সাক্ষী মালিক, ভিনেশ ফোগতদের লড়াই বিজেপি-আরএসএস শিবিরের ভাঙন আরও চওড়া করবে। কৃষক আন্দোলনের পর আরও একবার আভ্যন্তরীণ সংঘাতে বিদীর্ণ গেরুয়া শিবির। ফাটল ধরছে বিজেপির শক্ত ভূমি উত্তর ভারতে। হরিয়ানায় ক্রমশ সঙ্কট বাড়ছে বিজেপির। আন্দোলনরত কুস্তিগীরদের পাশে ইতিমধ্যেই সক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়েছে সংযুক্ত কিষাণ মোর্চা। ২০২৪ সালের মহাসংগ্রামের প্রাক্কালে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত সমস্ত বামপন্থীদের তাই এই লড়াইকে যথোপযুক্ত গুরুত্ব দিতেই হবে। সমস্ত বামপন্থী ও কমিউনিস্ট কর্মীদের এই লড়াইয়ে সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণও করতে হবে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে, অনেক ক্ষেত্রেই কমিউনিস্ট কর্মীরা কুস্তিগীরদের লড়াইয়ে যাচ্ছেন দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে অথবা রাজনীতির রঙ্গমঞ্চে প্রাসঙ্গিক থাকার বাধ্যবাধকতায়। ফলে কিছু গোল গোল সাধারণ কথা গলার শির ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উগরে দেওয়ার বেশি কিছু তাঁরা করে উঠতে পারছেন না। এর একটা বড় কারণ হল, ঘটনাটা ঘটছে উত্তর ভারতে। কিন্তু উত্তর ভারতে ঐতিহাসিকভাবেই কমিউনিস্ট আন্দোলন দুর্বল। ফলে সেখানকার বাস্তব বোঝেন এমন কমিউনিস্ট নেতার অভাব আছে। দেশের অন্য অঞ্চলের কমিউনিস্টরা, যাঁরা এ বিষয়ে প্রচার করছেন, তাঁদের বোঝায় ফাঁক আছে। ফলে অনেক ক্ষেত্রেই ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।

যেমন এই পশ্চিমবঙ্গের কথাই ধরুন। পশ্চিমবঙ্গকেন্দ্রিক বাম রাজনীতি যাঁরা করেন তাঁদের বিপুল অংশের ধারণা, লোকে রাজনৈতিক অবস্থান নেয় আদর্শের জায়গা থেকে। পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে কথাটা কিছুটা খাটে ঠিকই, কিন্তু সর্বত্র তা খাটবে না। তাই পশ্চিমবঙ্গের বামপন্থীদের মধ্যে যখন কেউ কেউ বলছেন, এই কুস্তিগীররা বিজেপি সমর্থক, এদের লড়াইতে আমরা যাব কেন, তখন তাঁরা কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় দেখতেই পাচ্ছেন না। তাঁরা বুঝছেন না, এই কুস্তিগীররা বিজেপির সমর্থক বলেই এই লড়াই অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

একথা ঠিকই যে, ফোগত বোনেরা, সাক্ষী মালিক, বজরং পুনিয়া প্রমুখ বিজেপি-আরএসএসের সমর্থক, কেউ কেউ সদস্যও। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের আগে ফোগত পরিবারের মাথা মহাবীর সিং ফোগত বিজেপিতে যোগদান করেছিলেন। ইনি আগে অন্য দলেও ছিলেন। একসময় ওমপ্রকাশ চৌতালার দীর্ঘদিনের সঙ্গী ছিলেন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা বিলুপ্তির পক্ষে খোলাখুলি সওয়ালও করেছিলেন। মহাবীর প্রাক্তন কুস্তিগীর এবং কোচ হবার কারণে তাঁর ছয় মেয়েকে (এর মধ্যে চার মেয়ে তাঁর নিজের এবং দুই মেয়ে ভাইয়ের) কুস্তিতে প্রশিক্ষণ দেন এবং এই ফোগত বোনেদের অনেকেই কমনওয়েলথ গেমসে সোনা এবং অন্যান্য পদক পেয়েছেন। ববিতা ফোগত তো বিজেপির পরিচিত কর্মী এবং ২০১৯ হরিয়ানা বিধানসভা নির্বাচনে দাদরি কেন্দ্র থেকে বিজেপির টিকিটে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আরও একজন ভারতীয় কুস্তিগীর হলেন পুনিয়া, যিনি সঙ্গীতা ফোগতকে বিয়ে করেছেন। তিনিও খোলাখুলি আরএসএস সমর্থক এবং মুসলমানবিদ্বেষী বলে পরিচিত এবং বর্তমানে কুস্তিগীরদের লড়াইয়ের নেতৃত্বে রয়েছেন। এই নেতৃত্বের আরও একজন হলেন সাক্ষী মালিক। তিনিও বিজেপি সমর্থক এবং হরিয়ানায় নরেন্দ্র মোদীর ‘বেটি বচাও বেটি পঢ়াও’ ক্যাম্পেনের ব্র‍্যান্ড অ্যাম্বাসাডর হিসাবে কাজ করেছেন।

