বিশ্বনাথ মন্দির তৈরি হয়েছিল আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায়, মনে করালেন মন্দিরের মহন্ত রাজেন্দ্রপ্রসাদ তিওয়ারি

আজাজ আশরফ

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

অযোধ্যার রাম জন্মভূমি – বাবরি মসজিদ বিতর্ক ভারতকে তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে অশান্ত করে রেখেছে। এ নিয়ে দাঙ্গা ও রক্তপাতে কয়েকশো মানুষ মারা গেছেন। ২০১৯ সালে সুপ্রিম কোর্টের রায়ের ফলে ওই বিতর্কিত জমি হিন্দুরা পেয়েছে। সমালোচনার অবকাশ থাকলেও ওই রায়ের পর অনেকেই আশা করেছিলেন যে ভারতে অতীত খুঁড়ে বিতর্ক তৈরি করার প্রবণতার অবসান হল এবং সামাজিক সমন্বয়ের যে ক্ষতি ইতিমধ্যেই হয়েছে, এবার থেকে তা মেরামত করার দিকে নজর দেওয়া হবে।

সে আশায় জল ঢালা হয় এ বছরের গোড়ার দিকে, যখন পাঁচজন মহিলা বারাণসীর নিম্ন আদালতে একটি পিটিশন দাখিল করেন। সেই পিটিশনে জ্ঞানবাপী মসজিদের পশ্চিমের দেওয়ালে মা শৃঙ্গার গৌরীর যে বিগ্রহ আছে তাকে এখনকার মত বছরে একদিন পুজো করার বদলে প্রতিদিন পুজো করার অধিকার দাবি করা হয়। ওই পিটিশন আরও বলে, জ্ঞানবাপী আসলে মসজিদ নয়, একটি মন্দির।

পিটিশনারদের যুক্তি হল, মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করেন এবং মন্দিরের ধ্বংসাবশেষের একটি অংশের উপরেই জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরি করা হয়। তাঁদের বক্তব্য, অষ্টাদশ শতাব্দীতে মসজিদের কয়েক মিটার দূরেই বিশ্বনাথ মন্দিরের পুনর্নির্মাণ হয়ে থাকলেও হিন্দুরা বরাবরই জ্ঞানবাপী মসজিদে মা শৃঙ্গার গৌরী সমেত দৃশ্যমান ও অদৃশ্য দেবতাদের (“visible and invisible deities”) পুজো চালিয়ে গেছে। নিম্ন আদালত এই পিটিশনের ভিত্তিতে জ্ঞানবাপী কমপ্লেক্সে একটি সার্ভে চালানোর আদেশ দেয়।

জ্ঞানবাপী মসজিদের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্বপ্রাপ্ত মসজিদ ইন্তেজামিয়া কমিটি এই পিটিশনের বিরোধিতা করে। তাদের যুক্তি ছিল, আদালত পিটিশনারদের রিলিফ দিতে পারে না, কারণ প্লেসেজ অফ ওয়ারশিপ অ্যাক্ট, ১৯৯১ অনুসারে কোনো উপাসনাস্থলের ধর্মীয় চরিত্র ১৫ অগাস্ট ১৯৪৭ তারিখে যা ছিল তা-ই রাখতে হয়, বদলানো যায় না। সুপ্রিম কোর্টে এই মামলা পৌঁছলে আদালত বলে, ১৯৯১ সালের ওই আইনে কোনো উপাসনাস্থলের ধর্মীয় চরিত্র নির্ধারণে (“ascertainment”) বারণ নেই। সর্বোচ্চ আদালত জেলা আদালতকে ওই পাঁচ মহিলার পিটিশন গ্রহণযোগ্য (“maintainable”) কিনা তা বিচার করতে বলে

এই মামলাগুলো বিশ্বনাথ টেম্পল করিডোর নির্মাণের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে যুক্ত। এই প্রকল্প প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদীর অতি প্রিয়। এই করিডোর নির্মাণের উদ্দেশ্য গঙ্গাতীর থেকে বিশ্বনাথ মন্দির পর্যন্ত সোজা, বাধাহীন রাস্তা তৈরি করা। যখন এই করিডোরের জন্য জায়গা খালি করতে বহু ঐতিহাসিক ইমারত ও মন্দির ভেঙে ফেলা হচ্ছিল, অনেকেই মনে করেছিলেন জ্ঞানবাপী মসজিদও ধ্বংসকার্যের লক্ষ্য হয়ে দাঁড়াবে। এই মসজিদকে হিন্দুদের সম্পত্তি বলে দাবি করা শুরু হয়েছে। এ যেন রাম জন্মভূমি – বাবরি মসজিদ বিতর্কেরই পরবর্তী সংস্করণ।

হঠাৎ জ্ঞানবাপী মসজিদ উত্তেজনার কেন্দ্রবিন্দু হয়ে উঠল কেন? জ্ঞানবাপীর অতীত এবং বিশ্বনাথ মন্দিরের কাছাকাছি অবস্থান এর আগে বারাণসী বা ভারতের মানুষকে অস্থির করে তোলেনি কেন? মোগলরা, আরও নির্দিষ্টভাবে বললে ঔরঙ্গজেব, কি কয়েক শতাব্দী আগে বারাণসীর হিন্দুদের উপর অত্যাচার চালিয়েছিলেন?

