ছোটবেলা থেকে এ যাবৎ যত গান শুনেছি বা গেয়েছি, তার মধ্যে রবীন্দ্রনাথের গান বোধহয় সবথেকে সম্পূর্ণ। কথা ও সুরের মধ্যে এমন অপূর্ব বন্ধুতা আমরা আর কোন গানেই বা পাই সেভাবে? কথার শক্তির সীমানা যেখানে শেষ হয়, সুর এসে সেখানেই হাত ধরে তার।

কথার জগত আর সুরের জগতের চলাচল ভিন্ন রকমের। তার ব্যাকরণও আলাদা আলাদা। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই যখন গান তৈরি হয় তখন গীতিকার এবং সুরকার মিলেই একটি গান বাঁধেন। কিন্তু একই ব্যক্তি যখন গান লেখেন ও সুর বাঁধেন, তখন তাঁকে এই দুই আলাদা ক্ষেত্রেই সমান দক্ষ হতে হবে সন্দেহ নেই। আমরা উনবিংশ ও বিংশ শতাব্দীর বাংলায় এমন কয়েকজন প্রতিভাবান স্রষ্টাকে পেয়েছিলাম, যাঁরা একাধারে গীতিকার এবং সুরকার। রবীন্দ্রনাথ ছাড়া এই ক্লাবে আমরা রাখতে পারি দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, কাজী নজরুল ইসলাম, অতুলপ্রসাদ সেন, রজনীকান্ত সেন এবং অবশ্যই সলিল চৌধুরীকে (হাল আমলেও আমরা পেয়েছি বেশকিছু নতুন যুগের নতুন ধারার গান কারিগর বা নাগরিক কবিয়ালদের। তার মধ্যে কবীর সুমন, অঞ্জন দত্ত এবং নচিকেতা চক্রবর্তীর নাম না করলেই নয়) এঁরা সকলেই বেশকিছু কালজয়ী গান সৃষ্টি করেছেন, কিন্তু রবীন্দ্রনাথের গান শিল্পের যে উচ্চতা ছুঁয়েছে তা অভাবনীয়। কথা ও সুরের মিলনে যে গান তৈরি হল তার নান্দনিকতা যে শুধু সুরেরই নয় বা কথারও নয় বরং সুর, তাল, ছন্দ ও কথার মিশ্রণে রাঁধা এক তৃতীয় পদের, এটা রবীন্দ্রনাথের প্রায় সব গানের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

তাঁর এক-একটা গান যেন তাঁর বিপুল কর্মযজ্ঞের অনবদ্য সব ট্রেলার। তাঁর গল্পে, উপন্যাসে, প্রবন্ধে, চিঠিপত্রে, নাটকে ও কবিতায় যে কথাগুলো আছে পাতার পর পাতা জুড়ে, তারই সারাৎসার আমরা পেয়ে যাই ১২-১৪ লাইনের কোনো গানে। জীবনের কোনো এক গভীর উপলব্ধিকে রবীন্দ্রনাথ ভাষায় ব্যক্ত করেছেন এবং সুর দিয়েছেন শুধু নয়, দেখা যাবে সেই একই ভাবনা থেকে জন্ম নিচ্ছে কোনো নাটক বা কবিতা বা উপন্যাস। আবার উল্টোটাও ঘটেছে। রবীন্দ্রনাথের এত সৃষ্টির মধ্যে মনে হয় তাঁর গানেই আমরা তাঁর জীবনদর্শনের সবথেকে নিবিড় ও আন্তরিক প্রকাশ পাই।

আরো পড়ুন বাঙালির রবীন্দ্রসঙ্গীত শোনা: অনুভবের ছবি

রবীন্দ্রনাথ সুরস্রষ্টা হিসাবে একাধারে প্রবল ভারতীয় এবং আন্তর্জাতিক। তাই তাঁর গান যেমন তানপুরার সঙ্গে গাওয়া যায়, তেমনি বিপুল অর্কেস্ট্রার সঙ্গে গাইলেও সে গান অন্য মাত্রা পায়। সেই কাজ আমরা বিজ্ঞানী পার্থ ঘোষের তত্ত্বাবধানে করা ‘টেগোর ইন সিম্ফনি’- তে শুনেছি, শুনেছি সত্যজিৎ রায়ের ছবির আবহসঙ্গীতে। সুরের প্রায়োগিক দিক দিয়ে তিনি বৈপ্লবিক কাজ করেছেন। ইমনকল্যাণের গানে একটি মাত্র জায়গায় ঝাঁকিয়ে দেওয়া কোমল ধা লাগিয়েছেন (দিনগুলি মোর সোনার খাঁচায়)। কখনো আবার ইমনের চলনে আমরা পেয়েছি পাশ্চাত্যের সিম্ফনির চলন (হৃদয় আমার নাচে রে আজিকে)। কখনো আবার ভৈরবীর চলনেও পেয়েছি একই সিম্ফনিক কন্টুর (আলোর অমল কমলখানি)। শ্রুতির প্রয়োগ করেছেন গানে, নোটেশনে দেখা পেয়েছি অতিকোমল, অনুকোমলের। গানের চারতুককে ভেঙেছেন। ব্যালাডধর্মী গান লিখেছেন। বাংলায় অপেরা বা গীতিনাট্য লিখেছেন। ‘নীল দিগন্তে’ শুনলে মনে মনে স্প্যানিশ ফ্লামেঙ্কোর সুর বেজে ওঠে। আবার ‘অন্তর মম বিকশিত করো’ শুনলে মনে আসে মধ্যপ্রাচ্যের সুর।

এইসব তথ্য বা কাটাছেঁড়া দিয়ে অবশ্য রবীন্দ্রনাথের গানের অন্তরকে স্পর্শ করা যায় না। তাঁর গানের আসল গুণ হল মর্মস্পর্শী হওয়ার ক্ষমতা। যে গান শুনে আমি মরণের ওপার থেকেও জেগে উঠতে পারি, যে গান শুনে কোনো মৃত্যুপথযাত্রী শান্তি পায়, যে গান শুনে আমাদের জীবন বর্তমানের কলুষতা থেকে কিছুক্ষণের জন্য হলেও মুক্তি পায় – সে গানের কোনো ব্যাখ্যা দিতে যাওয়া বোধহয় অনর্থক। যখন ব্রাত্যজনের রুদ্ধসঙ্গীত নাটক দেখতে গেছিলাম, তখন মনে হয়েছিল সারা প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে শুধু নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই আকাশভরা সূর্য তারা বাজছে। যখন মেঘ বলেছে যাব যাব শুনি, তখন স্পষ্ট বুঝতে পারি প্রকৃতির কাছে আমরা কতটা তুচ্ছ। এই বিশালতার প্রকাশ যে একমাত্র সঙ্গীতেই সম্ভব এবং অমন অসামান্য কাব্যিক কথায় যে সুরকে বাঁধা যায় – তা রবীন্দ্রনাথের গান থেকেই শিখতে পারি।

কতটা শিখতে পেরেছি তা অবশ্য জানি না, হয়ত এখনো ভুল করে চলেছি। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের কথা দিয়েই শেষ করি –

আমি         কখনো-বা ভুলি, কখনো-বা চলি
        তোমার পথের লক্ষ্য ধরে;
              তুমি নিষ্ঠুর সম্মুখ হতে
                                    যাও সে সরে।
              এ যে তব দয়া জানি জানি হায়,
              নিতে চাও বলে ফিরাও আমায়,
              পূর্ণ করিয়া লবে এ জীবন
                     তব মিলনেরই যোগ্য করে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.