রবীন্দ্রনাথ শুধুই পঁচিশে বৈশাখ আর বাইশে শ্রাবণ কিনা, তিনি শুধুই স্মৃতি আর উপলক্ষ্যের উদ্‌যাপনে মঞ্চজুড়ে উৎসব কিনা, বিষ্ণু দে বহু দশক আগে এই প্রশ্ন তুলে দিয়েছিলেন। আর, এই প্রশ্নের পথ ধরে এগোতে এগোতে বিশ্বযুদ্ধ, মন্বন্তর, নয়া-উপনিবেশ, দুর্ভিক্ষ, দাঙ্গা, বিশ্বায়ন, নয়া-ফ্যাসিবাদ, গণহত্যা, বিশ্বজোড়া মহামারী সমস্তই ঘটে গেছে। রবীন্দ্রনাথের গান-কবিতা-গল্প-প্রবন্ধ-উপন্যাস নিয়ে বহু গবেষণা, বহু বিশ্লেষণ, উদ্ধৃতির ছড়াছড়ি- কিন্তু এই সময়ে, আমাদের যাপনে কিংবা সমাজবস্তু সঞ্জাত ব্যক্তিচেতনায় রবীন্দ্রনাথের প্রয়োগ কতটুকু? তাঁর দর্শনের অনুশীলনের বাস্তবক্ষেত্র কতটা?

 