এইসব প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়েছিলাম রাজেন্দ্রপ্রসাদ তিওয়ারির কাছে। তিনি বিশ্বনাথ মন্দিরের মহন্ত এবং তাঁদের পরিবার কয়েক শতাব্দী ধরে শিবঠাকুরের এই পবিত্র বাসস্থানের দায়িত্বে রয়েছে। মোগল সম্রাটদের শাসনকাল এবং বিশ্বনাথ মন্দিরের উত্থান-পতন সম্পর্কে হিন্দুদের লিখিত ও অলিখিত সমষ্টিগত স্মৃতিতে ডুব দিয়ে রাজেন্দ্রপ্রসাদ অতীত ও বর্তমানের এক আশ্চর্য ছবি তুলে আনলেন। এই কথোপকথন হয়েছিল হিন্দি ভাষায় এবং ইংরেজি ভাষান্তর তাঁকে দিয়ে অনুমোদন করিয়ে নেওয়া হয়। নিউজক্লিকে প্রকাশিত সেই ইংরেজি সংস্করণের এই বাংলা ভাষান্তর নিউজক্লিকের অনুমতিক্রমে প্রকাশিত হল।

১৬৬৯ সালে ঔরঙ্গজেব যে বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করেন তা তৈরি হয়েছিল মারাঠি ব্রাহ্মণ পণ্ডিত নারায়ণ ভট্ট ও রাজা টোডরমলের অধীনে সম্রাট আকবরের পৃষ্ঠপোষকতায় ১৫৯৫ সালে। ভারত এবং বারাণসীর সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে এই তথ্য স্পষ্ট করে প্রোথিত নেই। এর কারণ কী?

সাধারণ মানুষের স্মৃতিতে তা-ই থাকে যা সিস্টেম সেখানে ঢুকিয়ে দেয়। সিস্টেম যা চায় লোকে আসলে সেটাই মনে রাখতে পারে।

“সিস্টেম” বলতে কী বোঝাচ্ছেন?

যারা ইতিহাস পড়ে, যারা ইতিহাস পড়ায় আর যারা স্মৃতি গড়ে তোলে – সিস্টেম তাদের নিয়ে তৈরি। তাদের মধ্যে এমন লোক থাকে যারা আমাদের জানা অতীতের সমস্ত দিক বিচার করে দেখে। কিন্তু আরেক ধরনের লোকও থাকে যাদের ইতিহাস পাঠ একেবারে অগভীর। তারা নিজেদের এজেন্ডা অনুযায়ী ইতিহাসকে সাজিয়ে নেওয়ার জন্য অতীতের সাক্ষ্যপ্রমাণ থেকে বেছে বেছে দৃষ্টান্ত তুলে আনে।

এই ধরনের লোকেদের জন্য মোগল যুগের ইতিহাস শুরু হয় ১৬৬৯ সালে ঔরঙ্গজেবের নির্দেশে বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস দিয়ে। তার আগেও কিছু নেই, পরেও কিছু নেই। তারা কখনো বলবে না যে আকবর এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন। তার কারণ তাদের উদ্দেশ্য একটা মুসলমানবিরোধী আবহাওয়া তৈরি করা আর হিন্দুদের আবেগকে ব্যবহার করে ভোট আদায় করা।

চার-পাঁচশো বছর আগে ছিল বাদশাহী বা রাজতন্ত্র। তার মানেই তো একনায়কতন্ত্র। এখন আমরা গণতন্ত্রের যুগে, আইনের শাসনের যুগে বাস করছি। আজকের শাসককে সংবিধান মেনে চলতেই হবে। এরা ক্ষমতায় এসেছে লোকে ভোট দিয়েছে বলে। কিন্তু এদের কাজকর্ম রাজতান্ত্রিক শাসনকেই মনে করাচ্ছে। সংবিধানকে পিষে ফেলতেই এরা মুসলমানবিরোধী আবহাওয়া তৈরি করছে।

আপনি “এরা” বলতে কি ভারতীয় জনতা পার্টি আর রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘকে বোঝাচ্ছেন?

নিশ্চয়ই। ওরাই তো ক্ষমতায় আছে।

আচ্ছা, আকবরের পৃষ্ঠপোষকতা কি বিশ্বনাথ মন্দিরের গুরুত্ব বাড়িয়ে দিয়েছিল?

