এ বছর ফেব্রুয়ারি মাসের ২৭ তারিখে রাজ্যের বাংলা দৈনিক সংবাদপত্রগুলোতে একটা সংবাদ প্রকাশিত হয় যে রাজ্য সরকার প্রাইমারি, আপার প্রাইমারি ও হাইস্কুল মিলিয়ে এমন ৮২০৭টা স্কুলকে চিহ্নিত করেছে, যাদের ছাত্রসংখ্যা গড়ে তিরিশের কম। সেই খবর অনুযায়ী, রাজ্য সরকার এই স্কুলগুলোকে ধাপে ধাপে বন্ধ করার দিকে এগোতে চাইছিলেন। তারপর এই প্রতিবেদন নিয়ে কিঞ্চিৎ চেঁচামেচি হওয়ায় রাজ্য সরকারের শিক্ষা দপ্তরের অধিকর্তারা ঠান্ডা ঘর থেকে নড়েচড়ে বসে জানালেন যে এই মুহূর্তে তাঁরা এসব নিয়ে ভাবছেন না।

এই মুহূর্তে ভাবছেন না মানেই যে পরে ভাববেন না, তা তাঁরা নিশ্চিত করে বলেননি, বলার দায়ও তাঁদের নেই। যাঁরা সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাকে অপরিবর্তনীয় ভাবেন, এ প্রসঙ্গে তাঁদের জন্য একটা প্রয়োজনীয় তথ্য দিই। ২০১৫ সালে রাজস্থানে তৎকালীন বিজেপি সরকার ৭০,০০০ সরকারি স্কুলকে এক ধাক্কায় বেসরকারি করতে গিয়েছিল। সাড়ে তিন লাখ শিক্ষক, শিক্ষাকর্মী এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন, তাই সে যাত্রায় স্কুলগুলো রক্ষা পায়। এরপর ভেঁপু বাজিয়ে জাতীয় শিক্ষানীতি চালু হয়ে গেছে, আমাদের রাজ্য তা মেনেও নিয়েছে। জাতীয় শিক্ষানীতিতে শিক্ষায় বেসরকারিকরণের পথ ইতিমধ্যেই খুলে দেওয়া হয়েছে, আর এ রাজ্যে বর্তমানে কারাবাসে থাকা প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী পার্থ চট্টোপাধ্যায় তাঁর আমলে বেসরকারি লার্নিং অ্যাপ টিউটোপিয়ার বিজ্ঞাপনে মুখ দেখিয়েছিলেন। সব মিলিয়ে বেশ ‘বেসরকারি হলে পরিষেবা ভাল হবে’ গোছের অনুভূতি চারিদিকে। দেশ বিক্রি হতে বসেছে, সামান্য কটা স্কুল কলেজ বিক্রি হলেই কী-ই বা এসে যায়?

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

যাকগে, মূল আলোচনায় ফিরি। যে ৮২০৭টা স্কুলের কথা বলা হচ্ছে, তার মধ্যে আপার প্রাইমারি স্কুল রয়েছে। প্রাইমারি আর হাইস্কুল নিয়ে সাধারণ মানুষের ধারণা থাকলেও আপার প্রাইমারি স্কুল নিয়ে অধিকাংশের খুব স্পষ্ট ধারণা নেই। আজকের আলোচনা এই আপার প্রাইমারি স্কুল নিয়ে। আপার প্রাইমারি স্কুলে ক্লাস ফাইভ থেকে এইট পর্যন্ত পড়ানো হয়। মূলত স্কুলের অভাব থেকেই ২০০৭ সালে তৎকালীন রাজ্য সরকার রাজ্যজুড়ে আরও কিছু আপার প্রাইমারি স্কুল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নেয় (Order no 125 SE(S)/ES/S/35-47/2006, Dated- 15/02/2007)। এই নতুন আপার প্রাইমারি স্কুল গড়ে ওঠার পিছনে কিছু শর্ত ছিল। শিক্ষার অধিকার আইন অনুযায়ী শহরাঞ্চলে প্রতি এক কিলোমিটারে আর গ্রামে দু কিলোমিটারে বাচ্চাদের জন্য স্কুল থাকতে হবে। সেই হিসাবে ২০১২-১৩ সালে শিক্ষা দপ্তর মোট ২০৭২টা আপার প্রাইমারি স্কুল গড়ে তোলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল।

