সুশোভন ধর

ভারতবাসীকে কেএফসি আর পিৎজা হাটের স্বাদ চিনিয়েছিলেন যিনি, মাস্টারকার্ডের সেই প্রাক্তন সিইও অজয় বাঙ্গা আগামীদিনে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্টের দায়িত্ব সামলাবেন। এই সংবাদ নিশ্চিত হয়েছে বিশ্বব্যাঙ্কের এক সাম্প্রতিক বিবৃতিতে – “The Board looks forward to working with Banga on the World Bank Group evolution process”। বাঙ্গার যোগদানের জন্য সাগ্রহ অপেক্ষার কথা জানিয়েছে বিশ্বব্যাঙ্ক।

ফেব্রুয়ারি মাসের শেষদিকে হিসাবে মার্কিন রাষ্ট্রপতি জো বাইডেন বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট বাঙ্গাকে মনোনয়ন দেন। বিদায়ী প্রধান ডেভিড মালপাসের আসন দখল করার জন্য বাঙ্গার কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীও ছিল না আসরে। খ্যাতনামা সংস্থা অক্সফ্যামের মতে, “এবারেই শুরু হবে অজয় বাঙ্গার পরীক্ষা। বিশ্বজুড়ে চূড়ান্ত অসাম্য প্রতিনিয়ত লক্ষ লক্ষ মানুষের অর্থনৈতিক সুরক্ষা ও বেঁচে থাকার ন্যূনতম মর্যাদা হরণ করে চলেছে। এর মোকাবিলায় বাঙ্গা কিভাবে বিশ্বব্যাঙ্কের নীতিগুলির পুনর্নির্মাণ ঘটাতে পারবেন সেটাই এখন দেখার। আমরা দারিদ্র্য অপসারণের স্বার্থে উন্নয়নে ব্যাপক লগ্নি চাই, কিন্তু বেসরকারি পুঁজি নয়। বরং দীর্ঘকাল ধরে চলে আসা ব্যক্তিপুঁজির রমরমার উপরে নিয়ন্ত্রণ চাই।”

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

সুসমাচার

নিঃসন্দেহে ভারতীয়দের জন্য একের পর এক সুখবর এসে চলেছে। কমলা হ্যারিস এবং ঋষি সুনকের উত্থানের উদযাপন শেষ হয়নি এখনো। ইন্দো-মার্কিন বিজনেস টাইকুন অজয় বাঙ্গার বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট পদে অভিষেক এই তালিকায় নবতম সংযোজন। নোবেলজয়ী থেকে শুরু করে সারা বিশ্বের সমাজহিতৈষী সহ বিভিন্ন খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বের সমর্থন ও প্রশংসা আদায় করেছে এই অভিষেক। অবশ্য নিন্দুকদের মতে এরপরেও ভারত কতদূর বিশ্বগুরু হতে পারবে তা নিয়ে বিতর্ক থাকবে, অন্তত যতক্ষণ দাতব্য খাদ্যশস্যের জন্য বিশ্বের সবথেকে লম্বা লাইন এদেশে পড়বে। তবে বিদেশে কয়েকজন ভারতীয় যে বড়সড় কাণ্ড বাধিয়েছেন তা তো মানতেই হবে। তাঁদের আখ্যান এদেশের মধ্যবিত্ত মা-বাবাদের অবিরত স্বপ্নের যোগান দিয়ে চলেছে, একদিন এভাবেই তাঁদের সন্তানদের উত্থান ঘটবে।

জোসেফ স্টিগলিৎজ, মাইকেল স্পেন্স এবং মহম্মদ ইউনুসের মত নোবেলজয়ীরা বাঙ্গাকে স্বাগত জানিয়েছেন। মার্চ মাসে ৫৫ জন স্বনামধন্য অর্থনীতিবিদ এবং পূর্বতন আমলা এক খোলা চিঠির মাধ্যমে তাঁর মনোনয়নে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। ভরসার বয়ানটি এইরকম – “…right person to lead the World Bank at this critical moment”, অর্থাৎ এই দুঃসময়ে বাঙ্গাকেই চাই।

