সারা বিশ্বের বামপন্থী দলগুলো বা বুদ্ধিজীবীরা দীর্ঘকাল ইউরোপ-আমেরিকার দেশগুলোর বিরুদ্ধে ঋণের ফাঁদ পাতার অভিযোগ এনেছে। এখন ওই দেশগুলো একই অভিযোগ আনছে ‘লাল’ চীনের বিরুদ্ধে। এ বছর মার্চ মাসের শেষে চীনা ঋণের ফাঁদ সম্পর্কে বাংলাদেশকে সতর্ক করে দিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। বেশ কয়েক বছর ধরে পশ্চিমি ও ভারতীয় সংবাদমাধ্যমে শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান বা আফ্রিকার দেশগুলোর চীনা ঋণের ফাঁদে পড়ার খবর প্রকাশিত হচ্ছে। বিশেষ করে এই মুহূর্তে শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটের প্রেক্ষিতে চীনা ঋণের ফাঁদ সংক্রান্ত তত্ত্বের ব্যাপক প্রচার চলছে। যেমন ৬ এপ্রিল আনন্দবাজার পত্রিকায় লেখা হয়েছে “চিনের কাছে বিকিয়ে গিয়েই সর্বনাশ হয়েছে শ্রীলঙ্কার! ভারতের দক্ষিণের প্রতিবেশী দ্বীপরাষ্ট্রের আর্থিক সঙ্কট প্রসঙ্গে এ বার ঝাঁঝিয়ে উঠলেন সে দেশের খাবার ব্যবসায়ীরা। শ্রীলঙ্কার রাজাপক্ষে সরকারের বিরুদ্ধে তাঁদের অভিযোগ, এই সরকার শুধু চিনের কাছে যথাসর্বস্ব বিক্রিই করে দেয়নি, অন্যান্য দেশের থেকেও সব কিছু দেনায় কিনেছে।”
পশ্চিমি মিডিয়ার ঋণের ফাঁদ সম্পর্কে দুটো তত্ত্ব আছে। একটা হল চীন চড়া সুদে, জটিল শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে। তা শোধ না করতে পেরে গরিব দেশগুলো বিপদে পড়ে। অন্যটা হল চীন খুবই কম সুদে তত্ত্ব দিয়ে এমন অলাভজনক ক্ষেত্রে খরচ করায় যে গরিব দেশগুলো সেখান থেকে ঋণ শোধ করার টাকা আদায় করতে না পেরে ফাঁদে পড়ে। ২০২০ সালে চীনের বিভিন্ন দেশকে দেওয়া ঋণ বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া ঋণের প্রায় সমান হয়ে গেছে। গত ১০ বছরে চীনের দেওয়া ঋণ বেড়েছে তিন গুণ। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য, চীনা লগ্নি মুলত বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ প্রকল্পের অন্তর্গত। এই প্রকল্প চালু হয় ২০১৩ সালে, অর্থাৎ মাত্র ন বছর আগে। যদিও চীনের বেলায় যাকে ঋণের ফাঁদ বলা হচ্ছে, এতদিন পাশ্চাত্যের মিডিয়ার কল্যাণে সেটাকে আমরা ‘স্ট্রাকচারাল অ্যাডজাস্টমেন্ট’ বলে জেনে এসেছিলাম। কিন্তু নামে কী যায় আসে? আমরা দেখব, চীনা ঋণের ফাঁদের তত্ত্বের কোনো বাস্তব ভিত্তি আছে কিনা। কেনই বা বহু দেশ আমেরিকা, ইউরোপের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ছেড়ে চীনা ঋণের দিকে ঝুঁকছে?
