সৌভিক গুহসরকার

গাঢ় মেঘে আকাশ ঢেকেছিল বাংলার জনপদের। শ্বেতকরবীর মালার মতো বকের সারি কাজলকান্ত মেঘের নূপুর ঘেঁষে উড়ে চলেছিল বিপুল অম্বর পেরিয়ে আম জাম হরিতকী বাতাবির বনে। পিতামহ বাতাসের আদরে খেলা ক‍রছিল নাতি-নাতনির মতো ধান্যক্ষেত্র। ঐ কারা ভ্রমরপংক্তির মতো আসে এই বাংলার আলুলায়িত শ্যামল পথে? তোমরা জানো না কি প্রসিদ্ধ বণিক শীর্ষগুপ্ত ও তার বিরাট দল দাক্ষিণাত‍্যের চালুক‍্য প্রদেশ থেকে বাণিজ‍্য সেরে ফিরছে গৌড়ের রাঙা ধুলোয়? তাদের গন্তব্য কর্ণসুবর্ণের কিনারে অবস্থিত মধুহাটি উপনগর। সেইখানে বিপুল বিলাস ও সমৃদ্ধির মধ্যে থাকে শীর্ষগুপ্ত। সে রাজা শশাঙ্কের প্রিয়জন, তাঁর বণিকসভার অগ্রগণ্য সদস্য। বাণিজ্যের সঙ্গে সঙ্গে গুপ্তচরের মত অন্যান্য রাজ্যের ভেতরকার রাজনৈতিক খবরও সে এনে দেয় রাজা শশাঙ্কের কাছে।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

শীর্ষগুপ্তর বয়স মাত্র পঁয়ত্রিশ, অথচ বিদগ্ধ বণিক হয়ে উঠেছে এর মধ্যেই। শৈশবে মাতৃহারা ও যৌবনে পিতৃহারা শীর্ষ নিজের বুদ্ধিতে বাণিজ‍্যে প্রভূত ধন উপার্জন করেছে। সে নিজেকে ক্রমাগত তীক্ষ্ণ করে তুলেছে গভীর অনুশীলনে। বাণিজ‍্য কি শুধুই বেচা-কেনা? কথা বলতে পারাও তো নিবিড় এক শিল্প। বন্ধুত্ব করতে পারাও বিশেষ শিল্প এক। তলার খবর উপরে তুলে আনা, ভিতরের খবর বাইরে বের করতে পারা – এসবও কি কম দক্ষতার কাজ? ঠিক সময়ে ঠিক জায়গায় পৌঁছে কীভাবে যেতে হয় ঈষৎ বঙ্কিম পথে, তাও জানে শীর্ষগুপ্ত।

নারীর শরীরে বহু ভ্রমণ করেছে সে। গান্ধার প্রদেশের রমণীদের পৃথুল স্তনভারে নিজেকে নিমজ্জিত করেছে, চিনেছে আপেল-রঙা পারস্য নারীর শরীরের উপত‍্যকা। সে মেঘ বলেছে, তারা উত্তর দিয়েছে বিদ‍্যুতে। আখরোট-ভাঙা সন্ধ‍্যায় হিন্দুকুশের শীতল বাতাসে তামার পাত্রে পান করেছে আরবি মদিরা। শীর্ষগুপ্ত এ সভ‍্যতার যাবতীয় আরাম ও অর্থ আস্বাদন করেছে নিজের বুদ্ধিবলে। তবু সে বিনয়ী, মাটিতে পা রেখে চলতে জানে। সে বুঝেছে, কেবল শিখর ছোঁয়া নয়, উত্থানকে ধরে রাখতে পারার নামই উন্নতি। না হলে উঁচু থেকে নিচে পড়ে যাওয়াটা শুধু কয়েক দিনের ঘটনা। পতন রোধ করতে শিখতে হয়, নয়ত যাবতীয় শৃঙ্গ ধুলো হয়ে যায়।

