চন্দননগরের আলোচনা কানাইলালের কথা দিয়ে শুরু হবে না তা কি হয়? স্বাধীনতা সংগ্রামে এই বাংলায় প্রথম সফল রাজনৈতিক হত্যা তো তাঁর হাত ধরেই সম্ভব হয়েছিল। ক্ষুদিরামের ফাঁসি যেমন মনে আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছিল, তেমনি ব্যর্থতার গ্লানিও জ্বালিয়ে রেখেছিল বহ্নিশিখা। তাই ধরা পড়ার পর জেলে চারুচন্দ্র রায় যখন কানাইলালকে জিজ্ঞাসা করেন, কেন নরেন গোঁসাইয়ের উপর গুলি চালালে? কানাইলালের উত্তর ছিল “I wanted to be sure about the result. I was simply disgusted with attempts, attempts and attempts.”
ফাঁসির রায় শুনিয়ে বিচারক কানাইলালকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন কোনো আপিল করবেন কিনা, পিঞ্জরাবদ্ধ সিংহের মত বজ্রগম্ভীর উত্তর দিয়েছিল সেই কুড়ি বছরের যুবক “There shall be no appeal”।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
চন্দননগরের লোকেরা ব্রিটিশদের ঘৃণা করত। তার কারণও ছিল। ফরাসী-ব্রিটিশ কলহে নবাব সিরাজের সময় একবার নিয়ে মোট চারবার ইংরেজরা চন্দননগর দখল করে। সেইসময় চন্দননগরের অধিবাসীদের উপর যে লুঠ ও অত্যাচার তারা চালায়, তা এখানকার মানুষের উপর স্থায়ী ছাপ রেখে গিয়েছিল। এছাড়া চন্দননগর দখল করার পর এখান থেকে ফরাসিদের গ্রেপ্তার করে কলকাতার হরিণবাড়ি সংলগ্ন এলাকার জেলে তাদের উপরও অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছিল। এইসব নিপীড়নের কাহিনী গোপন ছিল না, লোকের মুখে মুখে ফিরত। ফলত সারা দেশ জুড়ে ব্রিটিশবিরোধী সংগ্রামের আগুন জ্বললে চন্দননগরও সেই আগুনে ঝাঁপিয়ে পড়ে।
উনিশ শতকের শেষ কুড়ি বছর চন্দননগরের ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই শহরের বিপ্লবী আন্দোলনের প্রাণপুরুষ যাঁরা, তাঁদের প্রত্যেকের জন্ম এই সময়ে। বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য মতিলাল রায়, চারুচন্দ্র রায় কানাইলাল দত্ত,রাসবিহারী বসু, মণীন্দ্রনাথ নায়েক, শ্রীশচন্দ্র ঘোষ। অগ্নিগর্ভ সময় তার সন্তানদের জন্ম বোধহয় এভাবেই দেয়।
একটা পুরনো বিতর্ক এ প্রসঙ্গে একটু ঝালিয়ে নিই। অনেকেরই ধারণা আছে, ইংরেজদের তুলনায় ফরাসিরা বোধহয় কম সাম্রাজ্যবাদী ও অত্যাচারী ছিল। যদিও ভিয়েতনাম, আলজিরিয়ার ইতিহাস সেই সাক্ষ্য দেয় না, তবু ইংরেজদের সাথে ফরাসিদের একটা জায়গায় তফাত ছিল। তা হল ব্রিটিশ ও ফ্রেঞ্চ ইস্ট ইণ্ডিয়া কোম্পানির গঠনের তফাত। অর্থাৎ প্রথম থেকেই ব্রিটিশ কোম্পানিটি ছিল ব্যক্তিগত বাণিজ্য উদ্যোগ। রাষ্ট্র সেখানে সহযোগিতা করেছে। কিন্তু ফরাসী কোম্পানি প্রথম থেকেই ছিল রাষ্ট্রীয় উদ্যোগ। এদেশের বণিকদের ধ্বংসের অন্যতম প্রধান কারণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও তার কর্মচারীরা, যারা বাদশাহী দস্তককে ব্যবহার করে বিনা শুল্কে কোম্পানির বাণিজ্য তো করতই, এমনকি নিজেদের ব্যক্তিগত বাণিজ্যেও দস্তককে কাজে লাগাত। অন্য দিকে ফরাসি রাজকর্মচারীদের যদি চন্দননগরে ব্যবসা করতে হত, তাহলে তাদের ফরাসি সম্রাটের, বা ফরাসি বিপ্লবের পরে রাষ্ট্রের অনুমতি নিতে হত। এর জন্য আলাদা করে নির্দিষ্ট আবেদন করতে হত। সবক্ষেত্রেই যে আবেদন গ্রাহ্য হত এমন নয়। দেশীয় বণিকদের ওপর ফরাসি কোম্পানিও কর চাপিয়েছিল। কিন্তু তা ইংরেজ এলাকার মত লাগামছাড়া হয়নি।