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

আমরা মিল খুঁজতে ভালবাসি। ব্যথার মিল, শোকের মিল, উদ্‌যাপনের মিল কিংবা প্রাপ্তির মিল। আর, এইসব মিলের প্রকাশের জন্যে উদ্ধৃতি খুঁজি। বাঙালির জীবনে এই সমস্ত মিল উদ্‌যাপনের যত উদ্ধৃতি রবীন্দ্রনাথের লেখা থেকে গৃহীত হয়েছে, তেমনটা আর কারোর থেকে হয়নি। এরও ধারাবাহিকতা আছে, উত্তরাধিকার সূত্রে রবীন্দ্রানুরাগী হয়ে ওঠা। অন্ততঃ আমাদের মধ্যবিত্ত ঘরের বুকসেল্‌ফ আর টেপ-রেকর্ডারে তেমনই হয়েছে। ভদ্রলোকের উচ্ছ্বাস বা ভদ্রলোকের শোক রবীন্দ্রতারে বাঁধা থাকে। গল্পগুচ্ছের পাতায় পাতায় জীবনের সামান্য এদিক-ওদিকের রেফারেন্স পেয়ে যাই ঠিক। রবীন্দ্রনাথের কবিতায় মনমতো উদাহরণ খুঁজে পেলে শোক সঠিক গভীরতায় প্রকাশিত হতে পায়। রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধের উচ্চ-মানবতার আশ্বাস থেকে উদ্ধৃতি দিলে সমাজ ও সংস্কৃতির সামান্য এতোলবেতোল নিয়ে গম্ভীর জাজ্‌মেন্ট দেওয়া যায়। আমাদের চেনাবৃত্তে এঁটে যায় ঠিক। দেশ থেকে ঘর, সমষ্টি থেকে ব্যক্তিগত অভিব্যক্তি- কোনও না কোনও গানে মিলে যায়। তবু কিছু প্রশ্ন বেয়াড়া হয়ে ওঠে নিজস্ব কাঁটাছেঁড়ায়। বলুন রবীন্দ্রনাথ, ওই যে পরিযায়ীরা রেলট্র্যাক ধরে হাঁটতে হাঁটতে রুটি-আচার রেলট্র্যাকে ছড়িয়ে রেখে পরপর কাটামাথা ছেঁড়াধর নিয়ে গড়িয়ে পড়ল- ওইসব দৃশ্যের জন্যে কোন গানের লাইন অ্যাপ্রোপ্রিয়েট হবে? মৃত্যু নিয়ে আপনার যত গান আমাকে বিহ্বল করেছে, তার একটিও তেমন যুৎসইভাবে মেলাতে পারিনি ১২ বছরের জামলো মাকদমের এলিয়ে পড়া নিয়ে। বাড়ি ফেরার পথে বাধ্যতঃ হেঁটেছে দেড়শো কিলোমিটার, শরীরের জল শুকিয়ে গেছে। রাস্তার কোনও ট্রাফিক সিগন্যালে কোনও রবীন্দ্রগান কি তার শরীরে জল, দেহে শক্তি ফিরিয়ে দিতে পারত? আমি যদি ভেবে নিই, আড়াই দিন ধরে খালিপেটে হাঁটতে হাঁটতে বাড়ি থেকে মাত্র ১১ কিলোমিটার দূরে সে সমস্ত মানবতাকে ঘৃণা করেছিল, মৃত্যুর নান্দনিকতা বোঝার কোনও চেষ্টা করেনি- এবং রক্তবমি করতে করতে শ্যামসমান বলে মৃত্যুকে জড়িয়ে ধরেনি- সে ভাবনা কি ভুল হবে? অতিমারীর সঙ্কটে প্রিয়জনের মৃত্যুর খবরে ‘জীবন মরণের সীমানা ছাড়ায়ে বন্ধু হে আমার’ গেয়ে নিজের খোলসে ঢুকে যেতে যেতে দেখেছি গানটা কোথাও পৌঁছচ্ছে না; আত্মখোলসকে ক্ষণিকের জন্যে দৃঢ় করছে মাত্র, তার বেশি নয়। সারা গায়ে ব্লিচিং পাউডারের ঝলসানি নিয়ে, ছুঁড়ে দেওয়া বিস্কুট নিয়ে যে শ্রমিক কাজ হারিয়ে ফিরছে, তাকে কোন জীবনদেবতা সঙ্গ দিয়েছে, বলুন? আধা-ইচ্ছা বা অতি-ইচ্ছা তার কাছে সংকট নয়, বরং প্রবল বাসনায় প্রাণপণে সে জীবনের প্রাপ্য সম্মানটুকু পেতে চেয়েছে- রবীন্দ্রনাথ, আপনার গানের দর্শন তার কাছে পৌঁছে দিতে পারিনি। তার সংকটের সাযুজ্য কোন নান্দনিক অভিব্যক্তির? তাদের অপমানের খবর কাগজে পড়ে ব্যক্তিগত অসহায়তায় আপনার গানে ফিরতে চেয়েছি- সেও এক বাইশে শ্রাবণেই- কিন্তু, শুধু গুমোট মেঘ দেখেছি তাদের যাতায়াতের ছবিতে, বৃষ্টিহীন গুমোট ঘনমেঘ। ফ্যাসিস্ত দেশে কোনও এক সমস্বর হননোল্লাসে মেতে ওঠা সন্ধ্যের খবরে বেদনার্দ্র হয়ে আপনার কবিতা পড়েছি, ফেসবুকে স্টেটাস লিখেছি ‘ধর্মের বেশে মোহ যারে এসে ধরে’- কিন্তু সেই কবিতা কোথাও পৌঁছায়নি। আপনার মানবতার ধারণা উচ্চমার্গের, নিঃসন্দেহে তা অত্যন্ত শুদ্ধ পবিত্র মহান; কিন্তু আমাদের এখানে কোনও আলো জ্বালাতে পারেনি। আপনার শিল্প সৎ, আপনার গান মহান, কিন্তু আমাদের পাথেয় হতে পারেনি। যতটুকু প্রয়োজন নিজেকে সান্ত্বনার নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার নিজেকে ভাল রাখার, ততটুকু প্রয়োজনেই পাথেয় হয়েছে- কিন্তু সেইসব ব্যক্তিগত সেটের বাইরে যে অসংখ্য বাইশে শ্রাবণ, তার কোনও দিশা হতে পারেনি।

 

