্ন ভাবে স্পেস তৈরি করে সৃষ্টিশীলতার জমি তৈরি করা। তবে শুধু বল পায়ে পেয়ে কী করছে দল সেটাই নয়, বল ছাড়া কতটা কার্যকরী ভূমিকা নিচ্ছে সেটাও গুরুত্বপূর্ণ। তাই ইন্ডিভিজুয়ালের বাড়তি গুরুত্ব নেই দলে। এই পুরো পদ্ধতির মাঝে কখনও কোনও স্পেস বিপক্ষকে দিয়ে দেওয়া চলবে না। অর্থাৎ, খুব গোদা ভাবে বললে, এক ইঞ্চি জমিও বিপক্ষকে দেওয়া যাবে না যদিও এখানে শুধু মাঠ বা বলের দখলদারি না, লক্ষ্য সৃষ্টিশীল স্পেস তৈরির চেষ্টা করা। অর্থাৎ আক্রমণ বৈচিত্র বাড়ানো। গোল করার সুযোগ সৃষ্টি করা।
এই সম্পূর্ণ তত্ত্ব শুনতে সহজ লাগলেও তাকে মাঠে ফলানো সত্যিই ভয়ঙ্কর শক্ত। এই কাজে বিয়েলসার পছন্দের ছক ৩-৩-১-৩। একটা দলের এগারোজনের মধ্যে গোলকিপারকে বাদ রেখে বাকি দশজনকে সাজালে বিভিন্ন ছক পাওয়া যায় (ছক সাজানোর মান্য ক্রম হল ডিফেন্সের খেলোয়াড় সংখ্যা-মাঝমাঠে খেলোয়াড় সংখ্যা-আক্রমণ ভাগে খেলোয়াড় সংখ্যা) । বিয়েলসার এই ছক বেশ আধুনিক যার প্রায়োগিক আলোচনায় আবার পরে ফিরব। আপাতত জীবনের গল্পে ঢোকা যাক আবার।
৮।
ভেলেজে ট্রফি জিতলেও ৯৮ সালে বিয়েলসা ক্লাব ছাড়লেন। এবার লক্ষ্য স্পেনের এস্প্যানিয়ল। বিয়েলসার কোচিং এর খবর সেখানে গিয়ে পৌঁছেছে। এস্প্যানিয়লে গিয়ে বিয়েলসা ফের মিলিত হলেন পুরানো শিষ্য পচেটিনোর সঙ্গে। তার ফুটবলার জীবনের ঠিকানা তখন কাতালুনিয়ার ওই ক্লাব।
এদিকে ১৯৯৮ বিশ্বকাপে পাসারেল্লার কোচিংয়ে সাড়া জাগিয়েও আর্জেন্টিনা হেরে গেল দুর্ধর্ষ ডাচ দলের কাছে। দায়িত্ব ছাড়লেন পাসারেল্লা। আর্জেন্টিনা এই সময় থেকেই ধীরে ধীরে এক ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক মন্দার দিকে এগোচ্ছিল। আগের কয়েক বছরের ঘনঘন সংস্কার খুব কমসময়ের জন্য ফলদায়ী হলেও অর্থনীতির মুখ থুবড়ে পড়া বোধহয় সময়ের অপেক্ষা ছিল।
আর্জেন্টিনা ফুটবলমহলের ধারণা ছিল এবার জাতীয় ফুটবল দলের হাল ধরবেন জোসে পেকারম্যান। দীর্ঘদিন ধরে তরুণ খেলোয়াড় খুঁজে আনা এবং তাদের নিয়ে দু-দুবার যুব বিশ্বকাপ জেতায় তিনিই ছিলেন বড় দাবিদার। কিন্তু পেকারম্যান দায়িত্ব নিলেন না, তিনি বললেন, এই মুহূর্তে জাতীয় দলের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য সবচেয়ে যোগ্য লোক একজনই। মার্সেলো বিয়েলসা।
