সাগরদীঘির বিধায়ক বায়রন বিশ্বাসের দলবদল এখন রাজ্য রাজনীতির অন্যতম চর্চিত বিষয়। এই নিয়ে নাগরিক ডট নেটের সঙ্গে কথা বললেন বিশিষ্ট সাংবাদিক স্নিগ্ধেন্দু ভট্টাচার্য। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন অর্ক ভাদুড়ি

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

স্নিগ্ধেন্দু, মুর্শিদাবাদ এবং মালদহ জেলার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে আপনি দীর্ঘদিন সাংবাদিকতার প্রয়োজনে ঘুরেছেন। ২০২১ সালের বিধানসভা নির্বাচনের আগেও ওই এলাকার রাজনীতি, বিশেষত সংখ্যালঘু ভোট নিয়ে আপনার লেখা আমরা পড়েছি। বায়রন বিশ্বাসের দলবদল কি তৃণমূলের জন্য আদৌ লাভজনক বলে আপনার মনে হয়?

লাভ-ক্ষতির একটা হিসাব কষেই তৃণমূল বায়রন বিশ্বাসের দলবদল করিয়েছে। কারণ বায়রনের জয় একটি বিশেষ সম্ভাবনা তৈরি করেছিল – বাম এবং কংগ্রেসের পুনরুত্থানের সম্ভাবনা। এর ফলে তৈরি হচ্ছিল রাজ্যে তৃণমূল-বিজেপির মেরুকরণ ভাঙার সম্ভাবনা। আমার মনে হয়, এই তৃতীয় শক্তির উত্থানের সম্ভাবনা অঙ্কুরেই বিনাশ করার জন্য তৃণমূল এ কাজ করল। আমরা যদি সরাসরি অঙ্কের হিসাবে দেখি, মালদা এবং মুর্শিদাবাদ মিলিয়ে পাঁচটা লোকসভা আসন। দুটো কংগ্রেসের দখলে, একটা বিজেপির দখলে, দুটো তৃণমূলের দখলে। আগামী লোকসভায় তৃণমূল এই পাঁচটি আসনেই জিততে চায়। তাদের হিসাব অনুযায়ী, কংগ্রেস যদি শক্তিশালী হয়, তাহলে এই পাঁচটি আসনেই তৃণমূলের জয়ের অঙ্কে বেশ খানিকটা ঘাটতি থাকবে। এই গেল ছোট হিসাব। তার বাইরে, সাগরদীঘির ফলাফল গোটা রাজ্যেই তৃণমূল-বিজেপিবিরোধী অংশে আশার সঞ্চার করেছিল। তৃণমূল ও বিজেপি দু পক্ষকেই হারানো যায় – এই আশাতেও খানিকটা জল ঢেলে দেওয়া গেল।

এর মাধ্যমে তৃতীয় শক্তির উত্থানের যে সম্ভাবনা তৈরি হয়েছিল, তাকে তৃণমূল কিছুটা ধাক্কা দিতে পেরেছে। এটা একটা অঙ্কের হিসাব। কিন্তু যদি অঙ্কেরই আরেকটা হিসাব দেখি, সাগরদিঘির ৪৪% মানুষ তৃণমূলের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন। বায়রনকে কংগ্রেসের প্রতীকে ভোট দিয়েছিলেন। এই মানুষগুলি কি অপমানিত হলেন না? তাঁরা যাঁকে ভোট দিয়েছিলেন তাঁকে কার্যত কিনে নেওয়া হল। মানুষকে বলে দেওয়া হল, যে আপনি যাকেই ভোট দিন, শেষপর্যন্ত সে আমাদের দিকেই আসবে। বিশেষ করে এটা যেন মুসলিম জনতার প্রতি একটা বার্তা – আপনাদের তৃণমূলের সঙ্গেই থাকতে হবে। এটা মানুষ কীভাবে নেবেন সেটা কিন্তু অঙ্কে ঠিক হয় না। অঙ্কের বাইরের লাভ-ক্ষতি হয়ত পরবর্তী নির্বাচনের পরে বোঝা যাবে।

কংগ্রেসের মাত্র একজন বিধায়ক ছিলেন বিধানসভায়। তাঁকেও তৃণমূল দলবদল করাল। তৃণমূলের এমন আগ্রাসী মনোভাব, এটা কি শেষ অবধি বিজেপিকে শক্তিশালী করবে? বাম-কংগ্রেসের পক্ষে যে জনমত গড়ে উঠছিল, সেটা কি আবারও বিজেপির দিকে চলে যাবে? যদি আরেকটু স্পষ্ট করে জানতে চাই, আপনার কি মনে হয়, মমতা ব্যানার্জি আরএসএসের এজেন্ডা অনুযায়ী চলছেন?

