আবার হিন্দুত্বের জিগির তুলেই কর্ণাটক বিধানসভার নির্বাচনী বৈতরণী পার হতে চাইছে বিজেপি। আবার বাসবরাজ বোম্মাই সরকারের “লাগামছাড়া দুর্নীতি”-কে ইস্যু করে ক্ষমতায় ফিরতে চাইছে রাজ্যের দুই মূল বিরোধী দল কংগ্রেস ও জনতা দল (সেকুলার) বা জেডিএস। জাতীয় রাজনীতির বর্তমান পরিস্থিতিতে কর্ণাটক ভোট বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কেন্দ্রে নরেন্দ্র মোদী সরকারের জনপ্রিয়তা অটুট রয়েছে, নাকি বৃহৎ বিরোধী জোটের বার্তা জনমানসে জায়গা করে নিচ্ছে, তার কিছুটা আভাস পাওয়া যেতে পারে আসন্ন কর্ণাটক নির্বাচনের ফলাফল থেকে। গত কয়েক বছরে ধারওয়াড়ে এম এম কালবুর্গি ও বেঙ্গালুরুতে গৌরী লঙ্কেশ হত্যা, স্কুল কলেজে হিজাব বিতর্ক, ফ্রেজার টাউনের গণতন্ত্র রক্ষার্থে হিন্দুত্ববিরোধী গণআন্দোলন, সাম্প্রতিক হিন্দুত্ববিরোধী মন্তব্য করার জন্য অভিনেতা ও সমাজকর্মী চেতন কুমারের গ্রেপ্তারি এবং তাঁর পাসপোর্ট বাতিল – একের পর এক ইস্যুতে জাতীয় রাজনীতির শিরোনামে এসেছে কর্ণাটক। এইসব ঘটনার প্রভাব আসন্ন নির্বাচনে কীভাবে পড়ে তা রাজ্যের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

সারা বিশ্বে নির্বাচনী রাজনীতিকে এখন ব্যাখ্যা করা হচ্ছে যে মেরুকরণের দৃষ্টিভঙ্গি থেকে, কর্ণাটকও তার ব্যতিক্রম নয়। তবে সুদূর অতীত ও সাম্প্রতিক অতীতের ফলাফল খুঁটিয়ে দেখলে দেখা যাবে ২২৪ আসনের কর্ণাটক বিধানসভা ভোট নিছক শাসক বিজেপি বনাম কংগ্রেসের লড়াই নয়, তৃতীয় শক্তি হিসেবে লড়াইয়ে রয়েছে জেডিএসও। এছাড়া নতুন শক্তি হিসাবে আম আদমি পার্টিও দক্ষিণের এই রাজ্যে খাতা খুলতে মরিয়া।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

২০১৮ সালের বিধানসভা নির্বাচনে ভোট পরবর্তী জোট গড়ে ক্ষমতায় এসেছিল কংগ্রেস ও জেডিএস। আসনের নিরীখে বিজেপি একক বৃহত্তম দল হলেও, ভোট শতাংশে এগিয়ে ছিল কংগ্রেস। তারা পেয়েছিল ৩৮.৬% ভোট, যা বিজেপির তুলনায় প্রায় ২% বেশি। অন্যদিকে জেডিএস ১৮ শতাংশের কিছু বেশি ভোট পায়, যা উড়িয়ে দেওয়ার মত নয়। বিজেপিকে ক্ষমতার বাইরে রাখতে কংগ্রেস ভোট-পরবর্তী কৌশল হিসাবে সমর্থন করে দেশের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী তথা রাজ্যের প্রাক্তন জনতা সরকারের মুখ্যমন্ত্রী এইচ ডি দেবগৌড়ার পুত্র কুমারস্বামীকে। তবে সেই সরকার ১৫ মাসের বেশি স্থায়ী হয়নি শাসক জোটের ১৮ জন বিধায়ককে এনডিএ ভাঙিয়ে নিতে সক্ষম হওয়ায়। কেন্দ্রীয় বিজেপি তথা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহের সক্রিয়তায় এই ঘোড়া কেনাবেচার পর রাজ্যে বি এস ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পার নেতৃত্বে ক্ষমতায় আসে বিজেপি সরকার। তবে পর্বতপ্রমাণ দুর্নীতির অভিযোগ মাথায় নিয়ে ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পা মুখ্যমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দেওয়ায় মুখ্যমন্ত্রী হন প্রাক্তন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী এস আর বোম্মাইয়ের পুত্র বাসবরাজ বোম্মাই। বর্তমানে বাসবরাজের বিরুদ্ধেও “৪০% কমিশন সরকার” বলে কামান দাগছেন কংগ্রেসসহ সব বিরোধী নেতা। মজার কথা, অন্যান্য রাজ্যের শাসকদের যে দুর্নীতিকে অস্ত্র করে ভোট প্রচারে নামেন মোদীরা, কর্ণাটকে সেই দুর্নীতিকেই বিজেপির বিরুদ্ধে হাতিয়ারে পরিণত করেছে বিরোধীরা।