কোনও অসহায় ছটফটানির মুহূর্তে, কোনও অবসাদের ডুবো পাথরে ধাক্কা খেতে খেতে হাঁকপাঁক করতে করতে কিংবা কোনও আলোহীন মুহূর্তে দেশজোড়া এক কৃষ্ণগহ্বর প্রকট হতে দেখে আমি সান্ত্বনা খুঁজে নিই ‘আজি বিজন ঘরে… জানি, বন্ধু জানি’। সেই মুহূর্তগুলোয় আমি হেরে যেতে যেতে সান্ত্বনা খুঁজি কোনও এক আলোহাত আমায় টেনে তুলে নেবে ডুবোপাথরের সর্বস্বঘাতী সময় থেকে। কিন্তু, সে আমার একার সান্ত্বনা, নিজেকেই। ব্যক্তিগত যুদ্ধক্ষেত্রে আহত হওয়ার প্রত্যেক মুহূর্তের এসকেপ রুট। অসহায়তার সীমাবদ্ধতায় নিজেকে গুছিয়ে নেওয়ার আপ্রাণ চেষ্টায় কাল্পনিক সংলাপ- ওই গানের মধ্যেই থাকে। কিন্তু তা কাল্পনিকই, বাস্তব নয়। প্রার্থনার মানতে বাঁধা ঢিলে রবীন্দ্রকবিতার শব্দ মিলে যায় কখনও- চারপাশের অসহ্য অন্ধকার থেকে নিজেকে বিচ্ছিন্ন ক’রে আলোর কৃত্রিমতা অবিকল রাখা নিজের ওপরে। পুঁথিগত শিক্ষার প্রতি, বৈষম্য-বিভেদভরা সমাজে মেধার প্রতিযোগিতার প্রতি রবীন্দ্রনাথের বিতৃষ্ণা সর্বজ্ঞাত- প্রতিদিন সেই প্রতিযোগিতায় সামিল হতে হতে সচেতন অবজ্ঞায় রবীন্দ্রনাথকে ভুলে থাকা যায়। সিলেবাসের রবীন্দ্রনাথ ওই পুঁথির শিক্ষা আর প্রতিযোগিতার বাজারে পণ্যায়িত আমাদের দাম বাড়িয়ে দেয়। তারপর অবরেশবরে সেই মেধাবাজার আর প্রতিযোগিতার মন্দ-ভাল আলোচনায় রবীন্দ্রনাথের কোটেশন বা প্রবন্ধের কোনও অনুচ্ছেদ বেশ মানিয়ে যায়। আমাদের কিছু ‘পাপস্খালন’ হয় এবং ব্যক্তিগত পাপবোধের প্রতিযুক্তিতে সিডেটিভের কাজ হয়। ভাল ক’রে ঘুম এবং ঘুম থেকে উঠে রবীন্দ্রবিশ্বাসের উল্টোদিকে দৌঁড়; না, রবীন্দ্রনাথ, এতে ঠিক-ভুল বা উচিত-অনুচিত নেই, এতে বাস্তবতা আছে, এই সমাজব্যবস্থায় অভিযোজিত হওয়ার নিষ্ঠা আছে। রবীন্দ্রনাথ, আপনি একবার ভাষণে বলেছিলেন, “I have tried to save the children from such vicious methods of alienating their minds and from other prejudices which are fostered through books, through histories, geographies and lessons full of national prejudices… we are building up our institution upon the ideal of the spiritual unity of all races.”- আপনার শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ক্রমেই সরে গেছে আপনার ভাবনা থেকে। যে পাঁচিলগুলো আপনি ভাঙতে চেয়েছেন বরাবর, সেই সমস্ত পাঁচিল দিয়ে ঘেরা হয়ে গেছে বিশ্বভারতীকে। তপোবনের ঋষিদের শিক্ষাপদ্ধতি জ্ঞানের আদান-প্রদানকে আধুনিকায়িত করতে চেয়েছিলেন- কিন্তু, এখন শুধু বর্ণাশ্রমের অনুশীলন পড়ে আছে। প্রাচীন ভারত থেকে বর্ণবিদ্বেষ আর উচ্চবর্গের ক্ষমতায়নের পাঠ নিয়ে চলেছি আমরা। শিক্ষা কোনওদিনই সকলের জন্যে ছিলনা, হয়ে ওঠেনি; ক্রমে তা আরও কুক্ষিগত হয়ে পড়ছে বিত্তবানের- এই স্পষ্টতঃ বৈষম্য আর বিভেদের সন্ধ্যেয় রবীন্দ্রনাথের বক্তব্য-সম্বলিত বইয়ের পাতা আরও জীর্ণ হয়ে যাচ্ছে। এই বিশ্বায়িত-উদারনৈতিক সময়ে ‘রবীন্দ্রনাথের লেখা আমাদের দিশা দেখাবে’- এ শুধুই কথার কথা, এ শুধুই না-অনুশীলিত শুকনো তত্ত্ব। প্রত্যেকে এই সর্বগ্রাসী সমাজব্যবস্থার অভিমুখেই নিজেদের মানিয়ে যুঝিয়ে নিতে চায়। যদি সেই মানিয়ে-যুঝিয়ে চলার বাস্তবতায় কোনওভাবে রবীন্দ্রনাথের কোনও বাণী এঁটে যায় তো ভাল, নইলে তা শুধু বইয়ের পাতাতেই আটকে থাকে আর সেই পাতা জীর্ণ হতে থাকে।

 

