১
প্রায় দর্শকহীন অলিম্পিকো স্টেডিয়ামে আচমকাই ভুল হয়ে গেল স্টিফান রাডুর। বাঁ দিক থেকে উড়ে আসা ক্রস তাড়াহুড়োয় তার মাথা ছুঁয়ে চলে গেল প্রতিপক্ষের পায়ে৷ ফল যা হবার তাই। মিনিট দশেকের মধ্যে প্রতিপক্ষের মাঠে লিড আতালান্তার। পরের দশ মিনিটে আরো একটা। প্রথমার্ধ শেষ হতে দেখা গেল জাঁ-পিয়েরো-গ্যাস্পারিনির আতালান্তার হাতে নিজেদের দুর্গেই ল্যাজে গোবরে অবস্থায় পড়ে গিয়েছে অলিম্পিকো স্টেডিয়ামের অন্যতম অংশীদার লাজিও ফুটবল ক্লাব। উয়েফা ও ইতালিয়ান ফুটবল ফেডারেশনের নির্দেশে তখন স্টেডিয়াম জুড়ে সমর্থকদের গলার আওয়াজের রেকর্ড বাজছে সজোরে। খেলা শেষ হতে হতে ৪-১। টানেলে উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছেন আতালান্তার ফুটবলাররা। আপশোষ একটাই। মাঠের কোথাও লেখা নেই ‘নন ক্যামিনিরাই মাই সোলো’– ইংরেজিতে যার আক্ষরিক অনুবাদ ‘ইউ নেভার ওয়াক আ্যালোন।‘ তাদের উচ্ছ্বাসের ভাগীদার তারা একাই। অন্যদিকে মাথা হেঁট করে মাঠ ছাড়লেন লাজিও ফুটবলাররা। তাদের ভরসা একটাই। ‘কার্ভা নর্থ’ বা গ্যালারির উত্তরাংশ থেকে অন্তত আজকের দিনটা জ্বলন্ত আতসবাজি উড়ে আসবে না তাদের দিকে। মাঠ পেরোলেই শুনতে হবে না বোমার আওয়াজ। হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে ফেডারেশন আর পুলিশ প্রশাসনও। আজকে অন্তত রাস্তায় কোন গাড়ি পোড়ানো হবে না।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
২
এস এস লাজিও ফুটবল ক্লাবের বয়স প্রায় একশো কুড়ি বছর। শোনা যায়, ফ্যাশিস্ত আমলে এই ক্লাবের খেলা দেখতে নিয়মিত আসতেন বেনিতো মুসোলিনি ও তাঁর পরিবার। যদিও মুসোলিনি নন, শতাব্দীপ্রাচীন এই ক্লাবকে পার্টিশিও ন্যাশনালে ফ্যাশিস্তা বা কুখ্যাত ফ্যাশিস্ত পার্টির কাছাকাছি নিয়ে এসেছিলেন পার্টির সেক্রেটারি ও কুখ্যাত গোপন পুলিশ বাহিনী ‘চেকা’-র প্রতিষ্ঠাতা জিওভানি মারিনেল্লি। তাঁর উদ্যোগেই নবনির্মিত অলিম্পিক স্টেডিয়ামের (তখন নাম ছিল ‘স্তাদিও দেই সিপ্রেসি’) নামমাত্র ভাড়ায় অংশীদারিত্ব পায় লাজিও ফুটবল ক্লাব। ১৯২৭ সালে মুসোলিনি রোমের সবকটা ফুটবল ক্লাবকে যুক্ত করে একটা ক্লাব তৈরি করতে বললে লাজিও আপত্তি করে। শোনা যায়, এবারেও তাদের উদ্ধার করেছিলেন মারিনেল্লি। তাছাড়া বিভিন্ন টুর্নামেন্ট, খেলোয়াড় কেনাবেচা — সবেতেই চেকা প্রধানের অদৃশ্য হাত ছিল।
