এক অলৌকিক পশ্চাদভ্রমণে মনে হয়, মৃণাল সেন চলে যাওয়ার পরে কলকাতা সত্যিই কেমন জরাজীর্ণ বুড়ি থুত্থুড়ি হয়ে গেছে। এই একজন মানুষকে আমরা দেখতাম যিনি বয়স্ক হতে অস্বীকার করছেন। হয়ত স্ত্রী উনার কাছে বলা চার্লি চ্যাপলিনের সেই গল্পের মতন তিনি প্রতি জন্মদিনেই ছোট হতে চেয়েছিলেন এবং এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই মৃণালের বার্ধক্যের প্রতি প্রত্যাখ্যান এক সচেতন সিদ্ধান্ত। তাঁর জীবনের দিকে তাকালে আমরা বুঝি যে যা হয়ে উঠতে পারত একটি মফস্বলি বৃত্তান্ত, তা হয়ে গেছে একটি শহুরে ইশতেহার। তার পিছনে মৃণালদার মেধার প্রয়াস কম নয়। যেমন অনেকেই জানেন না, ভারতীয় গণনাট্য সঙ্ঘের প্রভাবে মৃণাল সেনও কিন্তু শুরু করেছিলেন নাটক দিয়েই।
তিনি লেখায়, আড্ডায় বহুবার পরিহাস ছলে বলেছেন যে দুজন সোম তাঁর জীবন পালটে দিয়েছেন – ভুবন সোম ও গীতা সোম। নাটমঞ্চে মৃণালের গোপন আবির্ভাবের প্ররোচনা, যিনি পরবর্তীকালে গীতা সেন হবেন, তাঁর কাছ থেকেই এসেছিল। গীতা ছিলেন উত্তরপাড়ার বাসিন্দা, গণনাট্য সঙ্ঘের কর্মী এবং অভিনেত্রী, এমনকি মৃণালদার সঙ্গে বিয়ের আগেই অন্তত দুটি ছায়াছবিতে তিনি অভিনয় করেছেন। ছবি দুটি যথাক্রমে অমর দত্ত পরিচালিত জীবন সৈকত এবং ঋত্বিক ঘটক পরিচালিত বিখ্যাত নাগরিক। লিখছি উত্তরপাড়া, কিন্তু কুমারী জীবনে আসলে উত্তরপাড়া সংলগ্ন ভদ্রকালীর অধিবাসী ছিলেন গীতা।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

মৃণালের নিয়মিত ভদ্রকালী যাত্রা মূলত এক প্রেমের কবিতা, যা আজকাল প্রায় কেউই বলে না। ১৯৫১ সালে সেখানকার দোলতলা এলাকায় ভদ্রকালী নাট্যচক্র যাত্রা শুরু করে। এই সংগঠন প্রথম থেকেই বামপন্থী আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি গ্রহণ করেছিল। এই সূত্রেই মৃণালের পরিচয় হয় অনুপকুমারের সঙ্গে, যিনি উত্তরকালে তাঁর অন্যতম শ্যালক। এখানে মৃণালের পরিচালনায় তাঁরা দুটি নাটক মঞ্চস্থ করেন। একটি দিগীন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় লিখিত মশাল এবং অন্যটি একটি ছায়ানাটক – শহীদের ডাক। আশ্চর্য সমাপতন যে বাংলা চলচ্চিত্রের পিতা হীরালাল সেনও আলোছায়ার জগতে অভ্যস্ত হয়েই আলোকচিত্রের জগতে প্রবেশ করেন। মৃণালদা অবশ্য মূল অনুপ্রেরণা পেয়েছিলেন তাঁর বন্ধু তাপস সেনের কাছ থেকে, আর মৃণালদার পিত্রালয়ে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের প্রভাব ছিলই। মূলত স্বাধীনতা আন্দোলনের উত্তাল আত্মনিবেদনের কাহিনি এই শহীদের ডাক। আমি নাটকটি দেখিনি, তবে মৃণালদা এই নাটক মঞ্চস্থ করতে তদানীন্তন বিহারের দুমকা অঞ্চলেও চলে গিয়েছিলেন এবং পুলিস এই প্রচেষ্টাকে সুনজরে দেখেনি। ফলে নাটক করার অনুমতি প্রত্যাহার করে। সৌভাগ্যক্রমে দুমকার পৌরপ্রধান সদয় হয়ে তাঁর বাড়ির উঠোনে এই নাটক মঞ্চস্থ করার সুযোগ করে দেন। মশাল অভিনীত হলেও বিদ্যুতের অভাবে শহীদের ডাক মঞ্চস্থ করা যায়নি।
