২৬ নভেম্বর থেকে অনির্দিষ্টকালের জন্যে রাজভবনের সামনে ধর্নায় বসে ছিলেন ঝাড়খণ্ডের প্রতিবন্ধী মানুষের বিভিন্ন সংগঠন। রাঁচির প্রচণ্ড ঠান্ডা অবহেলা করে তাঁরা এই অবস্থান চালিয়ে গেছেন তাঁদের একুশ দফা দাবি সরকারের কাছে তুলে ধরতে। তাঁদের আশা ছিল ৩ ডিসেম্বর, যে দিনটি বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবস হিসাবে চিহ্নিত, সেদিন তাঁদের সঙ্গে দেখা করে দাবিদাওয়া জানবেন সরকারি মুখপাত্র। কিন্তু ৩ তারিখ দূরের কথা, ১৯ তারিখেও সরকারপক্ষের কারোর দেখা পাওয়া যায়নি। উল্টে শাসক দলের লোকেরা যাঁরা ধর্নায় বসেছেন তাঁদের উপর চড়াও হয়েছে বলে আন্দোলনকারীরা অভিযোগ করেছেন।

আশ্চর্যের কথা, ঝাড়খণ্ডের বিরোধী দলও এই ধর্না নিয়ে একেবারেই নীরব। হিন্দি সংবাদমাধ্যমে ছোট আকারে এই খবর প্রকাশিত হলেও আমরা ইংরেজি দৈনিকে বা বড় কোনো সংবাদপত্রে এই অবস্থানের কথা প্রকাশ হতে দেখিনি। কাজেই স্থানীয় মানুষের কাছে খবর পৌঁছলেও এই আন্দোলনের কোনো নথি সর্বভারতীয় প্রতিবন্ধী অধিকার আন্দোলনের কর্মীদের কাছে পৌঁছয়নি। অবশেষে ২০ ডিসেম্বর আন্দোলনকারী প্রতিবন্ধীরা বিধানসভা ঘেরাও করার সিদ্ধান্ত নেন। ঠিক তার আগের দিন দিল্লি থেকে রাঁচি উড়ে আসেন স্বঘোষিত “দিব্যাঙ্গ” নেতা বিকাশ শর্মা, যিনি প্রত্যেক রাজ্যে ভোটের আগে বড় হোটেল ভাড়া করে “নমো দিব্যাঙ্গ” বলে সাংবাদিক সম্মেলনের আয়োজন করে থাকেন এবং প্রতিবন্ধীদের সঙ্গে দেখা করে বিজেপি প্রতিবন্ধীদের জন্য কত কাজ করেছে তার খবর দেন। ঝাড়খণ্ড বিধানসভা অভিযানে বহু প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ গ্রেপ্তার হন বলে খবর। আন্দোলনকারীরা বিজেপি নেতা বাবুলাল মারান্ডির সঙ্গে দেখা করেন বলে জানা গেছে। কিন্তু তারপরেও আন্দোলনের কোনো খবর সর্বভারতীয় সংবাদমাধ্যমে চোখে পড়েনি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রতিবন্ধকতা নিয়ে গত চার দশক কাজ করার অভিজ্ঞতা শিখিয়েছে যে আন্দোলনের যেসব মুখ বা কর্মসূচি সংবাদমাধ্যম এই জায়গা পেয়েছে বেশিরভাগ শহুরে দাবি কেন্দ্রিক । আরো স্পষ্ট করে বললে দুচারটে বড় শহর ছাড়া প্রতিবন্ধীদের নিয়ে আন্দোলনের খবর জনসমক্ষে আসে না।