জাতীয় দলের ডাক যখন এল ততদিনে এস্প্যানিয়লের হয়ে কয়েকটা মাত্র ম্যাচ খেলিয়েছেন বিয়েলসা। বিয়েলসার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল অনূর্ধ্ব ১৭ জাতীয় দলের কোচিংয়ের দায়িত্ব পালন করার। কিন্তু এ তো সরাসরি সিনিয়র দলের দায়িত্ব। তবু বিয়েলসা সাগ্রহে গ্রহণ করলেন সেই দায়িত্ব, নিজের দেশকে নিয়ে ভাল ফল করতেই হবে। এস্প্যানিয়লের দায়িত্ব ছেড়ে বিয়েলসা পাড়ি দিলেন আর্জেন্টিনার পথে।
৯।
প্রথম দিন। খেলোয়াড়রা সকলেই উপস্থিত ট্রেনিং গ্রাউন্ডে। বিয়েলসা সবার হাতে ধরিয়ে দিলেন একটা করে ছোট সাদা কাগজ। সেখানে লিখতে হবে খেলোয়াড়েরা কী চায়? দলের রক্ষণভাগে কতজন খেলোয়াড় থাকবে? সবার থেকেই উত্তর এল, চার। অর্থাৎ, চারব্যাকে (রক্ষণভাগের খেলোয়াড়) খেলার যে পদ্ধতি সেই সময়ে সমাদৃত তার পক্ষেই সায় দিলেন সব খেলোয়াড়ই।
সেদিন ট্রেনিং এর মাঠ ছাড়ার আগে বিয়েলসা তাঁদের জানিয়ে গেলেন, রক্ষণভাগে ফুটবলার সংখ্যা থাকবে ৩। অর্থাৎ, তিনি তিনব্যাকে খেলবেন। চার নয়। আর এটাই ফুটবলারদের মেনে নিতে হবে। এটাই হবে নতুন সিস্টেম যার সঙ্গে ফুটবলাররা মানিয়ে নেবেন ও সেইমত তৈরি হবেন।
তিন ব্যাকে খেলার ব্যাপারে বিয়েলসার নতুনত্ব নেই। অতীতে বহু কোচই তিনব্যাক খেলিয়েছেন। বিয়েলসার অন্যতম শিক্ষক এবং ১৯৮৬ এর বিশ্বকাপ জয়ী দলের প্রশিক্ষক কার্লোস বিলার্দোও তিনব্যাক (৩-৫-২ ছকে) খেলিয়েছিলেন। কিন্তু বিয়েলসার এই তিনব্যাকে খেলা কেন অন্যরকম তা বুঝতে গল্পের এই অংশে সম্পূর্ণ ৩-৩-১-৩ ছকটাকে বুঝে নেওয়ার একটা চেষ্টা করা যেতে পারে।
১০।
বিয়েলসা বলেন ফুটবল খেলাটাকে তিনি অনুভব করেন, বোঝেন একটা নির্দিষ্ট পদ্ধতিতে, নির্দিষ্ট পথ ধরে। তাঁর মতে ফুটবল খেলায় সব মিলে ১০ ধরনের কৌশলগত সিস্টেম রয়েছে। যদিও বিশ্বফুটবল ঘাঁটলে দেখা যাবে অসংখ্য ছক বা ফর্মেশন ব্যবহার করছে বিভিন্ন ফুটবল দল, বিয়েলসার নিজস্ব দর্শন বলে এই ১০ রকমের মূলগত সিস্টেমের বাইরে কিছু অবস্থান করে না। অর্থাৎ, ফুটবল খেলাটা এই দশ রকমের সিস্টেমকে ঘিরেই খেলা হয়।
কীভাবে এত নিশ্চিত হন তিনি? তাঁর মতে ৪০ বছর ধরে ৫০০০০ খেলা তিনি দেখেছেন ও বিশ্লেষণ করেছেন! এবং সেখানে এই ১০ রকমের বাইরে কিছু নেই!