বিশ্বনাথের শিবলিঙ্গ হল স্বয়ম্ভূ। এই শিবলিঙ্গ স্মরণাতীত কাল থেকে এখানেই রয়েছে, সুতরাং বিশ্বনাথের গুরুত্ব চিরকালই ছিল। কিন্তু আকবরই প্রথম লোক যিনি ওই শিবলিঙ্গের গৃহ হিসাবে একটা বড়সড় মন্দির তৈরি করিয়ে দেন। ফলে সেই মন্দির ঐতিহাসিক আর সেই মন্দিরই ঔরঙ্গজেব ধ্বংস করেন।

এখানে আরেকটু বিশদে ইতিহাসের কথা বলি। শাহজাহানের বড় ছেলে দারাশিকো, যাঁকে আকবরের যোগ্য উত্তরাধিকারী মনে করা হত, তিনি বারাণসীতে এসেছিলেন সংস্কৃত আর প্রাচীন হিন্দু ধর্মগ্রন্থ, শাস্ত্র ইত্যাদি পড়তে। দারাকে যাঁরা পড়িয়েছিলেন সেই পরিবারের সদস্যরা এখনো বারাণসীতেই থাকেন।

তাই নাকি? তাঁদের পরিচয়?

[প্রয়াত কংগ্রেস নেতা] কমলাপতি ত্রিপাঠীর পরিবার। তাঁর এক পূর্বপুরুষই দারাশিকোর গুরু ছিলেন। গুরুদক্ষিণা হিসাবে দারা নিজের একটা কোঠি ত্রিপাঠী পরিবারকে দেন। সেটা বারাণসীর ঔরঙ্গাবাদ এলাকায়।

এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, দারাশিকো আমাদের পরিবারকে যে পাট্টা দিয়েছিলেন সেটা কিন্তু এখনো আমার কাছে আছে।

এই পাট্টা কিসের?

এই পাট্টার মাধ্যমে দারাশিকো বিশ্বনাথ মন্দিরের দায়িত্ব আমার পূর্বপুরুষদের হাতে তুলে দেন। পাট্টায় লেখা আছে যে তাঁরা শৈব সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজন। তাই এই মন্দির এবং এর আচার অনুষ্ঠানের ধারা আমাদের হাতে নিরাপদ।

ঔরঙ্গজেব দারাকে হারিয়ে দিয়ে হত্যা করার পর আপনার পরিবার কী করল?

সিংহাসনে বসার পর যে দারার সমর্থক বা কোনোভাবে দারাকে সাহায্য করেছিল অথবা যার দারার সাথে সুসম্পর্ক ছিল বলে ঔরঙ্গজেবের মনে হয়েছিল, তাদের সকলকে উনি আক্রমণ করেন। উনি মনে করতেন তারা সবাই ওঁর প্রতিপক্ষ। আমাদের পারিবারিক স্মৃতি বলে বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করার কারণও এটাই।

আমাদের পরিবারের ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে লড়াই করার শক্তি ছিল না। যখন বোঝা গেল যে মন্দিরটা ভেঙে ফেলা হবে, তখন আমার পূর্বপুরুষরা শিবলিঙ্গটা তুলে নিয়ে গিয়ে নিজেদের কাছে রাখেন যাতে ওটা সুরক্ষিত থাকে। এখনকার বিশ্বনাথ মন্দিরে যে শিবলিঙ্গ রয়েছে সেটা আমার পূর্বপুরুষদের প্রতিষ্ঠিত করা সেই শিবলিঙ্গ। তাঁরা ঠিক যেখানে বসিয়েছিলেন সেখানেই আছে।

ওখানে কি আরেকটা মন্দির ছিল?

না। শিবলিঙ্গটা আমাদের বাড়িতে রাখা ছিল। কোথায় আছে তা আমরা প্রকাশ করিনি। তার ফলে মুখে মুখে রটেছিল যে ধ্বংস হওয়া মন্দিরের মহন্ত শিবলিঙ্গ নিয়ে কুয়োয় ঝাঁপ দিয়েছে। বারাণসীর লোককথার অঙ্গ হয়ে গেছে এই গল্প। কিন্তু আসলে তেমন কিছু ঘটেনি। ১৭০৭ সালে ঔরঙ্গজেব মারা যাওয়ার পর আমাদের পরিবার লোকজনকে জানায় শিবলিঙ্গ কোথায় আছে। তখন সকলে আমাদের বাড়িতে দর্শন করতে আসে।

অহল্যাবাঈ হোলকার [হোলকার রাজপরিবারের সদস্যা; ১৭২৫-১৭৯৫] ছিলেন শৈব। তিনি স্বপ্নাদেশ পান যে ওই শিবলিঙ্গের গৃহ হিসাবে একটা নতুন মন্দির বানিয়ে দিতে হবে। তিনি আমাদের পরিবারকে অনুরোধ করেন, আমরা যেন বাড়ির যে অংশে শিবলিঙ্গ রয়েছে সেই অংশটা তাঁর হাতে তুলে দিই। আমরা তাই করি। সেখানেই নতুন মন্দির তৈরি হয়। বিশ্বনাথ মন্দিরের এখনকার জায়গায় একটা পাথরের ফলক আছে, যাতে মন্দিরের অতীত লেখা আছে। ভাগ্যিস বিশ্বনাথ করিডোর তৈরি করার সময়ে ওই ফলকটা তুলে ফেলা হয়নি বা ভেঙে ফেলা হয়নি। অনেক মন্দিরই তো ওই করতে গিয়ে ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে

দারাশিকো আমাদের পরিবারকে যে পাট্টা দিয়েছিলেন সেটা কিন্তু এখনো আমার কাছে আছে… এই পাট্টার মাধ্যমে দারাশিকো বিশ্বনাথ মন্দিরের দায়িত্ব আমার পূর্বপুরুষদের হাতে তুলে দেন। পাট্টায় লেখা আছে যে তাঁরা শৈব সম্প্রদায়ের বিশিষ্টজন। তাই এই মন্দির এবং এর আচার অনুষ্ঠানের ধারা আমাদের হাতে নিরাপদ।

২৮ ফেব্রুয়ারি ১৬৫৮ তারিখে ঔরঙ্গজেব একটা ফরমান জারি করেন। সেটা এখনো বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। সেই ফরমানে বলা হয়েছিল পুরনো মন্দির এবং ব্রাহ্মণ পুরোহিতদের রক্ষা করা উচিত। কিন্তু তিনি ভোল পালটে বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করেন। অথচ কয়েক বছর পরে জঙ্গমবাদী মঠকে সাহায্য করেন, কুমারস্বামী মঠ নামে এক নতুন মঠ প্রতিষ্ঠার কাজেও সাহায্য করেন। আবার কেদার মন্দিরের সংস্কারের অনুমতিও দেন। এগুলো…

ঔরঙ্গজেব জঙ্গমবাদী মঠকে চার-পাঁচ বিঘা জমি দিয়েছিলেন আর রাজকোষ থেকে কিছু টাকাও দিয়েছিলেন যাতে লিঙ্গায়তরা শিবপুজো এবং সংস্কৃত পুঁথির পাঠ চালিয়ে যেতে পারে। ঔরঙ্গজেবের পাট্টা এখনো জঙ্গমবাদী মঠে আছে। ২০১৮ বা ১৯ সালে যোগী আদিত্যনাথ [উত্তরপ্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী] ওই মঠে গিয়েছিলেন। মঠের লোকেরা আমাকে বলেছে উনি ওই পাট্টাটা ওখান থেকে সরিয়ে ফেলতে চাইছিলেন। কিন্তু ওই পাট্টা তো ঐতিহাসিক নথি। আদিত্যনাথ চায় বলেই ইতিহাস থেকে বা আমাদের স্মৃতি থেকে ওটা মুছে ফেলা যায় না।

এই ঘটনাটাই প্রমাণ করে আসলে যা যা করা হচ্ছে সবই একটা নির্দিষ্ট বয়ান তৈরি করার স্বার্থে করা হচ্ছে। ইতিহাস ঔরঙ্গজেবকে একজন একনায়ক, অত্যাচারী রাজা হিসাবে দেখিয়েছে। সেটা করা খুব সহজও বটে। এটা তো ঠিকই যে উনি নিজের ভাইদের খুন করেছিলেন আর বাবাকে গারদে পুরেছিলেন। বিশ্বনাথ মন্দির তাঁর আমলেই ধ্বংস করা হয়েছিল। বিজেপি-আরএসএস ঔরঙ্গজেবের প্রচলিত ভাবমূর্তির সঙ্গে মন্দির ধ্বংসের ঘটনাকে জুড়ে তাঁকে আক্রমণ করে আর ঔরঙ্গজেবকে আক্রমণ করার মধ্যে দিয়ে ভারতের মুসলমানদের আক্রমণ করে। হিন্দুত্ব এজেন্ডা সফল করার জন্য ঔরঙ্গজেবকে দানব বানানো ওদের ড্রিম প্রোজেক্ট। (হাসি)

তাহলে এককথায় আপনি বলছেন ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকাল পুরোপুরি অন্ধকার সময় বা পুরোপুরি অশুভ নয়। তাই তো?

আরেকরকমভাবে দেখুন। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে বারাণসীতে একটা মন্দির ভাঙা হয়েছিল। ঐতিহাসিকরা নিশ্চয়ই একমত হবেন যে ঔরঙ্গজেব সশরীরে এসে মন্দিরটা ধ্বংস করে গিয়েছিলেন এরকম সম্ভাবনা কম। তবুও ওই ধ্বংসের দায়িত্ব তাঁর ঘাড়েই চেপেছে। তা নিয়ে আজকে প্রচুর অশান্তি হচ্ছে।

