পরশু ছিল বড়দিন। অতিমারীতে দু-দুটো বছর নষ্ট হয়ে যাওয়ার পর আরও একটা বড়দিন। অতিমারীর আরেকটা ঢেউ আসতে চলেছে এমন আশঙ্কার মধ্যেই বড়দিন চলে এল। মধ্য কলকাতায় মানুষের ঢল। সন্ধের পর থেকে আলো জ্বলে ওঠে পার্ক স্ট্রিট, বো ব্যারাক, পার্ক সার্কাসের গির্জাগুলোয়। মেট্রো-বাসে তিল ধারণের জায়গা থাকে না, রাস্তায় এত ভিড় যে পুলিস হিমসিম। গঙ্গার ক্রুজ, টুংনামের লাঞ্চ, ভিক্টোরিয়ার কমলালেবু, থিয়েটার ও গানের গুচ্ছ গুচ্ছ জলসা, সেন্ট পলস ক্যাথিড্রালের সামনে অষ্টমীর একডালিয়ার ভিড় আর কদিনের জন্য বাঙালির দার্জিলিং ভ্রমণ নিয়ে যথারীতি কেটে গেল আরও এক বড়দিন। ময়দান পেরিয়ে কিছু গ্যাসবেলুন উড়ে গেল সেন্ট জনস চার্চের দিকে। ডালহৌসির রাস্তা যেন বেকার স্ট্রিট। পোদ্দার কোর্টে চিনেদের মোমো-থুকপার সে কী আয়োজন! রোদ তেরছা হয়ে পড়ল পার্ক সার্কাসের শস্তা বেকারিগুলোর প্যাকেটে, ঠিক পাশে খড়ের গাদায় শুয়ে আছেন মাতা মেরির কোলে গরীব যীশু।

তবে, এ লেখাটার বিষয় কেবল বড়দিনের কলকাতা নয়। কলকাতায় নভেম্বর মাস এলেই মনে পড়ে যে কটা নাম, তার মধ্যে যেমন আছেন ভাস্কর চক্রবর্তীর সুপর্ণা, তেমনই আছেন অঞ্জন দত্ত। এ দুটো নামই মিলেনিয়ালদের বিশেষ করে মনে পড়ে, ফেসবুক ভরে যায় এঁদের নিয়ে উক্তিতে। আর এবারের শীতে স্বয়ং অঞ্জন একদিন ফোন করে আমার ওঁকে নিয়ে একটি ছবি বানানোর ইচ্ছেতে সায় দিলেন। সবাই জানি, অঞ্জন প্রতি বছরই নিজের বেনেপুকুরের পুরনো পাড়ায় বড়দিন উদযাপন করেন। আলোয় ঝলমল করে সেই পাড়াটা। এ পাড়ার বয়স কয়েকশো বছর। পাশের পার্ক স্ট্রিট সেমেটারিতে শুয়ে আছেন মাইকেল মধুসূদন, ডিরোজিওরা। তাই আমি ছবিটা বানাতে চেয়েছিলাম এই আবহ নিয়ে এবং এর মধ্যে কীভাবে আন্তর্জাতিক মানের একজন শিল্পী মানিয়ে নিয়েছেন। অঞ্জনের সেলিব্রিটি ভাবমূর্তিকে ভেঙে একটা বিকল্প শহরে বিকল্প বেঁচে থাকা ধরাই আমার উদ্দেশ্য ছিল।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

তুর্কি ভাষার ছবির পরিচালক মানো খালিলের সাথে আমার কদিন আগে কলকাতা আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে কথা হচ্ছিল। নন্দনের এলিট ভিড়ে অসহ্য লাগছিল তাঁর, তাই রবীন্দ্রসদন মেট্রো স্টেশনের ভিড়ের মধ্যে সাধারণ মানুষের ছবি তুলছিলেন তিনি। বলছিলেন, মানুষের মাঝখানে না থাকলে অস্বস্তি হয়। একই কথা এ শহরে দাঁড়িয়ে বারবার বলেছেন বাদল সরকার, মৃণাল সেন, সত্যজিৎ রায়রা। সে কথাই আমার ছবি বলো অঞ্জন -এর শুরুতে বেনেপুকুরের গলিতে হাঁটতে হাঁটতে বলছিলেন অঞ্জনও। নভেম্বরের শীতের বিকেল নেমে আসছিল তখন। গায়ে গায়ে লাগা বাড়িগুলোর নোনাধরা দেওয়ালে চলটা উঠে গেছে কবে। তারই উপর দিয়ে টুনি বালব লাগানো পাড়াজুড়ে হলুদ-লাল, সে আলোয় ঢেকে যাচ্ছে পাড়াটার গলা পর্যন্ত ডুবে থাকা দারিদ্র্য।