ঘরে ফেরার পথে আষাঢ়ের স্তম্ভিত আকাশ দেখে শীর্ষগুপ্ত চোখ বন্ধ করল। এই মেঘ, এই কালো, এই আকাশ, এই ধানের গুচ্ছ – সব তার বড় আপন, বড় ভিতরের জিনিস। সে তার শরীরকলস পূর্ণ করে শ্বাসগ্রহণ করল। চালুক্য প্রদেশে সে সম্মান পেয়েছে বিস্তর। সম্পদ সঞ্চয় করেছে প্রভূত। তবু সেখানকার বাতাসে, মাটির গন্ধে সে ঘরের স্বাদ খুঁজে পায়নি। এই দিগন্তবিস্তৃত মাঠের দিকে তাকিয়ে শীর্ষগুপ্ত অনুভব করল যে এই আকাশ বাতাস বৃক্ষ পক্ষী সবাই যেন তার প্রত্যাবর্তনের পথে ছড়িয়ে রেখেছে অপার্থিব আনন্দকুসুম।

বৃহৎ দলের অগ্রভাগে হাতির পিঠে চড়ে দুলকি চালে ফিরছে বণিক। মাথায় ছাতা ধরে রয়েছে ছত্রধারী। বালক বালিকারা মাঠে খেলতে খেলতে “ঐ হাতি যায়” বলে মাঠ ফেলে পথের দিকে দৌড় দিচ্ছে; জেলেরা নৌকায় বসে নদীতে মাছ ধরতে ধরতে তাকিয়ে দেখছে, কে এল; গ্ৰামের ডাগর বহুড়িরা স্নান সেরে ফিরছে – আড়চোখে হাতি দেখে তাদের সে কী হাসাহাসি! শীর্ষগুপ্তর মুখ কৌতুকে প্রসন্ন। চুলে তার লেগেছে ঘরের বাতাস।

শীর্ষগুপ্ত মধুহাটি উপনগরে ফিরল প্রভূত জয়ধ্বনির ভেতর দিয়ে। সকলে এসে অভিবাদন জানাল। তাকে দেখতে ভেঙে পড়ল সমস্ত গ্ৰাম। শীর্ষ দানশীল ব্যক্তি। তার গৃহ থেকে কেউ ফেরে না খালি হাতে। সকলেই কিছু না কিছু পেয়ে আনন্দিত চিত্তে ফিরে গেল।

সাঁঝ এল। ঘরে ঘরে জ্বলে উঠল প্রদীপশিখা। শীর্ষগুপ্তের সুসজ্জিত মনোরম কক্ষে প্রৌঢ় অমাত‍্য বিষ্ণুদত্ত গোঁফে মোচড় দিয়ে বলল, একটি ঘটনা ঘটেছে। এমন ঘটনা পূর্বে ঘটেনি।

— কী ঘটেছে? কৌতূহলী শীর্ষ।

— তুমি একটি তিব্বতী অশ্ব ক্রয় করে নিয়ে এসেছিলে গত বছর। মনে পড়ে?

মাথা নাড়ল শীর্ষ। মনে আছে তার। ধূসর পাহাড়ের দেশ তিব্বত থেকে ওই দুধ-সাদা ঘোড়াটি এনেছিল সে।

— সেই ঘোড়াটি এখন আর ঘোড়া নেই।

— ঠিক বুঝলাম না। বিস্মিত হল শীর্ষগুপ্ত!

— তোমার তিব্বতী অশ্বটি এক অসামান্য রূপসী নারীতে পরিণত হয়েছে।

— নারী? সে কী করে সম্ভব? এ অবাস্তব। তীক্ষ্ণ চোখে বলে উঠল শীর্ষগুপ্ত।

— কী করে সম্ভব হল তা জানি না। একদিন ধুবলিহাটের প্রান্তরে তোমার আস্তাবলের ছটি ঘোড়াকে নিয়ে গিয়েছিল সহিস কাহ্ন। সে নাকি দেখেছে তিব্বতী ঘোড়াটি হাওয়ায় মিলিয়ে যায় এবং অশ্বের জায়গায় বসে রয়েছে এক রূপসী নারী। সেই নারী আজ তোমার অপেক্ষায় দক্ষিণ কক্ষে অবস্থান করছে। সে অন্তর্মুখী। খুব বেশি কথা বলে না। গত কয়েকমাস সে ওইখানেই বাস করছে। তুমি গিয়ে কথা বলে দেখো।