অন্যদিকে বাতাসে উড়ছে বাঙ্গার সম্পত্তির খবরাখবর, ২০২১ সালে যার পরিমাণ ছিল ভারতীয় মুদ্রায় ১৭০০ কোটি টাকারও বেশি। মাস্টারকার্ডের চিফ একজিকিউটিভ হিসাবে তিনি দিনে ৫২ লক্ষ টাকা রোজগার করতেন। তাঁর মতো সফল মানুষেরা কীভাবে সম্পদ উপভোগ করেন তা এক রহস্য। কেউ কেউ বলছেন, আর যা-ই হোক, তিনি নিশ্চয়ই একটা প্রচণ্ড দামি শার্টের উপর আরেকটা ততোধিক দামি শার্ট চড়ান না। কিন্তু মাস্টারকার্ডের মতো ক্রেডিট কার্ড কোম্পানিগুলো কীভাবে গ্রাহকের গলায় ছুরি রেখে অনাবশ্যক ভোগ্যপণ্যকে অত্যাবশ্যকীয় করে তোলে তা নিয়ে খুব একটা কথা হয় না। এরপর যদি বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট হিসাবে বাঙ্গা গ্লোবাল নর্থের মুষ্টিমেয় কয়েকটা দেশের হয়ে ভাড়া খাটেন এবং মার্কিন পুঁজিবাদী আধিপত্য ছুরির মত অবাধ্য কালো ও বাদামি মানুষের গলায় ঠেসে ধরেন, তা খুব কম মানুষই খেয়াল করবেন।

ভারতের নেতৃত্বে যখন জি২০-তে বিশ্বব্যাঙ্ক বা আন্তর্জাতিক মুদ্রা ভাণ্ডারের মত বহুপাক্ষিক অর্থলগ্নি সংস্থার পুনর্গঠন বা সংস্কার নিয়ে আলোচনা-বিতর্ক চলছে, সেই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট পদে বাঙ্গার মনোনয়ন প্রত্যাশিত। তিনি ভারতে জন্মেছেন ঠিকই, কিন্তু মার্কিন নাগরিকত্ব নিয়েছেন। মনে রাখতে হবে, প্রথাগতভাবে বিশ্বব্যাঙ্কের প্রেসিডেন্ট মার্কিনী এবং ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড (আইএমএফ) প্রধান ইউরোপীয় হয়ে থাকেন। এই নকশা অপরিবর্তিত রইল। একজন মার্কিনীই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সহযোগী বড় বড় কর্পোরেট এবং এই গ্রহের সবচেয়ে ধনী ১% মানুষের সম্পদের অতন্দ্র পাহারায় রইলেন।

বিশ্বব্যাঙ্ক ও উন্নয়ন

বিশ্বব্যাঙ্ক তাদের নানারকম উদ্দেশ্য সগর্বে প্রচার করে থাকে। প্রথমত, অসহনীয় দারিদ্র্যের অবসান। দ্বিতীয়ত, সারা পৃথিবীকে টেকসই উন্নয়নের অংশীদার করা। অথচ বাঙ্গার উন্নয়ন নীতি সম্পর্কে কোনো অভিজ্ঞতাই নেই, পরিবেশ ও জলবায়ু নিয়েও নয়। তাঁর মূল যোগ্যতা হল বৃহৎ কর্পোরেট ও ফাইন্যান্স কোম্পানিগুলোর সঙ্গে নিবিড় যোগাযোগ। সিটি গ্রুপ বা মাস্টারকার্ডের মত বড় আর্থিক সংস্থার প্রধান হিসাবে কাজ করার ট্র্যাক রেকর্ড একটা স্পষ্ট দিকনির্দেশ দেয়। তাঁর কার্যকালে বাঙ্গা সম্পদ নিষ্কাশনমূলক পুঁজিতন্ত্রকে (extractivist capitalist system) বিশ্বব্যাঙ্কের নব্য-উদারবাদী ঋণ ও শর্তাবলীর মাধ্যমে জিইয়ে রাখবেন।