মমতা আরএসএসের এজেন্ডায় চলছেন – এটা আমার মনে হয় না। তাঁর নিজস্ব এজেন্ডা আছে। কিন্তু তিনি যে পথে চলছেন, তা যে সংঘ পরিবারের সুবিধা করে দিচ্ছে, এ কথা নিশ্চয় বলা যায়। আমার এখন পর্যন্ত ধারণা, ২০১৯ সালে পশ্চিমবঙ্গে বিজেপির যে বিপুল সাফল্য আমরা দেখেছিলাম, ১৮টা লোকসভা আসনে জয় তো বটেই, তার সঙ্গে ৪০% ভোট – এই বিপুল সংখ্যক ভোটার উগ্র জাতীয়তাবাদী এবং হিন্দুত্ববাদের হাওয়ায় বিজেপিকে ভোট দিলেও তাঁরা সকলেই হিন্দুত্ববাদী ছিলেন না। এঁদের অনেকেই ২০১৮ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে তৃণমূল যে লুঠতরাজ চালিয়েছিল, তার প্রতিবাদে নিজেদের রাগ উগরে দিয়েছিলেন বিজেপিকে ভোট দিয়ে। ২০১৪ সালের পর থেকে বাংলায় যে বিজেপির বাড়বাড়ন্ত হল, তার অন্যতম কারণ আমার মনে হয়, ২০১২ সাল থেকে তৃণমূলের রাজ্যকে বিরোধীশূন্য করার চেষ্টা। যার শুরু হয় মালদহের কৃষ্ণেন্দু নারায়ণ চৌধুরীকে তৃণমূলের পতাকা ধরানো দিয়ে। তারপর ধাপে ধাপে পুরসভা, পঞ্চায়েতগুলির হাতবদল হয়েছে। ২০১৩ সালের পঞ্চায়েত নির্বাচনে সন্ত্রাস কম হয়েছিল, কিন্তু ওই নির্বাচনে জেতা বিরোধী প্রার্থীদের অনেককেই পরে তৃণমূলে যোগ দিতে হয়েছিল।

এই বিরোধীশূন্য করার চেষ্টা কিন্তু আসলে সফল হয় না৷ কারণ বিরোধী মানুষ তো থাকেনই। তাঁরা দেখেছেন সিপিএম, কংগ্রেস পারছে না। বিজেপির এখন বাড়বাড়ন্ত, দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আছেন, মার খেলে বাম-কংগ্রেস নেতারা পাশে নাও দাঁড়াতে পারেন, কিন্তু দিল্লি থেকে কয়েকজন রাজ্যসভার সাংসদ চলে আসতে পারেন, সিআরপিএফ চলে আসতে পারে। এই ভরসাই তাদের বিজেপির ঝাণ্ডা তুলে নিতে প্ররোচিত করে। আমার এটা নিশ্চিতভাবেই মনে হয়।

সাগরদীঘির নির্বাচনের পর মনে করা হচ্ছিল অধীর চৌধুরী নিজের দুর্গ কিছুটা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছেন৷ সংখ্যালঘুদের একাংশ আবারও কংগ্রেসের দিকে ফিরছেন। বায়রনের দলবদল কি তাতে ধাক্কা দিল?

