খড়্গপুরে ছোট দুটি পাহাড় ছিল একসময়। সেই পাহাড়ের কথা বলেছিলেন তিনি আর চারপাশে রাঙামাটির ধুলো। ব্রিটিশরা সেই পাহাড় কেটে রেললাইন বসায়। রেলের গোড়াপত্তনের দিন, এক অংশে ঘন জঙ্গল, জঙ্গলের ভেতর ছমছমে মন্দির। ‘প্রথম প্রহর’ পড়তে পড়তে অধুনা লুপ্ত প্রাচীন জনপদকে খুঁজতে বেরিয়ে পড়েছি কতবার। নব্য হাইরাইজ আর মল-বাজারের তীব্র শহর হয়ে উঠতে থাকা মানচিত্রে অরণ্যের কল্পনাকে বসাই, মাথায় এঁকে দিই দুটি পাহাড়! এই শহরের ইতিহাস শুনিয়েছেন তিনি। মানুষের মতই শিকড় ছাড়া শহরও বাঁচে না। এই শহরকে আমৃত্যু ভোলেননি সাহিত্যিক রমাপদ চৌধুরী।
গোলবাজার দুর্গামন্দিরের কাছে লাল ইটের পুরনো বাংলো, যেখানে কৈশোর কাটিয়েছেন, আমরা বলি রমাপদ চৌধুরীর বাড়ি। এই বাড়ির সামনে এসে দাঁড়ালে তাঁর শৈশব কল্পনা করি অদ্ভুত রোমাঞ্চে। একটা কুয়াশার ভোর, উন্মুক্ত প্ল্যাটফর্মে হাঁটতে হাঁটতে ট্রেনের জানালায় পাঞ্জাবির হাতা গোটানো এক স্বর্ণাভ হাত, রবীন্দ্রনাথ! বিলিতি চাঁপা সদ্য তুলেছিলেন, সোজা গিয়ে কবির হাতে। আনন্দিত কবি বলে ওঠেন, মুচকুন্দ কোথায় পেলে? সেদিন কবি তাঁকে ফুল চিনিয়েছিলেন। গোলবাজার ওভারব্রিজ থেকে স্টেশন দেখি, এখানে কোনো এক অস্পষ্ট সকালে সাক্ষাৎ ঘটেছিল এক কিশোর আর এক শালপ্রাংশু মহাভূজের।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
খড়্গপুর রেলওয়ে বয়েজ স্কুল, যখন পড়তেন নাম ছিল বিএনআর ইন্ডিয়ান হাইস্কুল, সেই স্কুলের একশো বছর পূর্তিতে একটি লেখা দিয়েছিলেন, বয়স তখন ৮২। লেখাটি স্কুল কর্তৃপক্ষ হারিয়ে ফেলেন! কী মুখে আবার বলা হবে তাঁকে, এমন রাশভারী বিখ্যাত মানুষকে? অথচ কী আশ্চর্য! তিনি আবার লেখা দিলেন, এবার ইংরেজিতে। যে লেখার ভাষান্তর করেছেন এ শহরেরই একনিষ্ঠ রমাপদ চৌধুরী পাঠক সৌমেন গঙ্গোপাধ্যায়। ‘আওয়ার স্কুল’ শীর্ষক সেই লেখার ছত্রে ছত্রে এই শহর, এই বিদ্যালয় নিয়ে নিরবচ্ছিন্ন আবেগ, কত বছর আগে ফেলে চলে যাওয়ার পরেও! “ঠিক রেলশহর খড়্গপুরের মতোই এই বিদ্যালয়টিও বৈচিত্রের মধ্যে ঐক্য এই আদর্শের ভাবধারা বহনকারী এক ক্ষুদ্র ভারতবর্ষের প্রতিনিধিত্ব করত। মারাঠি, গুজরাতি, পাঞ্জাবী, বিহারী, তামিল, তেলেগুভাষী যেই হোক না কেন তাদের সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল তারা সবাই সবার বন্ধু” – লিখেছিলেন তিনি।