চলে গেল অমাত‍্য বিষ্ণুদত্ত। যুগপৎ বিমূঢ় এবং উৎকণ্ঠিত শীর্ষগুপ্ত চলল দক্ষিণ কক্ষের দিকে, যেখানে অবস্থান করছে এমন এক মানবী যার অস্পষ্ট ধারণা লকলক করে ক্রমাগত লতিয়ে উঠছে শীর্ষগুপ্তের হৃদয়ে।

দক্ষিণ কক্ষের শয্যায় সুদৃশ্য বক্ষাবরণ ও মেখলা পরিহিতা নারী বসেছিল পুষ্পের অভ‍্যন্তরে অনাঘ্রাত গন্ধের মত।

শীর্ষগুপ্ত ঘরে প্রবেশ করে প্রদীপের উজ্জ্বল আলোয় তার মুখমণ্ডল অবলোকন করে বিমুগ্ধ হল। এই নারী অশ্ব-উদ্ভূত?

শীর্ষগুপ্ত বলল, “তুমি কি সত‍্যিই –”

নারী বলল, “জানি না। জন্মের কথা মনে নেই আমার। আমি অশ্বজাতিকা কিনা বলতে পারি না। আমার শৈশব নেই, কৈশোর নেই, যৌবন আছে শুধু। এই জন্ম আমার কাছে নিদ্রাভঙ্গের মত। হঠাৎ এই পৃথিবী, এই সমাজ, এই তুমি!”

শীর্ষগুপ্ত তাকিয়ে ছিল রমণীর দিকে। সে ভারতবর্ষের নানা জনপদে ঘুরে অনেক নারী সংসর্গ করেছে, কিন্তু এর মত কেউ নয়। এ যেন মায়ানদীর পারের কোনও মানবী। তার শরীর থেকে এক আশ্চর্য কামলাবণ্য ঝরে পড়ছে। সে জিজ্ঞেস করল নারীকে, “কী নামে ডাকব তোমায়? তোমার কোনো নাম আছে?”

নারী বলল, “আমার কোনো নাম নেই।”

শীর্ষগুপ্ত একটু চিন্তা করে বলল, “আমি তোমার নাম দিচ্ছি দুহিতা। এ নাম কি তোমার পছন্দ?”

নারী নিজের নরম ঠোঁট দুটি ফাঁক করে নিজেই আপন মনে বলে উঠল – “দুহিতা, দুহিতা, দুহিতা!” তারপর কী যেন ভাবল। তারপর বালিকার মত স্মিত হেসে বলল, “এ নাম আমার পছন্দ হয়েছে। এই নামের ধ্বনি আমার স্বভাবকে প্রকাশ করছে।”

অকস্মাৎ বাতাস বয়ে গেল। উড়ল দুহিতার কাজল কালো কেশ। তার শ্বেত শরীর প্রদীপের আলোয় সুবর্ণরূপ ধারণ করল। এই অপরূপ দৃশ্যের দিকে মন্ত্রমুগ্ধের মতো তাকিয়েছিল বণিক।

দুহিতা বলল, “কী দেখছেন?”

শীর্ষ বলল, “রূপ…”

রূপের কী দেখছেন?

— রূপের জ্যোৎস্না দেখছি

— সে আলো কি আমার মধ্যে সত্যিই রয়েছে?

— যা নেই, তা দেখব কী করে?