এই বৃত্তান্ত লিখলাম এই কারণেই যে এহেন মৃণাল অনতিকালের মধ্যেই নাটকের সংসর্গ পরিত্যাগ করে চলচ্চিত্রে চলে এলেন। ঠিক যেমনভাবে একদিন বালি ব্রিজে তাঁর প্রথম চুম্বনের ফাঁকে উইলিয়াম গ্যালাহারের দ্য কেস ফর কমিউনিজম গ্রন্থটি ভাগীরথীতে পড়ে যায় এবং তিনি গীতা ও মার্কসবাদের দ্বন্দ্বে গীতাকেই গ্রহণ করেন, তেমনভাবে মৃণালদার জীবনের সব নির্বাচনই বৌদ্ধিক নির্বাচন। তাঁর বন্ধু ঋত্বিকের সঙ্গে যে সম্পর্ক, তা আমি অনেকটাই প্রত্যক্ষ করেছি – এই মৈত্রী, এই মনান্তর – এবং তা নিয়ে মৃণালদার সঙ্গে আলোচনা করার সুযোগও হয়েছে বহুবার। আবার দেখেছি তিনি সবসময়েই মনে করতেন, অপরাজিত ছবিতে আধুনিক মানুষের আসল যাত্রাপথ উৎকীর্ণ রয়েছে। কোনো সন্দেহ নেই মৃণালদা সারাজীবন যে ছবিটিকে চলচ্চিত্রে উৎকর্ষের শীর্ষবিন্দু ভাবতেন সেটি হল সত্যজিতের অপু ত্রয়ীর এই দ্বিতীয় ছবিটি। কেন ভাবতেন? কারণ কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টোর দ্বিতীয় অধ্যায়ে যেখানে কার্ল মার্কস নাগরিকতার পশ্চাদ্ধাবনকে অপ্রতিরোধ্য, নিষ্ঠুর কিন্তু অনিবার্য ভেবেছেন – তা মৃণালদার মনোহরণ করেছিল। ফলে তিনি যে কাহিনির অবতারণা করতেন, সেই কাহিনি হয়ত কখনো কখনো গ্রামবাংলার দিকে তাকিয়ে। যেমন তাঁর ছবিতে সত্যজিতের সর্বজয়া করুণা বন্দ্যোপাধ্যায় রান্না করেন। তিনি পথের পাঁচালী ছবিতেও রান্না করেছিলেন, কিন্তু মৃণালের তাকানো অন্যরকম। রান্নার যে ধোঁয়া ছাদ থেকে উড়ে যায়, মৃণাল চিন্তা করেন কলকাতা শহরে কজন নারীকে এই ধরনের দুর্বিষহ অবস্থার মধ্যে দিয়ে যেতে হয় এবং একটি যুক্তির খোঁজ করেন। যে কোনো আখ্যানেই তিনি যুক্তির খোঁজ করেন। যে কোনো আখ্যানেই তিনি যুক্তিবোধকে প্রশ্রয় দেন এবং তাকে একমুখী করেন।

ফলে মৃণালের ঋত্বিকের ছবি নিয়ে আপত্তিগুলো ভারি কৌতূহলোদ্দীপক। যেমন তিনি বলতেন, মেঘে ঢাকা তারা ছবির শেষদিকে নীতার প্রস্থানের কাঠামোটি নাটুকে। একটি মেয়ের দাদা, যে অতদিন পরে বোনকে দেখতে যাচ্ছে, সে একবারও জিজ্ঞেস করবে না “তুই কেমন আছিস”? মৃণালদা আমাকে বলতেন “তোমার গুরু [ঋত্বিক] সরাসরি এমন কথার অবতারণা করে যাতে নীতার রোগটা বেড়ে যায়। অথচ নীতার দাদাকে কিন্তু আগে সতর্ক করা