“রান্না খারাপ হলে সবাই আমাদের দোষ দেয়, চোর বলে। সরকার যে বাচ্চাদের জন্য এত কম টাকা দিচ্ছে সে ব্যাপারে তো কেউ কিছু বলে না।”
জীবনে প্রথমবার মঞ্চে উঠে মাইক হাতে কথাগুলো বললেন বাদুড়িয়ার মিড ডে মিল দিদি তসলিমা বিবি। গত ২০ ডিসেম্বর বারাসাতের রবীন্দ্র ভবনে তাঁরা আয়োজন করেছেন মিড ডে মিল কর্মীদের সংগঠন আম্মার প্রথম উত্তর ২৪ পরগণা জেলা সম্মেলন। মীর নিসার আলি, অর্থাৎ তিতুমীরের নামে রেখেছেন নগরের নাম, মঞ্চের নামে স্মরণ করলেন তেভাগা আন্দোলনের চব্বিশ পরগণার শহীদ সরোজিনী-অহল্যাকে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
তসলিমা বিবিদের স্বনির্ভর গোষ্ঠীর নাম ‘জীবনের ঠিকানা’। দলের ১২ জনের মধ্যে রান্না করেন ১০ জন। একজনের বয়স হয়ে গেছে আর একজন সন্তানসম্ভবা; তাই কাজ করতে পারেন না। ২০০৪ সালে শিশুর বাধ্যতামূলক এবং অবৈতনিক শিক্ষার অধিকারকে বাস্তবায়িত করতে সরকারি স্কুলে চালু হওয়া মিড ডে মিল প্রকল্পে শুরু থেকেই রান্না করেন তসলিমাদিরা। স্কুল খোলা থাকলে রোজ তাঁদের বাঁধাধরা জীবন। বাজার করা, রান্নার জন্য কাঠ জোগাড় করা, জল আনা, উনুন ধরানো, শিক্ষকের মেপে দেওয়া সবজি কাটতে বসা, রান্না চাপানো, খাওয়ার জায়গা পরিষ্কার করা, বাচ্চাদের খেতে দেওয়া, সবার খাওয়া শেষ হওয়া অবধি অপেক্ষা করে থালা বাসন মাজা, রান্নাঘর ধুয়ে পরিষ্কার করা। সব শেষ করে বাড়ি যেতে যেতে চারটে বেজে যায়। এর বাইরেও থাকে ফরমায়েশি কাজ – শিক্ষকদের জন্য চা করা, রান্নার কাঠ রোদে দেওয়া, বাথরুম পরিষ্কার করা, উঠোন ঝাঁট দেওয়া, ছুটির দিনে স্কুলে মিটিং পড়লে টিফিনের বন্দোবস্ত করা, আরও কত কী। সপ্তাহে ছয় দিন এই হাড়ভাঙা খাটুনির সরকারি বাহারি নাম ‘স্বেচ্ছাশ্রম’।
একটা স্কুলে মিড ডে মিল পরিচালনার জন্য কতজন নিযুক্ত হবেন তা ঠিক হয় ছাত্রসংখ্যার অনুপাতে। প্রতি ২৫ জন ছাত্রের জন্য একজন, ২৫ থেকে ১০০ জন ছাত্রের জন্য দুইজন এবং তারপর প্রতি ১০০ জন ছাত্রের জন্য একজন করে কর্মীর পদ যুক্ত হয়। প্রত্যেকটি পদের জন্য মাসে আসে ১৫০০ টাকা। কিছু পৌরসভা বাদ দিয়ে উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগণা জেলায় এই পদে কর্মীরা সরাসরি নিযুক্ত হন না। রান্নার দায়িত্ব পায় তাঁদের স্বনির্ভর গোষ্ঠী। তসলিমাদিরা দশজন রান্না করেন, তাঁদের মজুরি হিসাবে প্রধান