আতাউর হোসেন খোকা

১৯৭১ সালে ঐতিহাসিক মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে তৎকালীন পাকিস্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে প্রতিষ্ঠিত হয় স্বাধীন রাষ্ট্র বাংলাদেশ। ২০২১ সাল থেকে শুরু হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের পঞ্চাশতম বর্ষ উদযাপন। কিন্তু পাঁচ দশকের স্বাধীনতা বাংলাদেশের শ্রমিকের জীবনে কোনো আলোর সন্ধান দিতে পারেনি। বরং অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছে। বিশেষ করে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক শ্রমিক যে ক্ষেত্রে কর্মরত, সেই গার্মেন্টস সেক্টরে শোষণ লাগামছাড়া।

বাংলাদেশে করোনা সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার পর ২০২০-২১ সালে তৈরি পোশাক খাতে চাকরি হারিয়েছেন তিন লাখ ৫৭ হাজার শ্রমিক৷ চাহিদা কমে যাওয়ায় কারখানাগুলোতে শ্রমিক ছাঁটাই হয়েছে, এমনকি অনেক কারখানা বন্ধও হয়ে গেছে৷ শ্রমিকদের অধিকাংশই কোনো ক্ষতিপূরণ পাননি।

নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন

~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) এবং ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি প্রকল্প ম্যাপড ইন বাংলাদেশ (এমআইবি)-এর সমীক্ষায় দেখা গেছে, ২০১৯ সালের ডিসেম্বরের তুলনায় ২০২০ সালের সেপ্টেম্বরে ৫০ শতাংশ বেশি কারখানায় শ্রমিক কমেছে, প্রায় ৫৬ শতাংশ কারখানা বিভিন্ন স্তরে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে এবং ১১ শতাংশ কারখানা অনিশ্চয়তার মধ্যে আছে।

জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বরের মধ্যে প্রায় ২৫,৬২,৩৮৩ জন কর্মীর মধ্যে প্রায় ৩,৫৭,৪৫০ জন চাকরি হারিয়েছেন, যা মোট শ্রমিকের প্রায় ১৪ শতাংশ।

সিপিডি জানিয়েছে, কর্মী ছাঁটাই ও কারখানা বন্ধের ক্ষেত্রে আইনকানুন মানা হয়নি। মাত্র ৩.৬% কারখানা ক্ষতিপূরণের নীতি মেনে বেতন ও ক্ষতিপূরণ দিয়েছে এবং বকেয়া পরিশোধ করেছে।

সমীক্ষায় আরও বলা হয়েছে, যেসব কারখানায় নতুন কর্মী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে তাদের বেশিরভাগই আগে ছাঁটাই হওয়া কর্মী। নতুন করে নিয়োগ করার সময়ে তাদের আরও কম বেতন ও সুযোগসুবিধা দিয়ে চুক্তিবদ্ধ করা হয়েছে। শ্রমিকরা ফের চাকরি পেলেও আগের চাকরি চলে গিয়েছিল বলে প্রাপ্য নতুন চাকরিতে সুযোগ সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয়েছে।

বাংলাদেশের শ্রমিকদের উপর চলমান নির্যাতনের একটি বড় উদাহরণ রানা প্লাজার ঘটনা। ন বছর আগে সাভারে রানা প্লাজা নামে একটি ভবন ধসে পড়ে। এই ভবনটিতে গার্মেন্টসসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অফিস ছিল। ঘটনার সময় ওই ভবনে উপস্থিত ১,১৩৫ জন মারা যান। পঙ্গুত্ব বা মানসিক ট্রমা নিয়ে বেঁচে আছেন আরও প্রায় এক হাজার মানুষ। এঁদের অধিকাংশই গার্মেন্টস শ্রমিক। এই ঘটনার পর শ্রমিকদের কর্মপরিবেশের বিষয়টি সামনে আসে, বিশেষ করে গার্মেন্টস শ্রমিকদের ক্ষেত্রে। তবে আশার কথা, ওই ঘটনার পর পোশাক কারখানার কর্মপরিবেশ উন্নয়নে নিয়োজিত বিদেশি ক্রেতাদের জোট অ্যাকর্ড ও অ্যালায়েন্সের তত্ত্বাধানে এখন অধিকাংশ গার্মেন্টসের কর্মপরিবেশ আগের চেয়ে অনেকটাই উন্নত। তবে তা-ও প্রয়োজনের তুলনায় কম।

