ইন্টারনেটের যুগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অলিগলির খবর পর্যন্ত আমরা যেভাবে রাখি, আমেরিকানরাও ভারতের খবর সেভাবে রাখেন কিনা জানি না। মার্কিন জেলগুলোতে বন্দিদের ইন্টারনেট ব্যবহার করার অধিকার আছে কিনা তাও জানি না। তবে যদি থেকে থাকে, তাহলে নির্ঘাত সেখানে বসে ল্যারি নাসার আফসোস করছে ভারতে তার জন্ম হয়নি বলে। নামটা অচেনা? সেটাই স্বাভাবিক। বাংলা খবরের কাগজ আর টিভি চ্যানেলে খেলার খবর বলতে তো আইপিএল আর আইএসএল। আন্তর্জাতিক খেলা মানে বড়জোর ভারতীয় দলের ক্রিকেট আর ইউরোপের বিভিন্ন ফুটবল লিগ, চার বছরে একবার বিশ্বকাপ। ফলে ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসে দেড়শোর বেশি জিমন্যাস্টের সাক্ষ্যদানের পর দুই দশক ধরে যৌন নির্যাতন চালানোর অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত নাসারের ৪০ থেকে ১৭৫ বছরের কারাদণ্ডের খবর হয়ত অনেকেরই চোখে পড়েনি বা স্মরণ নেই। নাসার ছিল ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্স, ইউ এস অলিম্পিক কমিটি এবং মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির অগ্রগণ্য ডাক্তার। সেই মওকায় চিকিৎসার নাম করে সে মহিলা জিমন্যাস্টদের যথেচ্ছ যৌন নিপীড়ন করত।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

এমনিতে একজন আমেরিকানের ভারতীয় হয়ে জন্মাতে চাওয়ার কোনো কারণ নেই, বরং ভারতীয়রাই অনেকে আমেরিকান হয়ে জন্মাতে পারলে খুশি হত। কিন্তু নাসার মনে করতেই পারে, ভারতে জন্মালে সে স্রেফ ডাক্তার হয়ে না থেকে ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের শীর্ষ কর্তা হয়ে বসতে পারত। এমনিতেই তার বিকৃতির শিকার হওয়া মহিলাদের মুখ খুলতে বছর বিশেক সময় লেগেছে, কর্মকর্তা হলে নিশ্চয়ই তারা আরও ভয় পেত। ফলে আরও দেরিতে মুখ খুলত। খুললেও সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত না গেলে, অলিম্পিক পদকজয়ীরা রাস্তায় বসে না পড়লে পুলিস এফআইআর পর্যন্ত নিত না। নিলেও নাসার বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারত, সাংবাদিক সম্মেলন করতে পারত, যদি সে শাসক দলের টিকিটে নির্বাচিত সেনেটর হতে পারত। সেসব কিছুই হল না নাসার মার্কিন দেশে জন্মেছিল বলে। এসবের জন্যে যদি সে ব্রিজভূষণ শরণ সিংকে হিংসা করে, তাকে দোষ দেওয়া চলে কি? বিশেষ করে যখন দুজন কুস্তিগির ব্রিজভূষণের সম্পর্কে পুলিসের কাছে যে অভিযোগগুলো করেছেন তার সঙ্গে নাসারের বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের স্পষ্ট সাদৃশ্য রয়েছে।