ফলত ব্রিটিশ রেসিডেন্সি এলাকার মত চন্দননগরের লোকের দেওয়ালে পিঠ ঠেকেনি, যে তারা ফরাসি শাসন উচ্ছেদের বিরুদ্ধে সরব হবে। গুটিকয় প্রশাসনিক ও বাণিজ্যকেন্দ্রই যেহেতু ভারতে ফরাসিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল, সেহেতু তারা সেইসব এলাকায় এক সুষ্ঠু নাগরিক পরিষেবা ও শান্তিশৃঙ্খলা যে আপাতভাবে বজায় রেখেছিল তা বলা যায়। ফরাসি পুলিশ কি অত্যাচার করেনি? অবশ্যই করেছে, কিন্তু তা সামগ্রিকভাবে মাত্রা ছাড়া হয়নি।
কে আসেননি চন্দননগরে? ১৯১০ সালে এবং তার আগেও একবার অরবিন্দ ঘোষ; ১৯২৩ সালে বিপিনচন্দ্র পাল, সুভাষচন্দ্র বসু; ১৯২৪ সালে নজরুল ইসলাম; ১৯২৫ সালে মহাত্মা গান্ধী; ১৯২৭ সালে ভূপেন্দ্রনাথ দত্ত। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এসেছেন একাধিকবার। এঁদের প্রত্যেকের স্মৃতিধন্য ভাগীরথী তীরবর্তী এই প্রাচীন জনপদ। বেশিরভাগই এসেছেন প্রবর্তক সংঘের আমন্ত্রণে, যে সংঘ ও তার অসামান্য সামাজিক ও রাজনৈতিক কার্যকলাপ এই শহরের বিপ্লবী আন্দোলনে অগ্নিশলাকার কাজ করেছে ধারাবাহিকভাবে।
অনেকগুলো পত্রিকা ও মুখপত্র এই পর্যায়ে নিরবচ্ছিন্নভাবে ব্রিটিশ বিরোধী প্রচারকে অক্ষুণ্ণ রেখেছিল। চন্দননগর থেকে প্রকাশিত পত্রিকাগুলির মধ্যে যে নামগুলো সর্বাগ্রে আসে তা হল মাতৃভূমি, সেবক, স্বদেশী বাজার, দেশহিতৈষী, প্রবর্তক, নবসংঘ, প্রজাবন্ধু, দেশহিতসভা। বিংশ শতকের প্রথম থেকেই চন্দননগর বিপ্লববাদে দীক্ষিত হয়। গোন্দলপাড়ায় ‘বান্ধব সম্মিলনী’ গ্রন্থাগারকে কেন্দ্র করে সাহিত্য, ধর্ম, স্বাস্থ্য ও সঙ্গীতচর্চার যে পরিমণ্ডল গড়ে উঠেছিল তাকেই সামনে রেখে চন্দননগরের যুবকরা অনুশীলন সমিতির সাথে যোগাযোগ তৈরি করেন। বারীন ঘোষ, সখারাম গণেশ দেউস্কররা চন্দননগরে আসেন। পরবর্তীকালে বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনকে কেন্দ্র করে উত্তাল হয় চন্দননগর।
এই পর্যায়েই মতিলাল রায়ের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে ‘সৎপথাবলম্বী সম্প্রদায়’, যারা প্রথম দিকে সামাজিক কাজকর্মের মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকলেও মুক্তিসংগ্রামের চেতনা থেকে বেশিদিন নিজেদের বিচ্ছিন্ন রাখতে পারেনি। ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দের ৭ই আগস্ট রাত্রে এই সংগঠন স্বদেশী ও বয়কট আন্দোলনের সমর্থনে মতিলাল রায়ের নেতৃত্বে এক ঐতিহাসিক মিছিল করে। ব্রিটিশ প্ররোচনায় এই সময় থেকেই ফরাসি কর্তৃপক্ষ বিপ্লবীদের ওপর তীব্র আক্রমণ শুরু করে ও নানা বিধিনিষেধ জারী করে।
উচিত শিক্ষা দিতে চন্দননগরের বিপ্লবীরা এক দিকে বাংলার গভর্নর ফ্রেজারের রেলগাড়ি উড়িয়ে দেওয়ার যেমন পরিকল্পনা করেছিলেন (এই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়), অন্য দিকে চন্দননগরর ফরাসী মেয়র তার্দিভালের বাড়িতে বোমা ফেলেন। এই পরিকল্পনার পিছনে ছিলেন বারীন ঘোষ, শ্রীশ ঘোষ, চারুচন্দ্র রায়, নরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়। ১৯০৭ খ্রিস্টাব্দে ব্রিটিশবিরোধী প্রচার তীব্র করার জন্য শহরে গড়ে ওঠে চন্দননগর রিপাবলিকান র্যাডিকাল সভা। এখান থেকে সংবাদপত্রও প্রকাশিত হতে থাকে।
