প্রথমেই বলে রাখি হাওয়া ছবির গল্প আপনাকে হতচকিত করবে না। একদম নতুন, অভাবনীয় গল্প নয়। দ্য ট্রায়াঙ্গল বা নেটফ্লিক্সের লাভ, ডেথ অ্যান্ড রোবটস অ্যান্থলজির ‘ব্যাড ট্রাভেলিং’ এপিসোড প্রায় এই একই বিষয়ে অনেক ভালো চিত্রনাট্য লিখে দেখিয়ে দিয়েছে। তাহলে এত লোক নন্দনে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র উৎসবে ঘন্টার পর ঘন্টা লাইন দিয়ে হাওয়া দেখছে কেন? গ্রাম, শহরের মানুষের সিনেমার রুচি আলাদা – এই তত্ত্বের মুখে ছাই দিয়ে গোটা বাংলাদেশেই বা ছবিটা সুপারহিট হল কী করে? সবই কি তাহলে, বোদ্ধাদের কথা অনুযায়ী, ‘হাইপ’? হয়ত। কিন্তু হাইপ তৈরি করা কি অতই সোজা? ২০২১ সালের ভোটের সময়ে একদল লোক “দুশো, দুশো” করে হাইপ তৈরি করেছিল। তাদের পিছনে মিডিয়া, সোশাল মিডিয়া আর কাঁচা টাকার যোগানের কোনো অভাব ছিল না। কিন্তু সেই দুশোকে আজ সত্তরের ঘরে টিকিয়ে রাখতে সেই নেতাদের মাথার ঘাম পায়ে ফেলতে হচ্ছে। তাই হাইপ তৈরি করা হাতের মোয়া বা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্টের মায়া – কোনোটাই নয়।
হাওয়া ছবিটাকে হাইপ বলে এড়িয়ে যাওয়া মানে কামরুল হাসানের ক্যামেরাকে ছোট করা। ওঁর একেকটা শট নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা আলোচনা করা যায়। ওই ধরনের জলের তলার শট লাইফ অফ পাই ছবিতে দেখা গেছে। হাওয়ার বাজেট অ্যাং লির সেই এপিকের কত ভাগের কত ভাগ তা জিজ্ঞেস করতে সাহস হয় না। সমুদ্রের মধ্যে একটা ট্রলারের ভিতরের অজস্র আলাদা আলাদা রকমের শব্দ স্টুডিওয় ফুটিয়ে তুলতে ফলি আর্টিস্ট উত্তম নস্করকেও যে কতটা পরিশ্রম করতে হয়েছে তা আমাদের পক্ষে কেবল আন্দাজ করাই সম্ভব।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
এই ছবির প্রাণ এর অভিনেতারা। মাঝির চরিত্রের অভিনেতাদের মাঝিই মনে হয়েছে। এটা খুব স্বাভাবিক মনে হলে আপনাকে অভিনন্দন, আপনি সাম্প্রতিক বাংলা সিনেমার দর্শক নন। ইবার চরিত্রে শরিফুল রাজকে তো চেনাই যায় না। বেদের মেয়ে গুলতির চরিত্রে নাজিফা তুসীও রহস্য ও লাস্যের যথাযথ ভারসাম্য বজায় রেখেছেন গোটা ছবি জুড়ে। বিশেষ করে বলতে হয় নাসিরুদ্দিন খানের কথা। ওঁর কমিক টাইমিং অসাধারণ। নাগুর চরিত্রে উনি কমেডি থেকে ভয়, আবার সেখান থেকে জিঘাংসায় যেভাবে সরে গেছেন তা অনবদ্য। চিত্রনাট্যে লেখা চরিত্রের সীমাকে একজন অভিনেতা কেমন রুচিসম্মতভাবে লঙ্ঘন করতে পারেন তা ওঁকে দেখলে বোঝা যায়।
এবং চঞ্চল চৌধুরী। টরেন্ট, টেলিগ্রাম আর ওটিটির দৌলতে উনি এপার বাংলার মানুষের কাছেও এখন অতি পরিচিত। চরিত্রের প্রয়োজনে শারীরিক বদল তো অনেকেই করে। চঞ্চল শুধু সেখানে থেমে না থেকে চাহনিতে বদল আনেন। চান মাঝির চরিত্রে ওঁকে দেখে বোঝার উপায় নেই কদিন আগেই কারাগার সিরিজে একই লোককে দেখেছি। উনি হয়তো নওয়াজউদ্দিন সিদিক্কি ছাড়া উপমহাদেশের একমাত্র সিক্স প্যাকহীন চরিত্রাভিনেতা, যাঁর বিড়ি জ্বালানো দেখে হল হাততালিতে ফেটে পড়ে।