ভারতের প্রধান বিচারপতি ডি ওয়াই চন্দ্রচূড় যেদিন শপথগ্রহণ করেন, দেশের এক বিখ্যাত ইংরেজি দৈনিক তাঁর পরিবারের ছবি প্রকাশ করেছিল। সেই ছবিতে দেখা যায় মাননীয় বিচারপতি চন্দ্রচূড়ের দুই পালিতা কন্যাকে, যারা হুইলচেয়ার ব্যবহার করে। সেই ছবি দেখে, বলা বাহুল্য, প্রতিবন্ধী আন্দোলনের অনেক কর্মী খুব খুশি হন। তাঁরা মনে করেছিলেন প্রতিবন্ধী সন্তানদের পালন করছেন এমন মানুষের সুপ্রিম কোর্টের প্রধান বিচারপতির আসনে বসার ফলে আমাদের দেশের প্রতিবন্ধী মানুষের জীবনে বড়সড় পরিবর্তন আসতে পারে। মাননীয় বিচারপতির এই প্রতিবন্ধকতাযুক্ত কন্যাদের পালন করা অবশ্যই প্রশংসার্হ। একথা ভোলা মুশকিল যে আমাদের দেশে এখনও প্রতিবন্ধী সন্তান জন্মালে তাকে ত্যাগ করা রীতিমত স্বাভাবিক ঘটনা, আর ঘরে এমন সন্তান থাকলে তাদের লুকিয়ে রাখাই দস্তুর। মাননীয় প্রধান বিচারপতি স্বাভাবিকভাবেই প্রতিবন্ধীদের অধিকার বিষয়ে সচেতন এবং সুপ্রিম কোর্টকে ‘barrier free’ বা বাধাহীন বা সহজগম্য করার জন্য এর মধ্যেই উদ্যোগ নিয়েছেন, এ বিষয়ে কমিটি তৈরি করেছেন। সেই কমিটির কথা ঘোষণা করা হয় ৩ ডিসেম্বর অর্থাৎ বিশ্ব প্রতিবন্ধী দিবসে।

২০ ডিসেম্বর আমরা সংসদ সহজগম্য নয় বলে একটা টুইট করেন কংগ্রেস সাংসদ শশী থারুর। পায়ে আঘাতের কারণে তিনি এখন “temporarily disabled” এবং সংসদ ভবনে প্রবেশ করতে বেশ অসুবিধা হয়েছে বলে তিনি জানান। হুইল চেয়ারে বসা থারুরের ছবি মুহূর্তের মধ্যেই প্রতিবন্ধী আন্দোলনের কর্মীরা ভাইরাল করে দেন এবং তাঁর দাবির সপক্ষে পোস্ট করতে শুরু করেন।

থারুরের এই টুইট মূলধারার সংবাদমাধ্যমেও খবর হয়ে ওঠে। এ কাজ ইংরেজি বলতে বা লিখতে না পারা কয়েকশো মানুষের জমায়েতেও হয় না।

আরো পড়ুন স্পেশাল স্কুলে দৃষ্টিহীন শিশুর মৃত্যু: আমাদের অবহেলা

ঝাড়খণ্ডের প্রতিবন্ধীদের ধর্নার কারণগুলো দেখলে বোঝা যায় তাঁদের দাবি মাটির অনেক কাছাকাছি। প্রথম দাবি মাসিক ভাতা এক হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা করা। তারপর তাঁরা চাকরিতে সংরক্ষণ, প্রতিবন্ধী ছাত্রদের জন্য সরকারি ছাত্রাবাস, দারিদ্র্য দূরীকরণ প্রকল্পগুলোতে প্রতিবন্ধীদের জন্য সংরক্ষণ ইত্যাদির কথা দাবিপত্রে লিখেছেন।

এই নিবন্ধ সংসদ ভবন বা সুপ্রিম কোর্টকে প্রতিবন্ধীবান্ধব করার বিরুদ্ধে নয়। কিন্তু সেসবের প্রয়োজনীয়তা মেনে নিয়েও বলতে বাধ্য হচ্ছি, আন্দোলনের অভিমুখ উচ্চবিত্ত মানুষের দিকে হলে ক্ষতিগ্রস্ত হবেন হাজার হাজার গরীব প্রতিবন্ধকতাযুক্ত মানুষ। বিভিন্ন গবেষণাপত্র আমাদের বারবার মনে করিয়ে দিয়েছে, প্রতিবন্ধকতা ও দারিদ্র্যের নিকট সম্পর্কের কথা। যেসব মানুষ তীব্র ঠান্ডা সহ্য করে রাঁচির রাজভবনের সামনে রাস্তায় বসে থেকে মাসে আড়াই হাজার টাকা ভাতা পাবেন, তাঁদের খবর হিসাবে পাত্তা না দেওয়া কি অন্যায় নয়? সুপ্রিম কোর্ট বা সংসদের দরজার সামনে পৌঁছনোর জন্য আগে দুবেলা ভাত, ন্যূনতম শিক্ষা প্রয়োজন। প্রতিবন্ধীদের খাদ্যের অধিকার, শিক্ষার অধিকারকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিয়ে কবে বিচার করব আমরা?

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.