নিরপেক্ষ সাংবাদিকতার পাশে দাঁড়ান

আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। স্বাধীন মিডিয়া সজীব গণতন্ত্রের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ। যে কথাগুলো বলা আবশ্যক এবং যে প্রশ্নগুলো তুলতে হবে, তার জন্যে আমরা আমাদের পাঠকদের সহযোগিতা প্রত্যাশা করি।
নাগরিক ডট নেটে সাবস্ক্রাইব করুন
~ ধন্যবাদান্তে টিম নাগরিক।
শ্রীলঙ্কার সরকার চীন ছাড়াও আভ্যন্তরীণ ঋণসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মুদ্রা বাজার, এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক এবং জাপানের কাছ থেকে দীর্ঘদিন ধরে ঋণ নিয়ে আসছে। ২৯ মার্চ হিন্দুস্তান টাইমসের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, শ্রীলঙ্কার ঋণের ৩৬.৪% আন্তর্জাতিক সার্বভৌম বন্ডে। তারপর তালিকায় আছে যথাক্রমে এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাঙ্ক (১৪.৬%), জাপান (১০.৯) এবং চীন (১০.৮)। সুতরাং বৈদেশিক ঋণের উৎস হিসাবে চীন রয়েছে চতুর্থ স্থানে। এছাড়াও শ্রীলঙ্কা সরকার বিপুল পরিমাণ অভ্যন্তরীণ ঋণ নিয়েছে। সুতরাং শ্রীলঙ্কার দেউলিয়া হওয়ার জন্য চীনকে দায়ী করা রোমহর্ষক হলেও বাস্তবোচিত নয়।
শ্রীলঙ্কার সাম্প্রতিক অর্থসংকট প্রসঙ্গে ২৮ মার্চ ২০২২ তারিখে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বিবিসি কলম্বো বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক শ্রিমাল আবিরত্নেকে উদ্ধৃত করে বলছে “চীনের কাছ থেকে ঋণ নেয়া সহজ। সেজন্য তাদের কাছ থেকে নিয়েছে। শ্রীলংকার মোট ঋণের ১০ শতাংশ চীন থেকে নেয়া।” এই প্রতিবেদনে শ্রীলঙ্কার আর্থিক সংকটের জন্য জৈব চাষের নীতির ফলে খাদ্য উৎপাদন কমে যাওয়া, কর কমানো, কোভিডের জন্য পর্যটন ডুবে যাওয়ার মত ছটা কারণ উল্লেখ করা হয়েছে।
৮ জানুয়ারি ২০২২ বিবিসি বাংলায় প্রকাশিত এক প্রবন্ধে বিভিন্ন আমেরিকান ও ইউরোপিয় সংস্থার গবেষকদের মতামত তুলে ধরে ঋণের ফাঁদ তত্ত্ব প্রমাণ করার চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু একই প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে “বিশ্বের অন্যান্য জায়গাতেও চীনের দেয়া ঋণ বিতর্ক তৈরি করেছে। এসব ঋণের পেছনে এমন শর্ত জুড়ে দেওয়া হয়েছে যার ফলে গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ব্যাপারে চীন বিশেষ সুবিধা পেতে পারে।…কিন্তু এরকম কোনো উদাহরণ নেই…এইডডাটা গবেষণা প্রতিষ্ঠান এবং আরো কয়েকজন গবেষক চীনা ঋণের শত শত চুক্তি পরীক্ষা করে দেখেছেন। এসব গবেষণায় ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ায় চীনের রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন কোনো কোম্পানির বড় ধরনের সম্পদ জব্দ করার নজির খুঁজে পাওয়া যায়নি।”