একইভাবে বিশ্বনাথ করিডোর তৈরি করতেও প্রচুর প্রাচীন মন্দির ধ্বংস করা হয়েছে। এই ধ্বংসের দায়িত্বও মোদীর ঘাড়ে চাপা উচিত। প্রায় ২৮৬টা শিবলিঙ্গ উপড়ে ছুঁড়ে ফেলে দেওয়া হয়েছে। কয়েকটা তো নর্দমায় ফেলা হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ১৪৬টা শিবলিঙ্গ উদ্ধার করা গেছে। বলা বাহুল্য আমি ঔরঙ্গজেবের বিশ্বনাথ মন্দির ধ্বংস করা দেখিনি। কিন্তু আমি মোদীর দলবলকে হিন্দুদের আবেগের তোয়াক্কা না করে ঐতিহাসিক মন্দিরে প্রতিষ্ঠিত শিবলিঙ্গকে অসম্মান করতে দেখেছি। মোদী কোনো হিন্দুই নয়। হিন্দুইজম স্রেফ ওঁর আর ওঁর পার্টির ব্যবসা। সোজাসুজি বলছি, মোদী ঔরঙ্গজেবের চেয়ে বেশি মন্দির ধ্বংস করেছেন।

আচ্ছা, উদ্ধার হওয়া ওই ১৪৬টা শিবলিঙ্গ এখন কোথায়?

ওগুলো লঙ্কার [বারাণসীর একটি এলাকা] থানায় আছে। থানাতেই রোজ পুজো হয়।

ঔরঙ্গজেব জঙ্গমবাদী মঠকে চার-পাঁচ বিঘা জমি দিয়েছিলেন আর রাজকোষ থেকে কিছু টাকাও দিয়েছিলেন যাতে লিঙ্গায়তরা শিবপুজো এবং সংস্কৃত পুঁথির পাঠ চালিয়ে যেতে পারে। ঔরঙ্গজেবের পাট্টা এখনো জঙ্গমবাদী মঠে আছে।

বিশ্বনাথ মন্দির ভেঙে ফেলার পর মন্দিরের ধ্বংসাবশেষেরই একটা অংশের উপর জ্ঞানবাপী মসজিদ তৈরি করা হয় এবং মন্দিরের একটা দেওয়ালকেই মসজিদের কিবলা দেওয়াল (মক্কার দিকে মুখ করে থাকা দেওয়াল) করে দেওয়া হয়। ধ্বংসাবশেষের বাকি অংশে পুজো চালু ছিল আর সেখানে একটা পিপুল গাছ গজাচ্ছিল, যার নিচে একটা বিগ্রহ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছিল। এগুলো কি সত্যি কথা?

জ্ঞানবাপী মসজিদের বাইরের ময়দানে চারটে পিপুল গাছ ছিল। এখন মোটে একটা পড়ে আছে। বিশ্বনাথ করিডোর করতে গিয়ে বাকি তিনটে কাটা পড়েছে। তার একটার নিচে মহেশ্বর মহাদেবের একটা শিবলিঙ্গ ছিল। কিন্তু সেটাকে ভেঙে ফেলে দেওয়া হয়েছে। ওরা নিজেরা কতগুলো মন্দির ভেঙেছে তা কখনো বলে না। শুধু সেইটুকুই বলে যেটুকু বললে নিজেদের লাভ।

আপনি বিশ্বনাথ করিডোরের এত বিরোধী কেন?

আমি উন্নয়নের বিরোধী নই। উন্নয়নের নামে যে ভাঙচুর চালানো হয়েছে তার বিরোধী। ওই করিডোর বারাণসীর প্রাচীন পরিচয়টাই নষ্ট করে দিয়েছে এবং যাকে এই শহরের আধ্যাত্মিক-ধার্মিক পরিকাঠামো বলা যায় সেটাও ধ্বংস করে দিয়েছে। সোজা কথায়, আমি মন্দিরগুলোকে মলের মত চেহারা দেওয়ার বিরোধী। এসব কোনোদিনই মেনে নেব না।

বিগ্রহ প্রতিষ্ঠিত আছে এমন ঐতিহাসিক মন্দির, ঘরবাড়ি ধ্বংস বন্ধ করতে আপনি আদালতে যাননি?

করিডোর তৈরিতে গতি এসেছে ২০১৮ সালে। বেশি গুরুত্বপূর্ণ মন্দিরগুলোকে বাঁচাতে আদালতে পিটিশন দাখিল করা হয়েছিল। সেই পিটিশনগুলোর শুনানিই হয়নি। জ্ঞানবাপী মসজিদের পিটিশন নিয়ে আদালত যে অধ্যবসায় আর গতি দেখাচ্ছে তা ওই পিটিশনগুলোর বেলায় দেখিনি। মুসলমান আর হিন্দুদের ফাইল করা পিটিশনে পরস্পরবিরোধী প্রতিক্রিয়া দেখা যাচ্ছে।

হিন্দুরা কি কখনো জ্ঞানবাপী মসজিদের ভিতরে উপাসনা করতেন?