এমন নয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মেয়েদের জন্যে একেবারে স্বর্গরাজ্য। ২০২১ সালে ইংল্যান্ডের দ্য গার্ডিয়ান কাগজের মার্কিন কলামনিস্ট ময়রা ডোনেগান দ্ব্যর্থহীন ভাষায় লিখেছিলেন নাসার কাণ্ডে ফেডেরাল ব্যুরো অফ ইনভেস্টিগেশনের (এফবিআই) অপদার্থতার কথা। হলিউডি থ্রিলার দেখার অভ্যাস যাঁদের আছে তাঁরা জানেন, এই এফবিআইকে প্রায়শই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ তদন্তকারী সংস্থা হিসাবে দেখানো হয়। ব্যতিক্রমী ছবি না হলে এফবিআইয়ের গোয়েন্দাদের এত তৎপর, এত সৎ বলে দেখানো হয় যেন তাঁদের চোখ এড়িয়ে মাছি গলতে পারে না। কিন্তু ডোনেগান লিখেছেন ২০১৫ সালে অলিম্পিয়ান ম্যাককেলা ম্যারোনি নাসারের নামে এফবিআইয়ের কাছে অভিযোগ জানানোর পরেও তারা নড়েচড়ে বসেনি। তারা তদন্ত শুরু করে ২০১৬ সালে যখন স্থানীয় পুলিস নাসারের একটা হার্ড ড্রাইভ থেকে ৩৭,০০০ শিশু নির্যাতনের ছবি বাজেয়াপ্ত করে। নাসারের নামে এফবিআইয়ের কাছে জমা পড়া প্রথম অভিযোগ থেকে শুরু করে তার বিরুদ্ধে প্রথম ব্যবস্থা নেওয়ার সময়টুকুতেও সে প্রায় ৭০ জন মহিলা এবং অপ্রাপ্তবয়স্ক মেয়ের উপরে নির্যাতন চালিয়েছে। নাসারের ঘটনা নিয়ে মার্কিন সেনেটে শুনানির সময়ে এফবিআই ডিরেক্টর ক্রিস রে স্বীকার করেন যে তাঁর সংস্থার গাফিলতি ছিল। কিন্তু তিনি দাবি করেন সেটা সংশ্লিষ্ট এজেন্টদের ব্যক্তিগত গাফিলতি, প্রাতিষ্ঠানিক ব্যাপার নয়। অথচ ডোনেগান লিখেছেন স্থানীয় পুলিস থেকে শুরু করে এফবিআই পর্যন্ত সর্বত্রই যৌন নির্যাতনের অভিযোগকে গুরুত্ব না দেওয়ার প্রবণতা রয়েছে। গোটা আমেরিকা জুড়ে বহু মেয়ের অভিজ্ঞতাই তা বলে। সেদিক থেকে আমাদের মেয়েদের চেয়ে মার্কিন মেয়েদের অবস্থা বিশেষ উন্নত নয় বলতে হবে। কিন্তু তাহলেও তফাত বিস্তর। কোথায় তফাত?

এফবিআইয়ের গড়িমসির কথা প্রকাশ্যে এল কী করে? মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাস্টিস ডিপার্টমেন্টের ইনস্পেক্টর জেনারেল নাসার কাণ্ডের তদন্ত সম্পর্কে যে অন্তর্তদন্ত চালিয়েছিলেন তার নির্মম রিপোর্ট থেকে। উপরন্তু যে তিনটে প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে নাসার যুক্ত ছিল, সেগুলোকেও ফল ভোগ করতে হয়েছে। মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটি কর্তৃপক্ষ চাপের মুখে অ্যাটর্নি জেনারেলকে দিয়ে সংগঠনের প্রতিক্রিয়া সঠিক ছিল কিনা সে সম্পর্কে তদন্ত করায়। ইউ এস অলিম্পিক কমিটি একসময় ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের অনুমোদন বাতিল করে দেবে ঠিক করেছিল। অলিম্পিক কমিটির চাপে তাদের সিইও এবং প্রেসিডেন্ট কেরি পেরিকে পদত্যাগ করতে হয়। এমনকি তাঁর স্থলাভিষিক্ত অন্তর্বর্তীকালীন সিইও এবং প্রেসিডেন্ট মেরি বনোকেও পদত্যাগ করতে হয় চারদিনের মাথায়, কারণ জিমন্যাস্টরা তাঁকে ওই পদে দেখতে চাননি। আসলে বনো এমন এক ল ফার্মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন যা নাসারকে সাহায্য করেছিল।

