দুটো গল্প দিয়ে লেখাটা শুরু করা যাক। প্রথমটা কলকাতা শহরের। ২০২২ সালের পুরভোটের আগে সাহিত্যিক স্মরণজিৎ চক্রবর্তী কলম ধরেছিলেন আনন্দবাজার পত্রিকার হয়ে। লিখেছিলেন ফুটপাথ ধরে রাসবিহারী মোড় থেকে লেক মার্কেটের দিকে হাঁটা দুষ্কর হয়ে দাঁড়িয়েছে। সঠিকভাবেই চিহ্নিত করেছিলেন, যে রাস্তা দিয়ে হাঁটতে গিয়ে যে কোনো সময়ে দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু কারণ হিসাবে চিহ্নিত করেছিলেন ফুটপাথের হকারদের, গাড়ির মালিকদের নয়। আমি মনে করি না স্মরণজিৎ ব্যক্তিগত জীবনে গরিব বিরোধী। কিন্তু বহু দশকের প্রোপাগান্ডা ঘিঞ্জি রাস্তার সমাধান হিসাবে আমাদের আমাদের গরিব হকার সরানোর দাবি জানাতেই শিখিয়েছে, বড়লোকদের গাড়ির সংখ্যা কমানোর কথা আমাদের মাথাতেই আসে না। শহরের রাস্তায় ব্যক্তিগত গাড়ি যেন মনোলিথের মতো। সমাজের কাজে লাগুক বা না লাগুক, তারা আদি অনন্তকাল ধরে চলেছে, চলবে। আমাদের অর্থনীতিতে বিরাট অবদান রাখা হকারদের বিনিময়ে হলেও। তাই বাধ্য ছাত্রের মত আমরা ব্যক্তিগত গাড়ির যুক্তিকে প্রশ্ন করি না। ভুলে যাই “রাস্তা কারও একার নয়”।

আরেকটা গল্প ব্যক্তিগত গাড়ির স্বর্গরাজ্য আমেরিকার। সালটা ২০১৬। ইলন মাস্কের (কু)খ্যাতি তখনও আজকের মত মাত্রা ছাড়ায়নি। তবে ওঁর আত্মম্ভরিতা সম্পর্কে সেই কথা বলা মুশকিল। লস এঞ্জেলসের যানজটে বসে মানবজাতির ভবিষ্যতের স্বঘোষিত পরিত্রাতা ঠিক করে ফেললেন উনি ট্র্যাফিক জ্যামকে ডোডো পাখির মতো বিলুপ্ত করে দেবেন। কথাটা মন্দ নয়। প্রচণ্ড বিরক্তির উদ্রেক করা ছাড়াও যানজট প্রত্যেক বছর ভারতের অর্থনীতির ১.৫ লক্ষ কোটি টাকা মূল্যের ক্ষতি করে। অঙ্কটা পশ্চিমবঙ্গের গোটা স্বাস্থ্য বাজেটের দশ গুণ। আমেরিকায় অঙ্কটার পেছনে শূন্যের সংখ্যা আরও বেশি। কিন্তু কাজটা হবে কী করে? মাটির তলায় টানেল খুঁড়ে, যেখানে চলবে মাস্কেরই কোম্পানি টেসলার গাড়ি। কী অসাধারণ উদ্ভাবনীমূলক চিন্তা! যেমন বিলিয়নিয়ারের কথা তেমনি কাজ শুরু হল আমেরিকার ষড়রিপু উপচে পড়ার শহর লাস ভেগাসে। ছ বছর বিপুল টাকা খরচ করে কাজ চলার পরে ভেগাস লুপ খুলে দেওয়া হল সাধারণ মানুষ, থুড়ি, টেসলা গাড়ির মালিকদের জন্য। তারপর কি দেখা গেল? টানেলের মধ্যে যানজট। আসলে টানেল তৈরি করা আর রাস্তায় আরেকটা লেন তৈরি করার মধ্যে কোনো তফাত নেই। আর গত ৬০ বছরের নগরায়ণ সংক্রান্ত গবেষণা বারবার প্রমাণ করেছে যে লেনের সংখ্যা বাড়িয়ে যানজট কমানো সম্ভব নয়।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