কেবল গার্মেন্টস নয়, বাংলাদেশে আরো অনেক পেশাতেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় শ্রমিকদের। নির্মাণশিল্প, যানবাহন, জাহাজ ভাঙা শিল্প, ট্যানারিসহ অনেক পেশায় কোনো পরিবর্তনই আসেনি। ফলে সেই সব জায়গায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন শ্রমিকরা। শ্রমিকদের জীবনের ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি বলা হয় পরিবহনে। এরপরই নির্মাণশিল্প। বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব লেবার স্টাডিজের তথ্য অনুযায়ী, ২০০২ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১৫ বছরে নিহত হয়েছেন ১,৬৭৭ নির্মাণ শ্রমিক। অর্থাৎ বছরে ১০০ জনেরও বেশি। প্রতিষ্ঠানটির তথ্য অনুযায়ী, বর্তমানে ঝুঁকিপূর্ণ এই পেশায় কাজ করছেন প্রায় ৩৭ লাখ শ্রমিক।

শ্রমিকদের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ আরেকটি পেশা হল চামড়া শিল্প। সারাদেশে চামড়া নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান আছে প্রায় ১,০০০। এর মধ্যে চামড়াজাত বৃহৎ শিল্প প্রতিষ্ঠান রয়েছে ২৩টি এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠান ১০০টির মত। এর মধ্যে লেদার গুডস অ্যান্ড ফুটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (এলএফএমইএবি) সদস্য ১৫০টি ইউনিটে কর্মরত শ্রমিকের সংখ্যা ৫৩,০০০-এরও বেশি। তাঁদের সবাইকেই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয়। প্রতিনিয়ত তাঁরা নানা ধরনের রোগব্যাধিতে আক্রান্ত হলেও মালিকরা কোন খোঁজ নেন না।

ঝুঁকিপূর্ণ আরেকটি পেশা জাহাজ ভাঙা শিল্প। পুরনো জাহাজে থাকে নানা বিষাক্ত জিনিস, যা কর্মীদের ফুসফুসে ক্যানসারের ঝুঁকি বাড়ায়। এছাড়া অন্যান্য কারখানাতেও প্রায়ই দুর্ঘটনা ঘটছে। প্রাণও হারাচ্ছেন বহু শ্রমিক। কিন্তু শ্রমিকরা প্রাপ্য ক্ষতিপূরণ পাচ্ছেন না। ফলে দুর্ঘটনার শিকার অনেককেই দুর্বিষহ জীবন কাটাতে হচ্ছে। অনেকে সারাজীবনের মত পঙ্গু হয়ে যাচ্ছেন। তাঁদের খোঁজও নেন না মালিকপক্ষের কেউ।

বাংলাদেশে এক সময় গার্মেন্টস সেক্টরে অধিকাংশ কর্মীই ছিলেন নারী। সাম্প্রতিক এক গবেষণায় প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, এখন রেডিমেড পোশাকের কারখানায় যাঁরা কাজ করছেন তাঁদের মাত্র ৫৮ শতাংশ নারী। ফলে এই খাতের ৮০ শতাংশ কর্মীই নারী বলে যে ধারণা প্রচলিত ছিল, সেটি ঠিক নয় বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে।

বাংলাদেশের যেসব এলাকায় সবচেয়ে বেশি গার্মেন্টস শিল্প রয়েছে তার মধ্যে পড়ে ঢাকা, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ এবং চট্টগ্রাম।

এসব জেলায় ৩,২০০-র বেশি কারখানায় কাজ করছেন ২৫ লাখের বেশি শ্রমিক। এর মধ্যে পুরুষ কর্মী রয়েছেন সাড়ে ১০ লাখ, নারী ১৫ লাখ। এই বিপুল সংখ্যক মানুষ প্রতিনিয়ত শোষিত হচ্ছেন।

বাংলাদেশের মোট রপ্তানি আয়ের ৮৩ শতাংশ আসে পোশাক শিল্প থেকে। বাংলাদেশের রেডিমেড পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের সংগঠন এবং আন্দোলন এখন সবচেয়ে বেশি আলোচিত। রানা প্লাজার ঘটনার পর থেকে শ্রমিক ইউনিয়ন গঠন করতে দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক চাপ তৈরি হয়েছে। কিন্তু সাড়ে পাঁচ হাজারের মতো পোশাক কারখানা থাকলেও মাত্র ছশোর মত কারখানায় শ্রমিক ইউনিয়ন আছে।