শীর্ষর কথায় দুহিতার মুখে হাসির রেখা ফুটে উঠে পরক্ষণেই ম্লান হয়ে গেল। সে বলল, “আমার পিতা নেই, মাতা নেই, জন্মভূমি নেই। কোন পরিচয়ে আমি এখানে থাকব? আমি শুনেছি আপনি বিখ্যাত বণিক। আপনার এই প্রাসাদে আমাকে দাসী করে রাখবেন কি? আমি কোথায় যাব জানি না। কীভাবে পথের জন্ম দিতে হয়, আমি শিখিনি; তাই পথিক হবার যোগ্যতাও আমার নেই।”

শীর্ষগুপ্ত চুপ করে শ্রবণ করল দুহিতার কথা। তার সারল্য শীর্ষকে অভিভূত করল। বণিক হিসাবে যত নারীর সঙ্গে মিশেছে সে, সকলেই মনোরঞ্জনের কায়দা জানে। তাদের কথা বলা, শরীর মেলে ধরার ভেতর এক প্রকারের পরিশীলন রয়েছে। কিন্তু এই মেয়েটি কিছুই জানে না। এ নিজের শরীরটুকুও জানে না। শীর্ষগুপ্তের অনুকম্পা হল। তার অন্তঃস্থল আশ্রয় দেবার ইচ্ছায় ব্যাকুল হয়ে উঠল। এই রূপসী তরুণীকে নিজের প্রতাপশালী ডানার নিচে আগলে রাখতে চাইল সে।

স্তব্ধতা ভেদ করে দুহিতাকে সে বলল, “আমি তোমাকে বিবাহ করতে চাই। তোমার আপত্তি আছে কি?”

দুহিতা শান্ত ভীত দৃষ্টিতে তাকাল।

সে বলল, “বিবাহের অর্থ আমি জানি না। বিবাহিত নারীর কী কর্তব্য আমি তাও জানি না।”

শীর্ষ বলল, “আমি তোমাকে শেখাব। তুমি চিন্তা কোরো না।”

দুহিতা তার কোমল ভীরু চোখ তুলে বলল, “তুমি আমাকে নিয়ে যা করতে চাও, তা-ই হোক। আমি যে আর কাউকে চিনি না।”

শীর্ষ দুহিতার করতল নিজের হাতের ভিতরে নিয়ে বলল, “পৃথিবীতে সবাই নতুন থাকে, তারপর ক্রমশ পুরনো হয়। যে জানত না কিছুই, সে জেনে যায়; যে বুঝত না কিছুই, সে বুঝতে পারে। আজ তুমি নতুন, তুমি হরিণশাবকের মত সন্ত্রস্ত। সামান্য পাতার আওয়াজে তুমি চমকে উঠছ। কিন্তু কিছুদিন যেতে দাও, দেখবে ঝড় দেখেও তুমি বিচলিত হবে না। চিন্তা কী, আমি তোমার পাশে আছি।”

দুহিতার মুখে রাঙা আলো, সে এক ঘোরের মধ্যে বিচরণ করছে যেন।

শীর্ষগুপ্ত প্রফুল্ল চিত্তে ফিরে গেল। পরের দিন ডাক পড়ল সহিস কাহ্নর। সে ঘটনাটি অনুপুঙ্খভাবে জানতে চাইল সহিসের কাছ থেকে। সহিস বয়স্ক। সে যা বলল, তা এই – “হে প্রভু, প্রতিদিনের মত সেদিনও ছটি ঘোড়াকে নিয়ে প্রান্তরে ছেড়ে দিয়েছি। তারা ঘাস খাচ্ছিল। দিন ছিল মেঘময়। আকাশে বিদ‍্যুতের শিখা লম্বা হয়ে ছড়িয়ে পড়ছিল। হঠাৎ ওই তিব্বতী অশ্বটির উপর বজ্রপাত হল। আমি ভাবলুম অশ্বটি দগ্ধ হয়ে মৃত হয়েছে। দৌড়ে গিয়ে দেখি অশ্ব অন্তর্হিত, সেই জায়গায় অজ্ঞান অবস্থায় পড়ে রয়েছে একজন রক্তবসনা এক নারী। তাকে দেখে চমৎকৃত হলাম। এ অবিশ্বাস্য ঘটনা! এই নারীকে নিয়ে আসি আমি আপনার প্রাসাদে। অমাত‍্য বিষ্ণুদত্তকে খবর দিই। তিনি এসে কবিরাজকে ডাকেন ও দাসীদের বলেন পরিচর্যা করতে। এই ঘটনার তিনমাস পরে আপনি এলেন।”

