চার বছর অন্তর বিশ্বকাপের ঠিক আগে দুটি বিষয় নিয়ে ভারতীয় ফুটবপ্রেমীদের প্রচুর আক্ষেপ করতে দেখা যায়। প্রথমত, এতদিন পরেও আজও কেন ভারত বিশ্বকাপের মূলপর্বে পৌঁছে যাবার কোনো আশা জাগাতে পারল না। দ্বিতীয়ত, সেই ১৯৫০ সালে ব্রাজিল বিশ্বকাপে খেলবার সুযোগ পেয়েও শেষ মুহূর্তে নাম প্রত্যাহার করে নেয় ভারত, তাই নিয়ে এখনও অশ্রুপাত করেন কিছু মানুষ। তাঁদের বিশ্বাস, সেদিন যদি ভারত বিশ্বকাপে খেলবার এই অপ্রত্যাশিত সুযোগ গ্রহণ করত, তাহলে আজ অনেকটাই এগিয়ে যেত এ দেশের ফুটবল।

এখানে লক্ষণীয় ব্যাপার হল, এই হাহুতাশ যাঁরা করেন, তাঁরা প্রায় সবাই আধুনিক প্রজন্মের মানুষ। আজ থেকে ৭২ বছর আগে বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ হেলায় হারিয়েছিল ভারত, এটা তাঁদের কাছে একটি হাতের লক্ষ্মী পায়ে ঠেলবার মত অমার্জনীয় অপরাধ বলে গণ্য হয়, তারই ফলশ্রুতি এই ঘনঘন কপাল চাপড়ানো। কিন্তু ১৯৫০ সালে ভারতীয় দল যদি সত্যি সত্যি বিশ্বকাপে যেত, তাহলে যে সমস্ত ফুটবলারের সেই দলে নির্বাচন প্রায় নিশ্চিত ছিল, তাঁরা পরবর্তীকালে কী বলেছেন, তা জানলে যথেষ্ট অবাক হতে হয়। কিংবদন্তী স্ট্রাইকার মেওয়ালাল একবার বলেছিলেন, “হ্যাঁ, একবার শুনেছিলাম বটে বিশ্বকাপে যাওয়া হবে। কীসব কারণে সেবার যাওয়া হল না। আমরাও বিশেষ মাথা না ঘামিয়ে পরের বছরের এশিয়ান গেমস নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম।”

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আর তৎকালীন ভারতীয় দলের অধিনায়ক শৈলেন মান্না তো সরাসরিই বলেছিলেন, বিশ্বকাপের চেয়ে সেইসময় তাঁরা অলিম্পিককে অনেক বেশি গুরুত্ব দিতেন; ব্রাজিল যাওয়া হল না বলে তাঁদের মোটেই কোনো হেলদোল ছিল না। আজকের দিনে ব্যাপারটা অকল্পনীয় মনে হলেও এটাই ছিল বাস্তব।

আজ এই ২০২২ সালে দাঁড়িয়ে কেউ যদি প্রশ্ন করেন, সেদিন বিশ্বকাপ ঘিরে কেন এই আগ্রহের অভাব? কেন এই উদাসীনতা? তাহলে এর জবাবে মাত্র একটা কথাই বলা যায় – তখনো যে পেলে নামক এক ১৭ বছরের ব্রাজিলিয় যুবক বিশ্বকাপের আসরে আবির্ভূত হননি। বিশ্ব ফুটবল তখনও প্রাক-পেলে যুগের শেষ পর্যায়ে। আর বছর চারেকের মধ্যে মঞ্চে প্রবেশ করবেন পেলে, একটি কার্যত ইউরোপীয়-লাতিন আমেরিকান প্রতিযোগিতাকে প্রায় একক প্রচেষ্টায় করে তুলবেন ‘দ্য গ্রেটেস্ট শো অন আর্থ’ নামে একটি অতিমানবিক শো।

এক ইংরেজ সাংবাদিক একবার প্রশ্ন তুলেছিলেন, বিশ্বের সবচেয়ে পরিচিত চার অক্ষরের শব্দ কী? উত্তরটাও দিয়েছিলেন নিজেই – আজ্ঞে না। আপনারা যে শব্দটি ভাবছেন, সেটি এখন দু নম্বরে চলে গেছে, প্রথম স্থানে উঠে এসেছে পেলে নামক একটি শব্দ, যা বানান করতে প্রয়োজন হয় চারটি অক্ষর।