বাবার রেলের চাকরি, সারা ভারতবর্ষ ঘোরা, অথচ কত কত গল্পে রেল কলোনি ঘিরে চরিত্ররা উঠে এলে মনে হয় খড়্গপুরের স্মৃতি ছুঁয়ে গেছে তাদের গায়ে। সদ্য কৈশোর পেরিয়ে যে হাতে উঠে আসে ‘উদয়াস্ত’-র মত গল্প। দেখি স্টেশনমাস্টার বিষ্ণুরামকে। গতযৌবন এক মানুষ সংসারের ব্যর্থ মনস্কাম ছেড়ে হেঁটে যাচ্ছে তার একমাত্র আশ্রয় স্টেশন-ঘরের দিকে, সেখানের টরে-টক্কার প্রশান্তির ধ্বনি। তার কালো কোটের চকচকে পেতলের বোতামে তার আঙুল আজও অল্প ঘষা দেয়।
এই গল্পহীন গল্পের কথা শেষ বয়সে গিয়ে মনে পড়েছে আবার। ‘উদয়াস্ত’ গল্পের “রিক্তপ্রসাধন সহজ সরল ভাষা”-র কাছে ফিরতে চেয়েছেন। যা ধরে যাত্রা শুরু হয়, সেখানেই বুঝি ফিরে যেতে চায় মানুষ, লেখক।
সম্পাদনার অফিসঘরে সদা গম্ভীর বসে থাকা রাশভারী মানুষটির মনে অনন্ত ফল্গুধারা। লোকে বলে তাঁর কথন নির্মোহ গদ্য হয়ে বয়ে চলে, ভাবালুতাহীন, কাব্যবর্জিত। অথচ ‘বুড়ী ডিহিঙের সাঁকো’ নিখাদ কবিতার মতই মনে হয়। “লখিন্দর গান গায়, গীটার বাজায়। আর চোখ থাকে ওর দময়ন্তীর দিকে। দময়ন্তী! ষোলো বছরের সমর্থ শরীর ঘিরে পূর্ণ-জোয়ার যৌবনের উচ্ছ্বাস। সারা দেহে লাল মেঘের ঈষৎ লালিমা।…হাঁটুর নিচে সুডৌল এক জোড়া পায়ের চঞ্চলতা। বুকের পূর্ণিমা গোলাপি মলমলের কাঁচুলি দিয়ে বাঁধা। লম্বা আর সুস্পষ্ট কালো চুলের বেণী দুটোকে ঘিরে বুকে এসে পড়েছে আসমানি ওড়না। ফিকে নীল ওড়নার ছায়া ওর চোখে, চোখে তারা নীলার মতো নীল। আর নারেঙ্গী ঘাগরার নিচে দুটি নরম আর সুশুভ্র পায়ে রক্তকমলের আভা।” পরস্পরের প্রেমে পড়ে তারা। একদিকে সম্ভ্রান্ত বেজবড়ুয়া ঘরের মেয়ে দময়ন্তী অন্যদিকে “আব্রাহাম লখিন্দর পাদ্রীর জল নিয়েছে মাথায়”, ধর্ম বদলে খ্রিষ্টান হয়েছে। তার না আছে রূপ, না রুপো! দুজনের মাঝে বিঘত প্রাচীর। এই বাধা চূর্ণ করতে অপারগ দময়ন্তী। যৌবন আর শরীরের তাড়না তাকে টেনে নিয়ে গেছে ছোকরাবাবুর চটুল ডাকে। গর্ভে সন্তান এসেছে। তা লখিন্দরের ভেবে বাধ্যত বিয়ে দিয়ে দেওয়া তার সঙ্গে। কিন্তু দময়ন্তী কাছে থেকেও যে অনেক দূরের তখন। আত্মধিক্কার, গ্লানিতে ভরা নারী এগোয় আত্মহননের দিকে। লখিন্দর সেই পথ রোধ করে দাঁড়ায়। অমোঘ প্রশ্নটি রাখে। জাত ধর্ম সমাজ নিরিখে দুই ভিন্ন মেরুর মানুষকে এছাড়া মিলিয়ে দিতে পারত কে?