কখনোই না। কিন্তু মসজিদের ভিতর নমাজ পড়া হত এবং এখনো হয়। পূজাপাঠ আর রামলীলা মসজিদের বাইরে জ্ঞানবাপী ময়দানে হত। ওটা এখন বিশ্বনাথ মন্দির কমপ্লেক্সের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে। মসজিদটাও তাই।

কিন্তু পাঁচজন মহিলা বারাণসীর নিম্ন আদালতে একটা পিটিশন ফাইল করেছেন, যেন তাঁদের বছরে একবারের বদলে রোজ মা শৃঙ্গার গৌরীকে পুজো করতে দেওয়া হয়। তাঁরা দাবি করেছেন আবহমানকাল ধরে হিন্দুরা ওখানে হনুমান, গণেশ এবং অন্যান্য দৃশ্যমান ও অদৃশ্য দেবতাদের পুজো করে আসছেন।

মসজিদের বাইরের দেওয়ালে, মানে পশ্চিমের দেওয়ালে, একটা এক ফুট লম্বা শৃঙ্গার গৌরীর বিগ্রহ আছে। মসজিদের ভিতরে নয়। আমি ছোটবেলা থেকে দেখে আসছি বছরে এক দিন, মানে চৈত্র নবরাত্রির চতুর্থ দিনে [এ বছর দিনটা ছিল ৪ এপ্রিল] মানুষ শৃঙ্গার গৌরীর দর্শন এবং পুজোর জন্য আসে। এই পিটিশনার মহিলারা সকলেই কোনো না কোনোভাবে আরএসএস আর তার বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত। পরিষ্কার কথা, এরা মিথ্যে বলছে।

চতুর্দিকেই ভণ্ডামি। যেমন ধরুন করিডোর বানানোর জন্য যে ভাঙাভাঙি চালু করা হয়েছিল, তাতে ওরা ছপ্পন বিনায়ক [গণেশ ঠাকুর] মন্দির ভেঙে ফেলার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। আমরা বিরোধিতা করেছিলাম। বারাণসীর বাসিন্দা রমেশ উপাধ্যায় আর কয়েকজন উকিল মিলে একটা পিটিশন ফাইল করেছিলেন। বক্তব্য ছিল তাঁদের প্রতিদিন ছপ্পন বিনায়কের পুজো করার অধিকার আছে। এই অধিকারও আবহমানকাল ধরে চালু আছে। [ওই পিটিশন গ্রাহ্য হলে ছপ্পন বিনায়ক মন্দির ভাঙা আটকে যেত]।

জেলা জজ সঙ্গে সঙ্গেই প্রশাসনকে নোটিস দেন। দুদিনের মধ্যে তাঁর ট্রান্সফার হয়ে গেল। তার বদলে অন্য একজন জজ এলেন। এই নতুন জজ পিটিশনারদের বললেন তাঁদের মামলা উন্নয়নের পথে বাধা হয়ে দাঁড়াতে পারে না!

জ্ঞানবাপী নিয়ে যে পাঁচজন মহিলা পিটিশন ফাইল করেছেন তাঁদের মামলা কিন্তু ছপ্পন বিনায়ক কেসের মামলার পিটিশন যা দাবি করছিল তা-ই দাবি করছে। সুপ্রিম কোর্ট কেসটাকে লোয়ার কোর্ট থেকে জেলা কোর্টে ট্রান্সফার করে দিল, আর জেলা কোর্ট বলল এই মামলা প্লেসেজ অফ ওয়ারশিপ অ্যাক্ট, ১৯৯১-এর আওতায় পড়ে না, অতএব গ্রহণযোগ্য। আমি কী বলছি বুঝলেন তো? এক দল হিন্দুর মামলা বাতিল করে দেওয়া হল, আরেক দল হিন্দুর মামলা গ্রহণযোগ্য হল। এ হল একই ধরনের দুটো কেসে দুটো আলাদা নীতি প্রয়োগের উদাহরণ। এর বেশি কিছু বলার দরকার আছে কি?

এ বছর বারাণসীর লোয়ার কোর্ট জ্ঞানবাপী মসজিদ চত্বরে একটা সার্ভে করিয়েছে। দাবি করা হয়েছে যে মসজিদে ওজু করার জন্যে যে জলের ট্যাঙ্ক আছে, তার মধ্যে একটা শিবলিঙ্গ পাওয়া গেছে।

কোনখানে আছে সেটা সবাইকে দেখানো উচিত। আমার জীবনে চার-পাঁচবার জলের ট্যাঙ্কটা পরিষ্কার করা হয়েছে। কোনোদিন কোনো শিবলিঙ্গ পাওয়া যায়নি।

মুসলমানদের পক্ষ থেকে দাবি করা হয়েছে যেটাকে শিবলিঙ্গ বলা হচ্ছে সেটা আসলে একটা ফোয়ারা।