একেবারেই বাড়াবাড়ি করেননি এই সাংবাদিক। বিংশ শতাব্দীর ক্রীড়া ইতিহাসে যাবতীয় খেলাধুলা একত্র করলেও এমন একজন ক্রীড়াবিদকে পাওয়া যাবে না, যিনি সমগ্র বিশ্বের সব বয়সের মানুষকে এতটা প্রভাবিত করতে পেরেছেন। অনেকেই হয়ত উল্লেখ করবেন কৃষ্ণাঙ্গ ক্রীড়াবিদ হিসাবে তিরিশ দশকের জেসি ওয়েন্স অথবা পেলেরই সমসাময়িক মহম্মদ আলির নাম। কিন্তু এতে কোনো সন্দেহ নেই যে ‘ইমপ্যাক্ট স্পোর্টসপার্সন’ হিসাবে পেলে সম্ভবত আজও প্রতিটি বিষয়ে রেকর্ড মার্কস পেয়ে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম, ওয়েন্স কিংবা মহম্মদ আলি তাঁর কাছে বিশ্ববিদ্যালয়ের অতীব ভালো ছাত্র মাত্র, তার বেশি কিছু নন।

তবুও, যদি ইতিহাসের বিকৃতি না ঘটানো হয় (যা কিনা বর্তমানে আকছার ঘটছে), সবকিছু ছাপিয়ে আগামী কয়েক শতক সচেতন মানুষ পেলেকে মনে রাখবেন শুধুমাত্র একটা কারণে – ফুটবলের মত একটি সর্বাঙ্গীণ টিম গেমকে সদ্যপ্রয়াত এই ৮২ বছরের মানুষটি মাত্র তিরিশ বছর বয়সের মধ্যে যে উচ্চতায় নিয়ে গিয়েছিলেন, তা শুধু অবিশ্বাস্য নয়, কিছু কিছু জায়গায় আরব্য রজনীর গল্পের মত।

আজকাল সংবাদমাধ্যমে দুটি শব্দের ছড়াছড়ি – মেগা এবং মহা। এককথায় এ দুটি হল ‘অল সিজন্স ওয়ার্ডস’; যত্রতত্র, যে কোনো বিষয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। সে খেলাধুলা, চলচ্চিত্র, রাজনীতি, মায় গুরুগিরিতেও।

ষাট-সত্তর বছর আগে কিন্তু শব্দদুটি মোটেই এতটা সহজলভ্য ছিল না। চার্চিল অথবা স্তালিনকেও কেউ মেগা পলিটিশিয়ান বলে অভিহিত করেছে – এমন কথা খুব একটা শোনা যায় না, ফুটবলারদের কথা তো ছেড়েই দিলাম।

বলতে দ্বিধা নেই, মেগা অথবা মহা শব্দদুটি যদি ছেড়েই দেওয়া হয়, তাহলেও বিশ্বতারকা বলতে যা বোঝায়, তেমন কেউ ফুটবলে সেদিন ছিল না। এই মুহূর্তে যদি আদেমির দে মেনেজেস বা সান্দোর ককসিসের নাম সামনে রাখা হয়, তাহলে বেশিরভাগ মানুষ নিশ্চিতভাবে মাথা চুলকোবেন। আর যখন বলা হবে এঁরা দুজন ছিলেন ১৯৫০ এবং ১৯৫৪ বিশ্বকাপের সর্বোচ্চ গোলদাতা, তখন নির্ঘাত প্রশ্ন হবে “তাই বুঝি?”