সুতরাং প্রশ্ন তোলা যেতে পারে, শ্রীলঙ্কার হামবানতোতা বন্দর কেন গবেষকদের জন্য উদাহরণ হয়ে উঠল না? ২০২১ সালে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম প্রচার করেছিল, চীন ঋণের জালে ফাঁসিয়ে উগান্ডার এনটেব্বে আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কব্জা করেছে। চীন এবং উগান্ডার সরকার এই অভিযোগ অস্বীকার করে। সংবাদ সংস্থা ব্লুমবার্গ ওই চুক্তির নথি পরীক্ষা করে জানিয়েছে, এ অভিযোগ সত্যি নয়, তারা কোনো ঋণের ফাঁদ খুজে পায়নি।
পাক প্রধানমন্ত্রীর সংস্কার সংক্রান্ত পরামর্শদাতা ডঃ ইশরাত হোসেন এক সেমিনারে চীনা ঋণের ফাঁদ সংক্রান্ত তত্ত্ব উড়িয়ে দিয়ে বলেন, চীন ২.৩৪% সুদে অত্যন্ত শস্তায় ঋণ দেয়। তিনি ব্যাখ্যা করেন কীভাবে রেল, সড়ক এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষেত্রে চীনা বিনিয়োগ পাকিস্তানের ভোল বদলে দিচ্ছে।
ব্লুমবার্গের মতে, কেনিয়া এবং নাইজেরিয়ার মোট ঋণের যথাক্রমে মাত্র ১০% এবং ৪% চীন থেকে নেওয়া। চীন-আফ্রিকা সম্পর্ক বিশেষজ্ঞরা প্রশ্ন তুলেছেন, যে কোনো দেশের সমগ্র ঋণের ১০% বা তার কম অংশীদার হয়ে কিভাবে একটা দেশ ঋণী দেশকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে?
বাংলাদেশের প্রথম সারির সংবাদ মাধ্যম প্রথম আলো। সেখানে ১ সেপ্টেম্বর ২০২১ তারিখে প্রকাশিত প্রবন্ধে অর্থনীতিবিদ এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন অধ্যাপক মইনুল ইসলাম লিখেছেন “অনেকেই হয়তো এত দিনে ভুলে গেছেন যে ভারতের কংগ্রেস সরকার অত্যন্ত আগ্রহের সঙ্গে ২০০৬ সালে ‘বিসিআইএম ইকোনমিক করিডর’ চুক্তি স্বাক্ষর করেছিল, যার আরেক নাম ‘কুনমিং ইনিশিয়েটিভ’। ওই চুক্তির অধীনেই চীনের কুনমিং থেকে ভারতের সেভেন সিস্টার্স হয়ে বাংলাদেশের সিলেটের ভেতর দিয়ে ঢুকে ঢাকা হয়ে ভারতের কলকাতা নগরী পর্যন্ত সড়ক যোগাযোগ প্রতিষ্ঠার সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়েছিল। সেই কানেকটিভিটির পরিকল্পনা মোতাবেক বাংলাদেশ পদ্মা সেতু তৈরি করতে গিয়ে বিশ্বব্যাংকের ব্ল্যাকমেলের শিকার হয়। এমন পরিস্থিতিতে ২০১২ সালে বিশ্বব্যাংক-এডিবি-জাইকা-আইডিবির ঋণের পরিবর্তে বাংলাদেশ যখন নিজস্ব অর্থায়নে ওই সেতু নির্মাণের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে বাধ্য হয়, তখন চীনা কোম্পানিগুলোকে পদ্মা সেতুর ঠিকাদারির দায়িত্ব দেওয়া হয়। অতএব পদ্মা সেতুকে ‘চীনা ঋণের ফাঁদ’ আখ্যায়িত করা একেবারেই ভিত্তিহীন মিথ্যাচার।”
অন্যদিকে সিল্ক রোড ব্রিফিং ওয়েবসাইটে ক্রিস ডিভনসায়ার এলিসের প্রবন্ধ দাবি করছে, চীন সাধারণত ২% সুদে দশ বছরে শোধ দেওয়ার শর্তে ঋণ দিয়ে থাকে। সহজ শর্তের জন্যই বিশ্বব্যাঙ্ক বা আইএমএফের ঋণের চেয়ে চীনা ঋণের চাহিদা বেশি। বিশ্বব্যাঙ্কের দেওয়া তথ্য থেকে দেখানো হয়েছে ২০১৬ থেকে ২০১৯ সালের মধ্যে ‘বেল্ট এন্ড রোড’ সদস্য দেশগুলো রপ্তানি বাড়িয়েছে গড়ে ২৮.৮%।
কোনো তৃতীয় বিশ্বের দেশ আমেরিকান বা পশ্চিম ইউরোপের বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে আঘাত করলে বা ঋণ শোধ না করলে তার কী পরিণাম হয় অতীতে আমরা দেখেছি। এবার দেখা যাক এসব ক্ষেত্রে চীন কী করে থাকে?