কর্ণাটক রাজনীতির জাতিবিন্যাস দেখলে বোঝা যাবে ওই রাজ্যে লিঙ্গায়েতদের প্রাধান্য রয়েছে। বিশেষ করে যখন রাজ্যের ২৩ জন মুখ্যমন্ত্রীর মধ্যে ১০ জনই এসেছেন লিঙ্গায়েতদের মধ্যে থেকে। তবে লিঙ্গায়েত গোষ্ঠীর ভোট ১৭%। রাজ্যের লিঙ্গায়েতপ্রধান অঞ্চলের আসন সংখ্যা ৬৭, গত নির্বাচনে যার ৪০টি গিয়েছিল বিজেপির দখলে। কংগ্রেস জিতেছিল ২০টি আসনে, জেডিএসের দখলে যায় ছটি আসন। এইসব আসনে বিজেপির ভোট ৪১%, কিন্তু কংগ্রেস ও জনতা দলের সম্মিলিত ভোট ৫০ শতাংশের কিছু বেশি। অর্থাৎ গতবারের নিরীখে বিজেপি কিছুটা এগিয়ে থাকলেও বর্তমানে এই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিজেপির নিরঙ্কুশ প্রাধান্য রয়েছে এমন কথা বলা যাবে না। বিদায়ী বিধানসভায় ৫৪ জন লিঙ্গায়েত বিধায়ক রয়েছেন, যার মধ্যে ৩৭ জন বিজেপির। একসময় অবিভক্ত জনতা দলের ঘাঁটি এইসব অঞ্চলে বিজেপিকে প্রতিষ্ঠা করতে বড় ভূমিকা নিয়েছিলেন ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পা এবং তাঁর দক্ষিণ হস্ত বলে পরিচিত জগদীশ শেট্টার। এ বছর ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পা বিজেপির প্রচারের প্রধান মুখ নন (যদিও তাঁর পুত্র লড়ছেন শিকারপুরাতে লড়ছেন)। উপরন্তু শেট্টার, লক্ষ্মণ সাদাভির মতো নেতারা দল ছেড়ে কিছুদিন আগেই কংগ্রেসে যোগ দিয়েছেন। তাই রাজনৈতিক মহলের ধারণা লিঙ্গায়েত ভোটের একাংশ বিরোধী শিবিরের যেতে চলেছে। ১৯৯৮ সালের লোকসভা নির্বাচনের আগে এইচ ডি দেবগৌড়া এবং রামকৃষ্ণ হেগড়ে-এস আর বোম্মাইদের ইগোর লড়াইয়ে জনতা দল ভেঙে দু টুকরো হয়ে যায়। ‘বিদ্রোহী’ হেগড়ে গোষ্ঠীর সঙ্গে হাত মিলিয়ে প্রথম লিঙ্গায়েত অঞ্চলে জমি তৈরি করেছিল বিজেপি। এখন দেখার, দলছুট লিঙ্গায়েত নেতাদের প্রভাবে কত শতাংশ ভোট বিপরীতমুখী হয়।