আরো পড়ুন বেলা ফুরোতে আর বসে রইলেন না শেন ওয়ার্ন

যাবতীয় ধ্যানধারণা স্রেফ পা দিয়ে চুরমার করে দিলেন পেলে, মাত্র ১৭ বছর বয়সে, বিশ্বকাপের আসরে প্রথমবার নেমেই। প্রথম গোটা দুয়েক ম্যাচে তাঁকে খেলাননি কোচ – বাচ্চা ছেলে, যদি ঘাবড়ে যায়। শেষ অবধি পেলে নামলেন স্বাস্থ্যবান, দীর্ঘকায় এবং দক্ষ খেলোয়াড় নিয়ে সুসংবদ্ধ দল সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে। ঝড় তুলে দিলেন। যে ঝড় তিনি তুললেন, তাতে শুধু শক্তিশালী সোভিয়েত ইউনিয়নই খড়কুটোর মত উড়ে গেল তাই নয়, পৃথিবীর সেই দীর্ঘতম ঝড় শান্ত হল টানা বারো বছর ধরে চলবার পর ১৯৭০ সালে মেক্সিকোতে। সেদিন বিশ্বকাপ ফাইনালে ব্রাজিলের হাতে ৪-১ গোলে দুরমুশ হল ইতালি, তিনবার জেতার সুবাদে চিরকালের মত পেলের সঙ্গে জুলে রিমে কাপ পাড়ি দিল রিও দি জেনিরোর দিকে, দর্শকদের দিকে হাত নাড়তে নাড়তে বিশ্বকাপ থেকে চিরবিদায় নিলেন পেলে। রেখে গেলেন তাঁর নিজ হস্তে কর্ষিত বিশ্বকাপ নামক এক অতি উর্বর জমি, যা থেকে ২০২২ সালে ফিফা আয় করেছে ৭.৫ বিলিয়ন ডলার।

কে সর্বশ্রেষ্ঠ বড় ফুটবলার – পেলে, মারাদোনা না মেসি? এই নিয়ে প্রবল এঁড়ে তর্ক চলতেই থাকবে। ডি স্টিফানো, জর্জ বেস্ট অথবা য়োহান ক্রয়ফকে পেলের চেয়ে মহান খেলোয়াড় হিসাবে প্রমাণ করবার যাবতীয় প্রচেষ্টায় কোনো খামতি থাকবে না, পেলের গোলের সংখ্যাকে যে ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে দেখানো হয়েছে, তা নিয়ে সোশাল মিডিয়ায় ব্যঙ্গবিদ্রূপ অব্যাহত থাকবে। কিন্তু আধুনিক ফুটবলকে পেলে যা দিয়ে গেলেন, সেই কুবেরের ঐশ্বর্যকে মেপে দেখবার ক্ষমতা কারোর কোনোদিন হবে না। ১৯৫৮ সালে সুইডেনের মাঠে যেদিন তিনি প্রথম নেমেছিলেন, সেদিন তাঁর হাতে শঙ্খচক্রগদাপদ্ম ছিল না বটে, কিন্তু নারায়ণসম ছিল তাঁর আবির্ভাব; ভাগ্যিস সেদিন ভক্তদের সংখ্যা ছিল হাতে গোনা, না হলে অচিরেই একাদশ অবতার হিসাবে পরিগণিত হতেন।

কিন্তু তা বলে পেলে কি আমাদের কখনো হতাশ করেননি? করেছেন বৈকি! মহাভারতের শ্রীকৃষ্ণের মতই বারবার উজ্জীবিত করেছেন, আবার হতাশও করেছেন। ১৯৯৪ বিশ্বকাপের সময় মার্কিন দেশের সংগঠকদের যাবতীয় আজগুবি পরিকল্পনার সঙ্গে তাঁর সহমত হওয়া, কিছু বহুজাতিক সংস্থার সঙ্গে তাঁর নিত্য ওঠাবসা, তাঁর নিজের দেশেই চরম ক্ষতিকারক দক্ষিণপন্থী রাজনীতিকদের সম্বন্ধে তাঁর অস্বস্তিকর নীরবতা তাঁকে তৃতীয় বিশ্বের নায়কের আসনে চিরপ্রতিষ্ঠিত হতে মোটেই সাহায্য করবে না।

কিন্তু সেই যে, অরুণাভ দাশগুপ্ত একবার লিখেছিলেন “এই যে তোমার আঁচল ছুঁয়ে সকাল সন্ধ্যা দিব্যি দেওয়া/তার মানে কি?/একটু আধটু পদস্খলন হতেই পারে।”

তাই, আজ যখন ফুটবলের এই অসীম ক্ষমতাসম্পন্ন জাদুকর বিশ্বের যাবতীয় হিসাবনিকাশের বাইরে, তখন আমরা না হয় অরুণাভবাবুর কবিতা থেকেই সারসত্য অনুধাবন করবার চেষ্টা করি না কেন!

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.