মুসলিম ভোটের একটা অংশ বাধ্যতামূলকভাবে তৃণমূলের সঙ্গে এসেছিল ২০২১ সালে। যার ফলে আমরা দেখেছি মালদহ, মুর্শিদাবাদের মত কংগ্রেসের দীর্ঘদিনের ঘাঁটি, যে এলাকা তৃণমূল গত দশ বছরে দখল করতে পারেনি, সেখানেও কংগ্রেসকে ঝেঁটিয়ে সাফ করে দিয়েছিল। আমরা, সাংবাদিকরা, বিধানসভা ভোটের আগে ওই জেলাগুলিতে গিয়ে দেখেছি যে, মুসলিমরা বলছেন, এবার বিজেপিকে আটকাতে তৃণমূল বাদে অন্য কোনো বিকল্প নেই। তৃণমূল ভেবেছিল এই বাধ্যবাধ্যকতাজনিত সমর্থন আজীবন তাদের সঙ্গে থেকে যাবে। কিন্তু একের পর এক নানা ঘটনায় মুসলিম সমাজের একটি অংশের সমর্থন তৃণমূলের থেকে সরছিল। আনিস খানের মৃত্যু নিঃসন্দেহে বড় ছাপ ফেলেছিল। সাগরদীঘির পর সরাসরি মুসলিম সমাজ তৃণমূলকে বার্তা দিল, “আমরা তোমার কেনা গোলাম নই”। মুশকিল হল, বায়রনকে দলবদল করিয়ে এই জরুরি বার্তাটিকে তৃণমূল নস্যাৎ করতে চাইল। তাতে এক্ষুণি মুসলিম সমাজ তৃণমূলের পাশ থেকে সরে যাবে কিনা আমি বলতে পারছি না। কারণ বিজেপির বিপদটা এখনো তাঁদের সামনে আছে। রাতারাতি মুসলিম ভোটের বড় অংশ তৃণমূলের থেকে সরে যাবে এমনটা আমার মনে হচ্ছে না। তাঁদের বাধ্যবাধকতা আছে। কিন্তু এই ক্ষোভের কোথাও না কোথাও, কখনো না কখনো তো বহিঃপ্রকাশ ঘটবেই।

আরো পড়ুন কেন আইএসএফ বিঁধছে তৃণমূলের গলায়?

বামপন্থীদের সঙ্গে কংগ্রেসের জোট সম্ভাবনা কি খানিকটা ধাক্কা খেল? বাম শিবিরের একাংশ সাগরদীঘি মডেল নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলেন। অন্য একটি অংশ বায়রনের দলবদলের পর জোটের বিরোধিতা করছেন।

জোট নিয়ে বিরোধিতা বাম, কংগ্রেস শিবিরে চিরকালই আছে। বামফ্রন্টের বাইরের বামেদের মধ্যেও আছে। তাঁদের একাংশ এই জোট নিয়ে মস্করা করেন, সিপিএমকে কটাক্ষ করেন। বামফ্রন্ট বা সিপিএমের অন্দরে যাঁরা জোটবিরোধী, কংগ্রেস কর্মীদের মধ্যে যাঁরা জোট চান না – এই ঘটনার পর তাঁরা হয়ত বেশি সক্রিয় হয়েছেন। তবে আমার মতে, এতে জোটে প্রভাব পড়া উচিত নয়। কারণ সবাই বুঝতে পারছেন খেলাটা কী হয়েছে। এমন তো নয়, যে কংগ্রেস হাতে করে বায়রনকে পাঠিয়ে দিয়েছে শাসক শিবিরে। কংগ্রেস বায়রনকে ধরে রাখতে পারেনি। যেমন সিপিএমও খগেন মুর্মুকে ধরে রাখতে পারেনি। আমার মনে হয়, বাম ও কংগ্রেস – উভয় পক্ষেরই বাধ্যবাধকতা আছে জোট করার। ত্রিপুরাতেও একদম নিচুতলা অবধি জোট হয়েছিল। ফলে লোকসভায় কেরলে একরকম এবং বাংলা ও ত্রিপুরায় আরেকরকম- এটা দুই পক্ষই কেন্দ্রীয় স্তরে মেনে নেবে বলেই আমার ধারণা। বাম-কংগ্রেস সমঝোতার সম্ভবনা নস্যাৎ করার জায়গাই নেই। লোকসভায় একসঙ্গে লড়াই করাই এই দুই শক্তির জন্য বাস্তবতা।

এই ধরণের ঘটনা কি সংসদীয় রাজনীতিকে প্রহসনে পরিণত করছে না? বিজেপি বহু রাজ্যে বিরোধী বিধায়ক ভাঙিয়ে সরকার গড়ে ফেলছে, পশ্চিমবঙ্গে তৃণমূলও একই কাজ করছে। এতে কি সংসদীয় রাজনীতির প্রতি নির্বাচকমণ্ডলীর আস্থা কমে যেতে পারে?