শিক্ষকের অ্যাকাউন্টে মাসে তিন হাজার টাকা আসে, ভাগ করে দাঁড়ায় মাথাপিছু ৩০০ টাকা অর্থাৎ দিনে ১০ টাকা। মিড ডে মিল চালু হবার সময় থেকেই সামগ্রিকভাবে এই প্রকল্পকে সরকার অবহেলা করে আসছে। চাল বাদ দিয়ে অন্যান্য উপকরণ আর জ্বালানি বাবদ পড়ুয়া পিছু বরাদ্দ হয় প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৫.৪৫ টাকা এবং উচ্চবিদ্যালয়ে ৮.১৭ টাকা। এই সামান্য অর্থে সুস্বাদু, পুষ্টিকর খাবার রেঁধে দেওয়ার দায়িত্বও মিড ডে মিল কর্মীর কাঁধে বর্তায়। অন্যথায় জোটে চোর অপবাদ।
মিড ডে মিলের এই বিপুল দায়িত্ব যাঁরা সামলাচ্ছেন তাঁদের বেশিরভাগই মহিলা। সমাজের প্রান্তিক, নিপীড়িত অংশ থেকে আসা এবং শিক্ষা থেকে বঞ্চিত। তাঁদের নিয়োগও রাজনৈতিক নেতাদের দয়াদাক্ষিণ্যের ওপর নির্ভরশীল। এই নিরাপত্তাহীনতা এবং নিপীড়িত, বঞ্চিত ঘরের মেয়েদের কাজে লাগিয়েই বেতন একেবারে নিচুতে নামিয়ে রাখা সম্ভব হল। এতটাই নিচুতে যে তাঁরা তাঁদের মাইনের কথা কাউকে বলতে লজ্জা পান। তবুও সন্তান প্রতিপালনের মত সামাজিক কাজে বিনা স্বীকৃতিতে খেটে যাওয়ায় অভ্যস্ত মেয়েরাই ভবিষ্যতে কোনো একদিন সরকারি কাজের স্বীকৃতি মিলবে – এই আশায় মায়ের মত মায়া-মমতা দিয়ে এই প্রকল্প কার্যকরী করার দায়িত্ব বয়ে চলেছেন।
এইভাবে ১৮ বছর কেটে গেছে। এখনো শ্রমিকের স্বীকৃতি জোটেনি, মেলেনি প্রসবকালীন ও মাতৃত্বকালীন ছুটির অধিকার, দুর্ঘটনাজনিত কোনো ক্ষতিপূরণ, কর্মরত অবস্থায় মৃত্যু হলে কোনো ক্ষতিপূরণ, অবসরকালীন কোনো সুবিধা।
এখনও বহু জায়গায় রান্না হয় কাঠের আগুনে। ছাত্রসংখ্যা কম হওয়ার কারণে সরকারি স্কুল বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাজ হারিয়েছেন অনেকে। যাঁরা কাজ করছেন এখনো, তাঁরা দিনে দশ টাকায় খাটেন। এমনকি দুমাস স্কুল ছুটি থাকার অছিলায় বারো মাসের বদলে দশ মাসের মজুরি পাচ্ছেন। সঙ্গে পড়ুয়া পিছু সরকারের ধরে দেওয়া সামান্য অর্থে পুষ্টিকর সুস্বাদু খাবার তৈরির দায় মাথায় নিয়ে কুড়োচ্ছেন একরাশ সামাজিক অসম্মান।
