পশ্চিমবঙ্গের বুকে পাঁচটি পৌর নিগমে নির্বাচন সমাপ্ত হয়েছে এবং নতুন বোর্ড গঠিত হয়েছে। কয়েকদিনের মধ্যে আরও ১০৮টি পৌরসভায় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। সমস্ত পৌর নিগমেই অন্যতম সমস্যা কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনা। প্রত্যেকটি শহর তথা কলকাতার দিকে তাকালে দেখা যাবে বর্জ্যের পাহাড়। আর এই বর্জ্যের পাহাড়ে কী নেই? প্লাস্টিক, ছোট ছোট ফেলে দেওয়া ব্যাটারি, বিভিন্ন বাড়ি বা হোটেল থেকে ফেলে দেওয়া বর্জ্য সহ নানাবিধ ফেলে দেওয়া ওষুধ আর ইনজেকশনের সিরিঞ্জ।
১৯৮৬ সালে পরিবেশ সংরক্ষণ আইনের অঙ্গ হিসাবে ২০০০ সালে কঠিন বর্জ্য বা কঠিন পৌরবর্জ্য সংক্রান্ত নিয়মাবলী ভারত সরকার প্রকাশিত করেন। গত ২২ বছরে বেশ কয়েকবার পৌর নির্বাচন হয়ে গেল এবং নির্বাচনের সময় সমস্ত রাজনৈতিক দলই ইস্তাহার প্রকাশ করল, যে ইস্তাহারে ভাসা ভাসা পরিবেশ বিষয়ক কথা উচ্চারিত হয়েছে। কিন্তু একবারও বলা হল না দীর্ঘ ২২ বছরের মধ্যে কঠিন পৌরবর্জ্যের যথাযথ ব্যবস্থাপনা হল না কেন। অথচ আমরা প্রত্যেকে আমাদের বাড়ির বর্জ্য পদার্থ বা আমাদের ফেলে দেওয়া অপ্রয়োজনীয় অসংখ্য জিনিস ক্রমাগত ডাস্টবিনে ফেলে দিই এবং পৌরসংস্থা মাঝে মাঝে গাড়ি করে এসে আমাদের ফেলে দেওয়া বর্জ্য তুলে নিয়ে চলে যায়। সাম্প্রতিককালে বাড়ি থেকে পচনশীল ও অপচনশীল বর্জ্যকে পৃথকভাবে তুলে নেওয়ার জন্য গাড়ি করে লোক আসছে। এই উদ্যোগ নিশ্চয়ই অভিনন্দনযোগ্য। কিন্তু এর বাইরেও এমন কিছু পুরুষ, মহিলা ও শিশু আছেন, যাঁরা আমাদের ফেলে দেওয়া বর্জ্য সংগ্রহ করেন এবং সেই বর্জ্য থেকে সম্পদ তৈরির প্রক্রিয়ায় সর্বতোভাবে অংশগ্রহণ করেন। এঁরা প্রতিনিয়ত আমাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়ান। পরনে নোংরা জামাকাপড়, পায়ে জুতো নেই, হাতে গ্লাভস নেই, মুখে নেই কোনো আচ্ছাদন। এঁদেরই চলতি নাম কুড়ানি। এঁরা প্রত্যেকেই নেই রাজ্যের বাসিন্দা। এঁদের বাসস্থান রাস্তার ধারে কি কোনো বস্তিতে, অথবা রেললাইনের ধারে।
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
সকাল থেকেই এঁদের দেখা মেলে আস্তাকুঁড়ে, নালা-নর্দমায়। রাস্তা থেকে এঁরা কাগজ, প্লাস্টিক, শিশি বোতল সহ নানা ভাঙাচোরা জিনিস সংগ্রহ করে ঝোলায় ভরেন। দিনান্তে পরিত্যক্ত জিনিসগুলো নিয়ে চলে যান। বিভিন্ন বর্জ্য সংগ্রহকারী ব্যক্তি বা সংস্থার কাছে তাঁরা পৌঁছে যান এবং সামান্য অর্থের বিনিময়ে সংগৃহীত বর্জ্য বিক্রি করতে বাধ্য হন। এই কুড়ানিদের