হয়েছে। চিত্রনাট্যে এরকম গণ্ডগোল রেখে দেবেই ও, কেউ বললেও শুনবে না। এটা এক ধরনের গোঁয়ার্তুমি এবং গ্রাম্যতা।” এই গ্রাম্যতা শব্দটি জরুরি। এই একই কথা তিতাস একটি নদীর নাম প্রসঙ্গেও মৃণালদা বলতেন। যখন পাগল কিশোর (প্রবীর মিত্র) তার মূর্ছিতা স্ত্রীকে (কবরী সারোয়ার) নিয়ে পদ্মার চরে যাচ্ছে, মৃণালদা পরিহাস করে বলতেন, এই শটটা এমনিতেই দুর্দান্ত। পৃথিবীর যে কোনো প্রান্তেই অতুলনীয়। কিন্তু অকারণ একে সতীদাহের সঙ্গে যুক্ত করার প্রচেষ্টা, মিথিকাল স্তরে নিয়ে যাওয়ার ভাবনা, ঋত্বিকের পল্লীসমাজের বাসিন্দাসুলভ মনোভাব। হিন্দু ফিউডাল সংস্কারগুলোকে ঋত্বিক বাতিল করতে পারেন না।
এই পল্লীসমাজ এবং আধুনিক সমাজে ভাগ করে দেখা – এ জিনিস মৃণালদার এমন মজ্জাগত, যে তাঁর মধ্যে দেশভাগের জন্য কোনো নস্ট্যালজিয়া এবং বিধুর আবেগ প্রবেশ করেনি। তিনি ফরিদপুরের কথা অন্তত তাঁর ছবিতে স্মরণ করতে চান না। যারা তাঁর পাত্র পাত্রী, পরিহাসের বা প্রশংসার লক্ষ্য – তারা অনিবার্যভাবে শহুরে মানুষ। তিনি যখন পুনশ্চ (১৯৬১), অবশেষে (১৯৬৩), প্রতিনিধি (১৯৬৪)করেন তখন তাঁর উপজীব্য হয়ে দাঁড়ায় নির্মেদ নিম্নবিত্তের আখ্যান। এমনকি আমি সাহস করে বলব যে মহানগর ১৯৬৩ সালে নির্মিত হওয়ার পরেও মৃণালদা সত্যজিতের মত করে কলকাতাকে দেখেননি। তিনি ছবি করার সময়ে অবশ্যই সত্যজিৎ এবং ঋত্বিকের দিকে নজর রাখতেন। ভুবন সোম রাগ হংসধ্বনিকে এবং পথের পাঁচালীর নিসর্গকে খেয়াল করেছিল। কে কে মহাজনের ক্যামেরা দিয়ে পথের পাঁচালীর একটি বিকল্প প্রস্তাবও তৈরি করে। কিন্তু এই বিকল্প প্রস্তাবেও সর্বদাই মৃণাল শহরের ফিচেল পাতালে ঢুকে যেতে চান। তাঁর কাছে সত্যজিৎ বা ঋত্বিকের মত বড় ইতিহাস কোনো ঘটনা নয়। বড় ইতিহাস থেকে তিনি চলে আসেন এমন একটা ছোট ইতিহাসে, যা কেউ দেখেনি, যা অণুবীক্ষণের নিচে দেখতে হয়।
একথা মৃণালদার ব্যক্তিগত জীবন সম্পর্কেও সত্যি। তাঁর বিখ্যাত মার্কসবাদী বন্ধুরা, যেমন তাপস সেন, সলিল চৌধুরী, উৎপল দত্ত বা ঋত্বিক – তাঁদের সম্পর্কে কথা বলার সময়েও মৃণালদার এই আণুবীক্ষণিক দৃষ্টি ধরা পড়ত। যেমন মজা করে বলতেন যে সলিল তাঁর বিয়ের দিনে গেয়েছিলেন ‘অবাক পৃথিবী’। সে গানের পর, “যেহেতু খুব খরচ খরচা করে বিয়ে করতে পারিনি, সেহেতু বন্ধুবান্ধবরা চলে যাওয়ার পর আমরা মনোহরপুকুর রোডে ছাদে আমাদের টিনে ঢাকা ঘরে গিয়ে শুলাম। সকালে উঠে দেখি শুয়ে আছি পিঁড়ির উপর আর দরজাটা বন্ধ করতে ভুলে গেছি।” এই দরজা বন্ধ করতে ভুলে যাওয়ার গল্প বলার মধ্যে প্রবল বিদ্রূপ এবং তাচ্ছিল্য আছে। এই ভুলে যাওয়াকে আসলে তিনি