আরো পড়ুন মৃত্যুচেতনায় উদ্ভাসিত জীবনের কথাকার বিমল কর
লখিন্দরের মতো নিশ্চুপ, গোপন ভালবাসার প্রেমিকরা ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর গল্পে। যারা সেই অর্থে কিছুই পায় না, পেলেও বাধ্যত করুণার পাত্র হয়ে, অথচ ভালবাসার নাম চিরকাল আত্মত্যাগ জেনে এসেছে। ‘রেবেকা সোরেনের কবর’ গল্পের লালোয়া কুড়ুখ যেমন। রূপমতী সোরেনের রেবেকা সোরেন হয়ে ওঠার সামগ্রিক পর্যায়ের নীরব অসহায় সাক্ষী সে। দেহে এত রূপ নিয়েও পঞ্চায়েতে রূপমতীকে বিটলা ঘোষণা করা, সমাজ বহিষ্কৃত করা, স্বজাতীয়দের অত্যাচার থেকে বাঁচতে তার ধর্ম বদল, ম্যাকুসাহেবকে বিয়ে করে খ্রিষ্টান হওয়া। সাহেবের সন্তান জন্ম দেওয়া। সাহেব ফিরে আসবে বলেও আর আসে না। সন্তান আঁকড়ে বাঁচার স্বপ্ন দেখে রেবেকা, সাহেবের ফিরে আসার প্রতীক্ষা করে। কিন্তু সাহেবের ঘরণী হওয়া তাকে নতুন আত্মমর্যাদা দিয়েছে, সে না খেতে পেয়ে মরলেও কোলিয়ারির কাজে আর যাবে না, অন্য কাউকে বিয়ের প্রশ্নই তার নেই, তাতে সাহেবের অসম্মান! মৃত্যুপথযাত্রী রেবেকার কাছে আসে একমাত্র লালোয়া। মৃত্যুর পর তার কবরে একা একা চোখের জল ফেলে শুধু লালোয়া।
বস্তুত রমাপদ চৌধুরীর গল্প-উপন্যাস এভাবেই ঘুরেছে সমগ্র ভারতবর্ষ। খড়্গপুর থেকে আসামের অয়েল-টাউন ডিগবয়, কারানপুরা থেকে পালামৌ, মোগলসরাই থেকে সাঁওতালডিহি, বরকাকানার জংশন স্টেশন থেকে বেলেঘাটার অনাদি দস্তিদার লেন। গ্রামে-শহরে, জেলায় জেলায়, রাজ্যে রাজ্যে তাঁর গল্পের চরিত্ররা নির্লিপ্ত ঘুরে বেড়ায়। তাঁর গল্পসমগ্র একক ভারতের প্রতিচ্ছবি, যার অন্তঃসলিলে বয়ে যায় অনাবিষ্কৃত মনুষ্যত্ব। মধ্যবিত্ত যাপনের তীব্র ভণ্ডামি যেমন তীক্ষ্ম বিদ্রুপে ছুটে গেছে ‘শিশুমেধ’ গল্পে। যেখানে সুকোমল ডাক্তার নিরুপায় নারীর গর্ভের সন্তান নষ্ট করাকে বোঝে ন্যায়-নীতি-ধর্ম-সমাজ-সংসারের সংকট হিসাবে। অথচ একই কাজ তার নিজের কন্যার ক্ষেত্রে ঘটতে দেয় না। ব্যঙ্গ হয়ে তা আছড়ে পড়ে পাঠক মননে। এই ভণ্ডের সমাজকে নিরাবরণ করেছেন তিনি বারেবারে।
‘রাঙাপিসিমা’-র মত মানুষ, যিনি গোটা জীবন ধরে তাঁর স্বামীকে খুঁজে বেড়ান অথচ যখন সেই স্বামী প্রকৃতই ফিরে আসে, তিনি তাকে মেলাতে পারেন না আজীবন অন্বেষণের সঙ্গে। একুশ বছরের স্বামীর যে ছবি মনে থেকে গেছে আজ তাকে আগন্তুক মনে হয়। নিজেই সংসার ছেড়ে বেরিয়ে যান রাঙাপিসিমা। জীবনের অতল থেকে এমনই অভাবিত জীবন খুঁজে এনে পাঠকের সামনে রাখেন রমাপদ চৌধুরী। বিচারের জন্য নয়, মুখোমুখি দাঁড় করান। তাঁর বিশ্বাস ছিল গল্প-লেখক আসলে নিতান্ত অনাড়ম্বর, পথের ধারে গাছের ছায়ায় বসে থাকা উদাসী একজন। জীবনের মহাযুদ্ধে তার কাজ নেই, সে কেবল বাতায়নে বসে থাকা নারীর টলোমলো অশ্রু বোঝে। ঔপন্যাসিককে বলে “বন্ধু হে, ওই অশ্রুবিন্দুর মধ্যেই আমার অনন্ত সিন্ধু।”
মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
খুব ভাল লাগল। তবে অল্পই বলা হল। আরও বড় পরিসরের দাবি রইল, মৃণাল। শুধু প্রথম প্রহর নিয়েই যদি এই লেখাটি হত। ম্যাট্রিকুলেশনের পর প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হবার আগে অব্দি নির্মীয়মান রেলশহর খড়্গপুরের কথা প্রথম প্রহরে আছে, বড়ো নিবিড়ভাবে আছে। লিখবে না?