সহিস কাহ্ন চলে গেল।

শীর্ষগুপ্ত ঘোষণা করল নিজের বিবাহের সংবাদ। উপনগরে সংশয়মিশ্রিত আনন্দ প্রবাহিত হল। একদল বলল, “এই মেয়ের বর্ণ নেই, গোত্র নেই, অতীত নেই – এ বিবাহ ভুল পদক্ষেপ।” আবার অন্য দল বলল, “নিজের জীবন নিজে তৈরি করেছে শীর্ষগুপ্ত – তার যা ইচ্ছে সে করবে।”

বিবাহের রাতের উল্লাস উঠল ফেনিয়ে। দুহিতা ও শীর্ষগুপ্ত ক্রমশ পরস্পরের কাছাকাছি এল।

বণিকের সুরম্য কক্ষ অবাধ কামক্রীড়ার জন্য সুসজ্জিত করেছিল দাসীরা। অনেক রাতে বনঝাউয়ের মাথায় যখন এসে বসল শুক্লা ত্রয়োদশীর চাঁদ শ্রাবণ নিশীথের বেনে বউটির মত, তখন শীর্ষ মিলিত হল দুহিতার সঙ্গে। রতিক্রিয়ার মুহূর্ত ক্রমশ উঠল ঘন হয়ে। দুহিতার বাদামী স্তনবৃন্তে চুম্বনচিহ্ন এঁকে, শীর্ষ তার গহন নাভিতে ওষ্ঠ স্পর্শ করল। কেঁপে উঠল দুহিতার শরীর। তার নগ্ন পিঠের উপর অঙ্গুলি চালনা করতে করতে শীর্ষ বলল, “শৃঙ্গার একটি শিল্পের মত। এটিকেও আয়ত্তে আনতে হয়। নারী পুরুষ মিলনের পরে জড়বস্তুতে পরিণত হয়। তাই মিলনের পূর্বের মুহূর্ত স্বর্গীয়, পরের মুহূর্ত পার্থিব। নারী পুরুষ পরস্পরের শরীরকে জেনে নিলে, শরীরের স্বভাবকে বুঝে নিলে, একে অপরকে আনন্দ দান করতে পারে।”

দুহিতার নরম পেটের উপর শীর্ষগুপ্তের মাথা।

শীর্ষ বলল, “নারীর শরীর তোমার। নিজের আনন্দের কথা বুঝতে হবে। আমি যেমন তোমার শরীরের মাধ্যমে সুখ অনুভব করছি, তোমারও একই অধিকার রয়েছে। তুমি আমার ওপর আরোহণ করো।”

দুহিতার মুখে ফুটে উঠল হাসির রেখা।

শায়িত শীর্ষগুপ্তের উপর বিপরীত সম্ভোগের তৃষ্ণায় আরোহণ করল দুহিতা। সমস্ত আনন্দ আবেগের চরমতম মুহূর্তে দু চোখ বন্ধ হয়ে এল তার। অকস্মাৎ এক তীব্র আর্তনাদে খুলে গেল তার চোখ। সে দেখল শীর্ষগুপ্তের মুখে আতঙ্কের ছাপ। এক বিপুল ধাক্কায় সে ছিটকে পড়ল শয্যার এক প্রান্তে। শীর্ষ তখন অতি দ্রুত শয্যা পরিত্যাগ করে উঠে পড়েছে।

কী হয়েছে? কী হল? দুহিতা কিছু বুঝল না। শুধু সে দেখল শীর্ষগুপ্ত দ্রুত ঘ‍র থেকে বেরিয়ে গেল। অসমাপ্ত রইল তাদের মিলন। দুহিতা বাতায়নের ধারে গিয়ে বাইরে তাকাল। শুক্লা ত্রয়োদশীর চাঁদ তখন বেতসকুঞ্জের আড়ালে ডুবে গেছে। কী ভুল হল তার? কী কারণে তার আশ্রয়দাতা, স্বামী ও সখা তাকে এইভাবে পরিত্যাগ করে চলে গেল?