একান্ত নাগরিকতার ফসল বলে মনে করতেন। ফুলশয্যার রাতে ঘটে যাওয়া এই ভুল তাঁর চরিত্রকে ব্যাখ্যা করে দেয়। মৃণালদার ছেলে একবার বিদ্যুৎ চমকানো দেখে বলেছিল “আকাশকে একটা ওয়াইড স্ক্রিন মনে হল।” তাতে তিনি দারুণ খুশি হয়েছিলেন। বলেছিলেন কুণাল রবীন্দ্রনাথকে উদ্ধৃত করলেও অতটা খুশি হতেন না। কারণ মৃণালদা মনে করতেন প্রযুক্তিই আধুনিক পৃথিবীকে তৈরি করছে এবং ভারতবর্ষের অন্যতম বৃহৎ ব্যর্থতা হল প্রযুক্তিকে সফলভাবে ব্যবহার করতে না পারা এবং এক ধরনের সামন্ততান্ত্রিক মনোভাবে জারিত হওয়া। উৎপল দত্তের চরিত্রটি ভুবন সোমে এই ভ্রমেই পড়ে গিয়েছিল এবং আমরা দেখতে পাই যে আসলে মৃণাল ওখানে যে জিনিসটিকে ব্যঙ্গ করছেন, ঠাট্টা করছেন, আক্রমণ করছেন তা হল ওই আমলার প্রতি আমাদের অন্তর্গত এক মমত্ববোধ। এই বিশ্বাস যে সে অন্তত ভাল হয়ে যাওয়ার সুযোগ পাবে।
মৃণাল কিন্তু কাউকেই ভাল হতে দেন না। তিনি জানেন যে ইতিহাসের গতি অপ্রতিরোধ্য। আকাশ কুসুম ছবিতে তাঁর নায়ক অজয়ের (সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়) যে পতন, তিনি জানেন তা ঘটছে এক অনিশ্চয়তার ফলে এবং এই পতন থেকে ভারতীয় সভ্যতাকে উদ্ধার করতে পারে এমন কেউ নেই। একথা হয়ত অনেকেই জানেন যে ফ্রাসোয়াঁ ত্রুফোর জুল এ জিম দেখার পরেই মৃণালদা একরাত্রে আকাশ কুসুমের চিত্রনাট্য পালটে ফেলেন এবং ফ্রিজ শটের আধিপত্য সত্যজিতের সঙ্গে তাঁর বিরোধের (দ্য স্টেটসম্যান পত্রিকার পাতায় দীর্ঘ পত্রবিতর্ক স্মর্তব্য) অন্যতম কারণ হয়ে দাঁড়ায়। কিন্তু ত্রুফোর প্রতি তাঁর অসামান্য আনুগত্য সত্ত্বেও দেখা যায় একটা দোদুল্যমানতা তাঁর মধ্যে রয়েই গেছে।
বার্লিনে রৌপ্য পদকজয়ী আকালের সন্ধানে ছবিতেও সিনেমা বানানোর বিষয়ে যে অংশ তাতে সত্যজিতের অশনি সংকেত বা ঋত্বিকের পরিবেশ সম্পর্কে প্রায় তাচ্ছিল্যের মনোভাবে অন্যতম অভিনেতা দীপঙ্কর দে বলেন “বুঝলে স্মিতা পাতিল, এই হচ্ছে তোমার বাংলাদেশের ঐতিহ্য।” এই ঐতিহ্য শব্দটা দিয়ে কিন্তু মৃণাল সচেতনভাবে ঠাট্টা করেন। কারণ শহরের বাসিন্দা নাগরিকের কোনো ঐতিহ্য আছে বলে তিনি বিশ্বাস করতেন না। অতীত তাঁর কাছে একটি ধারাবাহিক বিশ্বাসঘাতকতা। তাঁর ধারণা, সমস্তটাই ‘আজ’ শুরু হয়েছে এবং আজই আমাদের স্বর্গারোহণ ও স্বর্গ থেকে পতন। আকালের সন্ধান ব্যর্থ হয়, কারণ মৃণালদা বলেন, বিশ্বাসটা চলে গেছে।
