গৌতমী সেনগুপ্ত

ইতিহাস রচনা বা historiography থেকে হেরোডোটাস বা কার্ল মার্কসকে বাদ দিলে ইতিহাসের ব্যাখ্যা করা কতটা সম্ভব? আপনি মার্কসবাদী হোন আর না-ই হোন, মার্কস পড়তে হবেই। তা না হলে মার্কসবাদের পক্ষে বা বিপক্ষে বক্তব্য রাখা যাবে না। রাষ্ট্রবিজ্ঞানের পাঠ্যসূচিতে মহম্মদ ইকবালকে রাখা তেমনই এক প্রয়োজনীয়তা। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের স্নাতক স্তরের ষষ্ঠ পেপারে ‘মডার্ন ইন্ডিয়ান পলিটিক্যাল থট’ শিরোনামের অধ্যায়টিতে ছিল ইকবালের প্রসঙ্গ। অর্থাৎ ইকবালের জীবনী, রাষ্ট্র সম্পর্কে তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। সেই ইকবালকে বাদ দেওয়া মানে পড়ুয়াদের কাছে একটা পর্ব উহ্য রাখা। স্বামী বিবেকানন্দ থেকে রবীন্দ্রনাথ, ভীমরাও আম্বেদকর থেকে জওহরলাল নেহরু যখন ব্রাত্য নন, তখন ‘সারে জঁহা সে অচ্ছা’ গানের স্রষ্টা উর্দু ভাষার কবি ইকবাল, যিনি ভারত-পাকিস্তান দুই দেশেই সমাদৃত, তাঁকে বাদ দেওয়া একমাত্র শিক্ষাকে মেরুকরণের চেষ্টা ছাড়া আর কিছু হতে পারে না।

বেশিদিনের কথা নয়। এপ্রিল মাসেই ন্যাশনাল কাউন্সিল অফ এডুকেশনাল রিসার্চ অ্যান্ড ট্রেনিং (এনসিইআরটি) জানায়, দ্বাদশ শ্রেণির বই থেকে বাদ পড়বে মোগল যুগ। অর্থাৎ আর্য সভ্যতা, বৈদিক যুগ থেকে রাজপুত পেরিয়ে মাঝের দীর্ঘ মোগল যুগ সম্পর্কে জানা থেকে বঞ্চিত হবেন পড়ুয়ারা। গোটা মোগল যুগ বাদ দেওয়া মানে মধ্যযুগের একটা বড় পর্ব ইতিহাস থেকে বাদ দেওয়া। যা আসলে ইতিহাসের উপর বিরাট এক কোপ। হিন্দু রাজাদের ইতিহাস পড়ুয়ারা পড়বে, কিন্তু মোগল শাসকদের সম্পর্কে পড়বে না। কারণ পাঠক্রমের বর্তমান নিয়ন্তাদের মতে, মোগল মানেই মুসলমান। আর মুসলমান মানেই নিষিদ্ধ।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

একটু পিছিয়ে যাই।

২৪ নভেম্বর ২০২২। দিল্লির বিজ্ঞান ভবন থেকে অমিত শাহের নতুন ইতিহাস লেখার নিদান। যে ইতিহাসে লেখা হবে রামমন্দিরের কথা, বিতর্কিত বাবরি মসজিদের কথা। ইতিহাসে থাকবে শুধুই হিন্দু রাজাদের সাহসের ইতিহাস। বাদ পড়ার তালিকায় প্রথমেই মোগলরা। এবার বাদ পড়লেন ইকবাল, আরও কতকিছু দেখা বাকি।