এই আপার প্রাইমারি বা জুনিয়র হাই স্কুলগুলোর পরিকাঠামো নিয়ে দু-চার কথা বলা দরকার। প্রাথমিক অবস্থায় সাকুল্যে তিনজন শিক্ষকের পদ অনুমোদিত হয়। একটা বিজ্ঞান শাখার, একটা ভাষার আর একটা সমাজবিজ্ঞানের। পরবর্তীকালে আরও দুটো পদ অনুমোদিত হয়। কোনো কেরানির পদ ছিল না, একজন করে পিওন দেওয়া হয়েছিল। অধিকাংশ আপার প্রাইমারি স্কুলের কোনো নিজস্ব ভবন ছিল না। পাশের প্রাইমারি স্কুল বা হাইস্কুলে একটা বা দুটো ঘর নিয়ে এই স্কুলগুলো চালু হয়। তারপরে ভবন তৈরির বরাদ্দ থেকে নিজস্ব ভবন গড়ে ওঠে। প্রত্যেকটা আপার প্রাইমারি স্কুলে ৫০০ জন করে ছাত্রছাত্রী ভর্তির লক্ষ্যমাত্রা রাখা হয়।

এই অব্দি সবই শুনতে ভাল ছিল। মুশকিল হল, রাজ্যের শিক্ষা দপ্তরের সৌজন্যে শিক্ষক নিয়োগ বিষয়টা ডোডো পাখির মত হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্কুলগুলো শিক্ষকের ঘাটতিতে ভুগছিল। যে স্কুলে তিনজন মাত্র শিক্ষক, সেখানে ক্লাস ফাইভ থেকে এইট, এই চারটে ক্লাস একসাথে চলে কী করে – এই সহজ ভাবনাটা শিক্ষা দপ্তর কখনো ভাবেনি। তার উপর কোনো কেরানি না থাকায় একজন শিক্ষককে সারাক্ষণ পড়ানোর বাইরের কাজে ব্যস্ত থাকতে হয়। মিড ডে মিলের দৈনিক রিপোর্ট, অমুক স্কলারশিপের হিসাব, পোর্টালে তথ্য আপলোড করা, সবই করতে হয় নিয়মিত। এক চুল দেরি হলে শিক্ষা দপ্তর চেঁচামেচি শুরু করে। এই রিপোর্ট চাওয়ার ব্যাপারটাও খুব অদ্ভুত। ধরা যাক, দুপুর তিনটের সময় খাস কলকাতায় শিক্ষা দপ্তরের ঠান্ডা ঘরে বসে ফুসকুড়ি চুলকোতে চুলকোতে মাননীয় বড় কর্তার মনে হল হাইস্কুলের কার্নিশে কটা টিকটিকি ল্যাজ ঝুলিয়ে বসে রোদ্দুর মাখে তা জানা দরকার। কর্তার ইচ্ছায় কর্ম। অমনি রিপোর্ট চেয়ে হুকুমনামা টাইপ হয়ে সেই রাতেই স্কুল শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকদের কাছে পৌঁছে গেল। তাঁরা তা পাঠিয়ে দিলেন প্রধান শিক্ষকদের কাছে, বললেন বেলা বারোটার মধ্যে রিপোর্ট দিতেই হবে। রিপোর্ট তো গেল, কিন্তু তাতে কাজের কাজ কী হল দেবা ন জানন্তি।

রিপোর্টের পর রিপোর্ট যায়, স্কুল ভিজিট হয়, ভবন নির্মাণের জন্য টাকা আসে সর্বশিক্ষা অভিযানের কল্যাণে। সবই হয়, কিন্তু তিনটে মাস্টার চারটে ক্লাস কীভাবে চালায় আর লেখাপড়া কী করে হয় তার হদিশ মেলে না।