বাঙ্গার আমলে মাস্টারকার্ডের তত্ত্বাবধানে দক্ষিণ আফ্রিকা এবং ব্রাজিলে Net1 নামে একটি ডেটা সার্ভিস সংস্থার মাধ্যমে শ্যাডো ব্যাঙ্কিং চালু হয়। সংস্থার আংশিক মালিকানা ছিল বিশ্বব্যাঙ্কের। এই শ্যাডো ব্যাঙ্কিং সংস্থাগুলো প্রধানত ক্ষুদ্র ঋণের মাধ্যমে বিশ্বজুড়ে গরীব মানুষের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির দাবি করলেও বাস্তবে তারা গরীব মানুষের উপর অনাবশ্যক ভোগ্যপণ্য এবং ঋণের সাঁড়াশি আক্রমণ চালায়। একদিকে মাস্টারকার্ড এক কোটি ডেবিট কার্ড ইস্যু করে, অন্যদিকে Net1 বেশকিছু আনুষঙ্গিক সংস্থা চালু করে, যার মধ্যে ছিল ঋণ, বিমা, এয়ার টাইম, বিদ্যুৎ এবং ই-ওয়ালেট সংস্থা। সরকারী অনুদানপ্রাপ্ত লোকেরা ছিল এই সংস্থাগুলোর টার্গেট গ্রাহক। একমাত্র পরিষেবা প্রদানকারী সংস্থা হিসাবে Net1 এদের ঋণ অ্যাকাউন্টগুলোকে অনুদান অ্যাকাউন্টের সঙ্গে যুক্ত রাখত। এই অর্থনৈতিক প্রক্রিয়ার সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ Net-এর হাতে থাকায় অনুদান অ্যাকাউন্টে টাকা জমা পড়লেই তা থেকে ঋণের কিস্তি কেটে নেওয়া হত। ঋণশোধের প্রক্রিয়া আর গ্রাহকের নিয়ন্ত্রণে থাকত না। খুব স্বাভাবিকভাবেই যে ধরনের আপাত প্রতিশ্রুতি এই সব স্কিমে দেওয়া থাকে, নানা লুকনো খরচের মাধ্যমে গ্রাহককে তা থেকে বঞ্চিত করা হয়। যেমন Net1 গ্রাহককে বিনা সুদে ঋণের প্রতিশ্রুতি দিত, কিন্তু মাসিক সার্ভিস চার্জ ছিল মাসিক পাঁচ শতাংশের বেশি। একই সময়ে ক্রেডিট কার্ডে ঋণের সুদ ছিল বছরে ২০ শতাংশের কিছু বেশি। গ্রাহক বুঝে ওঠার আগেই তাদের নগদ অনুদান Net1-এর গর্ভে চলে যেত। আর্থিক পরিস্থিতি সামাল দিতে তারা আরও বেশি করে প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক ঋণদাতাদের জালে জড়িয়ে পড়ত। লক্ষ লক্ষ গরিব পরিবার ধীরে ধীরে ভয়াবহ ঋণের জালের জড়িয়ে পড়েন।