কেউ কাউকে ক্ষমা ক’রে দেয়নি। ব্যক্তিগত দুর্বলতা ঢাকতে ক্ষমা পরমধর্ম হয়েছে। বহু ক্রোধ গিলে ফেলতে হয়েছে, অনেক ঘৃণা সয়ে নিতে হয়েছে, কাউকে ঘৃণা ক’রেও ভুলে থাকতে হয়েছে। উত্তরপ্রদেশ থেকে যাদের অসংস্কৃত লাশ ভেসে এসেছে, পথেঘাটে ছটফটিয়ে মরে গেছে যারা, তারা বা তাদের স্বজনরা ক্ষমা উচ্চারণের বিলাসিতা কোথায় পাবে? কোন উচ্চতর মানবধর্মের অনুশীলনে তারা এই রাষ্ট্রের প্রতি আস্থা ফিরে পাবে? ধীরে ধীরে তাদের ক্রোধ অসহায় হয়ে এলে, তাদের ক্ষোভ নতমুখ অসামর্থ্যে বদলে গেলে কোনও মায়ালাগা সন্ধ্যেয় ‘আছে দুঃখ আছে মৃত্যু বিরহদহন লাগে’ শব্দগুলো কিছু উপশম দেবে তাদের ক্ষতে, হয়তো। গত বছর ২২শে শ্রাবণ সাড়ে চার মাস লকডাউনের পরে কাজ চলে গেছিল শ্যামলের, বুড়োদা পেশা বদলে নিয়েছিল সব্জির ব্যবসায়। সেলস্‌ম্যান আলতাফ কাজ হারানোয় ওর মেয়ের পড়াশোনা বন্ধ হয়ে গেছে। ওরা লোভ করেনি, ওরা সরল যাপনে বেঁচেছিল, জীবনযাপনের প্রয়োজনীয় অর্থ বা ‘মেটেরিয়াল’ চেয়েছিল প্রাণপণে- “All our true enjoyment is in the realization of perfection. This can be reached, not through augmentation, but through renunciation of the materials for the sake of the ideal”- এই কথাগুলো ওদের কোন সত্যে উপনীত করাবে বা কোন ধর্মে ‘সিভিলাইজড’ ক’রে তুলবে? মানুষকে অবিশ্বাস করা পাপ- কিন্তু, ঠিক কতবার বিশ্বাস ক’রে ঠকলে পুণ্য অর্জন হয়? রবীন্দ্রনাথ ‘সিভিলাইজেশন’-র বাঙলা প্রতিশব্দ খুঁজেছিলেন ‘ধর্ম’ শব্দের মধ্যে- নিশ্চিতভাবেই তা আরএসএস বা আইসিস বা মিশনারী বা অন্য প্রাতিষ্ঠানিকদের ধর্ম নয়- যা ধারণ করে এবং মনুষ্যত্বের অনুশীলন করায় তার কথাই রবীন্দ্রনাথ বলতে চেয়েছেন। কিন্তু মনুষ্যত্বের সেই অনুশীলন কি আমার চেনা-দেখা পরিসরে সত্যিই হয়? অমন পূত পবিত্র অচঞ্চল ধারণা মানুষ অনুশীলন করবে কোথায়? কোন সামাজিক ব্যবস্থায়? ১৯২৪ সালে চিনদেশে প্রদত্ত ভাষণে বলেছিলেন, “One who is merely a comfortable money-making machine does not carry in himself the perfect manifestations of man. He is like a gaudily embroidered purse which is empty.”- পাঠক, এই লেখা যখন পড়ছেন, তখন আপনি সত্যিই কি এই কথাগুলো বিশ্বাস করেন? আমি করি? ১৯২৪ সালের দুনিয়া আর ২০২১ সালের দুনিয়ার মধ্যে ৯৭টা ২২শে শ্রাবণ আর ২৫শে বৈশাখের পার্থক্য- অর্থ জীবনকে শূন্য ক’রে দেয়- এ শুধু আপ্তবাক্য। ব্যর্থকে সান্ত্বনা দেয়, অসমর্থের মূল্যবোধকে পিঠ চাপড়ে দেয়। একটা আস্ত সমাজব্যবস্থা অর্থগৃধ্বের তালুবন্দি, দুনিয়া চালাচ্ছে যারা তারা অর্থের নিরন্তর প্রবাহকেই টিঁকে থাকবার একমাত্র উপায় বলে প্রতিষ্ঠা দিতে পেরেছে। রবীন্দ্রনাথের বিশ্বাস ও আদর্শ মানলে রাষ্ট্রের চলে না; এবং আমাদের সমস্ত ক্ষোভ-বিরক্তি-‘না’ রাষ্ট্র তার প্রাতিষ্ঠানিকতার চেনা ছকে আঁটিয়ে নেয়। ব্যক্তিগতভাবে আমি কী বিশ্বাস করি, রাষ্ট্রচালকদের তাতে কিচ্ছু যায় আসে না। লগ্নিপুঁজির ভরা বাজারে অর্থের চাহিদা-যোগান অস্বীকার করা যায়? সামাজিক বা ব্যক্তিগত পরিসরে? রাষ্ট্রনির্মাণের ও শাসনের চেনাছক থেকে বেরোলে ডিটেনশন, ইউএপিএ, গুম ক’রে দেওয়া। পাঠক, আমি-আপনিও সেই ব্যবস্থার শরিক, সেই ব্যবস্থার উপভোক্তা, সেই ব্যবস্থাকে টিঁকিয়ে রাখছি কোনও-না-কোনও উপায়ে এবং গণতান্ত্রিক পথে আইন-কানুন মেনে সেই ব্যবস্থাকে বেছে নিচ্ছি। মাঝে মাঝে ভান করছি রবীন্দ্রনাথের প্রবন্ধ-গান-কবিতা-গল্প নিয়ে; আদতে ওই ‘ধর্ম’, ওই উচ্চ-মানবতা, ওই মেটেরিয়ালবিমুখ সরল যাপন এবং ওই জীবনদেবতার অনুসন্ধান আমাদের ‘নিম্ন’মার্গের জীবনে কোত্থাও নেই।