একটা বড় অংশ মহিলা বা শিশু, যাঁদের পেটে ক্ষুধার আগুন। সেই আগুন নেভাতে ওঁরা নির্দ্বিধায় নেমে পড়েন নর্দমা বা ডাস্টবিনের ভিতর। ডাস্টবিনের ময়লার মধ্যে দাঁড়িয়েই খুঁটে খুঁটে বের করেন, কোন জিনিসগুলোকে বিক্রি করলে টাকা পাওয়া যাবে। এই বর্জ্য থেকে জিনিসপত্র বের করার সময়ে ওঁদের হাত ক্ষতবিক্ষত হয়, কিন্তু থেমে থাকলে চলবে না। কারণ পেটের জ্বালা বড় জ্বালা।
সমগ্র ভারতবর্ষে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা তথা শহর পরিষ্কার রাখার ক্ষেত্রে এই কুড়ানিদের অবদান এক অনুচ্চারিত সত্য। রাজ্যে ‘সবুজ শহর’ পরিকল্পনা আরম্ভ হয়েছে, যার অন্যতম উদ্দেশ্য শহরকে পরিবেশ-বান্ধব হিসাবে গড়ে তোলা। শহরকে পরিবেশ-বান্ধব হিসাবে গড়ে তুলতে গেলে কঠিন বর্জ্যের ব্যবস্থাপনা আবশ্যিক। এই আবশ্যিক কাজটির ক্ষেত্রে কুড়ানিদের অবস্থান অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনায় কুড়ানি সম্পর্কিত ভাবনা ব্রাত্য। এমনকি বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ইস্তাহারে যে কর্মসূচি প্রকাশিত হয়েছে তাতে এই হতভাগ্য কুড়ানিদের ব্যাপারে একটি শব্দও নেই।
কঠিন বর্জ্য ব্যবস্থাপনার আইনে এই কুড়ানিদের কথা কিন্তু উল্লেখিত হয়েছে। আইনে সুনির্দিষ্টভাবে বলা আছে, রাজ্য স্তরে বর্জ্য বিষয়ক উপদেষ্টামন্ডলীতে কুড়ানিদের প্রতিনিধিত্ব থাকবে। আইনে আরও বলা আছে, স্থানীয় প্রশাসন বর্জ্য কুড়ানিদের স্বীকৃতি দেবেন এবং তাঁরা যাতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনা চক্রের অন্যতম কুশীলব হিসাবে পরিগণিত হন, সেই নির্দেশিকা জারি করবেন। বর্জ্য কুড়ানিদের পরিচয়পত্র থাকবে। প্রয়োজনবোধে স্বনির্ভর গোষ্ঠী গঠন করে এঁদের উৎসাহ দিতে ও সহায়তা করতে হবে।
আইনে যা-ই লেখা থাকুক, বাস্তবে এঁরা আমাদের ভাবনার পরিমন্ডলের মধ্যে আসেন না। নির্বাচন আসে, নির্বাচন যায়। গরীব মানুষের জন্য ভাবনায় অস্থির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ সদর্পে প্রতিশ্রুতি ঘোষণা করেন, জনগণ হাততালি দেয়। আর আমাদের হতভাগ্য কুড়ানিরা ঘিঞ্জি বস্তিতে বা রেললাইনের ধারে আলোহীন জলহীন ভাঙাচোরা ঘরে কোনোরকমে রাত কাটান, আর সকাল হলেই ভোরের সূর্যকে সাক্ষী রেখে বেরিয়ে পড়েন আমাদের ফেলে দেওয়া উচ্ছিষ্ট সংগ্রহ করতে। ওঁরাই আমাদের নগর জীবনের ভ্যাকুয়াম ক্লিনার। আগামীদিনে এই কুড়ানিদের ভাগ্যাকাশে কোনো সুস্থতা আসবে কিনা তা ভবিষ্যৎই বলবে।
মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।