এই বিশ্বাসকে আমরা ইংরেজি তরজমায় ideology বলতে পারি। ওই বস্তুটি কিন্তু মৃণালদার জীবনে একটা বড় ভূমিকা নিয়েছে, কারণ তিনি পি সি যোশীর যুগে কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য না হলেও পার্টির আশপাশে ঘুরেছিলেন। পার্টির প্রতি তাঁর সমর্থনও আগাগোড়া প্রশ্নাতীত ছিল। সন্দীপন চট্টোপাধ্যায়কে এক সাক্ষাৎকারে মৃণালদা বলেছিলেন, পুনে ফিল্ম ইনস্টিটিউটের আধুনিক ছেলেরা – মণি কাউল, কুমার সাহনি – এদের তিনি পছন্দ করেন। এরা দুঃসাহসিক কাজকর্ম করতে পারে। কিন্তু সমস্যা তাদের ইডিওলজি। যে কোনোদিন তারা ফ্যাসিবাদের শিকার হতে পারে, কোনো রাজনীতি নেই। আমি বলতে চাইছি এখানেই তাপস সেন, ঋত্বিক বা সলিলের সঙ্গে মৃণালের তফাত। যেখানে ওই তিনজন অন্তত আদি যুগে মার্কসবাদী ঐতিহাসিক বস্তুবাদী ব্যাখ্যাটা গ্রহণ করেন, সেখানে মৃণালদার মধ্যে কিন্তু এক ধরনের দ্বিধা দেখা যায়। তিনি এই দোলাচলকে আধুনিকতা দিয়েই ব্যাখ্যা করেন। শহুরে মানুষের এই অ্যাম্বিগুয়িটি থাকে বলেই তাঁর মনে হয়। আর এই বৈপরীত্যকে তিনি উপজীব্য করে তোলেন।
মৃণালদা যখন স্ত্রী গীতা সেনকে নিয়ে রোমান পোলানস্কির নাইফ ইন দ্য ওয়াটার দেখেন, তখন বলেন “যদিও আমরা ইয়টিংয়েও যাই না আর আমার স্ত্রী সাঁতারের পোশাক পরেও ঘোরাঘুরি করে না, তবুও এই ছবি দেখার পর উই কুড আন্ডারস্ট্যান্ড ইচ আদার আ লিটল বেটার”। মৃণালদার বক্তব্য, আমরা যে জীবনে বাস করি সেখানে নাইফ ইন দ্য ওয়াটারের অর্থ আছে। একথা বলে লাভ নেই যে ওটা বিদেশি ছবি, আন্তনিওনির লা নত্তে বুর্জোয়া ছবি। যে বিদ্বেষ এবং যে সন্দেহ আমরা পোষণ করি, যে ফাটল আমাদের দাম্পত্যে তৈরি হয়, সেটা একাকার হয়ে থাকে আমাদের জীবনে। আমার মনে হয় এখান থেকেই সত্যজিৎ, ঋত্বিক, এমনকি সলিলের সঙ্গেও তাঁর আলাদা হয়ে যাওয়া শুরু হয়।
আমার এখন মনে হয়, গুগল এসে আমাদের পৃথিবীটাকে কত ছোট করে দিয়েছে! আমাদের পরিচালকদের মধ্যে এখন এমন কেউ নেই যিনি কোনো আন্তর্জাতিক মানের চলচ্চিত্র নির্মাতার সঙ্গে পরিচিত। মৃণালদা যখন আমাদের সঙ্গে ছিলেন তখন কিন্তু এমনটা ছিল না। আমি নিজের চোখে দেখেছি, ২০০৭ সালের কলকাতা চলচ্চিত্র উৎসব চলাকালীন মৃণালদার পদ্মপুকুর রোডের বাড়িতে অনায়াসে চলে গেছেন ফার্নান্দো সোলানাস। মৃণালদার মুখে এ গল্পও শুনেছি যে কান চলচ্চিত্র উৎসবে তিনি আর পোলানস্কি গল্প করছেন, জঁ লুক গোদার উল্টোদিক থেকে আসছেন। মৃণালদা হাঁ করে গোদারকে দেখছেন, কারণ গোদারের সঙ্গে কথা বলার খুব শখ। কিন্তু পোলানস্কি বললেন “ওদিকে তাকিয়ে লাভ হবে না। গোদার আমাকে অপছন্দ করেন। সুতরাং অন্যদিকে ঘুরে যাবেন।” হলও তাই। এইসব আড্ডা বা জার্মান ফিল্ম উৎসবের ডিরেক্টর উলরিখ গ্রেগরকে নিয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে আসা, বা যাদবপুরে কোনোরকম মঞ্চের