ব্যক্তিগত গাড়িই যানজটের নাটের গুরু। এর কারণ বোঝা খুবই সহজ। আসলে ব্যক্তিগত গাড়ি বেশিরভাগ সময়েই একজন বা দুজন চড়েন। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নিই যে গাড়িতে সবসময়েই চারজন বা পাঁচজন যাত্রা করেন, তাহলেও প্রতি একক ক্ষেত্রফলে যাত্রীর সংখ্যায় ব্যক্তিগত গাড়ি বাস, ট্রেন বা ট্রামের ধারেকাছে আসতে পারবে না। অর্থাৎ সমস্যাটা স্থানসঙ্কুলানের। গাড়ি বেশি জায়গা দখল করে আর কম যাত্রী বহন করে যানজট সৃষ্টি করে।

রাস্তা
ছবি ইন্টারনেট থেকে

এর সহজ সমাধান হতে পারত গণপরিবহণ এবং সাইকেল চালানোকে সমর্থন ও তহবিল জোগানো, যা ইউরোপের প্রায় সব শহরে করা হয়। কিন্তু এখানেই প্রবেশ করে রাজনীতি। আরও ভালো করে বললে শ্রেণি রাজনীতি।

ভারতের মত উঁচুনীচু নিয়ে প্রচণ্ড খুঁতখুঁতে সমাজে গাড়ি হল স্ট্যাটাস সিম্বল। অনেকেই চাকরি পেয়ে নিজের অবস্থার উন্নতি দেখাতে সবচেয়ে আগে মাসিক কিস্তিতে হলেও একটা গাড়ি কেনেন। এই শ্রেণির মানুষ গাড়ির ‘অর্জিত’ সুবিধা ছেড়ে দিয়ে আবার গরিবগুরবোদের সাথে বাসে-ট্রেনে ঘুরতে রাজি হবেন না। আমেরিকায় আবার গাড়ি ব্যক্তিস্বাধীনতা আর প্রাইভেসির প্রতীক। তাই ওদেশের বহু মানুষও গাড়ি ছেড়ে গণপরিবহণ ব্যবহার করতে নারাজ। এই দুই দলের মানুষ (যার মধ্যে মাস্ক মহাশয়ও পড়েন) খুব সহজ একটা যুক্তি ব্যবহার করেন “জায়গার অভাব? তাহলে জায়গা বাড়িয়ে দাও। আমাদের গাড়ি কেড়ে না নিয়ে রাস্তা আরেকটু চওড়া করে দাও। তাহলেই যানজট কমে যাবে।” কিন্তু বাস্তবে তা হয় না। কারণ আবেশিত চাহিদা (induced demand)।

এই ঘটনাটা আমাদের সাধারণ ধ্যানধারণার বিপরীত (counter-intuitive) হলেও বৈজ্ঞানিক সত্য, যা ১৯৩০-এর দশক থেকে শুরু করে আজ অবধি বারংবার প্রমাণিত হয়েছে। আবেশিত চাহিদার তত্ত্ব আমাদের বলে যে রাস্তার আয়তন যত বাড়ানো হবে যানজট তত বাড়বে।

রাস্তার আয়তন বাড়ানো চোরাবালির মত। একবার পা দিলে উঠে আসা মুশকিল। তত্ত্বের কচকচি শুনতে হবে না। টেক্সাসের কেটি ফ্রিওয়ের কথাই ধরা যাক। এই “রাস্তায় আর একটা লেন বাড়ালেই যানজট কমে যাবে” যুক্তিকে অস্ত্র করে টেক্সাস সরকার কেটি ফ্রিওয়েকে চওড়া করতে করতে ২৬ লেনের এক মহা হাইওয়েতে পরিণত করে। কিন্তু তাতে কি যানজট কমেছে? না, উলটে বেড়ে গেছে। টরন্টো বিশ্ববিদ্যালয় ও পেনসিলভ্যানিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই গবেষক দেখিয়েছেন, রাস্তার আয়তন ১০% বাড়লে যানজটের কারণে যাত্রার সময়ও ১০% বেড়ে যায়। অঙ্কের ভাষায় একে বলে ‘ওয়ান টু ওয়ান রিলেশনশিপ’।