ঠিক এই কারণেই এই লড়াই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই ঘটনা পরিষ্কার দেখিয়ে দিচ্ছে, যে বিজেপি করলেই বা আরএসএস সমর্থক হলেই আপনি এই ফ্যাসিবাদী সরকারের বন্ধু হতে পারবেন না, ফলত সুরক্ষিত থাকতেও পারবেন না। মহিলা কুস্তিগীরদের উপর চলা যৌন হেনস্থার অভিযোগের তির যার দিকে, সেই কুস্তি ফেডারেশনের প্রেসিডেন্ট ব্রিজভূষণ শরণ সিং বিজেপি নেতা এবং লোকসভার সদস্য। তাঁর ক্ষমতা অনেক বেশি। একটা ফ্যাসিবাদী সরকারের কাছে বাবরি মসজিদ ভাঙার অন্যতম সেনানী, বহু অপরাধের দীর্ঘ তালিকাসম্পন্ন উত্তরপ্রদেশ রাজনীতির অন্যতম কুশীলব ব্রিজভূষণের গুরুত্ব সাক্ষী বা ফোগত পরিবারের থেকে অনেক বেশি। হলই বা মালিক, ফোগতরা মোদিভক্ত। শেষ বিচারে তার মূল্য কতখানি?

মনে রাখতে হবে, এই ঘটনা যত না নাড়া দিয়েছে, ভয় ধরিয়েছে অন্যদের; তার চেয়ে অনেক বেশি আতঙ্কিত করেছে মোদীর ভক্তকুলকে। কারণ সরকারের আর সরকারে আসীন পার্টির ধামা ধরে যারা সামাজিক-রাজনৈতিক প্রতিপত্তি কিংবা নিরাপত্তা পেতে চেয়েছে, তাদের শেষ অস্ত্রও কার্যক্ষেত্রে ঘোড়ার ডিম ছাড়া আর কিছু প্রসব করতে পারেনি দেখে তারা অবিশ্বাস আর আতঙ্কের চোরাবালিতে তলিয়ে যাচ্ছে। পুলিশের লাঠি, ঘাড়ধাক্কা, মারধোর, ফৌজদারি মামলা ঠুকে দেওয়া আর মাটিতে ফেলে মুখে বুটসমেত পা চেপে ধরা দেখে আন্দোলনরত কুস্তিগীররা কেঁদে ফেলছেন। ভিনেশরা বারবার একটা কথা বলেছেন, “আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় দেশের জন্যে সম্মান নিয়ে এসে এই কি আমাদের প্রাপ্য ছিল?” মুখে না বললেও আরও কিছু কথা এর মধ্যে বলা হয়ে গেছে। এঁরা তো শুধু পদকজয়ী ক্রীড়াবিদ নন, প্রকাশ্যে বিজেপির ঝাণ্ডা কাঁধে নিয়ে আন্তর্জাতিক ক্রীড়াঙ্গন থেকে আনা স্বীকৃতি ও সম্মানকে পরিণত করেছিলেন বিজেপির রাজনৈতিক পুঁজিতে। বিজেপি-আরএসএসের হিন্দুত্ববাদী রাজনীতি আর দর্শনকে মনে প্রাণে বিশ্বাস করেছেন, তার পালে হাওয়া দিয়েছেন, কাশ্মীরে ৩৭০ ধারা অবলুপ্ত করে দেওয়া হলে সোচ্চারে তার গুণ ও উপযোগিতা প্রচার করেছেন। এমন আরও অনেককিছু তাঁরা করেছেন। তবুও এই পরিণতি? তাঁদের চোখে তাই আমরা অবিশ্বাস, ক্রন্দন আর মোহভঙ্গ দেখছি। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছে এই ক্রূর বাস্তব, যে হিন্দু হৃদয়সম্রাট মোদির ফ্যাসিবাদী হৃদয়ে কোনো স্তাবকই দাবার বোড়ের বেশি কিছু নয়।