তবে এই ছবির চরিত্রদের কাল হয় তাদেরই একেকটা চারিত্রিক ত্রুটি। একই পরিণতি হয়েছে ছবির চিত্রনাট্যের। শুরুতে দর্শককে সম্মান করে লেখা বুদ্ধিদীপ্ত ডায়ালগ আর পুরুষতন্ত্রের থিম আশা জাগায়। কিন্তু মেজবাউর রহমান সুমন, ফারুখ জাহিন আমিন ও সুকর্ণ শাহেদ ধীমানের লেখক ত্রয়ী মাঝদরিয়ার গল্পেও খুঁজে পেতে একটা কোদাল বের করে নিজেদের পায়েই কোপটা মারেন। সব ছবিরই একটা বক্তব্য থাকে। আপনি বলবেন সলমান খানের মারমার কাটকাট ছবিতে তো থাকে না? থাকে। বক্তব্য না থাকাও তো স্রষ্টাদের সচেতন বক্তব্য। লেখক-পরিচালকের কাজ সেই বক্তব্যকে চিত্রনাট্যের প্রত্যেকটি সংলাপ, চরিত্রের প্রণোদনা, টেক্সট, সাবটেক্সটে প্রতিষ্ঠিত করা। এখানেই হাওয়া ডাহা ফেল। ক্লাইম্যাক্সে গিয়ে মনে হয় লেখকরা নিজেদের পুরুষতান্ত্রিকতার থিমকে বঙ্গোপসাগরে বিসর্জন দিয়ে প্রায় প্রতিষ্ঠিতই করে ফেললেন মাঝিদের মধ্যে প্রচলিত এক নারীবিদ্বেষী মিথকে। আরেকটু সতর্ক হলে এই পরিণতি এড়ানো অসম্ভব হত না।
তাহলে প্রশ্ন ওঠা স্বাভাবিক যে এমন গড়পড়তা চিত্রনাট্য নিয়ে হাওয়া এত সফল হল কী করে। আসলে চিত্রনাট্যের বুনোটের উপর ছবির সাফল্য কোনোদিন নির্ভর করেনি। চিত্রনাট্য অনেকাংশে সাহায্য করলেও এই অস্বাভাবিক উন্মাদনা তৈরি করতে পারে না। সেলিম-জাভেদের চিত্রনাট্য যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হলেও সাত, আটের দশকে অমিতাভ বচ্চনের সেই বিপুল জনপ্রিয়তার প্রধান কারণ ছিল তাঁর চরিত্রগুলোর মধ্যে দিয়ে সেই সময়ের রাগ, ক্ষোভ, উদ্বেগের প্রকাশ। তাই পরবর্তীকালে অখাদ্য চিত্রনাট্যে কাজ করলেও শুধু সেই একই ধরনের চরিত্রের আবেদনেই ছবিগুলো সুপারহিট হয়। একই কথা বলা যায় হামফ্রে বোগার্ট সম্পর্কে। দ্যমলটীজ ফ্যালকন ছবির চিত্রনাট্য কোথায় শুরু কোথায় শেষ বোঝা দায়। পার্শ্বচরিত্রগুলোও অত্যন্ত অযত্নে লেখা। কিন্তু ছবিটা এবং বোগার্টের তুমুল জনপ্রিয়তার কারণ ওই ছবির এবং বোগার্টের চরিত্রের বাতাবরণ। মানুষের কাছে ১৯২৯ সালের মন্দা থেকে সদ্য উঠে আসা এবং দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিকে এগিয়ে চলা এক অন্ধকার, দ্বিধাপূর্ণ, অবসাদগ্রস্ত সময়ের প্রতিনিধি হয়ে উঠেছিল ছবিটা আর তার প্রধান চরিত্র।
আরো পড়ুন নবীন প্রজন্মের পাকিস্তানিদের বাংলার প্রতি কোনও দ্বেষ নেই, বলছেন ভাইরাল হওয়া পাক সিরিয়ালের পরিচালক
হাওয়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছে। এই সময়ের কোন দিককে ছবিটা ছুঁতে পেরেছে তা এখনই নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তা হয়ত ভবিষ্যতে পরিষ্কার হবে। আমরা কেবল আন্দাজ করতে পারি। হয়ত বিশ্বজোড়া পারস্পরিক বিশ্বাসের অভাব বা সমষ্টিগত সুখের অভাব এবং তার কারণ খুঁজে না পাওয়ার অনুভূতিকে ধরতে পেরেছে। কিন্তু যা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব তা হল কোনো না কোনোভাবে ছবিটা দর্শকদের অবচেতনে পৌঁছে যেতে পেরেছে। আমাদের সামগ্রিক সংকটের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছে। আজ এ জিনিসের বড় অভাব আমাদের সংস্কৃতিতে। তাই শুধু প্রায়োগিক নৈপুণ্য নয়, কী করে বিরাট অংশের মানুষের মন ছুঁয়ে যাওয়ার মত শিল্প সৃষ্টি করা যায় হাওয়া দেখে সেটাও শেখা যায়।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।