পরদিন প্রভাতে শীর্ষ এল দুহিতার কক্ষে। দুহিতার মুখ মলিন। তার কাজলরেখা বিধ্বস্ত।

দুহিতার পাশে বসে শীর্ষ কোমল স্বরে বলল, “দুহিতা, কীভাবে কথাটা তোমায় বলি!”

মুখে একরাশ আশঙ্কা ও ছলোছলো চোখ নিয়ে দুহিতা বলল, “কী হয়েছে?”

শীর্ষ বলল, “গত রাতে আমি ভয় পেয়েছিলাম, দুহিতা।”

বিস্মিত হয়ে দুহিতা বলল, “কেন, কীসের ভয় বণিক? কাকে ভয়?”

“তোমাকে”, বলল শীর্ষ।

হতবাক হল দুহিতা। “আমাকে? আমাকে ভয়? কী কারণে? আমি কি কিছু ভুল করেছি?”

শীর্ষগুপ্ত বলল, “ভুল তোমার নয় দুহিতা, তোমার নয়। এ ভুল আমার। আমার চোখের। একথা আমি নিশ্চিতভাবে জানি। কিন্তু সেই মুহূর্তে যে ভয়াবহ জিনিস আমি চোখের সামনে দেখেছি, তাকে মিথ্যা মনে করার ক্ষমতা আমার লোপ পেয়েছিল।”

দুহিতা বলল, “কী দেখেছিলে তুমি?”

শীর্ষ বলল, “তুমি আমার উপর আরোহণ করার পর সহসা দেখলাম তুমি নয়, একটি অতিকায় সাদা ঘোড়া আমার ওপর আরোহণ করেছে। তার বিপুল মুখ, উড়ন্ত কেশর, বিস্ফারিত নাসারন্ধ, হিংস্র দাঁত। আমার মনে হল, অশ্বটি আমায় ধ্বংস করে দেবে। আমাকে ছিঁড়ে খাবে, তার ক্ষুর দিয়ে আমাকে দলিত করবে। আমার মনে হল সাক্ষাৎ মৃত্যুদেবতা অশ্বরূপে আমার ওপর আরূঢ় হয়েছেন।”

বিস্ময়ে স্তব্ধ হল দুহিতা। তারপর বলল, “কীভাবে এ সম্ভব আমি জানি না। যে অশ্বটির বর্ণনা তুমি করছ, কাহ্ন আমাকে বলেছিল, ওইরকমই কোনো অশ্বের সঙ্গে আমার জন্মের যোগ রয়েছে। কিন্তু সেই অশ্বটি এখন আর নেই। আমার মনে হয় তোমার মনের মধ্যে ওই অশ্বটির রূপ বারবার ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাই তোমার ভয় করেছে। আমি অশ্বের ভিতরে নেই, অশ্বটিও আমার ভিতরে নেই। তুমি তোমার স্মৃতি থেকে, কল্পনা থেকে ওই অশ্বটিকে মুছে ফেলো।”

শীর্ষ বলল, “তা হয় না। গত বছরে তিব্বতে বাণিজ্য করতে গিয়ে এই ঘোড়াটিকে আমি অশ্বহাটে দেখেছিলাম। যেন সাদা মেঘের টুকরো। মুগ্ধ হয়েছিলাম। সেইসময় এক যবন বীর অশ্বটিকে ক্রয় করার মানসে অশ্ববিক্রেতার সঙ্গে কথা বলার পর, অশ্বটিকে পরীক্ষা করার জন্যে তার পিঠে চড়ামাত্রই ঘোড়াটি তাকে নিয়ে এক লহমায় ছুটে যায় এবং তার দুটি পা উঁচু করে লম্ফ দেয় হাওয়ায়। যবনটি ভূপতিত হয় এবং অশ্বটি মহা ক্রোধে যবনটির বুকে বারংবার ক্ষুরাঘাত করে। যবন বীর সেইখানেই প্রাণত্যাগ করে। এই দেখে আমার জেদ চেপে যায় যে এই অশ্বটিকে আমি আয়ত্তে আনব। বাংলার তেপান্তরে দৌড় করাব। কিন্তু আমি ভয় পেয়েছি। এক বছরেরও বেশি সময় গিয়েছে, আমি অশ্বটির পিঠে চড়িনি। চড়তে ভয় পেয়েছি। সেটি আমার আস্তাবলেই রয়ে গিয়েছিল। অকস্মাৎ সেই অশ্বটি থেকে তোমার উৎপত্তি হল। তোমার সঙ্গে সেই অশ্বটির যে পথে গহন সংযোগ, সেই পথে ভয় ঢুকেছে।”

