হপ্তা দুয়েক আগে শেষ হওয়া ফুটবল বিশ্বকাপে মেসি তথা আর্জেন্টিনার বিশ্বজয়ে যারপরনাই উদ্বেলিত বাঙালি ফুটবলপ্রেমী বাড়িতে মাংস ভাত খেয়ে এবং ছাদে বাজি ফাটিয়ে উৎসব পালনও করে ফেলেছে। কিন্তু বিশ্বকাপ পরবর্তী উদযাপনের এই আতিশয্যের মাঝেও এই প্রতিযোগিতার শুরুর দিকের কয়েকটা ঘটনা ফিরে না দেখলেই নয়।

যে কোনো আন্তর্জাতিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতাই রাজনৈতিক বা সামাজিক প্রতিবাদের আদর্শ মঞ্চ। আর সে প্রতিবাদ যদি সেই প্রতিযোগিতারই সংগঠকদের বিরুদ্ধে হয়, তাহলে তো কথাই নেই। ১৯৩৬ অলিম্পিকে লং জাম্পের ফাইনালে স্বয়ং হিটলারের রক্তচক্ষুকে উপেক্ষা করে জার্মান প্রতিযোগী লাজ লংয়ের বিজয়ী জেসি ওয়েন্সকে জড়িয়ে ধরা ছিল এক অনিন্দ্যসুন্দর রাজনৈতিক প্রতিবাদ।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

প্রতিবাদ
লাজ লং ও জেসি ওয়েন্স। ছবি ইন্টারনেট থেকে

তেমনই ২০১৯ সালে মহিলাদের ফুটবল বিশ্বকাপের ফাইনালে নেদারল্যান্ডসকে উড়িয়ে দিয়ে বিশ্বজয়ের পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিনায়িকা মেগ্যান র‍্যাপিনোর নেতৃত্বে গোটা স্টেডিয়ামের পুরুষদের সমান পারিশ্রমিকের দাবিতে উঠে দাঁড়ানোর মুহূর্তটাও রাজনীতি সচেতন ক্রীড়াপ্রেমীদের কাছে স্বতঃস্ফূর্ত প্রতিবাদের এক অনির্বচনীয় উদাহরণ।

প্রতিবাদ
মেগান র‍্যাপিনো। ছবি ইন্টারনেট থেকে

কাতারে অনুষ্ঠিত বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার বহু থেকেই কাতারের সংগঠকদের বিরূদ্ধে মানবাধিকার লঙ্ঘনের একাধিক অভিযোগ কানে আসছিল। তদুপরি কাতারী সমাজব্যবস্থা অত্যন্ত রক্ষণশীল হওয়ায় ফুটবল স্টেডিয়ামে মদ্যপান থেকে আরম্ভ করে মহিলা দর্শকদের পোশাক-আশাক – সবকিছুর উপরেই একগুচ্ছ মধ্যযুগীয় বিধিনিষেধ আরোপ করেছিল কাতার সরকার। এসব নিয়ে বাংলা সংবাদমাধ্যমগুলোতে পাতার পর পাতা লেখা হয়েছে, পক্ষে বিপক্ষে অনেক আলোচনা হয়েছে। আমার নতুন কিছু বলার নেই। যা নিয়ে বলার আছে তা হল কাতার বিশ্বকাপের সংগঠকদের কদর্য সমপ্রেমবিদ্বেষ (homophobia) এবং বাকি পৃথিবীর পক্ষ থেকে সেই কদর্যতার প্রতিক্রিয়া।

শুরু থেকেই শুরু করি।

কাতারে সমপ্রেমী মানুষের বেঁচে থাকার অধিকার নেই। সমপ্রেমী বিবাহ বা সমপ্রেমী যুগলদের দত্তক নেওয়ার অধিকার তো দূর অস্ত, একই লিঙ্গের দুই প্রাপ্তবয়স্ক মানুষের মধ্যে প্রেমই সে দেশে শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এইসব আইনকানুনের প্রতিবাদে পাশ্চাত্যের বেশকিছু দল শান্তিপূর্ণভাবে হাতে রামধনু-রঙা ‘ওয়ান লাভ’ আর্মব্যান্ড পরে খেলতে নামার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। উদ্দেশ্য কাতারবিরোধী বা ইসলামবিরোধী হওয়া নয়, ভালবাসাকে কেবলমাত্র ভালবাসা হিসাবেই স্বীকার করার অঙ্গীকারমাত্র। কিন্তু রাষ্ট্র আর ধর্ম যখন পরস্পরের ভঙ্গুর রক্ষণশীল চেতনাকে রক্ষা করার জন্য অঙ্গীকারবদ্ধ, তখন এই সহজ সত্যটুকুও আর গ্রহণযোগ্য থাকে না। স্বভাবতই যে সাতটি দল (ইংল্যান্ড, ওয়েলস, বেলজিয়াম, জার্মানি, সুইটজারল্যান্ড, ডেনমার্ক ও নেদারল্যান্ডস) ওই আর্মব্যান্ড পরবে ভেবেছিল, তাদের সেই স্বাধীনতাটুকুও দেয়নি ফুটবলের নিয়ামক সংস্থা ফিফা।