১৯৭০-৮০-র দশকে ইতালিয়ান সমাজ যখন ‘রোসসো’ বনাম ‘নেরো’ — এই লড়াইয়ে আড়াআড়ি ভেঙে যাচ্ছে– অতীতের নিয়ম মেনেই সে সময়ে দ্বিতীয় দলে যোগ দেয় লাজিও ফুটবল ক্লাব। ইতালিয় ভাষায় ‘রোসসো’ শব্দের অর্থ হল লাল৷ সত্তরের দশকে যেসব বামপন্থী ব্যক্তি অথবা গোষ্ঠী ইতালির রক্ষণশীল সরকারকে চ্যালেঞ্জ জানাত, তাদের অভিহিত করা হত ‘রোসসো’ বলে। অন্য দিকে, চল্লিশের দশকের উগ্র জাতীয়তাবাদী দক্ষিণপন্থী শাসনকে যারা নয়া মোড়কে ইতালিতে দরবারে ফিরিয়ে আনতে চাইছিল, তাদের বলা হত ‘নেরো’ অথবা ব্ল্যাক। পরবর্তী দুই দশক ইতালির অলিগলি, রাজপথ এই রোসসো বনাম নেরো লড়াইয়ের ক্ষেত্র হয়ে দাঁড়িয়েছিল। প্রবল রাজনৈতিক হিংসা ঢুকে পড়ল ফুটবল মাঠে। একের পর এক ক্লাব ঘিরে তৈরি হল ‘আলট্রাস’ সমর্থকগোষ্ঠী। প্রিয় দলের নামে একটানা চিৎকার, স্লোগান, স্টেডিয়াম দখলের পাশাপাশি অন্য দলের সমর্থকদের প্রতি তীব্র ঘৃণা এদের বৈশিষ্ট্য হয়ে উঠল।
আরো পরে ১৯৮৭ সালে উগ্র দক্ষিণপন্থী লাজিও ফুটবল ক্লাবে তৈরি হল ‘ইররিদুচিবিলি’ বা ইংরেজিতে ‘ইররিডিইউসিবল’। চেতনায় ও রাজনীতিতে ঘোরতর দক্ষিণপন্থী ও বর্ণবৈষম্যবাদী এই গোষ্ঠীর পরিচয় হয়ে উঠল তাদের অভিবাসীবিরোধী ব্যানার, পোস্টার, স্লোগান। রোমান ডার্বির দিন চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রোমা গ্যালারির দিকে তাদের টিফো ভেসে আসে। যাতে লেখা ছিল “আউশভিৎস তোমার দেশ, গরম চুল্লি তোমার ঘর” (Auschwitz is your country, Ovens are your home). চিরপ্রতিদ্বন্দ্বী রোমার ইহুদী প্রেসিডেন্টদের উদ্দেশ্যে ঐ পোস্টার। ইতালি জুড়ে কৃষ্ণাঙ্গ খেলোয়াড়দের যে প্রবল বর্ণবিদ্বেষের মুখোমুখি হতে হয়, তার প্রতি খোলাখুলি সমর্থন আছে ইররিদুচিবিলির। মাঠের বাইরে তাদের অবিসংবাদিত নায়কের নাম বেনিতো মুসোলিনি, আর মাঠের ভিতর তাদের এক ও অদ্বিতীয় নায়ক — পাওলো দি ক্যানিও। লিভর্নোর বামপন্থী সমর্থকদের প্রতি ও ইতালির ইহুদীদের প্রতি তাঁর ছুঁড়ে দেওয়া ফ্যাশিস্ত স্যালুটের সাথে সেরি এ-র দর্শকরা পরিচিত।
৩
ইতালির বার্গামো শহরের একটা দলের নাম আতালান্তা ফুটবল ক্লাব। নয়ের দশকের আর্জেন্তিনীয় ফুটবলের সুপারস্টার, একদা মারাদোনার ঘনিষ্ঠ সহচর ক্লদিও ক্যানিজিয়ার উত্তরাধিকার ছাড়া বিশেষ কিছুই থাকার কথা ছিল না এই দলটার, কিন্তু রয়েছে। সারা সপ্তাহ উদয়াস্ত পরিশ্রমের পর তাদের মাঠ ভরিয়ে দেন কাতারে কাতারে সমর্থক। উড়তে থাকে টিফো, ব্যানার। গ্যালারি জুড়ে একের পর