কোয়েল সাহা

এ শহর ধুলো ধোঁয়াময়। সম্পর্ক আর রোজকার জীবনেও ধুলো ধোঁয়ার কুয়াশা। উত্তর ২৪ পরগণার মফস্বল শহর কাঁচরাপাড়ার সীমানা ঘেঁষে থাকা খালপাড়ের বস্তি থেকে উদ্বাস্তু পরিবারের মেয়ে জীবিকার সন্ধান ও স্বপ্নকে আগলাতে আরও একবার পাড়ি দিলেন উদ্বাস্তু পরম্পরায় দেশের রাজধানী দিল্লিতে। শহরে মাথা গোঁজার ব্যবস্থা করা থেকে ভাত-ডালের সম্পর্কে নিজেদের গুছিয়ে নেওয়ার লড়াইয়ে এই উদ্বাস্তু জীবন কাঁথা সেলাইয়ের মত জুড়ে থাকে।

নাম কল্পনা দাস। বয়স ৩৯ বছর। পেশায় ব্যবসায়ী। ডিজাইন করা পোশাক-আশাক উচ্চ ও মধ্যবিত্তের নাগালে পৌঁছে দিতে চায়। উচ্চাশায় সবর্দা ঝলমল করে, পাশাপাশি আছে অনিশ্চয়তা। এ মেয়ে যান্ত্রিক তালে, লয়ে নিজেকে মানিয়ে নেওয়ার চেষ্টায় ইঁদুর দৌড়ে নেমেছে। মাঝে লকডাউনের উগ্র দাঁতনখের আঁচড় এসে পড়েছিল। সেই চরম অস্থিরতায় এ শহর তাকে কোনোরকম আশ্রয় দেয়নি। চকচকে কংক্রিট প্রকৃতির কাছে সান্ত্বনা পাওয়ারও কোনো উপায় রাখেনি। একঘেয়ে জীবনযন্ত্রণা কেবল ঘড়ির কাঁটার মত ঘুরে চলছিল।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

দুনিয়ায় শুধু মানুষই যে উদ্বাস্তু হয়ে যাচ্ছে তা কিন্তু নয়। গাছপালা কেটে, নদীনালা বুজিয়ে তথাকথিত সভ্যতার উন্নয়নের ধ্বজা ওড়ানো চলছে বীরবিক্রমে। অন্যান্য প্রাণীও বাস্তুহারা হচ্ছে। চোখে পড়ে পাড়ার গলিতে ভিনদেশি সারস দাঁড়িয়ে, কোনোরকম জড়তা ছাড়াই। ভারি মুখে অভিমানের হিসাব, শরীরে উদ্বাস্তু মেজাজের ঝাঁজ। এমনই উদ্বাস্তু পাখির দুই ছানা চোখ না ফোটা অবস্থায় কল্পনার ফ্ল্যাটের ঘরে আশ্রয় পায়, দানা পায়, একে অপরের কাছে ভরসা পায়। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয়স্বজন যেখানে এই মেয়েকে ভরসা জোগাতে পারেনি, সেখানে চোখ না ফোটা পাখির ছানাদের সম্পর্ক গড়ে ওঠে।

কনেক্টিকাট মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিউ ইংল্যান্ড অঞ্চলের দক্ষিণে। এক প্রবাসী ভারতীয় পুরুষ আর ইতালিয়-আমেরিকান নারীর গোছানো দাম্পত্যের বাগানে মাঝেমধ্যেই চলে আসত একজন মা ভালুক। সন্তান সন্ততিদের সঙ্গে নিয়ে গভীর জঙ্গল থেকে কিছু খাবার আর এই পরিবারের সঙ্গে গড়ে ওঠা একান্ত সম্পর্ককে ছুঁতে আসত। এও এক উদ্বাস্তু পরম্পরা। ঠিক যেভাবে মেরুভালুক খাবারের সন্ধানে বেরিয়ে পড়ে। নিজের পরিচিত ভৌগোলিক স্থিতি যখন ওলটপালট হয়ে যায়। স্থিতি ফিরিয়ে আনার জন্যই বেরিয়ে পড়তে হয়, অজানা পথে মুখোমুখি হতে হয় কোনো ক্যামেরার লেন্সের।

এ কোনো টানটান অ্যাডভেঞ্চার উপন্যাস নয়। উনবিংশ শতাব্দীর মাঝামাঝি কোনো এক সময়ে ভারতের সিন্ধু প্রদেশ, বালুচিস্তান, রাজস্থান ও আফগানিস্তান থেকে অস্ট্রেলিয়ায় উট রপ্তানি হত ক্যারাভ্যান টানার জন্য। সঙ্গে যেতেন চালক। এই পেশার সঙ্গে যুক্ত মানুষ পরিচিত হন গনি হিসাবে। তাঁদের আস্তানার নাম হয় গনি টাউন। এই উটে চড়েই শ্বেতাঙ্গরা অনুর্বর মরু অঞ্চলে শ্বেত সভ্যতা বিস্তার শুরু করেছিল। ১৯৩৫-১৯৬০ সালে পরিবহন ব্যবস্থার পরিবর্তন হলে উটের প্রয়োজন ফুরোল, গনি টাউন ছন্নছাড়া হল। পোষা উট প্রতিপালক হারিয়ে বুনো হয়ে উঠল। ২০১৯ সালে ঊষর মরুপ্রান্তর ছেড়ে টিকে থাকার প্রয়োজনে জনবসতিপূর্ণ এলাকায় বুনো উট ঢুকে পড়লে খাবার ও জল সঙ্কট তৈরি হয়।সেই সঙ্কট মোকাবিলার সহজতম পথ হিসাবে ২০২০ সালের ৮ জানুয়ারি অস্ট্রেলিয় সরকার পাঁচদিন ধরে হেলিকপ্টার থেকে গুলি করে উট হত্যা করে। ঠিক কত উট হত্যা করা হয়েছিল তার কোনো হিসাব নেই। সংখ্যাটা পাঁচ হাজার হতে পারে, আবার দশ হাজারও হতে পারে বলে শোনা যায়।

ভোগবাদ প্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে প্রকৃতির দখল নিতে চায়, মানুষ বা জীবজন্তুর প্রাণের তোয়াক্কা করে না।এভাবেই আজ প্রকৃতি বিপর্যস্ত। এই লালসা এক প্রজন্মে শেষ হওয়ার নয়। বরং পৃথিবীর আয়ুক্ষয় ঘটানো লোভকেই স্বাভাবিক নীতি বানাতে চাইছে। ফলে বিশ্বজুড়ে জলবায়ু পরিবর্তন চরম আকার ধারণ করেছে। পার্মাফ্রস্ট পর্যন্ত অবিশ্বাস্য গতিতে গলতে শুরু করেছে, মেরুভালুককে বরফগলা জলেই অভ্যস্ত হতে হচ্ছে। ইতিমধ্যেই সম্মিলিত জাতিপুঞ্জ জানিয়েছে, ২০২৩-২৭ হতে চলেছে নথিবদ্ধ ইতিহাসে উষ্ণতম পাঁচ বছর। কী হবে তারপর?

তথ্যসূত্র:
১. ‘প্রাণ আপ্রাণ ও আমি মানব’ – গৌতম ভদ্র, কালধ্বনি (জানুয়ারি ২০২৩; ষড়বিংশ বর্ষ; তৃতীয় চতুর্থ সংখ্যা)
২. ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক, মে ২০২৩

নিবন্ধকার বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ও মানবাধিকার কর্মী। মতামত ব্যক্তিগত

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.