এই বিষয়টিকে জাতীয় স্তরে প্রহসনে পরিণত করেছে বিজেপি। রাজ্য স্তরে বিজেপির বিরুদ্ধে এ নিয়ে বলার অধিকার হারিয়েছে তৃণমূল। কারণ বিজেপি ২০১৪ সালের পর থেকে জাতীয় স্তরে যা করছে, তা তৃণমূল রাজ্যে ২০১২-১৩ থেকেই করছে। এদের ন্যূনতম নৈতিকতাটুকুও নেই।দলবদলের পর বায়রন বলেছেন তিনি নাকি নিজের ভোটে জিতেছেন! জিতেছেন নিজের নামে। কংগ্রেসের চিহ্নে নয়। আমার কথা হল, এতটাই আত্মবিশ্বাস যখন, তাহলে মানুষের কাছে ফিরে যান না কেন? পছন্দের চিহ্ন নিয়ে লড়ুন না কেন? বিধানসভাতেও যে অদ্ভুত ব্যাপারটি হল… প্রথমে মুকুল রায়, পরে কৃষ্ণ কল্যাণী, যাঁরা খাতায় কলমে বিজেপির এমএলএ, তাঁদের পিএসির চেয়ারম্যান করা হল। আসলে এঁরা ধরে নিয়েছেন, তাঁরা মানুষকে যা বলবেন, মানুষ তাই মানতে বাধ্য। সংসদীয় ব্যবস্থা একটা দুর্ভাগ্যজনক জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় এবং রাজ্য স্তরে একই জিনিস দেখছি।

পঞ্চায়েত নির্বাচন কি তৃণমূলের জন্য সহজ লড়াই হতে চলেছে? নাকি বিরোধীরা খানিকটা প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারবেন?

একটা টেনশন অবশ্যই মাঠ পর্যায়ে আছে। কারণ তৃণমূলের একাংশ নিশ্চিত নন তাঁদের জনসমর্থন কেমন। এই উৎকণ্ঠা থেকে হিংসা এবং রিগিং করে জেতার চেষ্টা করতেই পারে তৃণমূল। অন্তত সেই সম্ভাবনা থাকবে। অভিষেক ব্যানার্জি বারবার বলছেন অবাধ ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন হবে। প্রথম কথা হল, দেখতে হবে, বিরোধীরা মনোনয়ন জমা দিতে পারেন কিনা। মনোনয়নপত্র জমা দিলেও অবাধে প্রচার করতে পারছেন কিনা। দেখতে হবে ভোটের দিন মানুষ ভোট দিতে পারছেন কিনা। এগুলো দেখার। যদি ঠিকভাবে ভোট হয়, তাহলে বাম-কংগ্রেসের উত্থানের সম্ভাবনা আছে। রাজ্যে এখন বামেদের উপস্থিতি অনেকটাই বেশি আগের চেয়ে। লাল পতাকা নিয়ে বহু কর্মসূচি হচ্ছে। তার পরেও সাংগঠনিকভাবে বাম ও কংগ্রেস দুর্বল। বিজেপিও দুর্বল, তবে বাম-কংগ্রেসের চেয়ে শক্তিশালী। সাগরদীঘির পরে বাম-কংগ্রেস সক্রিয়, উজ্জীবিত হয়েছিল। কিন্তু বায়রন যে দল বদলালেন একটা বড় আঘাত। বিজেপি সাগরদীঘির বিধায়কের তৃণমূলে যোগদানের পরে বলতে পারবে, বাম-কংগ্রেসকে জেতালে জয়ীরা তৃণমূলেই যাবেন। এটা বলতে পারি, বায়রন যা করলেন, তাতে বিজেপির জন্য তিন মাস আগের তুলনায় পরিস্থিতি সহজ হল।

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.