২০২১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর সংবাদ সংস্থা রয়টার্সের প্রতিবেদন থেকে জানা যাচ্ছে, কঙ্গো সরকার চীনা সংস্থাগুলোর সাথে ছয় বিলিয়ন ডলারের খনি অবকাঠামো সংক্রান্ত প্রকল্প নিয়ে তদন্ত করে। ২০ অগাস্ট কঙ্গোর আইন অনুযায়ী বেআইনি কার্যকলাপ চালানোর অভিযোগে ছটা চীনা খনি কোম্পানির কাজ বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ওই সংস্থার যাবতীয় দেশী-বিদেশী কর্মচারীকে কঙ্গো ছাড়তে বলা হয়। ১৪ সেপ্টেম্বর চীন সরকারের বিদেশ মন্ত্রকের আফ্রিকা সংক্রান্ত বিভাগের ডিরেক্টর জেনারেল উ-পেং বিবৃতি দেন, বেআইনি আর্থিক কর্মকাণ্ডে যুক্ত থাকার জন্য ছয় চীনা সংস্থার বিরুদ্ধে কঙ্গো সরকারের আইনি ব্যবস্থা নেওয়াকে চীন সরকার সমর্থন করে। তিনি আরও জানান, উক্ত সংস্থাগুলো চীনেও শাস্তি এবং নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়বে। চীন কখনোই আফ্রিকায় সেখানকার আইন লঙ্ঘন বরদাস্ত করবে না।
আখাউড়া-সিলেট মিটার গেজ লাইনকে মিশ্র গেজে রূপান্তর এবং জয়দেবপুর-ঈশ্বরদী মিশ্র গেজ ডাবল লাইন নির্মাণ প্রকল্পের জন্য বাংলাদেশকে ঋণ দিয়েছে চীন। সেই ঋণের শর্ত অনুযায়ী প্রকল্প বাস্তবায়নের জন্য চীনা ঠিকাদারি সংস্থাকেই নিয়োগ করতে হয়। কিন্তু বাংলাদেশ সরকারের মনে হয়, চীনা সংস্থা বেশি খরচ দেখাচ্ছে। ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে প্রকল্পের খরচ ফের পরীক্ষা করার জন্য একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি গত বছরের অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময়ে প্রতিবেদন জমা দেয়। সেই প্রতিবেদনে প্রকল্পে বাড়তি ব্যয় ধরার তথ্য উঠে আসে। ২০২১ সালের ১৭ জানুয়ারি ব্যয় কমানোর বিষয়ে চীন সরকারকে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগের (ইআরডি) মাধ্যমে চিঠি দেয় বাংলাদেশ রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এরপর চীন সরকার নিজেই স্বাধীন সংস্থা দিয়ে প্রকল্পের সম্ভাব্য খরচ মূল্যায়ন করে জানায় সত্যিই ব্যয় বেশি ধরা হয়েছে, ওই মূল্যায়নে প্রকল্প লাভজনক হবে না। এর পর ওই প্রকল্পের চীনা ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ব্যয় কমালে কাজ করবে না বলে ইঙ্গিত দেয়।