এই বঞ্চনা, অধিকারহীনতা ও অপমানজনক ব্যবস্থা পাল্টানোর জন্য মিড ডে মিল কর্মীরা আন্দোলন করে চলেছেন। ন্যায্য মজুরি ও সম্মান আদায়ের লক্ষ্যে নদিয়া জেলার শান্তিপুর ব্লক এলাকার মিড ডে মিল কর্মীরা গড়ে তুলেছেন মিড ডে মিল সহায়িকা সমিতি বা অ্যাসোসিয়েশন অফ মিড ডে মিল অ্যাসিস্ট্যান্টস। আদ্যক্ষর জুড়লে ‘আম্মা’। এ বছর জানুয়ারি মাসে কৃষ্ণনগরে জেলাশাসকের কাছে ডেপুটেশন আর জুন মাসে সম্মেলনে শান্তিপুর কেন্দ্রীয় কমিটি গঠনের মধ্যে দিয়ে যার পথ চলা শুরু। সম্মেলনে দিদিরা সিদ্ধান্ত নেন আম্মা কখনো কোনো রাজনৈতিক দল বা এনজিওর পিছনে গিয়ে দাঁড়াবে না, বরং নিজেকে মিড ডে মিল কর্মীদের একটি শক্তিশালী ইউনিয়ন হিসাবে প্রতিষ্ঠা করবে। ক্রমে এই সংগঠন ছড়িয়ে পড়ছে উত্তর ২৪ পরগণা, দক্ষিণ ২৪ পরগণা, পূর্ব বর্ধমান ও পশ্চিম মেদিনীপুরে।
আরো পড়ুন শুধু নিজেদের জন্য নয়, শিশুদের জন্যও লড়ছেন ‘আম্মা’
গত সেপ্টেম্বর মাসে হাজার হাজার মিড ডে মিলের দিদিরা চার ঘন্টার বেশি সময় উত্তর ২৪ পরগণার জেলা সদর বারাসাতকে স্তব্ধ করে দিয়ে মিছিল করে জেলাশাসকের দপ্তর ঘেরাও করেন। জেলাশাসকের কাছে পেশ করা দাবিপত্রে নিজেদের দাবির আগে প্রথম দাবি হিসাবে স্থান দিয়েছেন স্কুলে বাচ্চাদের খাবার বরাদ্দ বাড়ানোর কথা, রোজ ডিম দেওয়ার কথা, সব বাচ্চাদের মিড ডে মিল দেওয়ার কথাকে। গত ২০ ডিসেম্বর বারাসাতের রবীন্দ্র ভবনে অনুষ্ঠিত হয় উত্তর ২৪ পরগণা জেলার প্রথম সম্মেলন। কোনোদিন মঞ্চে না ওঠা দিদিরা অনভ্যস্ত হাতে ধরলেন মাইক, পরিচালনা করলেন নিজেদের সম্মেলন। জোর গলায় জানালেন পৃথিবীর সবচেয়ে অপুষ্ট বাচ্চাদের দেশেই যখন সরকারগুলো মিড ডে মিল প্রকল্পকে অবহেলার চোখে দেখে, তখন মিড ডে মিল কর্মীরা তাঁদের যোগ্য সম্মান পাবেন – এটা অবাস্তব ভাবনা। দুঃখ নিয়ে জানালেন, মায়েদের সবচেয়ে অসম্মান তখন হয় যখন রোজ নিজে হাতে আলুর পাতলা ঝোল অভুক্ত বাচ্চার পাতে দিতে হয়। খুঁজে বার করলেন, যে দিন আনা দিন খাওয়া অভিভাবকদের সংগঠিত হতে না পারার সুযোগ নিয়ে বাচ্চাদের মৌলিক অধিকারের উপর লাগাতার বঞ্চনা হয়ে চলেছে। সিদ্ধান্ত নিলেন আম্মা এই প্রশ্নে অভিভাবকদের সংগঠিত করার এবং বাচ্চাদের মিড ডে মিলের খাবারের বরাদ্দ বৃদ্ধি করার দাবিতে সামগ্রিক জনমত তৈরি করার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেবে।
এ লড়াই আজ শুধু মজুরি বাড়ানোর লড়াই নয়, এ লড়াই ভবিষ্যৎ প্রজন্মের স্বাস্থ্য-শিক্ষার লড়াই, এ লড়াই ভবিষ্যৎ তৈরির লড়াই, এ লড়াই বাঁচার লড়াই।
– মতামত ব্যক্তিগত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।