এক লাল পতাকা, সাথে চে গেভারার ছবি। লোম্বার্দো প্রদেশের বার্গামোর ক্লাব আতালান্তার অধিকাংশ সমর্থক আসেন শ্রমিক পরিবা থেকে৷ ইতালিয় পুলিশের কাছে এই আতালান্তা আল্ট্রাগোষ্ঠী পরিচিত ‘ওয়াইল্ড বিস্ট’ নামে। লিভর্নোর মত না হলেও, আতালান্তার সমর্থকরা পড়েন রোসসো অর্থাৎ বাম বা বাম ঘেঁষা সমর্থকদের দলে। আতালান্তার প্রত্যেকটা খেলায় তাই গ্যালারি ভরে যায় ‘ইউ নেভার ওয়াক অ্যালোন’ লেখা ব্যানারে। উড়তে থাকে চে-র ছবি। সঙ্গে থাকে গাঢ় নীল/কালো পতাকা, রংমশাল আর মাঝে সাঝে উড়ন তুবড়ি। রোসসো বা বামপন্থী সমর্থকগোষ্ঠীও মারামারিতে বিশেষ ডরায় না। জুভেন্তাস, রোমা অথবা ইন্টার মিলানের বিরুদ্ধে আতালান্তার আলট্রাদের লড়াই সুবিদিত৷ পুলিশের দিকেও উড়ে আসে একের পর এক শেল, কখনো বা গ্রেনেড৷ পুলিশের পাল্টা আক্রমণে ছত্রভঙ্গ হয়ে যায় আলট্রারা৷ ম্যাচের শেষে পুলিশ যাদের নাগালে পায়, তারা পৌঁছে যায় শ্রীঘরে। যারা আসে না, তারা ফিরে যায় ফ্যাক্টরি অথবা নিজেদের কাজে। আবার অপেক্ষা পরের সপ্তাহের।
৪
এই আলট্রাদের কল্যাণে খেলার শুরুতেই গ্যালারিতে দেখা যায় লাল পতাকা, ইতালিয় ভাষায় কমিউনিস্টদের ইন্টারন্যাশনাল গানে গলা মেলান সমর্থকরা। উল্টোদিক থেকে শুরু হয় ট্রেডমার্ক ফ্যাশিস্ত স্যালুট, সাথে মুসোলিনির জয়গাথা। দু পক্ষের মাঝামাঝি দাঁড়িয়ে থাকে বার্গামোর পুলিশ। খেলা শুরুর আগে চেষ্টা করেছিল বিনা টিকিটে প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করার, কিন্তু লাভ হয়নি। মাঝপথে ট্রেন থামিয়ে উঠে পড়ে ইররিদুচিবিলি, সাথে তাদের কুখ্যাত স্লোগান। জনশ্রুতি, ঐ ট্রেনেই নাকি এক দক্ষিণপন্থী দল ইররিদুচিবিলির সদস্যদের ক্যাডার হিসাবে নিয়োগ করে।
১৯৭০-৮০ থেকেই ইতালিয় ফুটবলের বিভিন্ন আল্ট্রা গোষ্ঠী তাদের সদস্যদের ভিড়িয়ে দেয় রাজনৈতিক দলে। তার পরিবর্তে মেলে বিপুল সুযোগ-সুবিধা, কিছু কিছু ক্ষেত্রে পয়সাকড়ি। আতালান্তা বনাম লাজিও তাই ইতালিয় ফুটবলের উত্তপ্ত লড়াইয়ের জায়গা। সেরি আ জৌলুস হারালেও, প্রিয় দল জিতলে এখনো পাল্লা ভারী হয় ফর্জা ইতালিয়া, ফিয়ামা ত্রাইকোলোরে অথবা কমিউনিস্ট রিফাউন্ডেশন পার্টির মত রাজনৈতিক দলগুলোর।
বিশ্বব্যাপী অতিমারীর ফলে দর্শকহীন ফুটবল চলেছে ইতালিতেও। আবার কবে মাঠে ফিরবে টিফো-ব্যানার, স্লোগানসহ এই উন্মাদনা — সেটাই এখন দেখার।
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।