কী কী সেই দশরকম সিস্টেম? ৪-২-১-৩, ৪-৩-৩, ৪-৩-১-২, ৪-২-৪, ৪-২-২-২, ৩-৩-১-৩, ৩-৪-৩, ৩-৪-১-২, ৩-৩-৪, ৩-৩-২-২।
এবার ভাল করে লক্ষ্য করলে দেখা যাবে এর মধ্যে প্রথম পাঁচটিতে রয়েছে চার ডিফেন্স/ব্যাক ও পরের পাঁচটিতে রয়েছে তিন ডিফেন্স/ ব্যাক। অর্থাৎ, ফুটবলে সমস্ত সিস্টেমেই আসলে চার ব্যাক বা তিন ব্যাকে খেলা হয়।
আবার ওপরের ক্রম অনুযায়ী লেখা প্রতিটি নির্দিষ্ট চারব্যাকের সিস্টেমের ডেরিভেটিভ ছক রূপে কাজ করতে পারে প্রতিটি নির্দিষ্ট তিনব্যাকের সিস্টেমের ছক (অর্থাৎ, ৪-২-১-৩ এর ডেরিভেটিভ ৩-৩-১-৩, ৪-৩-৩ এর ডেরিভেটিভ ৩-৪-৩ এভাবে ক্রমানুসারে)। এবং ফুটবল খেলা যখন হয় তখন খেলার শেপ খেলা শুরুর সময়ে লিখিত শেপের ওপরে নির্ভর করে করে না, কীভাবে বিভিন্ন সিস্টেমের মধ্যে ট্রান্সফর্মেশন ঘটে তার ওপরে নির্ভর করে।
তাঁর মতে প্রতিটি কমবয়সী খেলোয়াড়ের জুনিয়র দলে থাকার সময় অন্তত পাঁচ বছর ধরে এই ১০টি সিস্টেমে খেলা অভ্যেস করা দরকার- খেলোয়াড় হিসেবে তারা তবে সর্বোচ্চ স্তরে পৌঁছে যেতে পারে। এটাও শুনতে সহজ লাগলে কী যে প্রায় অসম্ভব জিনিস তা বোঝানো মুশকিল!
এত সব সিস্টেমের মধ্যে বিয়েলসা মনে করেন ৩-৩-১-৩ ই সবচেয়ে শ্রেষ্ঠ। এর মধ্যে ক্রিয়েটিভ স্পেস তৈরির সর্বাধিক সম্ভাবনা আছে। এবং একই ভাবে বিপক্ষকে স্পেস দেওয়ার সম্ভাবনা কম। এই সিস্টেমেরও বিবর্তন ঘটেছে তাঁর হাত ধরে। তাঁর দলে প্রথম দিকের এই সিস্টেম কেমন?
এই সিস্টেমে মূলত তিন সেন্টার ব্যাক থাকতে পারে। একজন ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার কিংবা হোলডিং মিডফিল্ডার থাকে। দুজন উইং ব্যাক থাকে যাদের আক্রমণ-এ প্রধান ভূমিকা থাকে, ৩ জনের মাঝমাঠের অংশ হিসেবে তারা ব্যবহৃত হতে পারে। সাধারণত অন্য সিস্টেমে উইং ব্যাকেরা মাঠের দুই সাইডলাইন বরাবর অপারেট করে। কিন্তু বিয়েলসার সিস্টেমে এরা ‘ইনভার্টেড উইংব্যাক’ রূপে গণ্য হয়। অর্থাৎ, এরা মাঝমাঠে ঢুকে আসে, দুই ধারের আক্রমণভাগের খেলোয়াড়কে পাস বাড়ায়, বিপক্ষের পা থেকে বল কেড়ে নিতে প্রেস করে, আবার সময় বুঝে সাইডলাইনের করিডরকে বন্ধ করার চেষ্টা করে। খুবই ঝুঁকির ভূমিকা, কিন্তু ঠিকমত করতে পারলে ফুটবলের সৌন্দর্য্য বৃদ্ধি হয়, খেলা কার্যকরীও হয়। এছাড়া মাঝমাঠ থেকে আক্রমণে দ্রুত বল নিয়ে যাওয়ার জন্য ও সংযোগ রক্ষা করার জন্য একজন সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার (নাম্বার টেন) থাকে। আক্রমণভাগের তিন খেলোয়াড়ের মধ্যে একজন সেন্টার ফরোয়ার্ড বা ফুটবলের স্পেশালাইজড রোলের পরিভাষায় ‘নাম্বার নাইন’ থাকে। আর দুজন মাঠের দুপ্রান্তে ওয়াইড ফরোয়ার্ড হিসেবে ব্যবহৃত হতে পারে।
এত কিছুর পরেও উল্লেখযোগ্য এই যে খেলা চলাকালীন খেলোয়াড়দের অবস্থান সবসময় এরকম থাকবে না। খেলোয়াড়দের মধ্যে পজিশন অদল বদল হবে। তবে তা স্পেসের ধারণাকে মাথায় রেখেই। ডাচ টোটাল ফুটবল ঘরানার প্রতি শ্রদ্ধাশীল বিয়েলসা মনে করেন আধুনিক ফুটবলে প্রতিটি খেলোয়াড়কে মাল্টিফাংশনাল হয়ে উঠতে হবে। অর্থাৎ, নব্বইয়ের দশকে ইউরোপের ফুটবলে স্পেশালাইজড পজিশনের যে চল তাকেও ছাড়িয়ে একটু এগিয়ে যাচ্ছেন