দাক্ষিণাত্যের এই রাজ্যের বৈশিষ্ট্য হল, কেন্দ্রীয় ভোটের হাওয়া বা দিল্লির নেতাদের প্রভাব এখানে বিশেষ কাজ করে না। বরং আঞ্চলিক রাজনীতির সমীকরণ এবং স্থানীয় নেতারাই বিধানসভা ভোটে জনগণকে অনেক বেশি আন্দোলিত করেন। ২০১৩ সালের নির্বাচনে ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পা বিজেপি থেকে সরে দাঁড়ানোয় মুখ থুবড়ে পড়েছিল পদ্ম শিবির। দেশজুড়ে তৈরি হওয়া ইউপিএ-বিরোধী হাওয়ার কোনও প্রভাব পড়েনি কর্ণাটকের ভোটে। একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় ফিরে আসে কংগ্রেস। আবার তার আগে ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পার নেতৃত্বেই ২০০৯ নির্বাচনে প্রথমবার এককভাবে ক্ষমতায় এসেছিল বিজেপি, সেবছরই লোকসভা ভোটে কংগ্রেসের বিরাট জয় সত্ত্বেও। এবার ভোটেও এই প্রবণতার ব্যতিক্রম হওয়া মুশকিল। তাই মোদী, রাহুল গান্ধী, অমিত শাহ, মল্লিকার্জুন খড়্গেরা যতই রাজ্যের বিভিন্ন জেলায় প্রচারে যান না কেন, তাঁদের ছাপিয়ে স্থানীয় জনগণ এবং রাজনৈতিক মহলের মধ্যে অনেক বেশি আগ্রহ সিদ্দারামাইয়া, বাসবরাজ, ইয়েদ্দিয়ুরাপ্পা, শেট্টার, শোভা কারনদলাজে, ডি কে শিবকুমার, কুমারস্বামী, এমনকি নব্বই ছুঁই ছুঁই দেবগৌড়াকে ঘিরে। যদিও পদ্ম বা হাত শিবির, কেউই মুখ্যমন্ত্রী পদপ্রার্থী হিসাবে কাউকে নির্দিষ্টভাবে উপস্থাপন করেনি। বিজেপির মধ্যে এই লড়াই ‘বিতর্কিত’ মুখ্যমন্ত্রী বাসবরাজের সঙ্গে ভোক্কালিগা নেত্রী শোভার; হাত শিবিরে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী সিদ্দারামাইয়া আর ১০ নম্বর জনপথের ঘনিষ্ঠ শিবকুমারের।

মেরুকরণের হাওয়া তুলতে তাই বিভিন্ন রণনীতি প্রয়োগ করছে বিজেপি। কংগ্রেস নেতা খড়্গে মোদীকে “বিষধর সাপ” বলে আক্রমণ করার বল পড়তে না দিয়েই সোনিয়া গান্ধীকে “চিন-পাকিস্তানের এজেন্ট” বা “বিষকন্যা” বলে প্রতিআক্রমণ করেছে গেরুয়া শিবির। তবে মেরুকরণের হাওয়া তীব্র করতে ভোটের আগে বিজেপির মোক্ষম চাল নয়া সংরক্ষণ নীতি। এই তাস ইতিমধ্যেই যথাসম্ভব খেলে ফেলেছে বিজেপি নেতৃত্ব। রাজ্যের মুসলমানদের জন্য ৪% সংরক্ষণ বাতিল করা হয়েছে, যা সমান ভাগে বন্টন করা হয়েছে লিঙ্গায়েত ও ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের মধ্যে। আবার তফসিলি জাতি, উপজাতির জন্য ২% অন্তর্বর্তী কোটা বৃদ্ধি করা হয়েছে। লিঙ্গায়েত সম্প্রদায় এবং তফসিলি জাতি, উপজাতিদের একাংশ সন্তুষ্টি প্রকাশ করলেও মুসলমান, বাঞ্জারা, ভোক্কালিগাদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ দেখা গিয়েছে এই নয়া সংরক্ষণ নীতি নিয়ে। বাঞ্জারা সম্প্রদায় এই নিয়ে সরাসরি আন্দোলনেও নেমেছে রাজ্য সরকারের বিরুদ্ধে। তাদের দাবি, অন্তর্বর্তী সংরক্ষণে তাদের তফসিলি জাতির আওতায় রাখতে হবে। কর্ণাটকে অন্যান্য রাজ্যের তুলনায় মুসলমান ভোট কম – ১৩ শতাংশের কিছুটা কম। অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণির (ওবিসি) ভোট এই রাজ্যে প্রায় ৩৫%, যার মধ্যে পড়ে বাঞ্জারা গোষ্ঠী। তফসিলি হাতি, উপজাতির ভোট ১৮% আর ব্রাহ্মণ ভোট মাত্র ৩%।

