ঋদ্ধি রিত

শৈবাল মিত্রের নতুন ছবি এ হোলি কনস্পিরেসি একজন শিক্ষকের অধিকারের প্রশ্নে আদালতের একটি লড়াই নিয়ে। দুই পাকা উকিলকে কেন্দ্র করে সিনেমার চিত্রনাট্য প্রস্তুত করা হয়েছে। তাদের একে অপরের বিরুদ্ধে যুক্তি-প্রতিযুক্তি, যা ধর্মান্ধতা এবং আধুনিক শিক্ষার (মূলত বিজ্ঞানের) মধ্যে একটি সময়োপযোগী এবং অর্থপূর্ণ বিতর্ক।

১৯২৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ঘটে যাওয়া স্কোপস মাঙ্কি ট্রায়াল দ্বারা এই ছবি অনুপ্রাণিত। ছবিতে নাসিরুদ্দিন শাহ বিজ্ঞানের প্রতিনিধিত্ব করেন, সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ধর্মের প্রতিনিধিত্ব করেন।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

বর্তমান ভারতে ধর্মীয় মেরুকরণ একটি বাস্তবতা এবং সেখানেই এই ছবির প্রয়োজনীয়তা। কেন্দ্রের শাসক দল দলিত ও আদিবাসীদের উপর অত্যাচারের সীমা বাড়িয়েই চলেছে। রোহিত ভেমুলার মত আরও কত ছাত্র খুন হচ্ছে প্রত্যন্ত গ্রামে, আমরা জানতে পারছি না বা বাজারি সংবাদমাধ্যম জানাচ্ছে না। মাঝেমধ্যেই কোনো কোনো মন্ত্রী বা নেতার মুখে ঘর ওয়াপসির কথা শোনা যায়। তাঁরা অন্য ধর্মের মানুষকে হিন্দু ধর্মে ধর্মান্তরিত করতে চান, কিন্তু আদিবাসীদের নিজস্ব জাতিসত্তা নিয়ে বাঁচার অধিকার স্বীকার করেন না। প্রত্যেক মানুষের নিজস্ব ভাষায় কথা বলার অধিকার সংবিধানস্বীকৃত, কিন্তু বাস্তবে সংখ্যাগুরু জনগোষ্ঠী নিজেদের ভাষা, নিজেদের ধর্মই চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করে অন্যদের উপর।

বাংলা ও ঝাড়খণ্ডের সীমান্তে কল্পিত হিল্লোলপুর শহরের আদালতে বিচারাধীন স্কুলশিক্ষক কুণাল জোসেফ বাস্কে (শ্রমণ চ্যাটার্জি) চার্লস ডারউইনের বিবর্তনের তত্ত্বের আগে বাইবেলের একটি অধ্যায় এবং বৈদিক বিজ্ঞানের গুণাবলী পড়াতে অস্বীকার করেন। সেই থেকেই স্কুল কমিটির সাথে বিরোধের সূত্রপাত। একজন সাংবাদিক (কৌশিক সেন) এই খবর ‘ব্রেক’ করার পর মামলাটি জাতীয় গুরুত্ব লাভ করে। এখানে দোষী কে? একজন শিক্ষক যিনি প্রতিষ্ঠানের স্বেচ্ছাচারিতা মানতে চান না, নাকি প্রশাসন, যা ক্ষমতাসীনদের রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রভাবের কাছে মাথা নত করছে?

আদিবাসী বিজ্ঞান শিক্ষক কুণালের বাবা খ্রিস্টান ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন ছেলেকে লেখাপড়া করার সুযোগ দেওয়ার জন্য। ছেলে শিক্ষক হয়ে নিজেই সেই ধর্ম পরিত্যাগ করে, ফিরে যায় নিজের উপজাতির ধর্মের, যেখানে রাম, আল্লাহ বা যীশু নেই। আছেন নিজস্ব প্রাচীন দেবতা। যে শিক্ষা তাকে বুঝতে সাহায্য করেছিল আদিবাসীদের নিজস্ব ধর্ম এবং লিপি রয়েছে, সেই শিক্ষাকে সম্বল করেই এগোতে চায় কুণাল। যে তথাকথিত ধর্মরক্ষকরা কুণালকে আধুনিক শিক্ষায় প্রবেশ করতে সাহায্য করেছিল এবং ভাবতে শিখিয়েছিল, তারাই এখন তার বিরুদ্ধে। কুণাল বিদ্বেষের রাজনীতির স্বীকার।

কুণালের বিপক্ষে এবং ধর্মের পক্ষে সওয়াল করেছেন সৌমিত্র। তাঁর অভিনীত চরিত্রটি হল প্রাক্তন রাজ্যসভার সদস্য রেভারেন্ড বসন্তকুমার চট্টোপাধ্যায়ের। তিনি একসময় দাবি করে বসেন, তিনি ঈশ্বরের সাথে কথা বলেন। এখানে মনে পড়ে রবীন্দ্রনাথের বিসর্জন নাটকের কথা। সেখানে রাজা গোবিন্দমাণিক্য এই দাবি করেছিলেন। শুনে রাজ্যের প্রধান পুরোহিতও চমকে গিয়েছিলেন। তিনি জানতেন রাজা মিথ্যে বলছেন। এখানেও একজন বিজ্ঞানের প্রাক্তন ছাত্রের মুখে এই কথা শুনে খানিকটা চমকেই যান কুণালের আইনজীবী অ্যান্টনি ডি সুজা। ওই চরিত্রে নাসিরুদ্দিন শাহ অসাধারণ। বারবার ক্যামেরায় ধরা পড়েছে তাঁর নৈপুণ্য। তাঁর চোখ এবং চোয়াল রাগ, দুঃখ, কষ্ট – প্রত্যেকটা অভিব্যক্তিকে নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তুলেছে পর্দায়।

আরো পড়ুন ইব আলে উউ: চাকরির সন্ধানে কয়েকটি চরিত্র

এই ছবির চিত্রনাট্যের থেকে সংলাপ বেশি আকর্ষণ করে, কিন্তু সংলাপ লেখার ক্ষেত্রে নাটকীয় হওয়ার প্রবণতা রয়ে গেছে এবং বাংলা ও ইংরেজিতে সংলাপগুলো (ইংরেজি সাবটাইটেলসহ) প্রায়শই ঘোষণামূলক হয়ে গেছে। এত তীক্ষ্ণ গল্প বলার জন্য সম্ভবত নাটক বেশি ভাল মাধ্যম।

তবে সবকিছুর পরেও বলতে হবে, এমন ভাবনার ছবি পাড়ায় পাড়ায় দেখানো উচিৎ।

নিবন্ধকার সাংস্কৃতিক কর্মী, মূলত পদ্য ও চিত্রনাট্য লেখার কাজ করেন। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.