ফলস্বরূপ আরও বিকৃত ও শোচনীয় দারিদ্র্যের উদ্ভব। সবচেয়ে গরিব মানুষের টাকা শুষে নেওয়া এবং তাদের চিরকালের মত ঋণের জালে জড়িয়ে ফেলা, যাতে জীবনধারণ এবং পুরনো ঋণ শোধ – দুটোর জন্যই তাদের নতুন ঋণ নিতে হয়। দরিদ্রতম দেশগুলো এবং দক্ষিণ আফ্রিকা বা ব্রাজিলের মত মধ্য-উপার্জনের অর্থনীতিতে শ্রমজীবী এবং পিছিয়ে পড়া মানুষের এই কাঠামোগত ঋণের জালে জড়িয়ে পড়া ইতিমধ্যেই এক উদ্বেগজনক সামাজিক ঘটনায় পরিণত হয়েছে। অবস্থা এত শোচনীয়, যে অবস্থার মধ্যে যাতে মানুষ বেঁচে থাকতে পারেন তার জন্য নির্দিষ্ট উন্নয়ন পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হচ্ছে।

আরো পড়ুন আবেনোমিক্স: শিনজো আবের মুখ ও মুখোশ

এসব জানলে বিশ্বব্যাঙ্কের এই নতুন প্রেসিডেন্ট নিয়োগের রঙ্গটা বুঝতে সুবিধা হবে। জলবায়ু সংক্রান্ত সামাজিক নীতি প্রণয়ন আজ জরুরি প্রয়োজন। বাঙ্গা পারবেন গোটা পৃথিবীর দূষণ ও জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার সাধারণ মানুষের জন্য বৈষম্যহীন নীতি নির্ধারণ করতে? বিশেষত ব্যর্থ উন্নয়ন নীতি ও গ্লোবাল নর্থের অত্যধিক ভোগবাদী জীবনযাত্রার ফলে যে মাত্রাতিরিক্ত কার্বন নির্গমন, তার যে মূল্য চুকিয়ে চলেছেন গ্লোবাল সাউথের মানুষ, তার প্রতিকার করতে পারবেন বাঙ্গা?

এসব প্রশ্নের উত্তর যদি না হয়, তাহলে বাঙ্গার নিযুক্তিকে ভারতীয়ের বিশ্বব্যাঙ্ক বিজয় হিসাবে বিশ্লেষণ না করাই বুদ্ধিমানের কাজ হবে। বিশ্বব্যাঙ্কের নীতি মার্কিনী বৃহৎ উদ্যোগ ও আর্থিক সংস্থাগুলোর স্বার্থেই প্রণীত হবে, প্রেসিডেন্টের আসনে যিনিই থাকুন। কারণ নীতি নির্ধারণ ও যে কোনো পুনর্গঠন বা সংস্কারের মত গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রকৃত প্রস্তাবে ভেটো দেওয়ার অধিকার রয়েছে।

বেশ কিছুকাল ধরে আমরা ভারতীয় বংশোদ্ভূতদের বিভিন্ন বহুজাতিক সংস্থার প্রধান পদে নিযুক্ত হতে দেখছি। মনে রাখতে হবে, তাঁরা নিজ নিজ মালিকের স্বার্থ রক্ষা করতে বাধ্য। জন্মসূত্র নয়, কর্মসূত্রে মালিকের প্রতি আনুগত্যই শেষ কথা। প্রয়োজনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী সুনক ব্রিটেনের পক্ষে চূড়ান্ত ভারতবিরোধী নীতি নিতে পারেন। একইভাবে গত চার বছরে ভারতীয় বংশোদ্ভূত মার্কিন উপরাষ্ট্রপতি কমলার সৌজন্যে ভারতের জনগণ কোনো সুবিধাই লাভ করতে পারেনি। বাঙ্গার প্রেসিডেন্ট পদে নিয়োগই হোক বা সুনকের প্রধানমন্ত্রী হওয়া – পরিণত ও সুষম পর্যবেক্ষণ দাবি করে। এঁদের ভারতীয়ত্ব নামে বা পদবিতেই সীমাবদ্ধ। এঁদের মাথা ঘুরিয়ে দেওয়া অর্থনৈতিক বা রাজনৈতিক ক্ষমতালাভের সঙ্গে সাধারণ ভারতবাসীর লাভ-ক্ষতির কোনো সম্পর্ক নেই।

নিবন্ধকার রাজনৈতিক কর্মী। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.