এ ব্যাপারে আমার কী মত সে কথা না হয় বাদ দিন। যুক্তি দিয়ে বিচার করে দেখা যাক। সার্ভে কমিশনার বলেছেন জলের ট্যাঙ্কের মধ্যে একটা লম্বাটে জিনিসের ভিতরে [যেটাকে মুসলমানরা ফোয়ারা বলছেন] একটা গর্ত ছিল। তিনি তার মধ্যে একটা শিক ঢুকিয়েছিলেন। শিকটা নাকি ৬৩ সেন্টিমিটার পর্যন্ত [২৪ ইঞ্চি] ঢুকে গেছিল। ওই জিনিসটা যদি সত্যিই শিবলিঙ্গ হয়, তাহলে ওতে একটা যোনি থাকবে। যোনি ছাড়া শিবলিঙ্গ হয় না। তদন্ত করে দেখা উচিত ওটা ঠিক কী জিনিস। তারপর সত্যিটা মানুষকে জানানো উচিত। স্রেফ লোককে বোকা বানানোর জন্য গুজব ছড়ানো উচিত নয়।

আসলে এই গুজব ইচ্ছাকৃতভাবে ছড়ানো হয়েছিল একটা নির্দিষ্ট বয়ান তৈরি করার জন্যে। কোনো একজন সার্ভেয়ার বলেছে বলেই আমাদের তাকে বিশ্বাস করতে হবে নাকি? মিডিয়া বলেছে বলেই আমরা বিশ্বাস করে নেব ওটা শিবলিঙ্গ? কাল যদি মিডিয়া বলে মোদী ভগবান রামের অবতার, আমরা কি মেনে নেব?

মনে হচ্ছে আপনি বিশ্বাস করেন মিডিয়া বিজেপির পক্ষ নিয়ে কথা বলে?

মিডিয়া তো বিজেপির পকেটে। মিডিয়াটা ওদেরই। এই মিডিয়া কখনো বিজেপিকে কোনো প্রশ্নের মুখে ফেলে? মোদী সরকার মিথ্যে কথা বললেও মিডিয়া সেটাকেই সত্যি বলে প্রমাণ করার চেষ্টা করে।

আপনি কি এখনো করিডোরের বিপক্ষে?

করিডোরের পরিকল্পনা যখন করা হয় এবং কাজ শুরু হয়, আমি তখন বিরোধী ছিলাম। আমার বিরোধিতার কারণ আমি প্রতিষ্ঠা করতে পেরেছি। কিন্তু এখন তো ওরা করিডোর বানিয়েই ফেলেছে। আর আমার বিরোধিতায় কী হবে? ওরা নিজেদের ক্ষমতার অপব্যবহার করে করিডোর তৈরির মিশন সফল করেছে।

বারাণসীর মানুষ করিডোরের বিরুদ্ধে আপনার আন্দোলনকে সমর্থন করেনি কেন?

ওরা [সংঘ পরিবার] তো হিন্দুদের সমষ্টিগত মগজধোলাই করেছে। তবে ভাববেন না লোকে আমাদের সমর্থন করেনি। প্রয়াত শঙ্করাচার্য স্বরূপানন্দ সরস্বতীকে নিয়ে আমরা ২০১৮-১৯ সালে একটা বিরাট ধর্ম সংসদ করেছিলাম। আমাদের আপত্তিগুলো শোনার বদলে গোটা মিডিয়া শঙ্করাচার্যকে কংগ্রেসি বলে অভিযুক্ত করতে ব্যস্ত ছিল।

আপনার উপর চাপ সৃষ্টি করা হয়নি হাল ছেড়ে দেওয়ার জন্যে?

প্রচণ্ড চাপ দেওয়া হয়েছিল। আমার বাড়ির চারদিকে ওরা গর্ত খুঁড়ে দিয়েছিল। আমাকে বাড়ি বেচে দিয়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে বলেছিল। আমার বাড়ি কিন্তু করিডোরের মধ্যে পড়েনি, তবুও। শেষ অব্দি বাড়িটা ভেঙেই দিল। ওদের বোধহয় ভয় ছিল আমি ওখানে থাকলে করিডোর তৈরির কাজে বাধা দেব।

কোনো হুমকি-টুমকি পাননি?

ফোনে অনেকবার হুমকি দেওয়া হয়েছে। এমনকি লোকসভা নির্বাচনের আগে আদিত্যনাথ আমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছিলেন। আমাদের প্রায় ৩০-৪৫ মিনিট কথা হয়। আমাকে সম্মান দিয়েই কথা বলেছে। মুখোমুখি তো ওরা ওইভাবেই কথা বলে। তা বলে আমার আপত্তিগুলোকে কিন্তু পাত্তা দেয়নি।

আমার বাড়ির চারদিকে ওরা গর্ত খুঁড়ে দিয়েছিল। আমাকে বাড়ি বেচে দিয়ে অন্য জায়গায় চলে যেতে বলেছিল। আমার বাড়ি কিন্তু করিডোরের মধ্যে পড়েনি, তবুও। শেষ অব্দি বাড়িটা ভেঙেই দিল।

করিডোর যখন তৈরি হচ্ছিল তখন কি অন্যদের মত আপনিও ভেবেছিলেন জ্ঞানবাপী মসজিদকে টার্গেট করা হবে?