২০১৪ সালে নরেন্দ্র মোদী ক্ষমতায় আসার পর এক নতুন ভারতের সূচনা হয়েছে, যেখানে মোদী-শাহকে প্রকাশ্যে বলতে শোনা যাচ্ছে ৭০ বছরের ভারতের ধারণাকে তাঁরা বদলে দিতে চান। বদলের অন্যতম হাতিয়ার পাঠ্য বই। ইতিহাস ও রাষ্ট্রবিজ্ঞানকে চাঁদমারি করেই তাই অমিত শাহের আস্ফালন। তিনি জোর গলায় বলেন, এখন আমাদের কে আটকাবে? রাজপুতানার ইতিহাস সম্পর্কিত বইপ্রকাশ অনুষ্ঠানে শাহকে বলতে শোনা যায় হিন্দু জাতীয়তাবাদী ইতিহাস রচনার কথা, যার প্রথম ধাপ মোগল যুগ বাদ দেওয়া। এবার মহম্মদ ইকবাল। অথচ ইকবাল যে শুধুই একজন কবি নন, একজন দার্শনিক, একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞানীও বটে, সেকথা চাপা পড়ে গেল।

শিক্ষায় শাসকের শক্তি প্রদর্শনের ফলটা ঠিক কী? শেষপর্যন্ত পড়ুয়াদের কাছে বিচ্ছিন্ন বা খণ্ডিত ইতিহাস তুলে ধরা। যে পাঠ্যসূচি যত্ন করে গঠনমূলক পদ্ধতিতে সাজানো হয়েছিল, সেখান থেকে আস্ত একটা পর্ব বাদ দেওয়া মানে ইতিহাস বা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের ভিতকে নড়বড়ে করে দেওয়া।

আরো পড়ুন ‘ঔরঙ্গজেবের চেয়ে বেশি মন্দির ধ্বংস করেছেন মোদী’

ইকবালকে পাঠ্য বই থেকে সরিয়ে দেওয়ার নেপথ্যে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্যের যুক্তি – পাকিস্তান রাষ্ট্রের দার্শনিক পিতা বলা হয় ইকবালকে। ভারত ভাগে ইকবালের ভূমিকা অপরিসীম। সেই ইকবালকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে আলোকিত করা অর্থহীন। এই যুক্তি দেখিয়ে ইকবালকে যদি পাঠ্যসূচি থেকে বাদ দেওয়া যায়, তাহলে ব্রিটিশ যুগকেও বাদ দেওয়া প্রয়োজন। যদি ইকবাল মুসলমান এবং উর্দু ভাষার কবি বলে বাদ পড়েন, যদি মোগল যুগ বাদ দিতেও একই যুক্তি প্রয়োগ করা হয়, তাহলে কেনই বা ২০০ বছরের ব্রিটিশ শাসনের ইতিহাস বয়ে বেড়াচ্ছে দেশের পাঠ্য বইগুলো? এই প্রশ্ন কি আমরা এড়িয়ে যেতে পারি?

ইকবালের লেখনী মহাত্মা গান্ধীকে পর্যন্ত কাঁদাত। আজ গান্ধীর দেশেই ইকবাল ব্রাত্য। সে কি তাঁর ধর্মীয় পরিচয়ের জন্য নাকি কোনো না কোনোভাবে শক্তি প্রদর্শন করতে হবে? সবচেয়ে চিন্তার কথা, পাঠ্য বইয়ের এইসব উদ্দেশ্যপ্রণোদিত পরিবর্তন, চিন্তার এই মেরুকরণকে বড় অংশের মানুষ সমর্থন করছেন। মোদী-শাহ বোঝাচ্ছেন পাঠ্যক্রমে মৌর্য, সাতবাহন, গুপ্তরা বঞ্চিত থেকে গেছে; কেবল মোগলদেরই গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। অথচ এই তথ্য একেবারেই অসত্য।

সেন্ট্রাল বোর্ড অফ সেকেন্ডারি এডুকেশনের (সিবিএসই) দশম শ্রেণির বই থেকে ডারউইনের বিবর্তনবাদের অধ্যায় বাদ দেওয়া থেকে শুরু করে মোগল যুগ আর এবার ইকবাল – আগামীদিনে আরও কত কী বাদ পড়বে কেউ জানে না।

নিবন্ধকার সাংবাদিক। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে দেড় দশক কাজের অভিজ্ঞতা। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.