কংগ্রেসের পাল্টা কৌশল হল সদ্য প্রকাশিত ইশতেহারে মুসলমানদের জন্য ৪% সংরক্ষণ ফিরিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি। তাছাড়া মোট সংরক্ষণ ৫০% থেকে বাড়িয়ে ৭৫% করার কথাও বলা হয়েছে যাতে সব সম্প্রদায়, জাতি ও উপজাতির কোটা বৃদ্ধি পায়। বিজেপির ইশতেহারে কর্ণাটকে এনআরসি করা এবং সারা দেশে অভিন্ন দেওয়ানি আইন চালু করার প্রতিশ্রুতির মোকাবিলায় শিবকুমারদের ঘোষণা – ক্ষমতায় এলে এক বছরের মধ্যে বিজেপি সরকার প্রণীত সমস্ত জনবিরোধী আইন প্রত্যাহার করে নেওয়া হবে। এছাড়াও রাজ্যে বজরং দলের মত উগ্র হিন্দুত্ববাদী সংগঠনকে নিষিদ্ধ করার কথাও বলা হয়েছে।

লিঙ্গায়েত ছাড়াও রাজ্যে জাতিভিত্তিক বিন্যাসে গুরুত্বপূর্ণ ভোক্কালিগা, মুসলমান ও ওবিসি ভোটব্যাঙ্ক। ভোক্কালিগা সম্প্রদায়ের ভোট ১৫%, এবং ৪৪টি আসনে নির্ণায়ক ভূমিকা এই সম্প্রদায়ের ভোটের। এই অঞ্চলে জেডিএসের প্রাধান্য রয়েছে। গত নির্বাচনে জেডিএসের জেতা ৩৭ আসনের ২১টি এসেছিল ভোক্কালিগা ভোটব্যাঙ্কের কল্যাণে। এবারও পুরনো মাইসুরু অঞ্চলে পঞ্চরত্ন প্রকল্প রূপায়ণের প্রতিশ্রুতি দিয়ে একের পর এক সভা করছেন কুমারস্বামী ও দেবগৌড়া। ভোক্কালিগা ভোট ধরতেও গত বছর থেকে এক নতুন কৌশল নেয় সংঘ পরিবার। একটি নাটক বিভিন্ন অঞ্চলে মঞ্চস্থ করা হয়, যেখানে দেখানো হয়েছে যে টিপু সুলতান দুজন স্থানীয় ভোক্কালিগার হাতে নিহত হন। ইতিহাসবিদরা নাটকের ওই দুই চরিত্রকে সম্পূর্ণ কাল্পনিক বলে আখ্যা দিয়েছেন। নাট্যকার আদান্দা কারিয়াপ্পা কোনো প্রত্যুত্তর দিতে পারেননি। ভোক্কালিগাদের প্রধান মঠ থেকেও এই তত্ত্বকে সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং তাদের সম্প্রদায়ের সঙ্গে মুসলমানদের বিভাজন ঘটানোর উদ্দেশ্যে নির্মিত বলে খারিজ করা হয়। রাজ্যের সমাজকর্মী-অভিনেতা প্রীতম কুমার বলেন “হিন্দুত্বের তত্ত্ব মিথ্যের ওপর নির্মিত”। এই নাটকের ঘটনা একথাকেই সঠিক বলে প্রমাণ করে।