২০১৯ সালে রাম জন্মভূমি – বাবরি মসজিদ মামলার রায় বেরোবার কয়েক মাস আগেই আমি একটা সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছিলাম যে অযোধ্যার বিতর্কিত জমি সম্ভবত হিন্দুদেরই দেওয়া হবে। ফলে ওই ইস্যুটা ব্যবহার করে আর ভোট আদায় করা যাবে না। সুতরাং ওরা বারাণসীতে আসবে মন্দির-মসজিদ এজেন্ডা নিয়ে। আমার আশঙ্কা ঠিক প্রমাণিত হয়েছে।

যখন বিশ্বনাথ করিডোরের পরিকল্পনা করা হয়েছিল আর প্ল্যানটা প্রকাশ করা হয়েছিল, জ্ঞানবাপী মসজিদের দেখভাল করে যে মসজিদ ইন্তেজামিয়া কমিটি, তাদের একজন সদস্যকে আমি বলেছিলাম করিডোরের বিরুদ্ধে ওঁদের পরিষ্কার অবস্থান নিতে হবে। নইলে বিজেপি-আরএসএসের জালে জড়িয়ে পড়বেন। এই কথাটাও ঠিক প্রমাণিত হয়েছে।

মানে আপনি বলছেন মুসলমানরা এই করিডোর তৈরি করার প্ল্যান সম্পর্কে চুপ ছিল?

আসলে প্রশাসন ইন্তেজামিয়া কমিটিকে খুশি রাখার জন্যে ওঁদের সম্মান করে চলছিল, নিশ্চিন্ত করছিল। এক দিক থেকে ওঁদের চুপ করে থাকা স্বাভাবিক। কারণ মসজিদটাকে ভেঙে ফেলার জন্যে চিহ্নিত করা হয়নি। হয়ত ওঁরা ভেবেছিলেন ওঁদের যখন কিছু এসে যায় না তখন এই ইস্যু নিয়ে মাথা ঘামিয়ে প্রশাসনের বিষনজরে না পড়াই ভাল।

এখন যেরকম মুসলমানবিরোধী আবহাওয়া, তাতে ওঁরা হয়ত ভেবেছিলেন চুপ করে থাকাই বুদ্ধিমানের কাজ।

আপনি যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই ভয় পেয়ে যান তাহলে তো আর লড়তে পারবেন না। ওরা তো আমার উপরেও ভীষণ চাপ দিয়েছে, কিন্তু আমি লড়ে গেছি। আজ আমি একমাত্র লোক যে এখনো বিশ্বনাথ করিডোরের বিপক্ষে কথা বলছে। এমনকি করিডোরের বিরুদ্ধে আমাদের আন্দোলনে যারা সঙ্গে ছিল তারাও চুপ করে গেছে। আমি আমার লড়াইয়ে সফল হতে পারিনি ঠিকই, কিন্তু ইতিহাস তো মনে রাখবে অন্তত একজন লোক ছিল যে একরোখা হয়ে করিডোর তৈরি করার জন্যে প্রাচীন মন্দির ধ্বংস করার বিরোধিতা করে গেছে।

আরো পড়ুন বিলকিস বানো: ছাত্রীর সঙ্গে অসমাপ্ত আলোচনা

যেখানে যেখানে মন্দির ছিল বলে মনে হয় সেই জায়গাগুলো পুনর্দখল করার বিজেপির যে চেষ্টা, সেটা কি আমাদের ভবিষ্যৎ আরও জটিল করে তুলবে না? যেমন ধরুন প্রত্নতাত্ত্বিকরা তো প্রমাণ করেছেন যে অনেক বৌদ্ধ স্তূপকেই হিন্দু মন্দিরে পরিণত করা হয়েছিল। আমাদের ইতিহাসে যত অন্যায় ঘটেছে সেগুলোর এখন প্রতিকার করতে গেলে উপাসনাস্থল নিয়ে নতুন নতুন বিতর্ক তৈরি করায় উৎসাহ দেওয়া হবে না?

অতীতের অন্যায়ের প্রতিকার করা কখনোই সম্ভব নয়। ইতিহাস থেকে আপনি শুধু শিক্ষা নিতে পারেন। সেটা ভাল শিক্ষা, মন্দ শিক্ষা যা-ই হোক। যারা ঐতিহাসিক অন্যায়ের প্রতিকার করতে চায় তারা নতুন ইতিহাস লিখতে পারে না। তারা শুধু আগুনে ঘি ঢালে; সমাজে বিষ ছড়ায়। আপনি যদি ঔরঙ্গজেবের ভুলগুলোর পুনরাবৃত্তি করেন তাহলে তাঁর থেকে উন্নত হতে পারবেন না। একটা ৩০০-৪০০ বছরের পুরনো ইস্যুকে খুঁচিয়ে তুলে কোনো লাভ হবে? তাহলে সমাজের কী হবে ভাবুন। আমাদের সকলের উচিত সমাজের এখনকার অবস্থার উন্নতির কথা ভাবা এবং উন্নতির চেষ্টা করা। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি না থাকলে কোনো দেশ উন্নতি করতে পারে না।

ভাষান্তর: প্রতীক

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

1 মন্তব্য

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.