অঞ্জন বলছিলেন, বাদলবাবু কীভাবে একটা সাধারণ বাড়ির ভিতরেই তাঁর নাটক মঞ্চস্থ করতেন। আর তা দেখতে দেখতে কীভাবে এই ভীষণ পুরনো আর নোংরা কলকাতাটাও অঞ্জনের শহর হয়ে উঠল। মনে পড়ছিল, আমার প্রজন্ম তথা আমাকেও এই সংকটের মধ্যে দিয়ে যেতে হয়েছে বারবার। কলকাতাকে ভালবেসে এখানে থেকে যাওয়ায় আমাকেও শুনতে হয়েছে, “কলকাতায় কিছু নেই, এখানে থেকে কিছু হবে না।” তাই অঞ্জনকে বোঝার মধ্যে দিয়ে আমি বুঝতে চাইছিলাম সত্যজিৎদের এ শহরকে ঘিরে লড়াই। কেন সত্যজিতের শহর পর্বের ছবিগুলোতে এই মধ্য কলকাতার অফিসপাড়া ও হাজার অচেনা গলি রেস্তোরাঁ বা বড়বাজার? কেন সন্দীপনের লেখাজুড়েও এই সদর স্ট্রিটের আশপাশ? কেন মহীনের ঘোড়াগুলির গানেও তাই? কোন চিহ্ন আমার কাছে ফিরে ফিরে আসছে এই সংস্কৃতির ঐতিহ্যে? কেন উনিশ শতকে অনেক টাকাপয়সা থাকা সত্ত্বেও দেশের পূর্ব প্রান্তে গোয়ার ওলন্দাজ-পুর্তুগিজদের মাঝে নয়, আমাদের এই বাগবাজার-মানিকতলায় রেনেসাঁ ঘটল? সত্যজিৎ কেন বারবার বললেন, এই শহরের জটিল নকশা আসলে ভাঁজে ভাঁজে? এই মজায় তিনি এমন মজে রইলেন যে দুনিয়ার ডাক তাঁকে উত্তেজিত করল না, বারবার বললেন, আমি এখানেই থাকব, এই কলকাতাতেই।

বড়দিনের কলকাতার দুমাস আগেই কিন্তু বাঙালির দুর্গাপুজো। কীভাবে একটা শহরের নানা দিক ম্যাজিকের মত বদলে বদলে যায় প্রত্যেক শরৎ আর শীতে! এই যে রাস্তার ভিড় তা তো একইসঙ্গে গোদারের ছবি দেখতে চলচ্চিত্র উৎসবে রাত জেগেছে, আবার এক পয়সা ভাড়া বাড়লে ট্রামও পুড়িয়েছে। গৌতম ঘোষকে গোদার নাকি কান ফিল্ম ফেস্টিভালে বাঙালির এই উত্তেজনার কথা জানতে পেরে বলেছিলেন, ফ্রান্সে তো মানুষের এই উৎসাহ নেই, তাই কলকাতাতেই সেটল করে যাবেন। বড়দিনের কলকাতার মানুষের ঢল দেখতে দেখতেও এই কথাটাই মনে পড়ল। অঞ্জন ছবিতে আমায় বলছিলেন, নন্দন বাগচী আর তাঁর একটা সার্ভের কথা। সেখানে দেখা যাচ্ছে, সত্তর দশকে যখন বরানগর ঘটছে ঠিক তখনই পার্ক স্ট্রিটের বারগুলোয় জ্যাজ-ব্লুজ বাজিয়ে যাচ্ছেন দেশের সব নামী শিল্পীরা।

আরো পড়ুন ফেস্টিভ্যালের মরসুম

এভাবেই আমার বলো অঞ্জন ছবিটা সেজে উঠছিল। মধ্য কলকাতার গলি-গলতা পেরোতে পেরোতে সে ছবি ঢুকে পড়ে অঞ্জনের ঘরে। তারপর অঞ্জনের শরীরে ও মনের ভিতর। যে মানুষটা বারবার নিজের শিল্প দিয়েই শূন্য থেকে রাজা হয়ে যেতে পারে, যাকে হারানো যায় না। যে একটা অন্য শহর, অন্য মানুষের গল্পই বলে গেল আজীবন। যার সমকালীন প্রায় সমস্ত শিল্পী দেউলিয়া, সরকারি প্রলোভন যাদের কোনো না কোনোভাবে খুন করল। একটা দুটো প্রজন্ম যখন আদ্যন্ত বিপথে চালিত, বাংলা ভাষা তথা বাঙালির আর অস্তিত্ব থাকবে কিনা তা নিয়েই যখন প্রশ্ন উঠে গেছে, তখন অঞ্জনকে খোঁজার মধ্যে দিয়ে এইসবই খুঁজছিলাম কোথাও।

বড়দিন এবারের মত শেষ হল। ছবিটা এখন ইউটিউবে সবাই দেখছেন। অন্ধকার টানেল পেরিয়ে আমার প্রজন্ম এভাবেই একটু একটু করে এগোচ্ছে ঠিকই। বসন্ত আসছে। এই তিনমাসের পাতায় জমে থাকা ধুলো তখন আবার ঝড়ে উড়ে যাবে, মধ্য কলকাতার পুরোনো সাহেবি বাংলোর কার্নিশ পেরিয়ে আমাদের বিচরণ আবার হয়ে যাবে মধ্যবিত্ত গড়িয়াহাট, গোলপার্কের চায়ের ঠেক বা কাফেগুলো। আমরাও আবার আমাদের মত করে খুঁজে পাব দাশ কেবিন বা সার্দান এভিনিউয়ের দিলীপদার টোস্ট। পার্ক স্ট্রিট ততদিনে ফাঁকা হয়ে যাবে আবার, কোনো এক অচেনা চিনে রেস্তোরাঁয় বসে হোটেলেরই ন্যাপকিনে সেই অবসরে আমি লিখে ফেলব পরের ছবির চিত্রনাট্য বা নতুন কোনো গান।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.