ফরাসি ডোমিনিয়ন থাকায় চন্দননগর বারবার বিপ্লবীদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল হিসাবে কাজ করেছে। ব্রিটিশ পুলিশকে শহরে তল্লাশি করতে হলে অনুমতিপত্র নিতে হত। সেই সময়টা কাজে লাগাতেন বিপ্লবীরা। মুরারীপুকুরে বোমার কারখানা ধরা পড়ার পর বোমা ও বোমার রসদ সরবরাহের পুরো ব্যবস্থাটাই প্রায় উঠে এসেছিল চন্দননগরে। এর প্রধান কুশীলব ছিলেন মণীন্দ্রনাথ নায়েক। ১৯১২ সালে রাসবিহারী বসু ও বসন্তকুমার বিশ্বাসের নেতৃত্বে বড়লাট হার্ডিঞ্জের ওপর যে বোমা ফেলা হয় সে বোমা মণীন্দ্রনাথেরই তৈরী।
অনেকেই হয়তো জানেন, বাংলার সর্ববৃহৎ দুই বিপ্লবী সংগঠন অনুশীলন সমিতি ও যুগান্তর সমিতি ইংরেজের ঘুম কেড়ে নিয়েছিল। তাদের মধ্যে নানা বিষয়ে মতপার্থক্য যেমন ছিল, তেমনই ব্যক্তিত্বের সংঘাতও ছিল। এই দুই সংগঠনের ঐক্য প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে ১৯২৭ সালে একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় চন্দননগরে। উদ্যোগের পুরোভাগে ছিলেন মতিলাল রায়।
রাসবিহারী বসুর সম্পর্কে তো আর নতুন করে কিছু বলার নেই। এই শহরেই কেটেছে তাঁর কৈশোরকাল। শিক্ষা তৎকালীন ডুপ্লে কলেজে, পরবর্তীকালে যার নাম হবে কানাইলাল বিদ্যামন্দির যে প্রতিষ্ঠানের অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র রায়ই রাসবিহারীর মনে স্বদেশপ্রেমের আগুন জ্বেলে দেন।
কানাইলালের মৃত্যুর পর গোটা শহরে অরন্ধন পালিত হয়েছিল, বিরাট সংখ্যায় মিছিলে সামিল হয়েছিলেন মহিলারা। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনের গোটা পর্যায় জুড়েই চন্দননগর বিপ্লবতীর্থ হিসাবে তার ভূমিকা সম্পাদন করেছে। অসহযোগ থেকে আইন অমান্য আন্দোলন, ভারত ছাড়ো আন্দোলন — প্রত্যেকটি গণআন্দোলনে এই শহর অংশগ্রহণ করেছে। অসংখ্য তরুণের বুকের রক্তে জন্মভূমির মাটি আর বধ্যভূমির কাদাকে এক করে দিয়ে স্বাধীনতার ব্রতচারী থেকেছে প্রাচীন শহর চন্দননগর।
মুক্তির মন্দির আর বিপ্লবতীর্থ চন্দননগর – বিপিনচন্দ্র পাল, অরবিন্দ ঘোষ, বারীন ঘোষ, কানাইলাল দত্ত ও রাসবিহারী বসু : ছবি উইকিপিডিয়া থেকে।
স্বাধীনতার ৭৫ বছর পূর্ণ উপলক্ষে নাগরিক ডট নেটের বিশেষ সংখ্যার লেখাগুলো (স্বাধীনতা ৭৫):
- সুভাষচন্দ্রের হাতে ৪৮ লক্ষ টাকার সম্পদ তুলে দিয়েছিল যে বাঙালি পরিবার
- হারানো অধিকারবোধ ও আমাদের স্বাধীনতা
- বিপ্লবীদের চারণভূমি মেদিনীপুর
- যে কিশোরের মরণ নেই
- মুক্তির মন্দির আর বিপ্লবতীর্থ চন্দননগর
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।
খুবই তথ্যবহুল লেখা। লেখককে ধন্যবাদ। চন্দননগরে এতজন বিপ্লবী ছিলেন বা আশ্রয় নিয়েছিলেন, এমন দৃষ্টান্ত বাংলার আর কোনো মফস্বল শহরে নেই। অনুশীলন সমিতির বিপ্লবী ত্রৈলোক্যনাথ চক্রবর্তীও এখানে ছিলেন। ব্রিটিশদের ফাঁকি দিতে বিপ্লবী শশধর আচার্য ও সুহাসিনী গাঙ্গুলী ( যার নামে ভবানীপুরে রাস্তা আছে জগু বাবুর বাজারের কাছে) চন্দননগরে আশ্রয় নিয়েছিলেন। গোপনীয়তার জন্য তাঁরা স্বামী স্ত্রী সেজে থাকতেন। তাঁদের ডেরায় কিছুদিন বিপ্লবী অনন্ত সিংহ ও গণেশ ঘোষ আশ্রয় নিয়েছিলেন