সারা বাংলা পত্রিকায় ২০২১ সালে প্রকাশিত প্রবন্ধে মুজাহিদুল হক সৌরভ লেখেন “‘ঋণের ফাঁদ’ থাকুক বা না থাকুক, বাংলাদেশকে যেন আমরা এই কথিত ফাঁদ থেকে বাঁচিয়ে রাখতে বা রক্ষা করতে পারি। আবারও বলছি — এ ধরনের কোনো ‘ফাঁদ’ আছে কি না, তা আমরা নিশ্চিতভাবে জানি না। যদি ‘ঋণের ফাঁদ’ বলতে কিছু থেকেও থাকে তাহলেও বাংলাদেশের সরকার প্রধানের সর্বপ্রথম দায়িত্ব এই ‘ফাঁদে’ বাংলাদেশ যেন না পড়ে, সেদিকে খেয়াল রাখা এবং কথিত ফাঁদ থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করা। মূলত এখানেই শেখ হাসিনা সুচারুভাবে দায়িত্বটি পালন করেছেন। এর আগে অনেক সরকারের ক্ষেত্রে ও আমলে আমরা বিশ্বব্যাংকের সঙ্গে কাফকো কিংবা বিবিয়ানা গ্যাস ফিল্ডের মতো অনেক ঘটনা দেখেছি, যেখানে অনেক ক্ষেত্রে তৎকালীন সরকারগুলো রাষ্ট্রীয় বা জাতীয় সম্পদ বন্ধক পর্যন্ত দিয়ে দিয়েছিল।
এই দুই রেললাইন প্রকল্পের বাজেট পুনঃপ্রাক্কলন করতে বলার কারণে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্ক খারাপ হয়েছে, এমনটিও নয়।”
আরও বলি, ২৯ মার্চ ২০১৯ তারিখের ফোর্বস পত্রিকা থেকে জানা যাচ্ছে, গত ১৮ বছরে চীন ৯.৮ বিলিয়ন ডলারের ঋণ মুকুব করেছে। এর মধ্যে অর্ধেকের বেশী ঋন মকুব হয়েছে কিউবার।
কয়েকশো বছর ধরে ইউরোপিয় ও আমেরিকান সাম্রাজ্যবাদী পুঁজি এক দিকে আফ্রিকা, এশিয়া, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোতে বেলাগাম শোষণ, লুণ্ঠন চালিয়ে দেশগুলোর স্বাভাবিক সমাজ বিকাশ, পরিকাঠামোর বিকাশকে অতিমন্থর করে দিয়েছে। অন্য দিকে চ্যারিটি বা এইড পাঠিয়ে মহান সেজেছে। আমেরিকান বা ইউরোপিয়দের বিনিয়োগ মূলত ফাটকা খাতে অথবা স্বল্প মেয়াদে মুনাফা করা যায় এমন খাতে হয়ে থাকে। কিন্তু চীনের সহজ ঋণে বিনিয়োগ মূলত দেশগুলোর পরিকাঠামো উন্নয়নে করা হয়। যেখান থেকে ঝটপট ফায়দা না হলেও দীর্ঘমেয়াদি অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি হয়। বর্তমানে বিভিন্ন দেশ যখন আফগানিস্তান সরকারকে ‘মানবিক সাহায্য’ পাঠাচ্ছে, সেইসময় চীন নিজের বাজার আফগানিস্তানের বাদামের জন্য খুলে দিয়েছে। ফলত চীনাদের বাদাম খাইয়েই বিদেশি মুদ্রা অর্জন করতে পারে আফগানিস্তান।
ব্লুমবার্গের পূর্ব আফ্রিকা ব্যুরোর প্রধান ডেভিড মালিঙ্গার মতে, মাও সে তুংয়ের সময় থেকেই চীন মূলত পারস্পরিক সহায়তার দৃষ্টি ভঙ্গি নিয়ে আফ্রিকার সাথে বাণিজ্যিক সম্পর্ক তৈরি করেছে। মাও পরবর্তী যুগেও চীনাদের নীতির সঙ্গে আফ্রিকান নেতারা খুব সহজেই আমেরিকা বা ইউরোপিয়দের দাদাগিরির তফাত করতে পারে।