বিয়েলসা। ভাবনায় আসছে স্পেশালাইজড রোল-সহ মাল্টিফাংশনালিটির ধারণা। খেলোয়াড়কে এই সবের জন্যই প্রস্তুত হতে গেলে উপরোক্ত ট্রেনিং এর মধ্য দিয়ে যাওয়া প্রয়োজন। মাল্টিফাংশনালিটির অর্থ এই নয় একজন খেলোয়াড় ডিফেন্স থেকে ফরোয়ার্ড সমস্ত পজিশনেই সমান ভাবে খেলতে পারবে, বরং একজন খেলোয়াড়কে নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে, নির্দিষ্ট স্পেসের ধারণাকে মাথায় রেখে তৎকালীন শেপকে ঠিক রাখার চেষ্টা করতে যেটুকু বাড়তি দায়িত্ব পালন করতে হবে সেটাই তার মাল্টিফাংশনালিটির পরিচায়ক।
এই সিস্টেমে খেলোয়াড়েরা প্রবল প্রেস করবে (প্রেস করার দর্শনে তাঁর শিক্ষাগুরু ইতালির কিংবদন্তি আরিগো সাচ্চি, যদিও বিয়েলসার খেলায় নিরন্তর প্রেসিং-এর ধারণা রয়েছে)। বিয়েলসার মতে, ডিফেন্ড করার কার্যকরী উপায় অনবরত ছুটে যাওয়া ও বিপক্ষের হাফেই বল কাড়া। বিপক্ষের আক্রমণের সময় একজন বিপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতি মুহূর্তে যেন নিজের দলের ২ জন খেলোয়াড় থাকে। শুনতে সহজ হলেও, এটাও ভয়ঙ্কর কঠিন আসলে!
বিয়েলসা বিশ্বাস করেন তাঁর দর্শন প্রয়োগ করেই একটা দলকে তৈরি করা সম্ভব। দলে কীধরনের খেলোয়াড় আছে তাদের মত করে দর্শন ঠিক করার পক্ষপাতী তিনি নন। সিস্টেমের জন্য খেলোয়াড় খুঁজে আনতে তিনি মাইলের পর মাইল ছুটে যেতে পারেন, কিন্তু ভাবনার সঙ্গে আপোষ একদমই নয়।
১১।
আপোষ তিনি কোনওকালেই করেননি। তাই আর্জেন্টিনার প্রতিভা জুয়ান রোমান রিকলমেকে তিনি তাঁর সিস্টেমে রাখতে চাননি। রিকলমে অসাধারণ খেলোয়াড় হলেও তাঁর সিস্টেমের সঙ্গে যায় না। তাঁর দলে চাই দ্রুত, গতিময় খেলোয়াড়। যে আক্রমণে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ডিফেন্সের ক্ষেত্রেও সাহায্য করবে দলকে, মোট কথা স্পেসের ধারণাকে অটুট রাখবে। কাজেই এটা আদৌ অদ্ভুত নয় যে বিয়েলসার আদর্শ ভ্যান গালও বার্সেলোনায় রিকলমেকে ব্যবহার করেননি প্রায় একই যুক্তিতে। এমনিতে ফুটবল খেলাটা যে সমর্থকদের জন্যই তা মনে করতেন বিয়েলসা। নিউওয়েলসে থাকাকালীন ট্রফি জেতার পরে খেলোয়াড়দের কাঁধে উঠে সেই সমর্থকদেরকেই ভালবাসা, কুর্ণিশ জানিয়েছেন তিনি। কিন্তু নিজের কাজের ক্ষেত্রে সমর্থকদের ভাবনা ধার নিতে তিনি আগ্রহী নন। ফলে, আর্জেন্টিনায় ফ্যান ফেভারিট হওয়া সত্ত্বেও জায়গা মেলেনি রিকলমের। ১৯৯৯ কোপা আমেরিকার পরে আর সুযোগ আসেনি রিকলমের সামনে। ইন্ডিভিজুয়ালকে সিস্টেমের ওপরে কখনওই পাত্তা দেননি বিয়েলসা।
১৯৯৮ থেকে ২০০২ অবধি যে বিশ্বকাপ যোগ্যতাঅর্জনের খেলা হয় তাতে দক্ষিণ আমেরিকার কোয়ালিফায়ার থেকে সর্বোচ্চ পয়েন্ট নিয়ে (মাত্র একটা ম্যাচ হেরে) বিশ্বকাপে ওঠে আর্জেন্টিনা। ৩-৩-১-৩ এই মাঠে ফুল ফোটায় আর্জেন্টিনার খেলোয়াড়েরা।
ততদিনে দেশ মন্দার কবলে। অর্থনীতি ধুঁকছে, বেকারত্ব বাড়ছে। ২০০১ সালে ঘটে গিয়েছে দাঙ্গাও। বিশ্বকাপের আগে আটমাস বিনা বেতনে কাজ করেন বিয়েলসা। কিন্তু দলের খেলায় সেই প্রভাব পড়েনি। বরং বিশ্বকাপ জয়ের জন্য ফেভারিট খেতাব নিয়েই যাত্রা শুরু হয় বিয়েলসার দলের।
১২।
কারা কারা ছিলেন বিশ্বকাপের স্কোয়াডে?