অর্থাৎ ও দেশে এক প্রতিষ্ঠানের দোষ দেখে অন্য প্রতিষ্ঠান শাক দিয়ে মাছ ঢাকেনি। অলিম্পিকে সোনা জয়ী সিমোন বাইলস, অ্যালি রাইসম্যান বা ম্যারোনি, ম্যাগি নিকলদের কথা সেনেট শুনেছে, আদালতও ধৈর্য ধরে শুনেছে। তার জন্যে তাঁদের ওয়াশিংটন ডিসি বা নিউইয়র্কের ফুটপাথে গিয়ে বসতে হয়নি। একথা সত্যি, যে ব্রিজভূষণ দোষী কি দোষী নন সেকথা বিচার করবে আদালত। কিন্তু তাঁকে গ্রেপ্তার করে আদালতের সামনে হাজির করার দায়িত্বটুকু নিতেও তো এ দেশের পুলিস বা সরকার রাজি নয়। এমনকি ভারতীয় অলিম্পিক কমিটির সভাপতি পিটি ঊষা কদিন আগে বলে বসেছিলেন, যৌন নির্যাতনের প্রতিবাদ করে বিনেশ ফোগত, বজরং পুনিয়া, সাক্ষী মালিকের মত কুস্তিগিররা নাকি দেশের বদনাম করছেন। নাসার কাণ্ডের বেলায় কিন্তু ইউ এস অলিম্পিক কমিটির প্রেসিডেন্ট সারা হির্শল্যান্ড একবারও বলেননি জিমন্যাস্টরা দেশের বদনাম করছেন। বরং জিমন্যাস্টদের বলেছিলেন, তাঁদের এই দুর্ব্যবহার প্রাপ্য নয়।

নাসার
ল্যারি নাসারের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দিতে হাজির ছিলেন সর্বকালের সেরা জিমন্যাস্টদের অন্যতম সিমোন বাইলস। ছবি: টুইটার

নাসার জেল খাটছেন, ইউএসএ জিমন্যাস্টিক্সের সেই কর্তারাও বিতাড়িত, জিমন্যাস্টরা আছেন স্বমহিমায়। বাইলস আরও একটা অলিম্পিকের প্রস্তুতি নিচ্ছেন, গোটা পৃথিবী অপেক্ষা করে আছে আবার কোন রুদ্ধশ্বাস দেহভঙ্গিমায় তিনি তাক লাগিয়ে দেবেন। এদিকে ভারতীয় কুস্তি ফেডারেশনের দায়িত্ব তুলে দেওয়া হয়েছে তিন সদস্যের অ্যাড হক কমিটির হাতে। নিউ ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস তাদের প্রতিবেদনে দাবি করেছে, এই অ্যাড হক কমিটি নাকি আসন্ন এশিয়ান গেমসের সংগঠকদের কাছে ভারত থেকে যে কুস্তিগিররা প্রতিযোগী হতে পারেন তার এক প্রাথমিক তালিকা পাঠিয়েছে। সেই তালিকায় প্রতিবাদী কুস্তিগিরদের মধ্যে থেকে বজরং, ভিনেশ আছেন। তাছাড়াও আছেন রবি দাহিয়া, দীপক পুনিয়া, অংশু মালিক, সোনম মালিক। কিন্তু অলিম্পিকে ব্রোঞ্জজয়ী সাক্ষী বাদ। কেন তিনিই বাদ? সরাসরি প্রধানমন্ত্রী এবং তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য স্মৃতি ইরানির জবাবদিহি দাবি করেছিলেন বলে কি?

আরো পড়ুন ক্রেডিটোলিম্পিকের মেডেল তালিকা

দেখে শুনে মনে হয়, কদিন আগে রাতের অন্ধকারে দিল্লি পুলিসের গলাধাক্কা খাওয়ার পর ভিনেশ কাঁদতে কাঁদতে ক্যামেরার সামনে যা বলেছেন তার চেয়ে ন্যায্য কথা নেই – দেশের মেডেল জেতার পরেও যদি এত অপমান সহ্য করতে হয়, তাহলে আর কারোর কখনো মেডেল না জেতাই ভাল।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.