 

“দশটার পাঁচটার উদ্ভ্রান্ত ট্রাফিকে,

বস্তিতে বাসায় আর বাংলার নয়া কলোনিতে,

জীবিকার জীবনের ভাঙা ধসা ভিতে,

বোম্বাই সিনেমা আর মার্কিনী মাইকে অসুস্থ বৈভবে,

মরা ক্ষেতে কারখানায় পড়ি যেন জীবনের

সংগ্রামশান্তির স্পষ্ট উপন্যাস,

খুঁজি যেন সকালের সূর্য থেকে সন্ধ্যার সূর্যের হবি”

না, রবীন্দ্রনাথ, এই লেখা আপনার প্রতি কোনও ক্ষোভ নয়। কিন্তু, আপনার উচ্চ-মানবতার আহ্বানে আমি সাড়া দিতে পারি না। আশেপাশে কাউকে তেমন দেখিওনা সাড়া দিতে। কিন্তু, তাতে আপনার লেখায় কোনও দাগ পড়েনা। আপনি সফল, রবীন্দ্রনাথ, আপনার শিল্পীসত্তায় খাদ ছিলনা কোনও। আপনি চেয়েছিলেন যেন আপনার দেখা-শোনা-বোঝার অভিজ্ঞতাসিক্ত কথন ভবিষ্যতক্ষেত্রকে উজ্জ্বল করতে পারে। কিন্তু, সেই চেতনার রঙে কোনও কিছুই আলাদা ক’রে রেঙ্গে ওঠেনি। বস্তুতঃ, কোনও কবিতা কোনও গান কোনও সাহিত্য আমাদের বদলে দিতে পারেনি, যে ব্যবস্থার শরিক আমরা তাকে পাল্টে দিতে পারেনি। আমাদের উদ্‌যাপন আপনার বলে যাওয়া অনাড়ম্বতার সঙ্গে মেলেনা। আমাদের যাপনক্ষেত্রের উপাদানসমূহ আপনার লিখে যাওয়া সরল গভীরতার উপাদান থেকে ভিন্ন। আপনার ভেবে যাওয়া জাতীয়তাবোধ, আপনার দেখতে চাওয়া রাষ্ট্রনির্মাণ এমুহূর্তে আর মূর্ত নয়। ‘রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন…’ বলে যে’কটা আপ্তবাক্য ছুঁড়ে দেওয়া হয় আমাদের দিকে অথবা আমরাও ছুঁড়ে দিই একে অন্যের দিকে, সেই সব কথা মাঝপথে শুষে নেয় কোনও এক কৃষ্ণগহ্বর। আমরাও ব্যক্তিগত শামুক-খোলস পরে নিই। তারপর বাইশে শ্রাবণ আর পঁচিশে বৈশাখের উদ্‌যাপনে কিংবা অন্য কোনও দিনের নিভৃতপঠনে দু-চারটে কবিতা-গান, কিছু ফুল-মালা ছড়িয়ে রেখে সরে আসি আপসের কক্ষপথে। উচিত-অনুচিত বা ঠিক-ভুলের বাইনারি দিয়ে মাপা নয়, এটা বাস্তব। এই নষ্ট সময়ের অভিজ্ঞতা।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.