রবার্তো আয়ালা, ওয়াল্টার স্যামুয়েল, মরিসিও পচেটিনো, জেভিয়ার জেনেত্তি, পাবলো সোরিন, ডিয়েগো সিমিওনে, জুয়ান সেবাস্তিয়ান ভেরন, পাবলো আইমার, কিলি গঞ্জালেজ, ক্লদিও লোপেজ, গ্যাব্রিয়েল বাতিস্তুতা, হার্নান ক্রেসপো এবং বেশি বয়স্ক ক্যানিজিয়া-সহ আরও কজন। সমস্ত পজিশনে তারকাখচিত এই লাইনআপ হয়তো আর্জেন্টিনার আর কোনওবারই ছিল না।
কিন্তু সবাইকে হতবাক করে দিয়ে বিশ্বকাপে আর্জেন্টিনা বিদায় নেয় গ্রুপ রাউন্ড থেকেই!
১৩।
বন্ধ ড্রেসিংরুমের ভেতরে তখন শ্মশানের স্তব্ধতা। শুধু দেওয়ালে মাথা ঠুকে চলেছে বছর ৪৬ এর লোকটা, তীব্র যন্ত্রণা।
সারা কোয়ালিফায়ারে জার্মান বার্গোস গোলকিপার হিসেবে খেললেও কাভালেরোকে বিশ্বকাপের তিন ম্যাচে খেলানো হয়েছে। সেই জার্মান বার্গোসই প্রথম এগিয়ে এলেন। লোকটাকে শান্ত করার চেষ্টা করলেন। এগিয়ে এলেন বাকি সতীর্থরা। তাঁরা জানেন, বিয়েলসা কী! তাঁরা দেখেছেন লোকটার প্রাণপাত পরিশ্রম। কিন্তু কী যে হয়ে গেল…
সেবারের বিশ্বকাপ জিতল চরম প্রতিদ্বন্দ্বী ব্রাজিল। দায়িত্বে লুইজ ফিলিপ স্কোলারি। যখন জানতে চাওয়া হল, তাঁর বিশ্বকাপ জয়ের রহস্য কী? ব্রাজিল তো কোয়ালিফায়ারে একেবারেই ভাল ফুটবল খেলেনি। সেখান থেকে সরাসরি বিশ্বকাপ জয়? কী করে সম্ভব?