দুহিতা স্মিত হেসে শীর্ষগুপ্তের আঙুল নিজের মুখে স্পর্শ করিয়ে বলল, “এখানে ভয়?”; স্তনে স্পর্শ করিয়ে বলল, “এখানে ভয়?”; নাভিতে স্পর্শ করিয়ে বলল, “এখানে?” উরুতে স্পর্শ করিয়ে বলল, “এখানে?”; চুলে স্পর্শ করিয়ে বলল, “এখানে?”

শীর্ষর মুখে হাসির রেখা। “না। কোত্থাও ভয় নেই।”

— তাহলে? কোথায় ভয় তোমার, বণিক?

— আমি জানি না, দুহিতা। আমার তো ভয় পাওয়ার মত হৃদয় নয়, অথচ ভয় পেয়েছি।

— বণিক, তোমার ভয় আমরা দুজনে অতিক্রম করব। মনের মধ্যে তোমার পুরাতন দৃশ্য ঘুরপাক খাচ্ছে, যা থেকে তুমি নিজেকে মুক্তি দিতে পারছ না। আমরা একসঙ্গে এই ভয়ের নদী পার হব। আজ রাতে আমরা মিলিত হবার চেষ্টা করব আবার। তোমার জন্যে শৃঙ্গারকক্ষ সাজিয়ে রাখব আমি।

শীর্ষ দুহিতাকে গাঢ় আলিঙ্গন করল। চুম্বন করল। প্রাসাদের বাইরে সোনা রোদে তখন ডানা মেলে উড়ছে অসংখ্য শ্বেত, পিঙ্গল ও কৃষ্ণবর্ণের কপোত।

সেই রাত্রে বহু যত্ন করে শৃঙ্গারকক্ষ সাজাল দুহিতা। দ্বাদশ প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হল কক্ষ। সুগন্ধি আতর সে ছড়িয়ে দিল কক্ষময়। উল্কিবিদ্যায় পারদর্শী দাসীকে দিয়ে নিজের শরীরের নানা স্থানে পত্র পদ্ম ময়ূর নক্ষত্র আঁকাল। কেশসজ্জায় যে দাসী নিপুণা, তাকে দিয়ে কবরী বাঁধাল।

অবশেষে রাত্রির দ্বিতীয় প্রহরে এল বণিক।

সে দুহিতার এই চন্দনলাঞ্ছিত অনির্বচনীয় রূপ অবলোকন করে মুগ্ধ হল।

তার ভিতরে জেগে উঠল আদিম জোয়ার, যে জোয়ার বেপরোয়া। যে জোয়ারের চেতনায় ভয়ের কোনো পূর্বস্মৃতি নেই।

দুহিতার স্তনে আঁকা পদ্ম ও কোমরে আঁকা ময়ূরে শীর্ষ বারংবার চুম্বন করতে লাগল।

শৃঙ্গারের টানে ভেসে যেতে লাগল দুটি শরীর। আকাশভর্তি চাঁদের আলোয় ডুবে রয়েছে সমস্ত চরাচর।

রতিক্রীড়ার ভিতর দুহিতা ফিসফিস করে বলে যেতে লাগল, “বণিক, আমি তোমার। শুধু তোমারই। আমার এই রূপ, এই যৌবন, এই জীবন— সব তোমার, তোমারই।”