আরো পড়ুন ভারতীয় দলের জার্সি এখন বিজেপির সম্পত্তি

হরিয়ানার গ্রামাঞ্চলে এই বোধ সঞ্চারিত হচ্ছে অতি দ্রুত। শুধু হরিয়ানাই নয়, দেশের অন্যত্রও। তাই মেনকা গান্ধীর মত বিজেপি নেত্রী উল্টো গাইতে শুরু করেছেন। কিন্তু বিজেপি বোধহয় সবথেকে বেশি ধাক্কার মুখোমুখি হরিয়ানায়। আমরা যারা হরিয়ানাকে জানি সাংস্কৃতিকভাবে পশ্চাদপর রাজ্য হিসাবে, কন্যাভ্রুণ হত্যার স্বর্গ, পারিবারিক সম্মানরক্ষার্থে খুন, আর লিঙ্গসাম্যের বধ্যভূমি হিসাবে – তারা জানি না, যে হরিয়ানার গ্রামাঞ্চলে পারিবারিক (অথবা গ্রামের) সম্মান অর্জিত হয় যে কয়েকটা পথে তার অন্যতম হল ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় পরিবারের বা গ্রামের মেয়েদের খেতাব অর্জন। তাই যে হরিয়ানার রাস্তায়, ক্যাফেতে, আড্ডাখানায় তথা নাগরিক জীবনে মেয়েদের উপস্থিতি উল্লেখযোগ্যভাবে কম, সেই হরিয়ানাতেই আপনি দেখবেন সকালবেলা কি শহরে কি গ্রামে রাস্তায় দৌড়চ্ছে, জগিং করছে, ঘাম ঝরানো অনুশীলন করছে অল্পবয়সী মেয়েরা। তাদের পরনে স্পোর্টস শর্টস, টি শার্ট। শুধু কুস্তি নয়; বক্সিং, ভারোত্তোলন, হকি, কাবাডি এবং শুটিংয়ে দেশের মধ্যে হরিয়ানার মেয়েরা অনেক এগিয়ে গেছে। মহিলাদের বক্সিংয়ে ভারতের আন্তর্জাতিক বক্সারদের অধিকাংশই হরিয়ানার। এমন ঘটনা অন্যান্য খেলাতেও দেখতে পাওয়া যাবে। পানিপথ, সোনেপত, ঝাজ্জর, ভিওয়ানির মত বহু জেলা থেকে দলে দলে মেয়ে খেলাধুলোর জগতে আসে। ভিওয়ানিকে বক্সিং মহলে তো ডাকাই হয় ‘ভারতের কিউবা’ বলে।

এই সামাজিক পরিবেশ হরিয়ানার সমস্ত সরকার, তা আগের কংগ্রেস সরকার হোক বা বর্তমানের বিজেপি সরকার হোক, সবাইকে বাধ্য করেছে ক্রীড়াক্ষেত্রে বিপুল টাকা বিনিয়োগ করতে, পরিকাঠামো নির্মাণ করতে। অনেকেই সরকারি চাকরিও পায় খেলার সূত্রেই। কৃষিকাজ, সেনাবাহিনীতে চাকরি আর মেয়েদের খেলাধুলো থেকেই পরিবারের সম্মান, গ্রামের সম্মান অর্জিত হয় হরিয়ানার গ্রামাঞ্চলে। যদিও এই অঞ্চলের মানুষই হনুমান চালিশা পড়তে পড়তে মোদীকেই এ যুগের রাম ভেবে নিয়েছিল একসময়। সে যুগ অতি দ্রুত অস্তমিত হচ্ছে কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে। মনে রাখতে হবে সাক্ষী বা ফোগত বোনেদের গায়ে হাত দেওয়া মানে হল হরিয়ানার গ্রামে গ্রামে ঘরের মেয়েদের গায়ে হাত পড়া। ফলত, হরিয়ানা ফুঁসছে। এই স্ফুলিঙ্গ দাবানলের রূপ নেবে কিনা তা একমাত্র সময়ই বলবে।

ইতিমধ্যে অযোধ্যায় ব্রিজভূষণের সমর্থনে আগামীকালের মহাসভা বাতিল করা হয়েছে। বিজেপিও বুঝছে শিয়রে শমন। শাস্ত্রে আছে “সর্বনাশে সমুৎপন্নে অর্ধং ত্যজতি পণ্ডিতঃ”। ফ্যাসিবাদীরা যে আদতে মহামূর্খ সেকথা কিন্তু দুনিয়া জানে।

মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.