তোয়াক্কা না করে ভিয়েতনাম যুদ্ধের সময়ে ছাত্রদের সামনে টুলের উপর দাঁড়িয়ে বক্তৃতা দেওয়া – এগুলো প্রমাণ করে যে মৃণালদা কিন্তু কোনোদিনই কলকাতার তারুণ্যকে হারাতে চাননি। সেই তারুণ্যকে তিনি আজকের শর্তেই গ্রহণ করতে রাজি ছিলেন। সত্যি কথা বলতে, যতদিন তিনি চিন্তক হিসাবে সক্রিয় ছিলেন এবং আপ্তবাক্যে বিশ্বাস করেননি ততদিন গ্রহণ করেও গেছেন। কলকাতার এই তারুণ্যের কথা তিনি প্রাণপণে বুঝিয়েছিলেন ফরাসি নবতরঙ্গের অন্যতম প্রতিনিধি লুই মালকে। তাঁর বক্তব্য ছিল, এত বড় ছাত্র মিছিল আর কোন শহর করতে পারে? প্যারিসও পারে না। সেই মহাপৃথিবী পর্যন্তও এই কাজের প্রতি আনুগত্যে অবিচল থেকেছেন। একটি ছেলের হত্যা তার জননীকে কীভাবে মথিত করে, মশারির মধ্যে কীভাবে বার্লিনের প্রাচীর ভেঙে পড়তে পারে তা দেখিয়ে গেছেন।
আরো পড়ুন সেলুলয়েডে মধ্যবিত্তের রাষ্ট্রদূত মৃণাল সেন
আমার কাছে মৃণাল সেন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে সমকালীনতা বস্তুটি আর কোনো ভারতীয় পরিচালকের কাজে এতটা গুরুত্ব পায়নি। ফরিদপুর থেকে এসে থাকলেও মৃণালদার ছবিতে ফরিদপুর এক বিস্মৃত অধ্যায়। তিনি সর্বত্রই কলকাতার, একান্তভাবে কলকাতার। সর্বতোভাবে নিবেদিত কলকাতার গলি, উপগলিতে। এইসব গলি, উপগলি, হাওড়া ব্রিজ বা ট্রাম – আসলে এগুলো তো মৃণালের নিসর্গ চিত্র। তিনি খুব একটা ধানখেত দেখেন না। আকালের সন্ধানে ছবিতে যখন দেখেন, তাও দেখেন অশনি সংকেতের প্রত্যুত্তর হিসাবে। মৃগয়া ছবির বিষয়বস্তু কিন্তু মোটেই গ্রাম নয়। ওখানে বিষয়বস্তু আসলে এক ধরনের শোষণ, যা ব্যাপ্ত। শুধুমাত্র যৌনতার মধ্যে সীমিত নয়।
মৃণালদা এভাবেই বেঁচে ছিলেন এবং তিনি বাংলা ছবির জগতের একমাত্র ব্যক্তি যিনি কলকাতা শহরকে কলকাতা হিসাবেই ভালবেসেছেন। সত্যজিৎ বাইসাইকেল থিভস অনুসরণ করেছিলেন অপরাজিত ছবিতে, মৃণালও করেছেন নীল আকাশের নীচে ছবিতে এবং ইন্টারভিউ-তে। কিন্তু দ্বিতীয় ছবিটায় পকেটমার ধরা পড়ে এবং মৃণালদা জানতেন যে কলকাতা পকেটমারকেও নিজের করে নিতে অভ্যস্ত। তাতে শহরটার কিছু এসে যায় না। তিনি যে নিজের ক্যামেরাম্যান কে কে মহাজনকে দেখান অথবা দারোগা হিসাবে শম্ভুবাবুকে উপস্থিত করেন, তাতে হয়ত গোদারকে উদ্ধৃত করেন এবং সিনেমার বাস্তবতা ভেঙে দেন। কিন্তু দেখা যায় কলকাতা নিজের বাস্তবতায় ফিরে আসছে। কলকাতা যে এক ধরনের আড্ডার কোলাজ, কলকাতা যে কিছুই বর্জন করে না এবং কিছুই গ্রহণ করে না, সবকিছুই তার কাছে দেখার রকমফের মাত্র। মৃণাল সেনও সেই দেখার রকমফের।
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।