এখন প্রশ্ন হল, চীনা ঋণের ফাঁদ তত্ত্বটা তাহলে এল কোথা থেকে? পর্যাপ্ত প্রমাণ না থাকা সত্ত্বেও কিসের জোরে শুধুমাত্র অনুমান এবং জল্পনার উপর ভিত্তি করে বিশ্বজুড়ে তত্ত্বটা রটিয়ে দেওয়া হল? আমেরিকার প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি ডোনাল্ড ট্রাম্পের সময়ে অফিস অফ দ্য সেক্রেটারি অফ স্টেট ‘দি এলিমেন্টস অফ দ্য চায়না চ্যালেঞ্জ’ নামে এক নথি প্রকাশ করে। তাতে জোরের সঙ্গে চীনের ‘ঋণের ফাঁদ কূটনীতি’ তত্ত্ব প্রচার করা হয়। এই নথি সংবাদমাধ্যমের একটা বড় অংশের অনুপ্রেরণা জুগিয়ে থাকতে পারে। অন্য দিকে মার্কিন প্রচারযন্ত্রের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বামপন্থীদের একাংশ চীনা “সাম্রাজ্যবাদের আগ্রাসন” নিয়ে প্রবল চিন্তিত হয়ে পড়েছেন।
ব্ল্যাক অ্যালায়েন্স ফর পীসের সংগঠক নেত্রী মার্গারেট কিম্বারলির মতে নিকারাগুয়া, কিউবা, ভেনেজুয়েলা সহ ৪০টি দেশের উপর আমেরিকা নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে নাগরিকদের জীবন দুর্বিষহ করে তুলেছিল। চীনা সমর্থনে এখন সেই পরিস্থিতি আর থাকছে না। আমেরিকার নিষেধাজ্ঞাকে আর কেউ পাত্তা দিচ্ছে না। গরিব দেশে সমাজতন্ত্র গড়তে গিয়ে লেনিন, স্তালিন, মাওকে যে সমস্যায় পড়তে হয়েছিল বা ট্রটস্কিকে যে কারণে জার্মানিতে বিপ্লব করে ফেলার তাড়াহুড়ো করতে হয়েছিল, চীনের উত্থান আসলে সেই সমস্যা বা কারণটারই সমাধান করে দিয়েছে।
চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে যা চীনা বৈশিষ্ট্যযুক্ত সমাজতন্ত্র, আমেরিকা-ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদীদের কাছে বা বামপন্থীদের একাংশের কাছে সেটা চীনা বৈশিষ্ট্যযুক্ত পুঁজিবাদ। চীনের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে যা সমাজতন্ত্রের আন্তর্জাতিক দায়িত্ব, আমেরিকান-ইউরোপীয় সাম্রাজ্যবাদী বা বামপন্থীদের একাংশের কাছে সেটাই চীনা সাম্রাজ্যবাদ।
তাহলে দেখা গেল এখন পর্যন্ত চীনা ঋণের ফাঁদের তত্ত্বের সপক্ষে পশ্চিমি মিডিয়া কোনো প্রমাণ জোগাড় করতে পারেনি। চীন সমাজতান্ত্রিক হোক বা পুঁজিবাদী, চীনের উত্থান যে এশিয়া, আফ্রিকা, লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর দর কষাকষির ক্ষমতা বাড়িয়েছে তাতে সন্দেহ নেই। বিশেষত মার্কিন নিষেধাজ্ঞায় জর্জরিত দেশগুলোর কাছে চীনের উত্থান টিকে থাকার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
মতামত ব্যক্তিগত
আরো পড়ুন
আফগানিস্তানে তালিবান রাজে সাঁড়াশি চাপে পড়ল ভারত
নাগরিকের পক্ষ থেকে আবেদন:
আপনাদের সাহায্য আমাদের বিশেষভাবে প্রয়োজন। নাগরিক ডট নেটের সমস্ত লেখা নিয়মিত পড়তে আমাদের গ্রাহক হোন।
আমাদের ফেসবুক পেজ লাইক করুন।
টুইটারে আমাদের ফলো করুন।
আমাদের টেলিগ্রাম গ্রুপে যোগ দিন।