আরো পড়ুন ৮,০০০ স্কুল বন্ধ: শিক্ষাব্যবস্থার কণ্ঠরোধ করছে সরকার

এই আপার প্রাইমারি স্কুলের অনেকগুলোই কিন্তু বেশ ভালো চলে। শ চারেক ছাত্রছাত্রী রয়েছে এমন স্কুলের সংখ্যা নেহাত কম নয়। আবার কিছু স্কুল একদমই চলে না। তার কারণ মূলত দুটো। প্রথমটা অবশ্যই শিক্ষক সংকট। অনেক আপার প্রাইমারি স্কুলে একজনও স্থায়ী শিক্ষক নেই। অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষকদের অতিথি শিক্ষক হিসাবে রেখে কাজ চালানো হয়। তাঁরা নাম কে ওয়াস্তে একটা বেতন পান, ফলে কাজ করার তাগিদ অনেক ক্ষেত্রেই থাকে না। তার উপর ওই শিক্ষকদের বয়স ৬৫ পেরিয়ে গেলে আর পুনর্নিয়োগ হয় না, তখন স্কুলগুলোতে আর কোনো শিক্ষকই থাকেন না।

দ্বিতীয় কথা, পরিকাঠামো। এই আপার প্রাইমারি স্কুলগুলোতে কোনো লাইব্রেরি নেই। শারীরশিক্ষা, কর্মশিক্ষা, তৃতীয় ভাষা পড়াবার কোনো শিক্ষক নেই। অধিকাংশ ক্ষেত্রে নিজস্ব খেলার মাঠও নেই। কোনো সচেতন ও সক্ষম অভিভাবক নিশ্চয়ই এমন স্কুলে নিজেদের ছেলেমেয়েদের ভর্তি করতে চাইবেন না যেখানে তারা পর্যাপ্ত শিক্ষক এবং ন্যূনতম পরিকাঠামো পাবে না।

নিজের বিদ্যায়তনিক প্রয়োজনে এই স্কুলগুলো ঘুরে দেখেছি, ছাত্রছাত্রীরা মূলত নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে আসে। তাদের মিড ডে মিলটা প্রতিদিন হওয়া প্রয়োজন। কিন্তু তার সঙ্গে শিক্ষার প্রয়োজন নিয়ে সরকার বাহাদুর একেবারেই ভাবিত নন।

গত শিক্ষাবর্ষে এ রাজ্যে ৭০-এর কাছাকাছি আপার প্রাইমারি স্কুল বন্ধ হয়ে গেছে। কলকাতা শহরে একের পর এক পুরোনো বাংলা মাধ্যম স্কুল ছাত্রছাত্রীর অভাবে বন্ধ হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে। রগরগে, মুচমুচে খবর নয় বলেই দৈনিক সংবাদপত্রের প্রথম পাতায় আসে না আর আমাদের মত সচ্ছল শিক্ষিত লোকেদের ছেলেপুলে যেহেতু প্রায় সবাই বেসরকারি স্কুলে পড়ে, তাই এ নিয়ে আমরাও ভাবিত নই।

মুশকিল হচ্ছে, আগুন বাড়ি বেছে পোড়ায় না। আজ মাননীয় সরকার বাহাদুর সরকারি শিক্ষাব্যবস্থাটাকে লাটে তুলতে চাইছেন। তাতে হয়ত আপাত দৃষ্টিতে আমরা কেউ আক্রান্ত হচ্ছি না, সরকারি শিক্ষাব্যবস্থা উঠে গেলে মূলত আক্রান্ত হবেন গরীব মানুষই। তাদের নিয়ে কে-ই বা কবে ভাবতে গেছে? আমাদের নেটফ্লিক্স অ্যাকাউন্ট, ফাইভ জি ডেটা স্পিড, মধ্যবিত্ত সুখযাপন – কোনোটাই বিঘ্নিত হচ্ছে না। কিন্তু এই আগুন আমাদের ঘরে এসে হানা দিলে তখন ফিরে তাকাবার সময় থাকবে তো?

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.