মনে প্রশ্ন আসা স্বাভাবিক, যে এমনটা কেন হয়? আসলে রাস্তার আয়তন বাড়ালে যাঁরা আগে গাড়ি চড়তেন না, তাঁরাও গাড়ি চড়তে উদ্বুদ্ধ হন। দেখা গেছে, আগে যাঁরা বাস-ট্রাম ব্যবহার করতেন বা অন্যান্য ছোট রাস্তা ব্যবহার করতেন তাঁরাও কম যানজটের আশায় সদ্য চওড়া হওয়া রাস্তায় এসে ভিড় করেন। এছাড়াও অধিকাংশ ক্ষেত্রেই শহরের মধ্যে রাস্তা চওড়া করার অর্থ আবাসিক এলাকা এবং কর্মক্ষেত্রের মধ্যে দূরত্ব বাড়িয়ে দেওয়া। ফলত যারা হেঁটে কর্মস্থল বা দোকান-বাজারে যেতেন তাঁরাও গাড়ি ব্যবহার করতে বাধ্য হন। ফলে যানজট আরও বেড়ে যায়। মোদ্দাকথা, রাস্তার আয়তন বাড়ালে যানজট কমার বদলে বেড়েই যায়।

ব্যক্তিগত গাড়ি শুধু যানজট তৈরি করে না, অর্থনীতিরও ক্ষতি করে। রাস্তা চওড়া করার নামে হাজার হাজার মানুষের উচ্ছেদ, যানজটের জন্য দায়ী করে আমাদের নাগরিক অর্থনীতির শিরদাঁড়াসম হকার উচ্ছেদ তো আছেই। আরও ভয়ানক ক্ষতি হয় গাড়ির জন্য তৈরি দানবিক রাস্তাগুলো আর্থিক কর্মকাণ্ডের সম্ভাবনাকে সমূলে বিনাশ করে বলে। হাইওয়ে বাসস্থান এবং কর্মস্থলের মধ্যে দূরত্ব ক্রমশ বাড়িয়ে তোলে, উঠে আসে মাইলের পর মাইল জুড়ে ফাঁকা, বন্ধ্যা এলাকা। সেখানে জনমনিষ্যির দেখা মেলে না। ফলে বসে না কোনো বাজার, ফল-মিষ্টি-চায়ের দোকান। ফলে হয় না কোনো আর্থিক ক্রিয়াকলাপ। সংলগ্ন এলাকার আয়, কর্মসংস্থান তো কমেই, সঙ্গে কমে যায় সরকারের কর সংগ্রহ। ফলে অন্যান্য ছোট ব্যবসা, হকার অধ্যুষিত এলাকার জিএসটি, ভ্যাটের মতো সেলস ট্যাক্সের টাকায় বড়লোকদের গাড়ি চলাচলের রাস্তার দেখভাল করা হয়। অর্থাৎ গরিব, মধ্যবিত্ত মানুষের টাকায় সেবা করা হয় সমাজের সবচেয়ে ধনী ব্যক্তিদের। এর থেকে বড়ো প্রতিক্রিয়াশীল করের উদাহরণ আর কী হতে পারে? ডেট্রয়েটের দেউলিয়া হওয়ার একটা কারণ কিন্তু শহরের কৃষ্ণাঙ্গ অধ্যুষিত সমৃদ্ধ এলাকাগুলোকে গুঁড়িয়ে দিয়ে হাইওয়ে তৈরি করা।