২০০৬ সালের জুন মাসে পোশাক শ্রমিকরা প্রথমবার বড় ধরনের আন্দোলনের মাধ্যমে তাঁদের অধিকার নিয়ে সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। মাসিক মাত্র ১,৬৬২.৫০ টাকা মজুরি নির্ধারণের বিরুদ্ধে তাঁরা প্রতিবাদ জানিয়েছিলেন। কোনো শ্রমিক সংগঠন ওই মজুরি মানেনি। তখন তারা তিন হাজার টাকার ন্যূনতম মজুরির দাবিতে আন্দোলন করে। সরকার রানা প্লাজা ধসের পর পাঁচ হাজার টাকা ন্যূনতম মজুরি নির্ধারণ করে।

আরো পড়ুন অ্যামাজন লেবার ইউনিয়ন তৈরি যুগপৎ ঐতিহাসিক ও অবিশ্বাস্য

করোনাভাইরাসের প্রভাবে ৮০% শ্রমিকেরই মজুরি কমেছে। তাই পরিস্থিতি সামাল দিতে শ্রমিকদের ধারকর্জের জন্য হয় আত্মীয়স্বজন, নয়ত ক্ষুদ্র ঋণদানকারী প্রতিষ্ঠানের দ্বারস্থ হতে হয়েছে। আবার কাউকে কাউকে নিতে হয়েছে সরকারের দেওয়া খাদ্য সহায়তা। রেডিমেড পোশাক, চামড়া, নির্মাণ ও চা — এই চার শিল্পক্ষেত্রের শ্রমিকদের উপর করা এক যৌথ জরিপে এসব তথ্য পেয়েছে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান (বিআইডিএস) ও সুইডেনের ওয়েজ ইন্ডিকেটর ফাউন্ডেশন (ডব্লিউআইএফ)।

জরিপে দেখা গেছে, এই ক্ষেত্রগুলোর নারী শ্রমিকরা পুরুষের তুলনায় গড়ে ৭৭% কম মজুরি পান। চারটি গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রের মধ্যে সবচেয়ে বেশি মজুরি পান নির্মাণশিল্পের শ্রমিকরা। আবার তাঁরাই আছেন সবচেয়ে ভঙ্গুর অবস্থায়। কারণ এই শিল্পে কর্মরত কোনো শ্রমিকেরই যৌথ চুক্তি নেই, যা অন্যগুলিতে কিছুটা হলেও আছে। নিরাপত্তার দিক থেকেও তাঁরা বেশি পিছিয়ে। সবচেয়ে বেশি ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে হয় তাঁদের। অন্যদিকে সবচেয়ে কম মজুরি পান চা শিল্পের শ্রমিকরা।

জরিপের তথ্য বলছে, মাসে গড়ে সর্বোচ্চ ১১,৫৪৭ টাকা করে মজুরি পান নির্মাণশিল্পের একজন শ্রমিক। থাকা চামড়া ক্ষেত্রের একজন শ্রমিক মাসে মজুরি পান ১০,৮০০ টাকা। পোশাক শিল্পক্ষেত্রের একজন শ্রমিকের মাসিক গড় মজুরি ৯,৪৫৭ টাকা। চা শিল্পের একজন শ্রমিক মাসে পান মাত্র ৩,০৯২ টাকা।

সব মিলিয়ে বাংলাদেশের শ্রমিকের অবস্থা ভয়াবহ বললেও কম বলা হয়। এক সময়ে এই দেশে বিরাট বিরাট শ্রমিক আন্দোলন হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময়েও শ্রমিকরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। রাষ্ট্রীয় নজরদারি, সরকারি স্বৈরাচার এবং মালিকদের সঙ্গে প্রশাসনের যোগসাজশে শ্রমিক আন্দোলন আগের মত গতিশীল নেই। তবে অবস্থা ধীরে ধীরে পরিবর্তিত হচ্ছে। একমাত্র দুর্বার শ্রমিক আন্দোলনই পারে বাংলাদেশের শ্রমিকের অধিকার ও মর্যাদা আদায় করতে।

লেখক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন গবেষক, শ্রমিক আন্দোলনের কর্মী, মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ। মতামত ব্যক্তিগত, তথ্য লেখকের। সমস্ত টাকার অঙ্ক বাংলাদেশি টাকার মূল্যে

নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:

 প্রিয় পাঠক,
      আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।

Leave a Reply

This site uses Akismet to reduce spam. Learn how your comment data is processed.