শীর্ষগুপ্ত চোখ বন্ধ করে ডুবে যেতে থাকল দুহিতার রভসে। দুহিতা নিজেকে মেলে দিল শীর্ষর তামাটে সুগঠিত বুকে। শীর্ষর গ্রীবা, কর্ণমূল, জংঘা সে চুম্বনকুসুমে ভরিয়ে দিল।

অধরোষ্ঠে চুম্বন করবে বলে শীর্ষ দুহিতার মুখটিকে ধরে নিজের মুখের কাছে নিয়ে এল। সেই মুহূর্তে সে দেখল দুহিতা নয়, ওটি একটি বিরাট অশ্বমুখ। সেই মুখ থেকে বিশ্রী লালা ঝরছে, জিভ বেরিয়ে এসেছে, নাক দুটি বিস্ফারিত হয়ে উঠেছে, দাঁতগুলো হিংসায় অধীর। ক্রমশ সেই অশ্বমুখ তার কণ্ঠনালীর দিকে ধাবিত হচ্ছে। সারা কক্ষ জুড়ে উড়ে বেড়াচ্ছে অশ্বঘ্রাণ। ভয়ে, আতঙ্কে, ঘৃণায় বণিকের শরীর কেঁপে উঠল। তার পৌরুষের ভিত নড়ে গেল। এতদিন এত নারীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে সে, অথচ শৃঙ্গারকালে তার অস্তিত্ব এইভাবে কখনোই বিপর্যস্ত হয়নি। এই নারীর বেলায় তা হচ্ছে। এই নারীর সামনে তার নিজের পৌরুষ সম্পর্কিত যাবতীয় ধারণা ভেঙেচুরে তছনছ হয়ে যাচ্ছে। এই নারী তো নারী নয়, এ এক অতিকায় ঘোড়া।

বালিশের তলায় লুকিয়ে রাখা অতি ধারালো ছু্রি হাতে তুলে নিয়ে সেটিকে শীর্ষগুপ্ত বসিয়ে দিল ঘোড়াটির মুখে।

ব্যথায় আর্তনাদ করে উঠল দুহিতা। শীর্ষগুপ্ত তাকিয়ে দেখল ছুরিকাটি দুহিতার কোমল নরম বুকের মধ্যভাগে আমূল গাঁথা। সে তাকাল তার পুরুষটির দিকে, তার আশ্রয়দাতার দিকে, তার সখার দিকে। কিছু বলল না। তার চোখের কোণ থেকে গড়িয়ে পড়ল কয়েক ফোঁটা জল।

পরদিন সকালে মহাসমারোহে দাহ করা হল দুহিতাকে। মধুহাটি উপনগরের লোকজন বলাবলি করল, “ডাইনি ছিল মেয়েটা। তখনই বুঝেছি। নইলে কি অমন হয়?”

কেউ কেউ বলল, রাতের বেলা ধুবলিহাটের প্রান্তরে মেয়েটিকে নাকি দেখা যায় আজকাল। সে নাকি চাঁদের আলোয় তিব্বতী ঘোড়ায় চড়ে ঘুরে বেড়ায়। তার গায়ে কোনো পোশাক নেই। একলা পুরুষ পথিক দেখলেই নাকি তাকে বশ করে কামতৃষ্ণা মেটায়। তারপর তাকে নাকি মেরে রেখে দেয়।

দুহিতার মৃত্যু দু’দিন পরে, অমাত‍্য বিষ্ণুদত্ত বণিকের ঘরে এল।

সাঁঝের বেলা। কক্ষ প্রায় অন্ধকার। জ্বলছে কেবলমাত্র একটি ক্ষীণ প্রদীপ।

শীর্ষগুপ্ত গভীর চিন্তায় মগ্ন।

বিষ্ণুদত্ত শীর্ষগুপ্তকে বলল, “মেয়েটাকে মেরে ফেললে একেবারে? পরিত‍্যাগ করতে পারতে তো। মেয়েটা বেঁচে থাকত অন্তত।”

শীর্ষগুপ্ত চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “আমি তো ঘোড়াটিকে হত্যা করলুম। দুহিতা মরল কী করে?”

আরো পড়ুন রাজা সুরমানের উপাখ্যান

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.