স্কোলারি যে উত্তরটা দিয়েছিলেন সেটা চমকপ্রদ। “আমরা বিয়েলসার ফর্মেশন কপি করেছিলাম”। যদিও সেই ফর্মেশনে অনেকটাই পার্থক্য দেখা যায়, এতে সন্দেহ নেই বিয়েলসার খেলা থেকে রসদ সংগ্রহ করেছিলেন স্কোলারি।
১৪।
লোকটাকে আরও একটা সুযোগ দেওয়া হল। চারবছর ধরে কিছুটা ভাল কাজ তো করেছে! তাছাড়া অর্থনৈতিক মন্দার বাজারে বিনা বেতনেও কাজ করেছে। নতুন লোক চাইলে খরচও বাড়বে। উল্টে পে-কাট হল বিয়েলসার। কিন্তু রাখা হল তাকে দায়িত্বে। বলা হল একটু বাস্তববাদী হও! সারা দেশের কণ্ঠস্বরেই যেন ঝরছে সেই কথা “আইডিয়ালিজম দিয়ে ফুটবল চলে না”।
২০০৬ বিশ্বকাপ ফুটবলের যোগ্যতা অর্জন পর্ব শুরু হল। ঘরের মাঠে খেলা থাকলেই দর্শকদের বিদ্রুপ শোনা যায় বিয়েলসার নামে। ততদিনে বিয়েলসার হাতে এসেছে আরও কিছু তরুণ খেলোয়াড়। গ্রিফার স্কাউটিং এ উঠে আসা ও পেকেরম্যানের কোচিং এ যুব বিশ্বকাপ জেতা কার্লোস তেভেজ এবং বিয়েলসার নিজের খুঁজে আনা জেভিয়ার মাসচেরানো। মাসচেরানো ক্লাবে সিনিয়র দলে সুযোগ পাওয়ার আগেই সিনিয়র জাতীয় দলের জার্সিতে অভিষেক ঘটিয়ে ফেলেছেন। সৌজন্যে ‘এল লোকো’।
২০০৪ কোপা আমেরিকায় আর্জেন্টিনা তুখোড় খেলল। পৌঁছে গেল ফাইনালেও। সামনে ব্রাজিল। নির্ধারিত নব্বই মিনিট অবধি আর্জেন্টিনা এগিয়ে রইল ২-১ গোলে। ইনজুরি টাইমের শেষ মিনিটে বক্সে একটা বল এসে পড়ল, অগোছালো ভাবে বল ওড়াতে গিয়ে জটলার মধ্যে বল গিয়ে পড়ল দীর্ঘদেহী আদ্রিয়ানোর পায়ে এবং গোল! খেলা শেষমেশ গেল টাইব্রেকারে। হেরে গেল আর্জেন্টিনা। আবার হারল লোকটা।
এর কিছুদিন পরেই অলিম্পিক ফুটবলে আর্জেন্টিনা সোনা আনল লোকটার হাত ধরে। কিন্তু সোনাজয়ের দিন দশেক বাদে বিশ্বকাপ যোগ্যতাঅর্জনের ম্যাচে পেরুর সঙ্গে জিতে পদত্যাগ করল লোকটা। আবারও সব শক্তি যে নিঃশেষিত। এবার সময় চাই নিজের জন্য। অনেকটা। ঠিকানা হল একটা কনভেন্ট। নির্জনে থাকার লক্ষে শুধুমাত্র কিছু বই নিয়ে যেন নির্বাসনে গেল লোকটা। ফোন বা টেলিভিশন কিচ্ছু নেই সঙ্গে। সময় কাটল নানদের সান্নিধ্যে আর বই পড়ে। আর? নিজের সঙ্গে কথোপকথন, নিজের ফুটবল দর্শনকে আবারও ঝালিয়ে নেওয়ার পালা। লোকটা ২৪ ঘন্টা বাঁচেই যে ফুটবলে!
লোকটা চলে গেল। পেছনে রেখে গেল অনেক ইতিহাস। এই আর্জেন্টিনা দলের দরজা আর খুলবে না তার জন্য। আর ডাকবে না কেউ কোচ হতে হয়তো। পড়ে রইলেন তার শিষ্যরা। তরুণ মাসচেরানো, তরুণ তেভেজ অনেক পরে বুঝবেন কী হারালেন তাঁরা।
১৫।
এর বছর খানেক আগের কথা। ইতালির রোমা ক্লাবে খেলছেন কেরিয়ারের শেষ প্রান্তে পৌঁছে যাওয়া বাতিস্তুতা। তাঁর এক নামকরা সতীর্থ বাতিস্তুতাকে বললেন তিনি ফুটবল কোচিং এর জন্য প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস জানতে চান। বাতিস্তুতা বললেন, “আর্জেন্টিনায় চলে যাও, সেখানে মার্সেলো বিয়েলসার সঙ্গে দেখা করো। যদি সত্যিই জানতে আগ্রহী থাকো অনেক কিছু জানতে পারবে।” তাঁর সতীর্থ সেই পরামর্শ মাথায় রাখলেন।

 

ছবি ঋণ – Wikimedia

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.