কংগ্রেসের সঙ্গে ভোট পূর্ববর্তী কোনো আসন সমঝোতায় যায়নি জেডিএস। দক্ষিণ কর্ণাটকের বিস্তীর্ণ অঞ্চলে তাদের বিরুদ্ধেই কংগ্রেসের লড়াই। জেডিএসের পাখির চোখ আসন সংখ্যা বাড়িয়ে ভোটের ফলাফল ত্রিশঙ্কু করা। একমাত্র নাঞ্জাগুড আসনে প্রয়াত কংগ্রেস নেতা ধ্রুবনারায়ণের পুত্র দর্শন ধ্রুবনারায়ণকে সমর্থন করছে কুমারস্বামীর দল। তবে ২০২৪ লোকসভা ভোটের আগাম কৌশল হিসাবে কেরালার জোটসঙ্গী সিপিএমের সঙ্গে বিশেষ আসন সমঝোতা করেছেন দেবগৌড়ারা। বাগেপল্লি, কৃষ্ণরাজপুরম আর গ্রামীণ কালবুরাগি আসনে বাম প্রার্থীকে সমর্থন করবে জেডিএস। রাজনৈতিক মহলের একাংশের ধারণা, কুমারাস্বামীর দলই ভোট পরবর্তী সমীকরণে হয়ে উঠবে রাজ্যের ‘কিং মেকার’।

সংখ্যালঘু অধ্যুষিত অঞ্চলে নিঃসন্দেহে এগিয়ে রয়েছে কংগ্রেস। আবার ওবিসি-প্রধান অঞ্চলে বিজেপির দাপট বেশি। গতবার নির্বাচনে ১৮টি মুসলিম অধ্যুষিত আসনের মধ্যে কংগ্রেস জেতে ১১টি, বিজেপি ছটি আর জেডিএস একটি। এবার ৪% সংরক্ষণ বাতিল হওয়া এবং হিন্দুত্ববাদীরা একের পর এক হিংসাত্মক ঘটনা ঘটানোয় মুসলমান ভোট আরও এককাট্টা হয়ে এক বাক্সে যাওয়ার সম্ভাবনা বেড়েছে। সেক্ষেত্রে বিজেপির প্রধান বিরোধী হওয়ায় কংগ্রেসের দিকেই পাল্লা ভারি। অন্যান্য অনগ্রসর জাতিপ্রধান ২৪ আসনেও শাসক বিজেপির ভোটে ভাগ বসাতে পারে কংগ্রেসসহ বিরোধীরা। এক্ষেত্রে বিজেপি সরকারের দুর্নীতি, গ্রামীণ কর্মসংস্থান, অনুন্নয়ন, ক্রমবর্ধমান উচ্চবর্ণের আক্রমণের ঘটনাকে ইস্যু করে জোরদার প্রচারে নেমেছে কংগ্রেস ও অন্যান্য বিরোধীরা। গেরুয়া শিবিরের পক্ষে গতবারের ৪৫% শতাংশ ভোট এবং ১৮ আসন ধরে রাখা কঠিন।

আরো পড়ুন রাহুল গান্ধীর সঙ্গে জড়িয়ে গেল গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ

দক্ষিণের পাঁচটি রাজ্যের মধ্যে কর্ণাটকে বামপন্থীরা সবথেকে দুর্বল। রাজ্যের গত তিনটি বিধনসভায় কোনো বাম সদস্য ছিলেন না। অন্ধ্র সীমান্তের কাছে চিক্কাবালপুরা জেলার বাগেপল্লি আসনটিতে সিপিএম গতবার দ্বিতীয় হয়েছিল ১৪,০০০ ভোটে কংগ্রেস প্রার্থীর কাছে হেরে। অতীতে তিনবার এই আসনটিতে জয়ী হয় তারা, শেষবার ২০০৪ সালে। এবার জেডিএস সমর্থন করায় বাম প্রার্থী ডঃ অনিল কুমার আভুলাপ্পার জয়ের সম্ভাবনা নিঃসন্দেহে বেড়েছে এই খনি অঞ্চলে। আরেক বাম দল সিপিআইও বাগেপল্লিতে সিপিএম প্রার্থীকে সমর্থন জানিয়েছে। অন্যত্র “সাম্প্রদায়িক শক্তিকে রুখতে” ২১৫ আসনে কংগ্রেস প্রার্থীদের সমর্থন করবে সিপিআই। কর্ণাটকে মাত্র সাতটি আসনে তারা প্রার্থী দিয়েছে এবং কংগ্রেসের সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ লড়াইয়ের কথা ঘোষণা করেছে। বিজেপির যাত্রা ভঙ্গ করতে রাজ্যের উপকূলবর্তী কোনো আসনে প্রার্থী দেয়নি এই দুই বাম দল। এছাড়া সিপিআই (এম এল) লিবারেশন দুটি আসনে লড়ছে। অন্যত্র যেখানে যারা বিজেপিবিরোধী প্রধান শক্তি তাদের সমর্থন করবে লিবারেশন। তবে বামপন্থী দলগুলোর মধ্যে কোনো আসন সমঝোতা হল না কেন তা জনগণের কাছে বিভ্রান্তিকর হতে পারে। বেঙ্গালুরুর কে আর পুরমে সিপিএম ও লিবারেশন – দুদলেরই প্রার্থী রয়েছে। পূর্বোল্লিখিত আরও দুটি আসনে জেডিএস সিপিএমকে সমর্থন করলেও বাগেপল্লি ছাড়া কর্ণাটকে আর কোনো আসনে বামেদের জয়ের সম্ভাবনা নেই।

দেশজুড়ে যখন বিরোধী দলগুলো একত্রিত হওয়ার তোড়জোড় শুরু করেছে, তখন আসন্ন কর্ণাটক নির্বাচন শাসক ও বিরোধী – দুপক্ষের কাছেই বড় চ্যালেঞ্জ। ২০২৪ লোকসভার আগে গেরুয়া শিবির দক্ষিণ ভারতে তাদের একমাত্র গড় ধরে রাখতে মরিয়া। আবার বিরোধী শক্তি কর্ণাটকে বিজেপিকে ক্ষমতাচ্যুত করে সারা দেশকে পরিবর্তনের বার্তা দিতে সচেষ্ট। বিহারের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার বলেছেন, কর্ণাটক নির্বাচনের ফলাফল ঘোষণার পরই দেশে বৃহৎ বিরোধী জোট গড়তে বহুদলীয় বৈঠক-কর্মসূচি নেওয়া হবে। গত লোকসভা ভোটে সারা দেশের মত কর্ণাটকেও গেরুয়া ঝড় উঠলেও চার বছর পর হিন্দুত্বের হাওয়া অনেকটাই স্তিমিত। এই পরিস্থিতিতে বিরোধীদের বড় জয় দক্ষিণ ভারত থেকে গেরুয়া মুছে দিয়ে জাতীয় রাজনীতিকে দিতে পারে নতুন দিশা – একথা বিলক্ষণ জানেন মোদীরা। লোকসভা নির্বাচনে পুলওয়ামার ঘটনার প্রভাব পড়েছিল। বর্তমানে সত্যপাল মালিকের বহুচর্চিত সাক্ষাৎকার অস্বস্তিতে ফেলেছে মোদীসহ বিজেপি নেতৃত্বকে। এখন পর্যন্ত নির্ভরযোগ্য ভোট সমীক্ষাগুলো বলছে কর্ণাটকে সরকারবিরোধী হাওয়া তীব্র, যার প্রভাবে বিধানসভা ত্রিশঙ্কু হওয়ার সম্ভাবনা বেশি। যদি এই সমীক্ষা ঠিক হয়, তাহলে নির্বাচনোত্তর জোট, না আবার ঘোড়া কেনাবেচা? কোনটা অপেক্ষা করছে কর্ণাটকের মানুষের জন্য, তা সময় বলবে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.