আরো পড়ুন কাতারে বিশ্বকাপ: নিরোর অতিথি আমরা সবাই

সভাপতি জিয়ান্নি ইনফান্তিনো বিশ্বকাপ শুরু হওয়ার আগেই কাতারের শাসকদের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী যাবতীয় আপত্তিকে নস্যাৎ করে সাংবাদিক সম্মেলন করেন, বলেন ইউরোপ যা করে এসেছে তার জন্যে কয়েক হাজার বছর ধরে ক্ষমাপ্রার্থনা করা উচিত। ফলে ফিফা যে সেই শাসকদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের স্বাধীনতা দেবে না তাতে আর আশ্চর্য কী? বিশ্বকাপের মত মঞ্চে খেলা শুরুর আগেই হলুদ কার্ড দেখানোর ভয় দেখানোর দরুন সাত ভাই চম্পার কোনো ভাইই সাহস করে আর আর্মব্যান্ডটা পরেনি। এদের মধ্যে জার্মান ফুটবল দল আবার এই হলুদ কার্ড দেখানোর সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করে মুখে হাত চাপা দিয়ে গ্রুপছবি তুলে।

প্রতিবাদ
ছবি: টুইটার

পাশাপাশি কাতার প্রশাসনের সমপ্রেমবিদ্বেষের নির্লজ্জ উদযাপন চলতেই থাকে। রামধনু রঙা জামা পরে আসার অপরাধে টিকিট থাকা সত্ত্বেও বেশকিছু দর্শককে মাঠে ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। সাংবাদিক গ্রান্ট ওয়াল এর প্রতিবাদে মুখ খুললে তিনি কাতারি চরমপন্থীদের থেকে খুনের হুমকি পান, কয়েকদিন পরে প্রেস সেন্টারেই মারাও যান। তাঁর মৃত্যুর পরে, তাঁর সমপ্রেমী ভাই এক হৃদয়বিদারক সাক্ষাৎকারে জানান তাঁর ভাইয়ের শেষ কয়েকদিনের ভয়াবহতার কথা।

একজন বাঙালি হয়ে হঠাৎ এইসব স্মৃতি কেন ঘাঁটছি?

তার কারণ গত কয়েক সপ্তাহ ধরে কাতারের এই বর্বরতার সপক্ষে বাংলা ফেসবুকে যে পরিমাণ উল্লাস দেখলাম তাতে আমি ব্যক্তিগতভাবে অত্যন্ত হতাশ। আরও হতাশাজনক হল উন্নয়নশীল বিশ্বের বামপন্থী সংগঠনগুলোর তুলনামূলক নীরবতা। আজ যদি একটি ইসলামিক মহাশক্তি কুইয়ার ব্যক্তিদের উপর সংস্কৃতি এবং ধর্মের দোহাই দিয়ে যথেচ্ছাচার চালায়, তার প্রতিবাদ করা ‘ইসলামোফোবিয়া’ নয়। শুধু তাই নয়, যে রাজনৈতিক মতাদর্শ সবসময়ে প্রান্তিক মানুষের সমর্থন পেয়ে এসেছে, এই সময়ে ইসলামিক শোষণের প্রতিবাদ করা তাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। একথা অনস্বীকার্য, যে তুলনামূলকভাবে পাশ্চাত্যের বামপন্থীরা এ বিষয়ে অনেকখানি সাবালকত্বের পরিচয় দিয়েছেন এবং প্রয়োজনমত ইসলামিক বিশ্বের মতাদর্শের কট্টর সমালোচনা করতেও পিছপা হননি। সিএনএন থেকে দ্য গার্ডিয়ান – আমেরিকা, ব্রিটেনের নিরিখে বাম ঘেঁষা অনেক সংবাদমাধ্যমই বিশ্বকাপের প্রতিবেদনে যথেষ্ট ভারসাম্য বজায় রেখেছে। শুধু তাই নয়, পাশ্চাত্যের দক্ষিণপন্থীদের একাংশও এ বিষয়ে যথেষ্ট মুক্তমনের পরিচয় দিয়েছে।

তাহলে কি পাশ্চাত্যের বাইরে কুইয়ার লিবারেশনের কোনো আশা নেই?

অবশ্যই আছে। নইলে আজ ইসলামিক সংগঠনগুলো এতো আদাজল খেয়ে কুইয়ার লিবারেশনের বিরোধিতা করত না। আশা না থাকলে বেলজিয়ামের ফুটবল জার্সির কলারের ভিতরের ট্যাগটাতে ‘লাভ’ লেখাটা থাকায় (যা জার্সি পরার পর দেখাও যায় না) ইসলামিক সংগঠনগুলো অস্বস্তি বোধ করত না। আশা না থাকলে কাতার সরকারকে বিশ্বকাপের মঞ্চে প্রাইড ফ্ল্যাগ টাঙিয়ে তার তলায় ‘ব্যানড ইন কাতার’ লিখে দিতে হত না। ২০২২ সালের কাতারে দাঁড়িয়ে এগুলোই হয়ত প্রাপ্তি।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.