আরো পড়ুন ভর্তুকি উন্নয়নের পরিপন্থী: বাজার মৌলবাদীদের কুসংস্কার

শহর হওয়া উচিত মানুষের জন্য, গাড়ির জন্য নয়। তাই শহরের রাস্তাঘাটের নকশা এমনভাবে করা দরকার যাতে হাঁটা, সাইকেল চালানো সুবিধাজনক হয়, গাড়ি চালানো নয়। শহরের ব্যস্ততম এলাকাগুলোতে গাড়ির প্রবেশ বন্ধ করে মানুষের হাঁটার উপযোগী করে তুললে শুধু যানজটই কমে না, আর্থিক বৃদ্ধিও হয়। তাই নিউ ইয়র্ক, প্যারিস, বার্লিন, ব্রাসেলস, টোকিও সমেত পৃথিবীর প্রায় সব বড় শহর, যারা তাদের সৌন্দর্যের জন্য বিখ্যাত, এই পথেই হাঁটছেপ্যারিস তো প্রায় সারা শহরেই গাড়ি নিষিদ্ধ করে প্রায় সমস্ত রাস্তা সাইকেল এবং পথচারীদের জন্য খুলে দিয়েছে। আমাদের দেশেও মুষ্টিমেয় মানুষ গাড়ি ব্যবহার করেন, সাইকেল ব্যবহার করেন বিরাট অংশের খেটে খাওয়া মানুষ। সরকারের নীতিও তো তাঁদের মাথায় রেখে করা উচিত, তাই না? তাই শহরকে আবার সবার শহর করে তুলতে দরকার নিউ ইয়র্কের মতো কনজেশন প্রাইসিং, টাইমস স্কোয়্যারের মতো ব্যস্ত এলাকায় গাড়ি সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করা, আমেরিকার বস্টন বা দক্ষিণ কোরিয়ার সিওলের মত শহরের ভিতরের হাইওয়েগুলোকে সরিয়ে দেওয়া এবং বাস, ট্রাম, লোকাল ট্রেনের মত গণপরিবহণে আরও অনেক বেশি সরকারি বিনিয়োগ।

কলম্বিয়ার রাজধানী বোগোতার মেয়র গুস্তাভো পেত্রো বলেছিলেন “যে দেশে গরিবরা গাড়ি চড়েন সেটা উন্নত দেশ নয়। উন্নত দেশ সেটাই যেখানে বড়লোকরাও গণপরিবহণ ব্যবহার করেন।” তাই রাস্তায় থাকুক শুধু পায়ে পায়ে এগিয়ে চলা শহরের মানুষ, শহরের হকার, শহরের বাস-ট্রাম-ট্রেন। কারণ “তাকেই একদিন রাস্তা ছাড়তে হয়, যার স্পর্ধা আকাশ ছুঁয়ে যায়”।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

  1. খুব যথার্থ লিখেছেন। শহর গাড়ির জন্য না সাজিয়ে সাইকেল বা গণপরিবহনের উপযুক্ত না করলে সমস্যা নানান দিক থেকে গুরুতর হতে থাকবে। কলকাতা থেকে ট্রাম প্রায় উঠে যাবার যোগাড় অথচ ট্রামের মত সুবিধার গণপরিবহণ ভাবাই যায় না। বড় ট্রলি বাসে সে সুবিধা হবে না, মেট্রো ব্যয়বহুল। শুধু তাই নয়, শহর যদি সাইকেল বা স্কেটবোর্ডের যাতায়াতের সুগম করতে হয়, ফুটপাথ নতুন করে সাজাতে হবে, কার্ব কাটের ব্যবস্থা করতে হবে। পুরনো কলকাতায় ফুটপাথ নীচু করে করা থাকত, মানুষের যাতায়াতের সুবিধা হত। পরিবেশের উপকারের কথা যদি ছেড়েই দেন। ব্যাটারি বা তেলের গাড়ির ব্যবহার যত কম করা যায়, ততটাই মঙ্গল।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.